সোমবার, ৭ অক্টোবর, ২০১৩

ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি এবং রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র


গত ৫ অক্টোবর একই দিনে দুই নেত্রীর মুখে জাতিকে দুই রকম কথা শুনতে হয়েছে। দু’জনের মধ্যে বিএনপির চেয়ারপারসন ও ১৮ দলীয় জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ভাষণ দিয়েছেন সিলেটের বিশাল জনসমাবেশে। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমে ভেড়ামারায় এবং পরে কুষ্টিয়ায় বক্তৃতা করেছেন সরকারি খরচে আয়োজিত দুটি পৃথক অনুষ্ঠানে। খালেদা জিয়া ক্ষমতাসীনদের একতরফা নির্বাচন প্রতিহত করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। আগামী ২৪ অক্টোবরের মধ্যে সংবিধান সংশোধন করে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের বিধান যুক্ত করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেছেন, দাবিটি না মানা হলে ২৫ অক্টোবর থেকে সরকার পতনের লক্ষ্যে জোর আন্দোলন শুরু করা হবে। সে আন্দোলনের অংশ হিসেবেই প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে সংগ্রাম কমিটি গঠনের ডাক দিয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেছেন, সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যুক্ত করলে মেয়াদের বাকি সময় কোনো আন্দোলনে যাবে না বিরোধী দল। কিন্তু সেটা না করে একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা করা হলে তা প্রতিহত করা হবে। তখন দেখা হবে রাজপথে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেয়ার পাশাপাশি খালেদা জিয়া ‘হটাও হাসিনা, বাঁচাও দেশ’ এবং ‘হটাও আওয়ামী লীগ, বাঁচাও দেশ’Ñ এই স্লোগানও দিয়েছেন। শেয়ারবাজারের লুণ্ঠন ও পদ্মাসেতুকেন্দ্রিক দুর্নীতি থেকে হত্যা-গুম ও নির্যাতনসহ রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রায় সব প্রসঙ্গেই বলেছেন তিনি। কঠোর সমালোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের। বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী আবারও ভোট ভিক্ষা চাইতে শুরু করেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এলে পুরো বাংলাদেশকেই গিলে খেয়ে ফেলবে। খালেদা জিয়া ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির এবং সুন্দরবন ধ্বংস করে রামপালে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণেরও বিরোধিতা করেছেন। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী যথারীতি তার সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়া এবং তার দোসর যুদ্ধাপরাধীরা নাকি ওই নির্বাচন প্রতিহত করতে পারবেন না! দুটি অনুষ্ঠানেই প্রধানমন্ত্রী কথিত যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গ ত্যাগ করার জন্য খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন, বিএনপি নিজেও নাকি যুদ্ধাপরাধীদের দল! ঘটনাপ্রবাহে কথা উঠেছে আসলে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির এবং সুন্দরবন ধ্বংস করে রামপালে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনার পরিপ্রেক্ষিতে। কথা ওঠার কারণ, এই অভিযোগ প্রথম থেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আওয়ামী মহাজোট সরকার ভারতের জন্য বাংলাদেশের দরজা উন্মুক্ত করার কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে। সে কর্মকা-ের অংশ হিসেবেই গত ৫ অক্টোবর ভেড়ামারায় ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধন তাই বলে তিনি একা করেননি, অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অংশ নিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনরেমাহন সিংওÑ যার কারণে একজন প্রবীণ সাংবাদিক মন্তব্য করেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী আসলে বাংলাদেশের বিদ্যুতের রিমোট কন্ট্রোল হাতে নিয়েছেন। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক এলাহী চৌধুরী বেশ কিছুদিন ধরে রীতিমতো প্রচার অভিযান চালিয়ে এসেছেন। মনে হচ্ছিল যেন আমদানি নয়, সরকার নিজেই বিদ্যুতের উৎপাদন শুরু করতে যাচ্ছে! এদিকে ঢাকঢোল যথেষ্ট পেটানো হলেও বিদ্যুতের পরিমাণ এবং তার মূল্য সম্পর্কে শুনলে যে কারও আক্কেল গুড়–ম হয়ে যাবে। ভেড়ামারার এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাধ্যমে  ভারত বাংলাদেশে পাঁচশ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রফতানি করবে। সেটাও আবার তিন পর্যায়ে। শুরু হবে মাত্র ৫০ মেগাওয়াট দিয়ে, নবেম্বরে গিয়ে বাংলাদেশ পাঁচশ মেগাওয়াট পাবে। উৎপাদন খরচ মাত্র দেড় টাকার মতো হলেও প্রতি ইউনিটের জন্য বাংলাদেশকে গুণতে হবে ছয় টাকারও বেশি। গ্রাহকের ওপর যে আরও অনেক বেশি দরে বিল হাকানো হবে সে কথা ধরেই নেয়া যায়। আপত্তি শুধু ভেড়ামারা দিয়ে বিদ্যুৎ আমদানির কারণে ওঠেনি। দেশপ্রেমিক সব মহলের প্রতিবাদ ও বিরোধিতা উপেক্ষা করে সরকার রামপালেও ভারতের সহযোগিতা নিয়েই তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে। আগামী ২২ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী এর ভিত্তি স্থাপন ও নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করবেন। এর মাধ্যমে সুন্দরবনকেই শুধু ধ্বংস করা হবে না, বাংলাদেশের প্রকৃতিকেও স্থায়ী ক্ষতির মুখে ঠেলে দেয়া হবে। প্রাসঙ্গিক অন্য তথ্যটি হলো, ছয় হাজার থেকে নয় হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রচারণা চালানো হলেও বাস্তবে বিদ্যুৎ খাতে টেকসই কিছু করতে পারেনি বলেই মেয়াদের শেষ প্রান্তে এসে সরকার ভারতের সাহায্য না নিয়ে পারছে না। সরকার প্রকৃতপক্ষে বিদ্যুতের মতো অত্যাবশ্যকীয় একটি বিষয়েও দেশকে ভারতের ইচ্ছাধীন করে ফেলছে। কথাটা বলার কারণ, খোদ ভারতেই এখনও যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যুতের ঘাটতি রয়েছে। সে দেশটির ওপর নির্ভরশীল হতে হলে শিল্প-কারখানার উৎপাদনসহ সব ব্যাপারেই ভারতের অনুগ্রহের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। এমনকি বিনা নোটিশে রফতানি বন্ধ করলেও আমাদের বলার কিছুই থাকবে না। এজন্যই খালেদা জিয়া এর বিরোধিতা করেছেন। আমরাও সরকারের এই ভারতপন্থী নীতি ও কর্মকা-ের তীব্র বিরোধিতা করি এবং দেশে উৎপাদনের ব্যবস্থা না নিয়ে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির এবং রামপালে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাই। বলা দরকার, মূলত সরকারের সেবাদাসধর্মী নীতি ও কর্মকা-ের কারণেই বর্তমান সরকারের পৌনে পাঁচ বছরেও ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সর্বাত্মকভাবে বঞ্চিতই রয়েছে। যে কোনো পর্যালোচনায় পরিষ্কার হয়ে যাবে, আওয়ামী লীগ সরকারের বর্তমান মেয়াদে বাংলাদেশের প্রাপ্তির পরিমাণ শূন্যের চাইতে বেশি নয়। প্রধান আপত্তি উঠেছে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে। কারণ, ভারতীয়দের জন্য সীমান্তের পাশাপাশি নৌপথ ও স্থলপথ উন্মুক্ত করে দেয়ার ফলে বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। পণ্য পরিবহনের নামে সড়ক পথে শুধু ভারতের ভারী যানবাহনই চলাচল করছে না, ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্যও বাংলাদেশ মুক্তরাজ্যে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশকে তারা বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যের স্বাধীনতাযুদ্ধ নির্মূল করার অভিযান চালানোর পশ্চাৎভূমি হিসেবে ব্যবহার করছে। যৌথ সীমান্ত ব্যবস্থাপনা চুক্তির মাধ্যমে এ ব্যাপারেও সরকার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। উদ্বেগের কারণ হলো, ভারতীয় সেনা ও অন্য কিছু বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশের বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থাকেও কাজে লাগাচ্ছে। ওদিকে ১৪০ চাকার ট্রেইলারসহ ভারী যানবাহন চলাচল করায় একদিকে বাংলাদেশের অপ্রশস্ত সড়ক পথগুলো দেবে যাচ্ছে, অন্যদিকে বিশেষ করে তিস্তার ওপর আড়াআড়িভাবে দুর্বল বাঁধ ও সড়ক নির্মাণের মাধ্যমে ভারতীয়রা বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে অচল করে ফেলছে। সব মিলিয়েই ভারতকে করিডোর দেয়ার পরিণাম হতে যাচ্ছে ভয়াবহ। এর ওপর আবার বিদ্যুতের জন্যও দেশকে ভারতের অনুগ্রহের ওপর নির্ভরশীল করা হলো। এমন অবস্থা কোনোক্রমেই সমর্থন করা যায় না। আমরা তাই জাতীয় স্বার্থে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার দাবি জানাই। রেণ্টাল ও কুইক রেন্টাল নিয়ে এত যে হইচই করা হলো এবং ওই বিদ্যুতের জন্য আড়াইশ-তিনশ টাকার স্থলে জনগণের পকেট থেকে যে দু’তিন হাজার টাকা পর্যন্ত কেটে নেয়া হচ্ছে, সে বিদ্যুতের বর্তমান অবস্থা এবং আগামীর সম্ভাবনা সম্পর্কেও জনগণকে জানাতে হবে। কারণ, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল সত্যি সংকট কাটিয়ে উঠতে পারলে ভারত থেকে এত চড়া দামে বিদ্যুৎ আমদানি করতে হতো ন্।া  সরকারের উচিত মিথ্যা বাগাড়ম্বর ছেড়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর এবং সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা। বিশেষ করে ভারতের ওপর বাংলাদেশকে নির্ভরশীল না করা।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads