বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৩

২৫ অক্টোবরের পর পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে?


১.
একটি দৈনিকে আলী রীয়াজ, [ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক এবং বর্তমানে পাবলিক পলিসি স্কলার, উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলারস, ওয়াশিংটন, যুক্তরাষ্ট্র] লিখেছেন: ‘‘রোজ কেয়ামত হলেও নির্বাচন হবে’ বলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিমের বক্তব্যের সঙ্গে আক্ষরিকভাবে একমত হওয়ার অবকাশ নেই। তবে তাঁর এ বক্তব্যের মর্মবস্তু বুঝতে কারও অসুবিধা হয় না; সরকারি দল বিরোধী দলের সঙ্গে কোনো রকম আপসের কথা বিবেচনা করবে না, যেভাবেই হোক নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সরকারি দলের নেতারা, বিশেষত প্রধানমন্ত্রী সংকল্পবদ্ধ। অন্যদিকে বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া বলেছেন যে তাঁরা নির্বাচন প্রতিহত করবেন। এসব বক্তব্যের পাশাপাশি রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি, ২৫ অক্টোবরের পর সরকারের কাজ দৈনন্দিন দায়িত্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। এই প্রেক্ষাপটে অনেকের মনেই প্রশ্ন, ২৫ অক্টোবরের পর পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে?’’ বিরোধী দলও ২৫ অক্টোবরের পর তাদের শক্তির প্রমাণ দেবে মর্মে হুঙ্কার দিচ্ছে। এদিকে, বৃটেনের ফিনান্সিয়াল টাইমস এ বৃহস্পতিবার প্রকাশিত ‘ফ্ল্যাউড ওয়ার ক্রাইমস ট্রায়াল পুশ বাংলাদেশ টু দ্যা এ্যাজ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের পরিচিত ছিল ক্ষুধা, দারিদ্র্য এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য। কিন্তু শেষ দুই দশকে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে। এইসময়ে অপুষ্টি, শিশু মৃত্যুর হার এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে, বেড়েছে সাক্ষরতা এবং জীবনযাত্রার মান। এইসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশে তার বৃহৎ প্রতিবেশি ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। এতে বলা হয়েছে, ১৫ কোটি জনসংখ্যার মুসলিম দেশ বাংলাদেশ- চীন এবং ইতালির সঙ্গে বিশ্বের বৃহৎ গার্মেন্ট পণ্য রফতানিকারক দেশ। যদিও গার্মেন্ট কারখানায় আগুন এবং ভবন ধসের ঘটনায় এক্ষেত্রে বাংলাদেশের খ্যাতি নষ্ট হয়েছে। ভবন ধসের ঘটনায় এক হাজারেরও বেশি শ্রমিক মারা যায়। যদিও রাজনীতির কারণে বাংলাদেশের অর্জন আজ হুমকির মুখে। বিশেষত বিরোধীদের দমনে, তাদের ফাঁসি দিতে শেখ হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগের সংকল্পের কারণে বাংলাদেশে অর্জন হুমকির মুখে পড়েছে। ট্রাইব্যুনাল তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। সন্দেহ নেই, সর্বত্র প্রশ্ন আর সংশয়। বাংলাদেশে চলমান সব কিছু দেখে-শুনে কি কেউ বলতে পারবে পুরো পরিস্থিতি ও বিচিত্র ঘটনা প্রবাহ কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে?  মানুষ ও সমাজকে আসলে কোন দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? আসলে কি হবে ২৫ অক্টোবরের পর? অর্থাৎ সংঘাত, সমঝোতার কথা বলতে বলতে সকলেই মুখে ফেনা তুলে ফেললেও সেটা হয়নি। এমনকি, সঙ্কট সম্পর্কে দায়িত্বপূর্ণ কথা-বার্তা বা সংলাপ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। পরিণামে আমরা সর্বনাশের দ্বারপ্রান্তে এসে উপস্থিত হয়েছি। এখন ১৫ দিন বাদের ২৫ অক্টোবরকে দিন ধার্য্য করে ক্ষমতার দড়ি টানাটানি শুরু হয়েছে। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা, শান্তিপূর্ণ ক্ষমতার পালাবদল, সুশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নিয়মতান্ত্রিক পথচলা সর্বনাশা ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কারণে কোথায় গিয়ে পৌঁছায়, ২৫ অক্টোবরের পরেই সেটা জানা যাবে। সেই জানাটা সুখকর না দুঃখজনক হবে, সেটা নিয়েও ভরপুর আশঙ্কা বিদ্যমান। প্রসঙ্গত সর্বনাশ নিয়ে একটি আপ্ত বাক্য স্মরণ করা যেতে পারে। সুপ্রাচীন প-িত বিষ্ণুশর্মা বলেছিলেন, ‘সর্বনাশ সমুৎপন্ন হলে অর্ধেক ত্যাগ করে বাকি অর্ধেক রক্ষা করতে হয়।’ সরকারি ও বিরোধী দলের প্রাজ্ঞ নেতারা নিশ্চয়ই প্রাচীন নীতি-কাহিনী ‘পঞ্চতন্ত্র’ জানেন।  কিন্তু তাঁরা বোধ করি সুকুমার রায়ের শ্লেষাত্মক ছড়াও পড়েছেন। ফলে বলা যায়, রাজনীতিবিদগণ এই সত্যও অবগত আছেন যে, ব্যাকরণ শিংয়ের সেজোমামার আধখানা কুমিরে খেয়ে ফেললে বাকি আধখানা মরে যায়। অর্থাৎ ‘পরিণামকৈবল্যবাদী’ হলে গণতন্ত্রের চলে না। নীতি, পদ্ধতি এবং আচরণ যথাযথ হওয়াই গণতন্ত্রে সমান আবশ্যক। এক অর্থে এই শর্তগুলি পরিণাম অপেক্ষা অধিক মূল্যবান। এই মূল্য সকলেই সমানভাবে অনুধাবন করেন না। যেমন, সপ্তদশ শতকে ফরাসি সম্রাট চতুর্দশ লুই বলেছিলেন ‘আমিই রাষ্ট্র’। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদগণের বোঝা দরকার, লুইয়ের কথার পর চারশ’ অতিক্রান্ত হয়ে এখন একবিংশ শতাব্দী। বিলবোর্ডে বিজ্ঞাপন দিয়ে নেতারা গণতান্ত্রিক মানসিকতা জাহির করেছেন। এবার সর্বনাশ ঠেকিয়ে গণতান্ত্রিকতার প্রমাণ দিলেই মানুষ খুশি হবে; জাতি উদ্ধার পাবে। 
 ২.
জর্জ অরওয়েল বিখ্যাত হয়েছেন রাজনৈতিক উপন্যাসের জন্য। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের লৌহ শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর ‘নাইনটিন এইটিফোর’ বিশ্বব্যাপী সাড়া জাগানো গ্রন্থ। অরওয়েলের আরেক প্রসিদ্ধ বইয়ের নাম ‘বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ’। বাংলা করলে বইটির শিরোনাম দেয়া যায়, ‘দাদা তোমাকে নজর রাখছেন’। এই ‘দাদা’ বা ‘বড় ভাই’কে, সেটা ব্যাখ্যার দরকার হয় না। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতিতে দাদাদের চেনা কষ্টকর নয়। জাতীয় রাজনীতিতেও দাদাগিরি অনুপস্থিত নয়। বহু দাদা আছেন, যারা জনগণকে, অফিসারদের নিত্য শাসাচ্ছেন। এখন চলছে দাদাদের যুগ। জবরদস্তিমূলকভাবে চেপে ধরার যুগ। নজরদারি আর খবরদারির আমল। এইসব আগ্রাসন বা খবরদারির সঙ্গে সোসিওলজির ‘প্যানঅপটিকন’ তত্ত্বের তীব্র মিল রয়েছে। এই তত্ত্বে সর্বাঙ্গীণ নজরদারিকে কর্তৃপক্ষের তুঙ্গ ক্ষমতার অঙ্গ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। উল্লেখ করা হয় রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের বা রাষ্ট্রের চরম স্বৈরাচারের দ্যোতক হিসাবে। এতে যে ব্যক্তির গোপনীয়তা, নিরাপত্তা ও অধিকার ক্ষুণœ হচ্ছে, সেটাও বিবেচনা করা হয় না। ব্যক্তিকে যে প্রবল সন্দেহের মধ্যে এবং আতঙ্কের আবর্তে ফেলে দেয়া হচ্ছে, সেটাও ভাবা হচ্ছে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মানিতে ইহুদিদের এমনই সন্দেহের তালিকায় রেখে নজরদারির সম্মুখীন করা হয়েছিল। ৯/১১-এর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম নামের কাউকে পেলেই প্রচ- নজরদারির আওতায় আনা হতো। যেন রাষ্ট্রের নাগরিক হয়েও লোকটি কেবল মুসলিম হওয়ার কারণে শত্রুপক্ষ বা সন্দেহভাজন। ব্যক্তির গণতান্ত্রিক ও মৌলিক মানবাধিকারের এমন চরম লংঘন অতীতে কখনও হয়েছে কি-না, কে জানে! এখন ভারতের কোথাও কোথাও মুসলিমদের সন্দেহভাজন তালিকায় রাখা হয় বলে অভিযোগ শোনা যায়। বাংলাদেশে বা উন্নয়নশীল বহু দেশেই এই খবরদারির সংস্কৃতি চালু হয়েছে। তুমি আমার পক্ষেও নওÑঅতএব শত্রুপক্ষ এবং সন্দেহভাজন। এমন সরল ও উগ্র রাজনৈতিক বিবেচনায় সমাজ, প্রশাসন, শিক্ষাঙ্গন, মিডিয়াসহ সকল ক্ষেত্রেই বিভাজন হয়ে গেছে। নিজের পক্ষের বাইরের সবাইকে নজরদারি ও খবরদারির মধ্যে রাখা হচ্ছে। গোয়েন্দা লাগানো, ফোনে আঁড়ি পাতা, গোপন ক্যামেরা লাগানো ইত্যাদি অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি খবরদারি-নজরদারিকে সর্বাত্মক করেছে। ব্যক্তির অতি গোপনীয় ও ব্যক্তিগত বিষয় বলে আর কিছুই থাকছে না! ভেতরের দাদা বা পাপাদের মতো বাইরের দাদারাও নানা কৌশলে ব্যক্তি, নেতৃত্ব, সমাজ, প্রশাসন, দেশ ইত্যাদির ওপর চরম নজরদারি করছে। সব গোপন খবর হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে গোপন তথ্য ফাঁস করে দেয়ার ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইলও করা হচ্ছে। বলাই বাহুল্য, পুরো পরিস্থিতিটিই অস্বাস্থ্যকর ও কুরুচিপূর্ণ এবং একই সঙ্গে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও মৌলিক অধিকারের জন্য হানিকর। কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ, নজরদারি, খবরদারি আর ব্যক্তির স্বাধীনতার মধ্যে তাহলে কি কোনওই সীমা-পরিসীমা থাকবে না? ব্যক্তির যা খুশি তা-ই কি কর্তৃপক্ষ উন্মোচিত করতে পারবে? এই ব্যাপারে অবশ্যই একটি সীমারেখা টানা জরুরি। বাইরের থেকে যারা নজরদারি বা খবরদারি করছেন, তাদের ব্যাপারেও তো একটি প্রতিবিধান রাখা দরকার। আমাদের কতটুকু বাইরে প্রকাশযোগ্য সেটাও ঠিক করতে হবে। বাইরের যে কেউ এসে আমাদের সব কিছু দেখে ফেলবে বা প্রচার করবে, সেটাও তো কাম্য নয়। পুরো ব্যাপারটিকে তো আর উদাম করে দেয়া যায় না। সরকারের নানা আইনের আওতায় যখন ব্যক্তির স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হয়, তখন ক্ষমতার দাপটে বাইরের কেউও দেশের অনেক গোপন বিষয় নিয়ে টানাটানি করতে পারে। এইসব কুরুচিপূর্ণ এবং গর্হিত কাজ ভালো প্রতিফলের বদলে খারাপ উদাহরণই সৃষ্টি করণে। যদিও ভেতরে ও বাইরের নজরদারি যেন ব্যক্তি  সমাজের অধিকারকে নস্যাৎ না করে, সেটাই কাম্য হওয়া উচিত, তথাপি সর্বশেষ খবরে প্রকাশ, যুক্তরাষ্ট্র সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথোপকথন-সংক্রান্ত এটিএন নিউজের একটি ভিডিও ক্যাসেট জব্দ করা হয়েছে। এ নিয়ে এখন সর্বত্র চলছে ব্যাপক কানাঘুষা। এটিএন নিউজের এক বহুল আলোচিত নারী সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতা বিনা অনুমতিতে রেকর্ড করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তা হাতেনাতে ধরা পড়লে ভিডিও ক্যাসেটটি জব্দ করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের সূত্রে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার এটিএন নিউজের ওই সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হোটেল রুমে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। এ সময় তার সঙ্গে ছিল ভিডিও ক্যামেরা। এটাকে অনানুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী তার কথাবার্তা রেকর্ড করতে বারণ করেন। সাংবাদিক কোন কথা রেকর্ড না করার প্রতিশ্রুতি দেন। এ সময় দু’জনের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিস্তর কথাবার্তা হয়। এর সবই  গোপনে রেকর্ড হচ্ছিল। সাংবাদিকের বেরিয়ে যাওয়ার সময় বিষয়টি সবার নজরে আসে। সূত্র মতে, প্রধানমন্ত্রী এতে বিস্ময় প্রকাশ করে ক্যাসেটটি জব্দ করার নির্দেশ দেন। তখন তাৎক্ষণিকভাবেই ক্যামেরা থেকে খুলে নেয়া হয় ক্যাসেটটি। অতএব সাধু সাবধান! খবরদারি-নজরদারি ব্যক্তি থেকে নেতৃত্বে ছড়াচ্ছে সর্বত্র।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads