সোমবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৩

শুধু উৎসব নয় ঈদুল আজহা আত্মত্যাগের অঙ্গীকার করার দিন


গতকাল পবিত্র হজ্জ পালিত হয়েছে, আগামীকাল মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহা। দিনটি মহান আল¬াহতা’লার উদ্দেশে পশু কোরবানীর উপলক্ষ হলেও এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জন করা। সেদিক থেকে ঈদুল আজহা একটি অত্যন্ত মহিমান্বিত দিন। আরবি শব্দ ঈদ-এর অর্থ আনন্দ উৎসব এবং আজহা’র অর্থ পশু জবাই করা। অর্থাৎ ঈদুল আজহা একই সঙ্গে পশু কোরবানী দেয়ার এবং উৎসব করার দিন। আল¬াহতা’লার উদ্দেশে পশু কোরবানী দেয়ার প্রথম নির্দেশ এসেছিল হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর কাছে। তিনি আল¬াহকে বেশি ভালোবাসেন ও মান্য করেন নাকি সন্তানের গুরুত্ব তাঁর কাছে বেশি সেটা পরীক্ষা করাই ছিল উদ্দেশ্য। এজন্য তাঁকে আদরের পুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে আল¬াহতা’লার উদ্দেশে কোরবানী দেয়ার  নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। নির্দেশ অনুযায়ী ইবরাহিম (আ.) প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, ইসমাঈল (আ.)-ও সানন্দে সম্মত হয়েছিলেন। দেখে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন আল¬াহ রাব্বুল আলামিন। পুত্রের গলদেশে ছুরি চালানো শুরু করার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে ইবরাহিম (আ.)-কে এই সন্তুষ্টির কথা জানিয়ে বলা হয়েছিল, তিনি যেন ইসমাঈল (আ.)-এর পরিবর্তে একটি পশু কোরবানী দেন। সে অনুযায়ী পশুই কোরবানী দিয়েছিলেন হযরত ইবরাহিম (আ.)। সেই থেকে পশু কোরবানীর মধ্য দিয়ে মুসলমানরা পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপন করে আসছেন। বিধানটি চূড়ান্ত হয়েছে শেষ রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে। ঈদুল আজহা উপলক্ষে পশু কোরবানীই অবশ্য একমাত্র করণীয় নয়। তার আগে পবিত্র হজকে মুসলমানদের জন্য ফরজ বা অবশ্যপালনীয় করা হয়েছে। হজ্জ উপলক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মুসলমানরা পবিত্র নগরী মক্কা মুকাররমায় সমবেত হন। ৮ জিলহজ্জ থেকে তিন দিন ধরে তারা মিনা, মুযদালিফা ও আরাফাতের ময়দানসহ নির্ধারিত স্থানগুলোতে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন। বলতে থাকেন, ‘লাব্বাইক, আল¬াহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা, ওয়াননি’মাতা লাকা ওয়ালমুল্ক, লা শারিকা লাকা’। অর্থাৎ ‘হে আল¬াহ, আমি হাজির হয়েছি। আমি হাজির। আমি হাজির, আপনার কোনো শরিক নেই, আমি হাজির। নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা ও নিয়ামত আপনার এবং রাজত্বও আপনারই। আপনার কোনো শরিক নেই।’ আরাফাত ময়দানে সমবেত হওয়ার পর সেখানে হজের খোৎবা পাঠসহ বিশ্বের মুসলমানদের কল্যাণের জন্য মোনাজাত করা হয়। তারপর আল¬াহর ঘর পবিত্র কাবায় গিয়ে চারদিকে সাতবার ঘুরে ‘তাওয়াফ’ করেন হজকারীরা। ‘সাঈ’ করার জন্য যেতে হয় সাফা ও মারওয়া নামের দুটি পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে, যেখানে শিশু ইসমাঈল (আ.)-কে পানি খাওয়ানোর জন্য মা হাজেরা ছুটোছুটি করেছিলেন এবং যেখানে আল¬াহর কুদরতে তৈরি হয়েছিল জমজম কূপ। সাতবার ‘সাঈ’ করার তথা সাফা ও মারওয়ার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে আসা-যাওয়া করার পাশাপাশি ‘আবে জমজম’ বা জমজমের পানিও পান করেন হজকারীরা। হজের পরদিন আসে কোরবানীর পালা, উদযাপিত হয় ঈদুল আজহা। পবিত্র এ দিনটিতে পশু কোরবানী দেয়ার আগে দু’ রাকাত ওয়াজিব সালাত তথা নামায আদায় করতে হয়। এ বছর হজ পালিত হয়েছে গতকাল, ১৪ অক্টোবর। সৌদি আরবসহ মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশে আজ উদযাপিত হচ্ছে ঈদুল আজহা। বাংলাদেশে ঈদুল আজহা পালিত হবে আগামীকাল, ১৬ অক্টোবর। বলা দরকার, একশ্রেণীর মুসলমান ঈদুল আজহাকে কেবলই পশু কোরবানী দেয়ার এবং উৎসব করার দিনে পরিণত করলেও দিনটির প্রধান উদ্দেশ্য মুসলমানদের মধ্যে আল¬াহতা’লার প্রতি পরিপূর্ণ ভালোবাসা ও আনুগত্য তৈরি করা এবং স্বার্থচিন্তার উচ্ছেদ করে আত্মত্যাগের শিক্ষা দেয়া। আল¬াহতা’লার কাছে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করাই ঈদুল আজহার প্রকৃত শিক্ষা। সুতরাং কেবলই লোক দেখানোর জন্য বেশি টাকায় কিনে পশু কোরবানী দেয়ার পরিবর্তে মুসলমানদের উচিত নিজেদের আল¬াহতা’লার কাছে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করার এবং তাঁর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করা। একই কারণে পশু কেনা উচিত সৎপথে উপার্জিত অর্থ দিয়ে। পশুর গোশ্ত যত বেশি সম্ভব আত্মীয়-স্বজন ও গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়ার মধ্যেও কল্যাণ রয়েছে। এভাবে সব মিলিয়েই কোরবানী তথা আত্মত্যাগ করার শিক্ষা দেয় পবিত্র ঈদুল আজহা। আমরা আশা করতে চাই, বাংলাদেশের মুসলমানরাও দিনটির মূল শিক্ষা অনুধাবন করবেন এবং চেষ্টা করবেন যাতে প্রতিবেশী ও স্বজনসহ অন্যরাও উৎসবে শরিক হতে পারেন।
প্রসঙ্গক্রমে পবিত্র ঈদুল আজহার প্রাক্কালে জনগণের কষ্ট ও দুর্ভোগের কথা না বলে পারা যায় না। ঈদুল ফিতরের মতো এবারও মানুষকে বাড়ি যাওয়ার সময় অবর্ণনীয় ভোগান্তির মুখে পড়তে হয়েছে। ট্রেনের টিকেট হাওয়া হয়ে গেছে যথারীতি। কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করেও টিকেট পাননি বহু মানুষ। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষও সময়সূচি বজায় রাখতে ব্যর্থতাই দেখিয়েছে। ট্রেন যাতায়াত করেছে কয়েক ঘণ্টার বিলম্বে। বাসের যাত্রীরাও একই ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। কোনোভাবে বাসে উঠতে পারলেও বেহাল সড়কপথের ঝুঁকি ও বিড়ম্বনার মধ্যেই তাদের বাড়ি যেতে হয়েছে। ওদিকে শত শত অতিরিক্ত যাত্রী নেয়ায় লঞ্চে যারা গেছেন তাদের যেতে হয়েছে জীবন হাতে নিয়ে। এতকিছুর পরও আমরা আশা করতে চাই, ঈদ সবার জন্য আনন্দপূর্ণ হয়ে উঠবে। যদিও সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপিসহ বিরোধী দলের শত শত নেতা-কর্মীকে জেলখানায় মাসের পর মাস কাটাতে হচ্ছে, অনেকে নির্যাতন এড়ানোর জন্য পালিয়ে থাকতেও বাধ্য হচ্ছেন। ওদিকে তথাকথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ কয়েকজন নেতাকে ফাঁসির মঞ্চে নেয়ার প্রস্তুতিও এখন শেষ পর্যায়ে। ফলে ফাঁসির দ-প্রাপ্ত এবং বন্দী ও পলাতক নেতা-কর্মীদের পরিবার সদস্যরা এবারের ঈদে আনন্দ করতে পারবেন না। তাদের জন্য আমাদের সমবেদনা রইল। পবিত্র ঈদুল আজহার প্রাক্কালে অন্য দুটি বিশেষ বিষয়ে বলা দরকার। প্রথম বিষয়টি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কিত। সিটি করপোরেশনগুলোকে অবশ্যই যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি রক্ত ও আবর্জনা সরিয়ে ফেলার পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যক্তিগতভাবেও প্রত্যেককে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। কারণ, ইসলাম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে ঈমানের অঙ্গ হিসেবে ঘোষণা করেছে। সুতরাং প্রত্যেক মুসলমানের উচিত পরিবেশকে দূষিত না করা এবং কোরবানীর কারণে যাতে অসুখ-বিসুখ ছড়িয়ে না পড়ে সেদিকে সচেতনভাবে লক্ষ্য রাখা।  প্রাসঙ্গিক ™ি^তীয় বিষয়টি কোরবানীর চামড়া সম্পর্কিত। প্রকাশিত খবরে এরই মধ্যে ভারতে চামড়া পাচার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। এর একটি কারণ দেশের ভেতরে চামড়ার কম দাম আর অন্য কারণ ভারতীয় ব্যবসায়ীদের জোর তৎপরতা। সীমান্তের ওপারে তো বটেই, দেশের ভেতরেও ভারতীয়রা তাদের দালালদের নিয়োজিত রেখেছে। দালালরা বেশি দাম ও লাভের প্রলোভনও দেখাচ্ছে অনেক আগে থেকে। এজন্যই চোরাচালান প্রতিহত করতে হবে। সে দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের চামড়ার এবং চামড়াজাত পণ্যের বিশেষ জনপ্রিয়তা রয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে। সে কারণে চোরাচালান ঠেকানো না গেলে দেশকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে। আমরা আশা করতে চাই, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থেই সরকার চামড়ার পাচার প্রতিরোধের জন্য সকল ব্যবস্থা নেবে।
পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে দৈনিক সংগ্রাম-এর সকল পাঠক, এজেন্ট, হকার, বিজ্ঞাপনদাতা, লেখক, সংবাদদাতা ও শুভানুধ্যায়ীসহ দেশবাসীর প্রতি আমাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা রইল। ঈদ মোবারক।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads