বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৩

যে কারণে সরকার এত অনীহ


সিরাজুর রহমান
আপনাদের মনে আছে কি ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনের কথা? সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দারুণ মার খেয়েছিল। শেখ হাসিনা তার স্বভাবসুলভ রূঢ় ভাষায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং রাষ্ট্রপতিকে গালাগাল করেছিলেন। নির্বাচনে জয়ের নীলনকশা অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকার গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী পদগুলোতে নিযুক্ত আমলাদের নিয়োগ ও বদলি করেছিল। প্রধান উপদেষ্টা হয়েই বিদায়ী প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান সেসব আমলার মধ্যে মাত্র ১২ জনকে আবার বদলি করেন। তখন থেকেই শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ মরা কাঁদুনি শুরু করেন। বিদায়ী সরকার দুর্নীতিপূর্ণ পন্থায় নির্বাচনে জয়ী হওয়ার যে ষড়যন্ত্র করেছিল সেটা সবার কাছে ফাঁস হয়ে যায়। 
দেশবাসী সবচেয়ে মর্মাহত হয়েছে, রাষ্ট্রপতিকে গালাগাল করতে গিয়ে শেখ হাসিনা যে ভাষা ব্যবহার করেছিলেন তাতে। হাসিনা বিচারপতি লতিফুর রহমান ও রাষ্ট্রপতিকে বিশ্বাসঘাতক বলেও গালি দিয়েছিলেন। অথচ সে রাষ্ট্রপতি ছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে গদিচ্যুত সামরিক স্বৈরশাসক লে. জে. এরশাদ তার কাছেই ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে তখন তিনি যেভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং যেভাবে ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচন পরিচালনা করেছেন দেশে ও বিদেশে সবাই তখন তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন এবং মনে রাখতে হবে যে, ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী হয়ে শেখ হাসিনাই বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদকে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য মনোনীত করেছিলেন। 
আশা করি আপনাদের আরও মনে আছে, নির্বাচনে পরাজিত হয়েও শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনের দখল ছাড়তে রাজি ছিলেন না। নানা অছিলায় তিনি কেবলই কালক্ষেপণ করছিলেন। শেষপর্যন্ত যেভাবে তাকে প্রায় টানাহেঁচড়া করে গণভবন ছাড়তে বাধ্য করা হলো, সেটা অনিচ্ছুক পাঁঠাকে বলি দেবার যূপকাষ্ঠে নিয়ে যাওয়ার সাথে তুলনা করা যেত। 
একটা মাস্টারপ্ল্যানের সাজানো নির্বাচনে ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী হয়ে শেখ হাসিনা প্রথমেই বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে তার দীর্ঘকালের পারিবারিক বাসভবন থেকে বের করে দেয়ার জন্য অত্যন্ত অশোভনভাবে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। তখন আমার ২০০১ সালের গণভবনের ঘটনাটি বারবার মনে পড়ছিল। হাসিনা গণভবন ছাড়তে রাজি ছিলেন না। ভবনটা অবশ্যই তার ভালো লেগেছিল। সেটা সে ভবনের স্থপতি ও প্রকৌশলীদের প্রতি প্রশংসার কারণে ছিল না। হাসিনা নিজেকে বাংলাদেশের রানী ও সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়ার মতো বলেই মনে করেন। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের মসনদ তার পৈতৃক সম্পত্তি। এ সম্পত্তিতে আর কারো অধিকার নেই। সুতরাং তার পছন্দের বাড়ি গণভবন বরাবরই তার নিবাস হবে। 
ঘুরেফিরে নাটকের সে অঙ্কটি আবার ফিরে এসেছে। সবার কাছেই এখন স্পষ্ট, এ সরকার গদিতে থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়ে ফেলেছে। জনগণ অনেক দিন আগেই অনানুষ্ঠানিকভাবে তাকে ও তার সরকারকে বিদায় দিয়েছে। আনুষ্ঠানিক বিদায়ের প্রক্রিয়া নির্বাচনটা শেখ হাসিনা ঠেকিয়ে রাখছেন। মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে তাকে আবারো গণভবন ছাড়তে হবে। সে সম্ভাবনাকে তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। শেখ মুজিবের মেয়ে তিনি, তিনি সিংহাসনে অধিষ্ঠিত থাকবেন না, এটা কী করে হতে পারে? গণতন্ত্রকে মনে মনে তিনি অনবরত শাপ-শাপান্ত করছেন। মুখ ফুটে অবশ্যি বলা যাবে না। নানা ধানাইপানাই তিনি করছেন সেজন্য। যেকোনোভাবেই হোক অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ঠেকিয়ে রাখা প্রয়োজন। তেমন অবস্থায় নীলনকশা আর মাস্টারপ্ল্যানগুলোকে কাজে লাগানো যাবে। 

ভারত-আওয়ামী লীগ ষড়যন্ত্র 
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ সব দেশের প্রস্তাবই নাকচ করে দিয়েছেন শেখ হাসিনা। এমনকি বিরোধী দলের সাথে সংলাপের ব্যাপারে জাতিসঙ্গকেও উপেক্ষা করেছেন। এখন তার একমাত্র ভরসা ভারত। অনেক কিছু পেয়েছে ভারত গত পাঁচ বছরে। আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং আমাদের জমিজমাও (ভৌগোলিক এলাকা) পুরোপুরি সাফকবলা না হলেও অন্তত বর্গা নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু পুরোপুরি কবলা না হওয়া পর্যন্ত ভারতকে শেখ হাসিনার ওপর নির্ভর করে থাকতে হচ্ছে। যেকোনো মূল্যে ভারত তাই শেখ হাসিনাকে গদিতে রাখতে চায়। গোল্লায় যাক বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার আর তাদের অবাধ ভোটদান! 
কিন্তু সফল হবে কি এই ভারত-আওয়ামী লীগ ষড়যন্ত্র? আমার মনে হয়, ‘না। আগে না হোক অন্তত বিগত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের মানুষ খেলাটা বুঝে গেছে। এখন তাদের বোধোদয় হয়েছে। দেশ বিক্রি করে গদি রাখা এখন আর তাদের সম্মানজনক মনে হয় না। তা ছাড়া মীর জাফরদের দাপট তো আর চিরদিন বজায় থাকতে পারে না। তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ আর ভোলাগঞ্জ থেকে মোরেলগঞ্জ পর্যন্ত দেশের সর্বত্র মানুষ লাখে লাখে খালেদা জিয়ার পেছনে কাতারবন্দী হয়ে প্রমাণ দিয়েছে যে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি ছাড়া কোনো সাজানো-পাতানো নির্বাচনে তারা বিশ্বাস করে না। সমস্যা হচ্ছে সেখানে। তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি আর নিরপেক্ষ নির্বাচনকে গণভবনের বর্তমান ভাড়াটিয়া যমের মতো ভয় করেন। 
প্রাণপণে গদির পায়া আঁকড়ে ধরে রক্ষা পেতে চাইছেন এ সরকার ২০০১ সালের মতো। দুনিয়ার সব দেশ, এমনকি জাতিসঙ্ঘও বলছে বিরোধীদের সাথে সংলাপ করো, সবার গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে রাজি হও। সেগুলো বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর চোখে পড়ে না। তার দৃষ্টিশক্তি আঠা দিয়ে এঁটে আছে দিল্লির দিকে। দিল্লি গণতন্ত্র চায় নিজ দেশে, কিন্তু বাংলাদেশে নয়। তাদের ফতোয়া, বাংলাদেশের নির্বাচন হবে শেখ হাসিনার অধীনে; ফলাফল তো তৈরি করেই রেখেছেন তিনি। শেষ মুহূর্তে এসেও অসাধুতা আর ধূর্তামি দিয়ে পার পেতে চাইছেন তিনি। 
শুক্রবারের (২৫ অক্টোবর) জনসভায় খালেদা জিয়া ঘোষণা দিলেন, সেদিন এবং পর দিনের (২৫ ও ২৬ অক্টোবর) মধ্যেই অর্থবহ সংলাপে বসতে হবে, নইলে ২৭ তারিখ ভোর ৬টা থেকে লাগাতার হরতাল। সরকার ও গণভবন ২৫ তারিখে কোনো উদ্যোগই নেয়নি। ২৬ তারিখ বিকেলে খবর দেয়া হলো প্রধানমন্ত্রী অনেক চেষ্টা করেও বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়ার সাথে টেলিফোন সংযোগ করতে পারেননি। খালেদার মিডিয়া সচিব মারুফ কামাল খান ব্যঙ্গ করে বললেন, ১২ হাজার মাইল দূরে নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘ থেকে মহাসচিব বান কি মুন টেলিফোন করে খালেদা জিয়াকে পেলেন, আর ঢাকায় বসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নাকি সেটাও করতে পারলেন না। 
পরে জানা গেল আসল রহস্যটা। বিরোধী দলের নেতার যে রেড টেলিফোন থাকে সেটা কয়েক মাস ধরেই অচল। (সরকার কি ইচ্ছা করেই অচল করে দিয়েছে?) খালেদা জিয়ার কার্যালয় থেকে সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগে বারবার যোগাযোগ করেও অচল লাল টেলিফোন সচল করা যায়নি। সেই অচল টেলিফোনেই প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের নেতার সাথে নাকি কথা বলার চেষ্টা করছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে ঢাক পেটানো হলো শেখ হাসিনা সন্ধ্যা ৬টায় আবার খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করার চেষ্টা করবেন। সে চেষ্টা তিনি সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার আগ পর্যন্ত করেননি। 

প্রধান অভাব সদিচ্ছার 
সেটাও যে সদিচ্ছার বশবর্তী হয়ে করা হয়েছিল তা নয়। কার্যত তার বক্তব্য ছিল : গণভবনে আসুন, খানাপিনা হবে, সংলাপ হবে, ইতোমধ্যে আপনি হরতালটা তুলে নিন। ঢাকার একটি টিভি-চ্যানেল এখন দুই নেত্রীর ৩৭ মিনিট স্থায়ী টেলিফোন কথোপকথনের বিবরণ প্রকাশ করেছে। স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ১৮ দলের জোটের নেত্রীকে বেকায়দায় ফেলে ৬০ ঘণ্টার হরতাল ঠেকানোই ছিল হাসিনার উদ্দেশ্য। বহু দেশের বহু নেতার একান্ত টেলিফোন সংলাপের খবর জানার সুযোগ আমার হয়েছে। কিন্তু সেসব আলাপের সময় টেলিভিশন ক্যামেরা চালু রাখার কথা এই প্রথমবার শুনলাম। প্রধানমন্ত্রীর কথাগুলো টেলিভিশনে ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু খালেদা জিয়ার কোনো ক্যামেরা ছিল না। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, বিরূপ প্রচারণা দিয়ে খালেদা জিয়াকে অপদস্থ করা, বেকায়দায় ফেলাই ছিল হাসিনার উদ্দেশ্যÑ দেশের সঙ্কটের অবসান নয়। 
কিন্তু সরকারের ফাঁস করা টেলিভিশন ছবিতেও প্রমাণ হয় যে, খালেদা জিয়া কাঁচা খেলোয়াড় নন। প্রধানমন্ত্রী তাকে ফাঁদে ফেলতে পারেননি। বর্তমানে গণভবনে মেহমানদারির বাজেট কয়েক কোটি টাকা। খালেদা জিয়ার সামর্থ্য বোধ হয় অত বেশি নয়। কিন্তু তিনি অনাহারে-অর্ধাহারে আছেন বলে শুনিনি। জিয়াফতের লোভে তিনি আত্মহারা হয়ে যাননি। পোলাও আর কোফতার সুঘ্রাণ নিয়ে আলোচনায় মজে যেতে তিনি চাননি। তিনি, তার দল ও জোট এবং বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মানুষ চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। তত্ত্বাবধায়ক কথাটা যদি ভাশুরের নাম হয়, প্রধানমন্ত্রীর জিহ্বায় আটকায়, তাহলে অন্য যেকোনো নামে একটা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করতেও খালেদা জিয়া রাজি আছেন। কিন্তু সব আলোচনারই একটা ভিত্তি থাকা দরকার। ভিত্তিই যদি না থাকল তা হলে সংলাপ-সংলাপ খেলায় সময় নষ্ট করে কী লাভ? 

সরকারের আসল খেলা 
সরকারের আসল খেলাটা স্পষ্ট হতে দেরি হয়নি। খানাপিনার আগে খালেদা জিয়াকে ১৮ দলের লাগাতার হরতাল তুলে নিতে হবে। দেখুন তো! কী ঝামেলা! হরতাল ডেকেছে ১৮ দল। ১৮ দল তো আর বাকশাল নয়, আর খালেদা জিয়া তো বাকশালী মহাপ্রভু নন যে, তিনি এক কথায় সে হরতাল তুলে নেবেন। তা ছাড়া স্পষ্ট হয়ে গেল যে, খালেদা জিয়াকে বেকায়দায় ফেলতেই সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের নেতার সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ পর্যন্ত করতে পারলেন না। আন্তরিকতা থাকলে তার আগে তিনি হেঁটেই চলে যেতে পারতেন খালেদা জিয়ার গুলশানের অফিসে! আসলে বিরোধী জোটের নেতাদের সাথে যাতে তিনি আলোচনার সময় না পান সে জন্য ইচ্ছা করেই অতি দেরিতে তাকে টেলিফোন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। 
ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। আঠারো দলের হরতাল যথারীতি হয়েছে। দেশ অচল ছিল। ব্যবসায়-বাণিজ্য অর্থনীতি তালাবন্ধ। দলীয়কৃত পুলিশ, বিডিআরের পরিবর্তে গড়া (দলীয়কৃত) বিজিবি আর আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের সরকার ময়দানে নামায় মন্ত্রীদের উক্তিমতো কঠোরহস্তে বিএনপির হরতাল ভণ্ডুল করতে। মিডিয়ায় ফটো ছাপা হয়েছে র‌্যাবের সাথে অপরিচিত (বিদেশী কি?) লোকেরাও একে ৪৭ রাইফেল নিয়ে গুলি চালাচ্ছে হরতালকারীদের ওপর। সরকারের লোকেরা বোমা ফাটাচ্ছে, আগুন লাগাচ্ছে, মানুষ খুন করছে। আর উল্টো দোষ চাপাচ্ছে হরতালকারীদের ওপর। মন্ত্রীরা যার যা খুশি উল্টোপাল্টা বিবৃতি দিচ্ছেন। তাদের সাথে মাঝে মাঝে ফুটুস কাটছেন সজীব ওয়াজেদ জয়। আজেবাজে কথা বলার জন্য হানিফ বরখাস্ত হয়েছেন। এই মন্ত্রীগুলোকেও সে রকমই বরখাস্ত করা উচিত ছিল। সরকারের হাতে মিডিয়া আছে, আছে সরকারি প্রচারযন্ত্র এবং শূন্য ভাণ্ডের মতো বাকসর্বস্ব আর মাকাল ফলের মতো অপদার্থ পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি আছেন। দেশের মানুষ আর এই সরকার ও তাদের মন্ত্রীদের কোনো কথাই বিশ্বাস করে না। কিন্তু বিদেশীদের তারা বোঝাতে চাইবে তাদের সংলাপের প্রস্তাবে বিরোধী দলের নেতা সাড়া দেননি, তারা অর্থনীতিকে ধ্বংস করছে, দেশের সর্বনাশ করছে ইত্যাদি ইত্যাদি। 
কিন্তু কোনো লাভ হবে কি গণভবনের ভিত্তিস্তম্ভ দুহাতে আঁকড়ে থেকে? গণজোয়ার দুর্বার হয়ে উঠেছে। বিদেশী সমর্থন আর বিদেশী দালালদের দিয়ে সে জোয়ার ঠেকিয়ে রাখা চলবে না। সরকার যদি ভালোয় ভালোয় বিদায় হতেন তা হলে দেশের সর্বনাশ কিছুটা কমানো যেত। খালেদা জিয়া ও ১৮ দলের নেতা-নেত্রীরা গণতন্ত্রের সংগ্রামে ব্যস্ত। সে সংগ্রামে বিজয়ের পর দেশকে এবং দেশের ইনস্টিটিউশনগুলোকে নতুন করে গড়ে তোলার চিন্তা করার সময় এখন তাদের নেই। কিন্তু চিন্তা কাউকে না কাউকে অবশ্যই করতে হবে। আসুন, চিন্তাগুলো আমরাই শুরু করি। 

দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ 
গত প্রায় পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশে প্রকৃতই দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ চলছে। এ যুদ্ধ প্রথম মুক্তিযুদ্ধ থেকে মোটেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। একাত্তরে আমরা পাকিস্তানের দখলকার থেকে মুক্ত হতে, গণতন্ত্র স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব পেতে চেয়েছিলাম। প্রভু বদল করা মোটেই আমাদের উদ্দেশ্য ছিল না। দুর্ভাগ্যবশত বর্তমান সরকারের আমলে গণতন্ত্র লাঠিপেটা খেয়ে পালাই পালাই করছে। আমাদের স্বাধীনতা ফিকে হয়ে গেছে, সার্বভৌমত্বেরও অনেকখানি হাতছাড়া হয়ে গেছে। আমাদের সড়ক, রেল, নদ-নদী, বন্দর সবই বিনামূল্যে ভারতের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। আমাদের সম্পদ খোলা ও চোরাপথে ভারতে চলে যাচ্ছে। 
হাজার হাজার, হয়তো লাখ লাখ ভারতীয় বিনা পারমিটে বিনা ভিসায় বাংলাদেশে বাস করছে, চাকরি করছে আয়কর না দিয়েই। তারা হয়তো চোরাগলি দিয়ে আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংকেও ঢুকে গেছে। সবচেয়ে ভয়ের কথা, ভেতর থেকে তারা স্যাবোটাজ আর নাশকতা চালাচ্ছে, আমাদের তৈরী পোশাক শিল্প এবং অন্যান্য উৎপাদন যন্ত্রগুলো ধ্বংস করে দিচ্ছে। আমাদের তৈরী পোশাক রফতানির বাজার এখন প্রতিবেশী দেশের হাতে চলে যাচ্ছে। অন্য দিকে সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশীদের অবলীলায় গুলি করে মারছে বিএসএফ। বাংলাদেশ সরকারের প্রতিবাদ এরা কানে তুলছে না। মোট কথা, ভারতীয়রা বর্তমানে আমাদের সরকারের মাথার ওপর ছড়ি ঘোরায়, কর্তালি করে। 
এসবই করা হচ্ছে এই আশায় যে, ভারতীয়রা কোনো-না-কোনোভাবে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের মতো মাস্টারপ্ল্যানের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করবে, শেখ হাসিনাকে আবারো প্রধানমন্ত্রী করা হবে। তার পরিণতির কথা কেউ ভেবে দেখেছেন? বিগত প্রায় পাঁচ বছরে ভারত বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে করিডোর ও ট্রানজিটের পথ এবং আমাদের সামুদ্রিক বন্দর দুটি ব্যবহারের অধিকার আদায় করে নিয়েছে। আমাদের অবকাঠামোগুলো এখন ভারতের নিয়ন্ত্রণে। ভারতের অনুগ্রহে এ সরকার যদি আবারো গদি পান তা হলে সম্ভবত বাংলাদেশকে সিকিমের মতো একটা করদ রাজ্যে পরিণত করা হবে। আমাদের স্বাধীনতা এখন সত্যি সত্যি বিপন্ন। 
বিএনপির নেতা বেগম খালেদা জিয়া ১৯৮২ সাল থেকে ৯ বছর ধরে সামরিক স্বৈরতন্ত্রকে উৎখাত করে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য আপসবিহীন সংগ্রাম করেছেন। আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা এর বেশির ভাগ সময়ই জেনারেল এরশাদের সামরিক স্বৈরতন্ত্রের সাথে সহযোগিতা করেছেন। না হলে গণতন্ত্রের সংগ্রাম আরও স্বল্পস্থায়ী হতে পারত। বিএনপি এবং বেগম জিয়াকে বর্তমানে সংগ্রাম করতে হচ্ছে আওয়ামী লীগ এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদের সম্মিলিত শক্তির বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের জনসাধারণ যেভাবে তার পেছনে কাতারবন্দী হয়েছে তাতে মনে হয় অবশ্যই তিনি ১৯৯০ সালের মতো স্বৈরতন্ত্রকে পর্যুদস্ত করতে পারবেন, ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারির মতো গণতন্ত্রকে বিজয় দিতে পারবেন। 
কিন্তু শত্রু এবারে সংখ্যায় ভারী এবং আন্তর্জাতিক একটা ষড়যন্ত্র জাল তারা ছড়িয়ে রেখেছে। আমরা যারা দেশে কিংবা প্রবাসে আছি, আমরা সম্মিলিতভাবে খালেদা জিয়ার আন্দোলনে সক্রিয় এবং সোৎসাহ সমর্থন দিতে আত্মীয়-বন্ধুদেরও প্রভাবিত করতে পারি। প্রবাসে আমরা গণতন্ত্রের সপক্ষে জনমত গড়ে তুলতে পারি, রাজনীতিকদের ও মিডিয়া সমর্থন সংগ্রহ করতে পারি। তা হলে এবারেও আমরা গণতন্ত্রের সংগ্রামকে জয়যুক্ত করতে পারব। 

গণতান্ত্রিক সরকারের প্রায়োরিটি কর্তব্য 
কিন্তু কর্তব্যের এখানেই শেষ নয়। বিজয় দিবসের পরবর্তী বছরগুলোতে আমাদের স্বাধীনতাকে সংহত করা হয়নি। ইউফোরিয়া, স্তবস্তুতি আর ফুলের মালা দিয়ে নেতাকে বুঁদ করে রাখা হয়েছিল। সে অবকাশে দেশের সম্পদ লুণ্ঠিত হয়েছে, বাকস্বাধীনতা স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে, গণতন্ত্র আর গণতন্ত্রীদের হত্যা করা হয়েছে। নিজের চোখে দেখা পরিস্থিতি থেকে বলতে পারি বাহাত্তরে যারা শেখ মুজিবুর রহমানকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছিল তাদের সবাই স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিও ছিল না। আর এ কথাও সত্যি যে, স্তবস্তুতি যদি পুরস্কৃত হয় তাহলে দেশপ্রেম পিছিয়ে যায়। এবার যখন গণতন্ত্রের সংগ্রাম জয়ী হবে অতীতের ভুলের যাতে পুনরাবৃত্তি না হয় সেদিকে এখন থেকেই মনোযোগ দিতে হবে। গদির লোভে নেতানেত্রীদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্যই যারা রাজনীতি করেন তাদের সম্বন্ধে পরবর্তী সরকারের নেতাদের বিশেষ সতর্ক হতে হবে। একাত্তরে যারা নিজের শ্রম, নিজের সময় ও নিজের সম্পদ দিয়ে মুক্তিসংগ্রাম করেছেন আমার জানা মতে তাদের অনেকে আজো যথাযোগ্য স্বীকৃতি পাননি। অন্য দিকে ঘটা করে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে ভুল লোকেদের, এমনকি মুক্তিযুদ্ধে যারা এক পাশে সরে গেছে তাদেরও। এবারেও দেশে এবং প্রবাসে কারো কারো কথা জানি যারা সমান আন্তরিকতা নিয়ে গণতন্ত্রের সংগ্রামে কাজ করেছেন। প্রকৃত এবং আন্তরিক কর্মীরা যদি পুরস্কৃত না হন তাহলে ভবিষ্যতে কেউ দেশের জন্য প্রাণ দিতে এগিয়ে আসবে না। ছলনা দিয়ে যারা পুরস্কৃত হয়, পদে পদে তারা প্রতারণা করবেই। 
প্রথমেই ২০১০ সালের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনা দিল্লিতে গিয়ে যে গোপন চুক্তিগুলো করে এসেছিলেন সেগুলো নির্বাচিত সংসদে পেশ করতে হবে। চুক্তিগুলোর যেসব অংশ আমাদের জাতীয় স্বার্থের অনুকূল সেগুলো অবশ্যই রাখা হবে। কিন্তু যেসব চুক্তি আমাদের জাতীয় স্বার্থের কিংবা আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতিকূল বিবেচিত হবে সেসব চুক্তি অথবা চুক্তির ধারা স্বাক্ষরের তারিখ থেকেই বাতিল করে আইন পাস করতে হবে। 
বাংলাদেশে ন্যায়বিচার অসম্ভব করে তোলা হয়েছে। গণতান্ত্রিক সরকারকে অবিলম্বে একটা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে যেসব বিচারক পক্ষপাতদুষ্ট তাদের দায়িত্বচ্যুত করতে হবে। 
অবৈধভাবে অভিজ্ঞ সিনিয়র কর্মকর্তাদের ডিঙিয়ে ডবল কিংবা ট্রিপল পদোন্নতি দিয়ে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের প্রশাসন, পুলিশ, ডিজিএফআই এবং এনএসআই প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী রাষ্ট্রযন্ত্রে স্থাপন করা হয়েছে। একটা প্রশাসনিক কমিশন গঠন করে তাদের খুঁজে বের করতে এবং অপসারণ করতে হবে। 
বর্তমান সরকারের আজ্ঞাবহ দুর্নীতি দমন কমিশন ভেঙে দিয়ে উপযুক্ত এবং নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে নতুন একটা দুদক গঠন করতে হবে। বিগত পৌনে পাঁচ বছরের ব্যাপক দুর্নীতি সম্বন্ধে তদন্তের জন্য একটা জাতীয় কমিশন গঠনের প্রয়োজন হতে পারে। তবে সেসব দুর্নীতির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি এবং সংশ্লিষ্ট অর্থ রাষ্ট্রীয় তহবিলে ফেরত আনার ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে। 
নির্বাচন কমিশনও পুনর্গঠনের প্রয়োজন হতে পারে। সরকারের ভোট ব্যাংকের ভোটার তালিকার মধ্যে লাখ লাখ ভারতীয় নাগরিক আছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে সম্যক তদন্ত করতে হবে। 
নতুন গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর সীমিত সময়ের মধ্যে প্রারম্ভিকভাবে উপরোল্লিখিত ব্যবস্থাগুলো নেয়া হলে প্রশাসনের ওপর জনসাধারণের আস্থা ফিরে আসবে এবং জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতায় সরকারের যাত্রাপথ সুগম হবে। 

সুষ্ঠু মিডিয়ানীতি 
আমি আগেও লিখেছি বিএনপির বড় দুর্বলতাগুলোর মধ্যে শীর্ষে আছে সুষ্ঠু মিডিয়ানীতি ও মিডিয়া সম্বন্ধে সম্যক উপলব্ধির অভাব। এ দলের কাউকে কাউকে বলতে শুনেছি মিডিয়ার সমর্থন ছাড়াও বিএনপি নির্বাচনে জয়ী হয়েছে। কিন্তু তারাও অবশ্যই স্বীকার করবেন, ক্ষমতা পাওয়ার জন্য না হলেও ক্ষমতা রাখার জন্য মিডিয়া সমর্থন অত্যাবশ্যকীয়। শেখ হাসিনার পূর্ববর্তী সরকার এবং বর্তমান সরকারের আমলেও একটা অনুগত মিডিয়া গঠন ও লালন করার যথাসাধ্য চেষ্টা হয়েছে। আওয়ামী লীগ মিডিয়ার গুরুত্ব বোঝে। বিরোধী মিডিয়াকে ধ্বংস করার কোনো সুযোগ তারা ছাড়ে না। তাদের আন্দোলনের ফসল বর্ণচোরা সামরিক সরকারের আমলে যায়যায়দিন পত্রিকাটি বেহাত করা হয়েছিল এ লক্ষ্যেই। 
বর্তমান ও পূর্ববর্তী সরকারের আমলে তারা উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় অনুগত টেলি-চ্যানেল চালু করেছে। অন্য দিকে বিরুদ্ধ মতাবলম্বী টেলিভিশন চ্যানেল ও পত্রিকা বন্ধ করা আওয়ামী লীগের মৌল আদর্শের অন্তর্ভুক্ত। এরা জানে মুক্ত ও স্বাধীন মিডিয়াকে প্রশ্রয় দেয়া হলে তাদের স্বৈরতন্ত্রী শাসন সম্ভব হবে না। সে কারণেই বাকশাল প্রতিষ্ঠার প্রারম্ভেই শেখ মুজিব চারখানি সরকারি পত্রিকা ছাড়া অন্য সব পত্রপত্রিকা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। ঠিক একই লক্ষ্যে বর্তমান সরকার গদি লাভের প্রায় প্রথম দিন থেকেই বিরোধী মিডিয়ার কণ্ঠরোধের কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল। মিডিয়ায় সমালোচনা বন্ধ করার কোনো চেষ্টা এরা ছাড়েনি। মেহেরুন রুনি আর তার স্বামী সাগরসহ ২৩ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন এ সরকারের আমলে। আহত হয়েছেন অনেকে। দেশের মানুষকে সত্য কথা বলার দায়ে মাহমুদুর রহমান নির্যাতিত, নিগৃহীত হচ্ছেন। আমার দেশ পত্রিকাটির মুদ্রণ বন্ধ করার সবরকম ব্যবস্থা করেছে এই সরকার। দিগন্ত টেলিভিশন আর ইসলামী টেলিভশনও সেই একই কারণে বন্ধ রয়েছে। 
দেশের মানুষ আশা করে আছে যে, দেশে শিগগিরই নতুন সরকার আসবে, খালেদা জিয়া আবারো প্রধানমন্ত্রী হবেন। দেশের মানুষ আবারো আশা করবে যে, বিএনপি অতি বিলম্বে হলেও একটা সুষ্ঠু মিডিয়ানীতি তৈরি করবে। ইতোমধ্যে বর্তমান সরকারের আমলে যেসব মিডিয়া এবং মিডিয়াব্যক্তিত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণদানের ব্যবস্থা নতুন সরকারকে অবিলম্বে করতে হবে। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads