সোমবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৩

দেশে খুনের মহড়া : সরকার ঘুমিয়ে আছে?


খুনের পর খুন, এমন দিন নেই, ১০ থেকে ১৫ জন মানুষ দেশে খুন হচ্ছে না। একের পর এক নিজ গৃহে খুন হচ্ছেন নাগরিকেরা। পুলিশের বড় কর্মকর্তাও খুনের শিকার হচ্ছেন। ৩০ আগস্ট পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা ফজলুল করিম খুন হয়েছেন ঢাকাতেই। এর আগে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের কর্মরত এক কর্মকর্তা ও তার স্ত্রী খুন হয়েছেন। রাজধানীসহ সারা দেশে খুনের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় জনজীবনে উদ্বেগ বাড়ছে। বিষয়টি আতঙ্কজনক এ কারণে যে, খুনের আসামিদের ধরা এবং প্রকৃত কার্যকারণ উদঘাটন করার ক্ষেত্রেও ব্যর্থতা রহস্যজনক। এ অবস্থা জননিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি। এতে রাষ্ট্রের ভাবমর্যাদাও বিপর্যস্ত। ডাকাতিও বেড়েছে। ১০ সেপ্টেম্বর রাতে সাভারে পৌর এলাকাতেই ৯ বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। ডাকাতেরা একের পর এক বাড়িতে হানা দিয়া গ্রিল ও দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে ৫৪ ভরি স্বর্ণের গয়না ও চার লাখ টাকা লুট করে নিয়ে গেছে। 
হতবাক হওয়ার মতো বিষয়, যুবলীগের নেতা রিয়াজুল হক খান মিল্কি হত্যা মামলার এক আসামির পক্ষে আছেন সরকারি দলের ২২ নেতা ও এক সংসদ সদস্য। ১৩ সেপ্টেম্বর প্রথম আলো লিখেছেÑ সিলেটে গয়নার দোকানে লুট ও হত্যার কারণে যুবলীগের নেতাকে গ্রেফতার করায় ওসি প্রত্যাহার করা হয়েছে মহানগর পুলিশ কমিশনারের নির্দেশে। পুলিশ জানিয়েছে, ৪ সেপ্টেম্বর বুধবার রাত ৮টায় নগরের কেন্দ্রস্থল জিন্দাবাহার এলাকায় বোমা ও গুলি ছুড়ে গয়নার দোকানে লুটপাট হয়। গুলিতে বিপণিবিতানের নিরাপত্তাকর্মী বাদশা মিয়া নিহত হন। খুনিদের মুখোশ উন্মোচন করতে গেলে সরকারি দলের রোষানলে অনেকের পড়তে হয় পুলিশের কর্মকর্তাদের। কর্মকর্তাদের নিহত, আহত ও নাজেহালের একটি কারণ এটি। 
১২ সেপ্টেম্বর রাত ৩টার দিকে রাজধানীর উত্তর যাত্রাবাড়ীতে পরিবহন ব্যবসায়ী জাহিদ আল লতিফের বাড়িতে ঢুকে তার লেভেল পড়য়া ছেলে বখতিয়ার লতিফকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ সময় গুলিবিদ্ধ ছেলে বিছানায় ছটফট করছিলেন। পিঠমোড়া করে হাত বাঁধা অবস্থায় মেঝেতে বসা বাবা। ছেলের মুখে একটু পানি দিতে মা আকুতি মিনতি জানালেন অস্ত্রধারী যুবকদের প্রতি। এতে পাষণ্ড দুর্বৃত্তরা কর্ণপাত করেনি। মনে হচ্ছিল আমরা জাহেলিয়াতের যুগে প্রবেশ করছি। এ ধরনের ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই পত্রিকায় থাকে। প্রশ্ন থেকে যায়, সন্তানহারা বাবা-মা, স্ত্রীহারা স্বামী, বাবা মা হারা সন্তানদের মনটা তখন কেমন ছটফট করে, বিষের যাতনার চেয়েও যে তা কষ্টকর, বিবেকবান ব্যক্তি ছাড়া উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। সমাজের প্রকৃত চেহারা আজ এমনি নিষ্ঠুর হয়েছে যে নিজের ওপর বিপদ না আসা পর্যন্ত কেউ বুঝতে চায় না। যখন নিজের ওপর বিপদ আসে, তখন আর কিছুই করার থাকে না। বিপদ আসা পর্যন্ত কেন আমরা অপেক্ষা করি? এর আগে কেন আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে এর বিরুদ্ধে তৎপর হই না। এখানে যা ঘটছে, তাকে মানবিক মূল্যবোধের চরম বিপর্যয় ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। 
১২ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার দড়িবাড়ী গ্রামে রাতে মা, মেয়ে ও নাতি ধারালো অস্ত্রের আঘাতে খুন হয়েছেন। গৃহকর্তা ুদ্র কৃষক আবদুল লতিফ রাত সাড়ে ৮টায় বাড়িতে ফিরে এসে এ দৃশ্য দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। একই রাতে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলায় নির্যাতনের শিকার হয়ে গৃহবধূ রোজিনা আক্তার (২০) হাসপাতালে মারা গেছেন। ১৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় দৈনিকে সম্পাদকীয় মন্তব্যে লিখেছেÑ খুনের আসামির পক্ষে সরকারি দলের ওকালতিÑ তাহলে কি আওয়ামী লীগ নেতারা মিল্কি হত্যার বিচার চান না? উদ্বেগের বিষয়টি হলো, মিল্কি হত্যা মামলার অন্যতম আসামি মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলামকে রক্ষা করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদনপত্র পাঠিয়েছেন দলেরই ২২ জন নেতা। কিন্তু গুরুতর অভিযোগ উঠেছে যে, জাহিদসহ যুবলীগের কয়েকজন নেতার নির্দেশেই মিল্কিকে খুন করা হয় গুলশানে। এখন আবার সেই মিল্কি হত্যার এক আসামিকে রক্ষায় ক্ষমতাসীন দলের নেতারা জোর তদবির শুরু করেছেন। হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত দেশে এখন খুব কম বললেই চলে। আইন যদি নিজস্ব গতিতে চলত, তাহলে হত্যাকাণ্ডের পরিধি এত বিস্তৃতি লাভ করত না। 
অপ্রিয় হলেও সত্য, মরহুম রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান তাহের ও গামা হত্যা মামলার ২২ জন ফাঁসির আসামিকে (উচ্চ আদালতের রায়ে দণ্ডিত) দলীয় রাজনীতির বিবেচনায় বেকসুর খালাশ দিয়েছেন। খুনের আসামিদের এভাবে ক্ষমা প্রদর্শন বিশ্বে নজিরবিহীন। তিনি ফাঁসির আসামিদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিতে পারতেন। উল্লেখ্য ওয়ান-ইলেভেনে যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল সেসব মামলার মধ্যে একমাত্র সরকারি দলের সদস্যের বিরুদ্ধে মামলার আদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান বিরোধী দল বিএনপির কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত একটি মামলাও প্রত্যাহার করা হয়নি। রাজনৈতিক বিবেচনায় যদি জঘন্য অপরাধের মামলা প্রত্যাহার করা হয়Ñ তা হলে এর চেয়ে নিকৃষ্ট কাজ বেশি আছে বলে জানা নেই। দেশে হত্যাকাণ্ড এত বৃদ্ধির মূল কারণÑ রাজনৈতিক বিবেচনায় আসামিদের রেহাই দেয়া। আইনকে নিজস্ব গতিতে চলতে দিতেই হবে। অন্যথায় অপরাধের গতি আরো বেগবান হবে। যখন যে ক্ষমতায় আসে তখন সে দলটি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না থাকার কারণেই বাংলাদেশ আজ অপরাধের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। শাস্তি না হলে অপরাধ বাড়তেই থাকবে। আত্মহত্যার ঘটনাও বাড়ছে। ১৩ সেপ্টেম্বর পত্রিকায় উঠেছেÑ পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলায় মৌসুমি আক্তার নামে সপ্তম শ্রেণীর এক ছাত্রী আত্মহত্যা করেছে। ধর্ষণজনিত কারণে সে আত্মহত্যা করেছে লোকলজ্জার ভয়ে। এটা একই দিনের পত্রিকায় উঠেছেÑ রাজশাহীতে বান্ধবী, ঢাকায় বন্ধুর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এ দুজন হলেন ফাহমিদা সুলতানা (২২) (রাজশাহীর বেসরকারি উদয়ন ডেন্টাল কলেজে শেষ বর্ষের ছাত্রী) এবং মিনহাজ চৌধুরী (২৫) (ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ বর্ষে পড়তেন)। দেশে দুই-তিন দিনের হত্যাকাণ্ড এবং অপরাধজনিত ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ বর্ণিত হলো। সরকারের শেষ সময়ে খুনে সন্ত্রাসীরা এত বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কেন? রাজনৈতিক কারণেও এ সময় অপরাধ চক্রের পৃষ্ঠপোষকতা যেমন বেড়ে যাচ্ছে, তেমনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যেও দেখা দিচ্ছে শিথিলতা। 
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয় যেমন বাড়ছে, তেমনি দল বিবেচনায় মূল অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে। ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা কমছে। এ কারণে মানুষের মধ্যে পশুচরিত্রের বিকাশ সাধন ঘটছে। বর্তমানে যে খুন, গুম, অপহরণ ও পাশবিক অত্যাচার ধর্ষণ চলছে তাও এক ধরনের জঙ্গিবাদের পর্যায়ে পড়ে। 
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আচরণ নিয়ে নানা বক্তব্য পত্রিকায় উঠছে। ২৩ সেপ্টেম্বর দেশের বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিকে অনলাইনে পাঠকের মন্তব্য ছিলÑ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আক্রণাত্মক বক্তব্যেই দেশে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটেছে। ২৪ অক্টোবর থেকে আসল খেলা বিরোধী দল দেখতে পাবে। বিএনপি রাস্তায় দাঁড়াতেই পারবে নাÑ সেই সুযোগ তাদের দেওয়া হবে না।এই উক্তি মারাত্মক আক্রমণাত্মক ও উসকানিপূর্ণও বটে। শক্তি ও চাপার জোরে আমরা মানুষের মৌলিক অধিকার পর্যন্ত অস্বীকার করছি। পাঠকের মন্তব্য ছিলÑ দেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ই দায়ী। খুনের বদলে খুনÑ এ ধরনের বক্তব্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখে শোভা পায় না। আরেকজনের বক্তব্যÑ এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তো দেখি আইনের ভাষায় কথাও বলতে জানেন না। পুলিশ আইনে আছেÑ ‘পুলিশ শুধু আইনশৃঙ্খলা ও মানুষের জানমাল হেফাজতে শক্তি প্রয়োগ করতে পারে এবং আত্মরক্ষার্থে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু কোনোভাবেই আক্রমণ করতে পারে না।ফৌজদারি কার্যবিধিতে কিংবা পুলিশের আচরণবিধি মোতাবেক পুলিশ যে ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে, সেগুলোর মধ্যে আক্রমণবলতে কোনো শব্দ নেই। সীমালঙ্ঘন করলে সরকারের ভাবমর্যাদা নষ্ট হবেই। আল্লাহ তাঁর পবিত্র গ্রন্থে ঘোষণা করেছেনÑ সীমালঙ্ঘন করো না। আমি সীমালঙ্ঘনকারীদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছি।আইনশৃঙ্খলা ইতিবাচক পরিবর্তনে বিষয়গুলো রাষ্ট্রের অভিভাবকদের জানা ও মানা দরকার। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads