রবিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৩

জাতীয়তাবাদীদের বিভ্রান্ত করার ষড়যন্ত্র


শিমুল বিশ্বাস

২০১৩ সালে এসে আওয়ামী লীগ জনবিচ্ছিন্ন এক রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। জনসমর্থন হারিয়ে দলটি এখন নানাভাবে, নানা ফ্রন্টে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে আসন্ন নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগের দেশী-বিদেশী মদদদাতারাও তৎপর হয়েছেন একই সাথে। সাম্প্রতিক কালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনপদ্ধতি বিষয়ে নানা পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় সর্বজনস্বীকৃত তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থাই যে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, তা জানা সত্ত্বেও শুধু আওয়ামী লীগকে পুনরায় ক্ষমতায় আনার কৌশল হিসেবে কেউ কেউ নানা ফর্মুলা দিয়ে শেষ রক্ষার চেষ্টা করছেন। সম্প্রতি জাতীয় সংসদ নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে দুটি প্রস্তাব এসেছে, নিরপেক্ষতার মুখোশ পরা আওয়ামী ঘরানার দীর্ঘ দিনের বিশ্বস্তদের প্রস্তাবকে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। কারণ সাধারণত তাদের কণ্ঠে পৃষ্ঠপোষকদেরই ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে। প্রস্তাব দুটি মিডিয়ায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সমস্বরে এগুলোরও বিরোধিতা করেন। তাদের কেউ কেউ বলে বসেন, প্রস্তাব দুটি বিএনপির। ফলে জনমনে কিছুটা হলেও সৃষ্টি হয় একধরনের ধোঁয়াশা। আসলে এটা পাতানো একটি প্রস্তাব। তারা মনে করেছিল, আওয়ামী লীগ প্রস্তাব দুটির বিরোধিতা করলে জাতীয়তাবাদী দল সেগুলোকে লুফে নেবে। প্রস্তাব দুটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সরকারি ও বিরোধী দলের সমানসংখ্যক সদস্য প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচিত করার বিষয়ে স্পিকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ পাঠাবেন। যদি উভয় পক্ষ প্রধান উপদেষ্টার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত না নিতে পারে, তাহলে উভয় পক্ষ থেকে সমানসংখ্যক নাম (দুজন অথবা তার বেশি) স্পিকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে। রাষ্ট্রপতিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন কে প্রধান উপদেষ্টা হবেন। এটা কে না জানে যে, রাষ্ট্রপতি আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি। সুতরাং তিনি আওয়ামী লীগের পছন্দনীয় ব্যক্তিকেই প্রধান উপদেষ্টা করবেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি, কট্টর আওয়ামী লীগ সমর্থক খায়রুল হক, আওয়ামীপন্থী সাবেক বিচারপতি অথবা যেকোনো আওয়ামী বুদ্ধিজীবীকেই বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রধান উপদেষ্টা করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগের এজাতীয় পাতানো ফাঁদে ধরা দেয়নি জাতীয়তাবাদী শক্তি। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে জাতি যখন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন, তখনো আওয়ামী জোট গোপনে অনেক খেলা খেলেছিল। কিন্তু জাতীয়তাবাদী শক্তি তথা বিএনপি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে সৎ ও ন্যায়বান প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নাম প্রস্তাবকে সমর্থন করে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়। তাদের সব কূটকৌশল ব্যর্থ হয়। আওয়ামী লীগ সব সময় আমার লোক’-এর সন্ধান করে। ২০০১ সালের নির্বাচনেও তারা আমার লোকদ্বারা প্রধান উপদেষ্টা, নির্বাচন কমিশন এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি শাখা-প্রশাখা সজ্জিত করে। কিন্তু সে নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়। সে কারণে ২০১৪ সালের নির্বাচনে তারা নিজের লোককেও আর বিশ্বাস করতে পারছে না। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাই বাতিল করে দিয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন করার জন্য তারা চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগ দলীয় লোকজন দিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের শাখা-প্রশাখা এমনভাবে সজ্জিত করেছে, যা অকল্পনীয়। এ অবস্থায় বিরোধী দলÑ জাতীয়তাবাদী জোট কী ভূমিকা পালন করতে পারে? এ ক্ষেত্রে কিছু বিষয় বিবেচনা করতে পারে। প্রথমত, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে অটল থেকে আওয়ামী লীগকে এই গণদাবি মানতে বাধ্য করা। দ্বিতীয়ত, বিরোধীদলীয় একজন প্রবীণ নেতা সম্প্রতি বলেছেন, আওয়ামী লীগের সিনিয়র অনেক নেতা নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে সমর্থন করেন, কিন্তু কথাটা আদৌ সত্য নয়। আওয়ামী লীগের এ থেকে জেডঅর্থাৎ তৃণমূল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নেত্রী যা বলবেন বা মনে করবেন, তা-ই তারা সমর্থন করবেন। ফ্যাসিবাদী ভাবধারার অনুসারী হওয়ায় তারা তাদের নেত্রীর ইচ্ছা ব্যতীত ভিন্ন কিছু কল্পনাও করতে সাহস করবেন না। শেষ পর্যন্ত অবশ্য জনগণের এই ন্যায়সঙ্গত দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা মেনে নেয়া ছাড়া তাদের কোনো গত্যন্তর থাকবে না। তৃতীয়ত, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি মেনে নেয়ার পর আওয়ামী লীগ প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বিচারপতি খায়রুল হক অথবা অন্য কোনো আওয়ামী লীগ সমর্থক বিচারপতি বা শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী বা বুদ্ধিজীবীর নাম প্রস্তাব করবে। আওয়ামী লীগ সমর্থিত রাষ্ট্রপতিও অনেক সমস্যার সৃষ্টি করবেন। চতুর্থত, রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি স্তরে আওয়ামী লীগের দলীয় ব্যক্তিরা নিয়োজিত। বিচারপতি, সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব, উপসচিব, সহকারী সচিব থেকে উপজেলার কর্মকর্তা পর্যন্ত বেশির ভাগ আওয়ামী লীগ ভাবধারার ব্যক্তিরা। তেমনি পুলিশ বিভাগ থেকে শুরু করে অন্য সব সরকারি স্তরেও আওয়ামী লীগ ভাবধারার ব্যক্তিরা নিয়োজিত আছেন। সুতরাং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যাপক রদবদল করতে হবে। পঞ্চমত, নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ বাতিল করে নতুন করে গঠন করতে হবে। আর ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে হবে। এসব বিষয় সবাই জানেন তাই বিস্তৃত ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার কৌশল আওয়ামী লীগ নিজ কৌশলের অংশ হিসেবে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টি করে জাতিকে বিভক্ত করছে। বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার পরামর্শে আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় কিছু ব্লগার কুশ্রী, অশ্লীল ও স্থূল ভাষায় ইসলাম ধর্ম ও মহানবী সা: এবং তাঁর পরিবার সম্পর্কে অসত্য ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রচার করেছে; তা অমার্জনীয় অপরাধ। একইভাবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মন্দির ও বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়ে মূর্তি ভাঙচুর, সম্পদ লুণ্ঠন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারীদের শ্লীলতাহানির মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। এসব ঘটনার সাথে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেলেও তারা দায় চাপাচ্ছে অন্যের ঘাড়ে। লক্ষণীয় যে, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ এ ব্যাপারে তেমন কোনো প্রতিবাদ করতে পারছে না। অতীতে সাধারণ কোনো ধর্মীয় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে সংগঠনটি বেপরোয়াভাবে প্রতিবাদমুখর হতো। কিন্তু এত ঘটনা ঘটার পরও তারা চুপচাপ। কারা এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে, তা ঐক্য পরিষদ নেতৃবৃন্দ বা হিন্দু নেতৃবৃন্দ জানার পরও রহস্যজনক কারণে নীরব থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। এসব ঘটনা যে কত ভয়াবহ, কত মারাত্মক, কত বড় অপরাধ তা আওয়ামী লীগ বুঝতে পারছে না। স্বাধীনতার পর আর কোনো সময়ই এত ভয়াবহ ঘটনা ঘটেনি। আওয়ামী লীগকে ভবিষ্যতে এর জন্য কী মূল্য দিতে হবে, তা তারা এখন কল্পনাও করতে পারছে না। অনুরূপভাবে বৌদ্ধ প্যাগোডা বা বৌদ্ধমূর্তি ভাঙা, আগুন জ্বালানো, ধ্বংস করাও একই ধরনের অপরাধ। আসলে সব ঘটনাই ঘটানো হয়েছে এক সুদূরপ্রসারী চক্রান্তের অংশ হিসেবে। দেশে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করার জন্য বিদেশী ছক মোতাবেক আওয়ামী লীগের মাফিয়া চক্র দেশের অভ্যন্তরে এসব সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক নাশকতার তৎপরতা চালানোর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ সব ধর্মাবলম্বী মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রয়োজন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট রাখতে হবে। অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি বিধানের দাবিতে সোচ্চার হতে হবে। সতর্কতা প্রয়োজন এক : ভোটার তালিতায় লাখ লাখ জাল ভোটার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সীমান্ত অতিক্রম করে ভোট দেয়ার জন্য জাল ভোটারেরা এ দেশে আসার পাঁয়তারা করছে। একটি উদাহরণ, ২০০১ সালের নির্বাচনের ভোটার তালিকায় দেখা যায়, সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরের ঠিকানায় কয়েক শজাল ভোটারের নাম। ওই এলাকার কয়েকজন সচেতন ভোটার নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করার পর তা আইনগতভাবে তদন্তের মাধ্যমে সংশোধন করা হয়। এ ধরনের জাল ভোটার বাংলাদেশের হাজার হাজার কেন্দ্র বললে ভুল হবে, লাখ লাখ কেন্দ্রে পাওয়া যাবে। সীমান্তের কাছাকাছি সবগুলো ভোটকেন্দ্রেই জাল ভোটারদের তৎপরতা লক্ষণীয়। এসব জাল ভোটের সবটাই আওয়ামী লীগ সমর্থক। এসব বিষয়ে সচেতন থেকে নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য কঠোর ও আপসহীন সংগ্রাম করা জরুরি। দুই : অবশ্যই সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ও তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের সব ভোটকেন্দ্রে নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। তিন : নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর রাষ্ট্রপতির কার্যালয়সহ সরকারের অন্যান্য বিভাগ থেকেও সমস্যা সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকবে। ক্ষমতা হস্তান্তরে নানা বাধাবিপত্তি আসবে। সে সময়েও সবাইকে সজাগ থেকে উদ্ভূত যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি ও জনমত বিবেচনায় বিএনপির নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী জোট ও শক্তি যেহেতু ঐক্যবদ্ধ, সে কারণে আওয়ামী লীগের সব অশুভ পরিকল্পনাই ব্যর্থ হতে বাধ্য। জনগণের ইচ্ছা-আকাক্সা ও আবেগকে রোধ করা যায় না। সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগ যত দিন থাকবে তত দিন বাংলাদেশের জনগণকে নিরন্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়েই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads