শুক্রবার, ১১ অক্টোবর, ২০১৩

ধর্মীয় বিষয়ে ধর্মনিরপেক্ষ আচরণ কেন?



বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে একটি বড় অভিযোগ, এ সরকার জনমানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়। আমাদের দুটি প্রধান ধর্মীয় গোষ্ঠী মুসলমান ও হিন্দুদের বিভিন্ন ধর্মীয় ইস্যুতে প্রচলিত বিধিবিধানের পরিবর্তে নতুন নতুন আইনের প্রস্তাব করা হচ্ছে এবং কখনো কখনো আইন প্রণীতও হচ্ছে। ফলে ধর্মের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে সরকারের অযৌক্তিক হস্তক্ষেপে তৃণমূল জন সমর্থন থেকে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে। গত ১০ সেপ্টেম্বর একজন হৃদরোগী বন্ধুকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইব্রাহিম কার্ডিয়াকের দিকে রওনা হলাম। ইব্রাহিম কার্ডিয়াকের সিইও প্রফেসর আব্দুর রশীদ অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু শাহবাগ মোড়ে এসে আর সামনে এগোতে পারলাম না। গেরুয়া রঙের আলখেল্লা পরা হিন্দু পুরোহিতরা প্রধান সড়ক দখল করে আছেন। ১২ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া নবম সংসদের শেষ অধিবেশনে দেবোত্তর সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১৩ পাস হতে যাচ্ছে, এমন সম্ভাবনার প্রতিবাদ জানাতে তাদের এই সড়ক অবরোধ। প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাবিত এ আইনের বিরুদ্ধে স্মারকলিপিও দেয়া হচ্ছে বলে মঠ-মন্দির ও দেবোত্তর সম্পত্তি রক্ষা ও পুনরুদ্ধার জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক সত্যরঞ্জন বাড়ৈ উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশ ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সহিষ্ণুতার মধ্য দিয়ে বড় হয়ে ওঠে। ধর্মীয় সম্প্রীতি ও মিলনের লীলাকুঞ্জ বাংলাদেশে মাঝে মধ্যে রাজনৈতিক নীতি ও রাজনৈতিক স্বার্থকে ঘিরে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সম্প্রতি কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় সন্ত্রাসী-মাস্তানদের মন্দির, পূজালয় ভাঙচুর ও দখলের ফলে আমাদের ধর্মীয় সহাবস্থানের চিরায়ত সংস্কৃতির ভিত নড়ে ওঠে। ধর্মীয় সহিষ্ণুতায় লালিতপালিত বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এবং প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে খানিকটা ধর্মকেন্দ্রিক রেষারেষির বীজও রোপিত হলো মনে হচ্ছে। যে মুহূর্তে মিয়ানমারের মুসলিম জনগোষ্ঠীকে সমূলে উচ্ছেদের (ethnic cleansing) উদ্দেশ্যে নির্যাতন করে বাংলাদেশে ধাক্কা দিয়ে প্রবিষ্ট করানো হয়েছে, তাতে এখানে মারাত্মক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেধে যেতে পারত। আমাদের ধর্মীয় সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এখানেও দেদীপ্যমান হলো। যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তা নিছক কায়েমি স্বার্থবাদী চক্রের লুণ্ঠনপ্রক্রিয়া মাত্র, বিন্দুমাত্র ধর্মকেন্দ্রিক অসহিষ্ণুতা নয়। সমাজ বিশ্লেষণের এ প্রক্রিয়ায় ভুল করলে বাংলাদেশের সমাজতত্ত্বের নির্মোহ বিশ্লেষণ হলো বলে মেনে নেয়া যাবে না। বলছিলাম দেবোত্তর সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১৩-এর বিরুদ্ধে দ্রোহে ফেটে পড়া হিন্দু মুনী-ঋষীদের সড়ক অবরোধের কথা। আমাদের দেশে হিন্দুরা স্মরণাতীতকাল থেকে যে প্রক্রিয়া, যে সংস্কৃতি এবং যে কায়দায় তাদের ধর্ম-কর্ম করে আসছে, তা আমাদের আবহমান বাংলার উজ্জীবিত সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। সাধারণ হিন্দুদের দান করা বা অন্য কোনো উপায়ে মালিকানাপ্রাপ্ত হয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা তাদের ধর্মীয় উপাসনালয়, মন্দির ও মঠে জমায়েত হয়। হিন্দু জনগণের কল্যাণে প্রত্যেক হিন্দু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের রয়েছে ব্যবস্থাপনা পরিষদ, যা স্বচ্ছন্দে ওই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দেখাশোনা করে আসছে। কিন্তু হঠাৎ করে কেন দেবোত্তর সম্পত্তি আইন পাস করতে হচ্ছেÑ এমন প্রশ্নের গূঢ় রহস্য উন্মোচন করেছে শাহবাগে জমায়েত হিন্দু সম্প্রদায়। তাদের প্রথম ও প্রধান আপত্তি হলোÑ ধর্ম একটি পবিত্র বিষয় এবং হিন্দু ধর্মালয়গুলো হিন্দুদের সম্পত্তিতে স্বাধীন ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে। এখানে প্রস্তাবিত আইনে ব্যবস্থাপনা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটিতে রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িয়ে হিন্দু ধর্মের স্বাধীন আচারব্রত পালনে বাধা সৃষ্টি করবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনের ৬ ও ৭ ধারা অনুযায়ী দেবোত্তর বোর্ডের কেন্দ্রীয় কমিটিকে ১৭ জনের ১২ জন হবেন গণ্যমান্য ওই হিন্দুরা, যারা সরকারের দলীয় ব্যক্তিত্বÑ এমন কথা লেখা হয়েছে বাড়ৈ প্রচারিত লিফলেটের দ্বিতীয় পৃষ্ঠায়। এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করা হয়েছে যে, মঠ-মন্দিরে ভগবানের বিধানের পরিবর্তে দলের বিধান চলতে থাকবে এবং আমাদের উত্তর প্রজন্ম ধর্মচ্যুত হয়ে পড়বে, সমূলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। সত্যরঞ্জন বাড়ৈ প্রচারপত্রে নাস্তিকতার আশঙ্কাও করা হচ্ছে। দ্বিতীয় অভিযোগ হলোÑ এ আইনের মাধ্যমে গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী, ব্রহ্মচারী, সাধু-মোহন্ত, সেবায়েতরা মুক্তভাবে ভগবানের সেবা-আরাধনা ও প্রচার করতে পারবে না বরং এরা সরকারের বেতনভোগী কর্মচারী হিসেবে বিশেষ গোষ্ঠীর মনোরঞ্জনে ধর্মবিধান শিথিলভাবে পালন করতে সক্ষম হবে। ৩৯ ও ৪০ ধারা অনুসারে সরকার হবে মঠ-মন্দিরের মালিক, আর পূজারীরা কর্মচারী। তৃতীয় আপত্তি হলোÑ ৪১ ধারা অনুসারে মন্দির-মঠে সাধারণের দেয়া দানের মাধ্যমে গঠিত আয় থেকে একটি অংশ প্রশাসনের ফান্ডে জমা দিতে হবে, যা হিন্দুশাস্ত্রীয় আইনবিরোধী। কেননা ওই আয় দিয়ে কেবল ভগবানের সেবা করা যায়, অন্য কারো স্বার্থে তা ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। চতুর্থ বিপজ্জনক আপত্তি হলোÑ প্রস্তাবিত আইনের ৫৩ ধারা অনুসারে সরকার মন্দির-মঠের সম্পত্তি লিজ বা বিক্রয় করার অধিকার পাবে। হিন্দুদের আশঙ্কা হলো, এই বিধান কার্যকর হলে ভূমি মন্ত্রণালয়ের ভূমি দখলের মতো ধর্ম মন্ত্রণালয় মঠ-মন্দির দখল করবে, সব হিন্দুধর্মের সম্পত্তি টাউট-বাটপারদের করায়ত্তে চলে যাবে। দেবোত্তর সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১৩-এর মতো একটি খবর বেরিয়েছিল পত্রপত্রিকায় বেশ কয়েক দিন আগে। আমাদের বেসরকারি মাদরাসা-মক্তব ও অন্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসে সরকারের একটি ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ফুঁসে উঠেছিল মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক-ব্যবস্থাপনা কমিটি। হিন্দুদের মতো মাদরাসা-মসজিদের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও বেশ সংুব্ধ হয়ে ওঠে। আন্দোলন-প্রতিবাদও হয় কিছুটা। মাদরাসা, মসজিদ, মক্তব প্রতিষ্ঠার পেছনের ইতিহাস বেশ মর্মন্তুদ ও হৃদয়স্পর্শী। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে শ্বেতাঙ্গ ইংরেজদের মুসলিমনিধন ও হিন্দুতোষণ বিভাজনী নীতির কারণে মুসলমানেরা উপমহাদেশে নিগৃহীত নির্যাতিত সম্প্রদায়ে পরিণত হয়। ব্রিটিশের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, আন্দোলনের, বিদ্রোহাগ্নিতে ব্রিটিশের সব স্পর্ধা জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যায়। মুসলমানেরা ইংরেজি শিক্ষা বন্ধ করে নিজস্ব সম্পত্তিতে নিজেদের ব্যয়ে মাদরাসা, মক্তব, মসজিদ গড়ে তুলে দ্বীনি ইলম শিক্ষাদীক্ষা ও ইবাদত বন্দিগি করে শান্তিতে বসবাস করতে থাকেন। ব্রিটিশ শাসকদের প্রভাবমুক্ত হয়ে তারা তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করতে থাকে। বেশ অবাক হতে হয়, আমাদের সামাজিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের বাস্তবতায় গড়ে ওঠা মসজিদ-মাদরাসা-মক্তবের স্বাধীনতা, পবিত্রতা, ুণœ করে সেখানে প্রশাসক নিয়োগ দেয়ার পরিকল্পনা করে বর্তমান সরকার এ দেশের মুসলমানদের সেই চিরায়ত শান্তির ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান থেকে চ্যুত করতে চাচ্ছে কেন? কোনোরকম সামাজিক জরিপ, গবেষণা, বিশ্লেষণ ছাড়া এমন স্বেচ্ছাচারী, খামখেয়ালি নীতি সরকারকে যে গণবিচ্ছিন্নতায় নিক্ষিপ্ত করবে, তার পূর্বধারণা থাকা উচিত। বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক-দার্শনিক চেতনা প্রোথিত ধর্মনিরপেক্ষতার গভীরে। ধর্মনিরপেক্ষতা রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় বেশ নবীন। এর চারণভূমি ও পুণ্যভূমি হলো ওয়েস্টফালীয়-উত্তর ইউরোপীয় ভূখণ্ডে। ইউরোপের খ্রিষ্টান জনগণের ওপর খ্রিষ্টান ধর্মগুরু, পুরোহিত, পাদ্রিদের চাপিয়ে দেয়া তথাকথিত খ্রিষ্টান ধর্মীয় রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও শাসন থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে জাগরিত জনতার আন্দোলনে সৃজিত হয় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। জালিম ধর্মগুরুদের বিরুদ্ধে মজলুম খ্রিষ্টীয় জনগণের আন্দোলন একসময় ৩০ বছরব্যাপী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৬৪৮ সালে ওয়েস্টফালিয়ান চুক্তির (westphalian treaty) মাধ্যমে এ নতুন সামাজিক, রাজনৈতিক ধারার সূত্রপাত ঘটে। জাগরিত জনগণ ধর্মগুরুদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে দেয়াল টেনে দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রক্ষাকবচ হিসেবে গ্রহণ করে। ইউরোপের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে তা অনিবার্য ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের সমাজ-রাজনৈতিক-সংস্কৃতির প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, যেখানে ধর্মজীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ধর্ম এখানে কোনো অত্যাচারের ভূমিকা পালন করে না। কেবল অত্যাচারের বিরুদ্ধে দ্রোহ রচনা করে। যেমনভাবে ব্রিটিশের জবরদখলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল সে দিনের মুসলিম হিন্দু জাগ্রত জনতা। সেই জাত্যাভিমানী মুসলিম-হিন্দু জনগণের প্রাণের ধর্ম ইসলাম ও হিন্দু, যার স্বাধীনতা, স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করা আমাদের সব সরকারের কর্তব্য। বিশেষ করে ধর্মনিরপেক্ষতার অনুসারী বর্তমান সরকার তাত্ত্বিক ও চেতনাগতভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে, ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে তারা দেয়াল স্থাপন করবে। অর্থাৎ ধর্মের ব্যাপারে তারা হস্তক্ষেপ করবে না। ধর্ম চলবে ধর্মগুরুদের লালনপালনে, আর রাষ্ট্র চলবে রাষ্ট্রগুরুদের দায়িত্বে। এতটুকু বিচ্যুত হয়ে ধর্মস্থান, উপাসনালয়, মঠ-মন্দির, মসজিদ, মক্তব, মাদরাসার দখল ও কর্তৃত্ব নিতে প্রশাসক নিয়োগের বিধান আদৌ যুক্তিযুক্ত ও প্রয়োজনীয় নয়। ধর্মীয় বিষয়গুলো নিয়ে সরকারের কর্তব্য হলোÑ নিরপেক্ষ আচরণ করা। মসজিদের ইমাম নিয়োগ, মাদরাসার শিক্ষক নিয়োগ, খাদেম নিয়োগ, মঠ-মন্দিরের সেবায়েত নিয়োগ, পুরোহিত নিয়োগ ইত্যাদি বিষয় দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষত বাংলাদেশের সমাজ-দর্শনের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। ইউরোপের ভ্যাটিকান পোপের নিয়োগ আর বাংলার ইমাম-মুয়াজ্জিন-পুরোহিত, মুনী-ঋষী নিয়োগ কখনো অভিন্ন হতে পারে না। পোপের নিয়োগ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কিন্তু ইমাম-মুয়াজ্জিন-মুদাররিস-হাফেজ-পুরোহিত-সাধুর জায়গাটি ধর্মীয়, ধর্মভীরুদের হৃদয়ের গভীরতায় সংযুক্ত। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads