রবিবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৩

সর্বদলীয় সরকার গঠনের আহ্বান


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় জাতির উদ্দেশে এক আবেগঘন ভাষণ দিয়েছেন। এর সারকথা এই যে, আগামী নির্বাচনকালে তিনি একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করতে চান। এ জন্য তিনি বিরোধী দলের কাছ থেকে সেই সরকারে কারা থাকবেন, তাদের নাম প্রস্তাব করতে বলেছেন। তিনি যেভাবে বলে থাকেন, সেভাবেই তার সরকারের অন্তঃসারশূন্য সাফল্যের গীত গেয়েছেন। আর চারদলীয় জোট সরকার যে কত খারাপ ছিল, তার বর্ণনা করেছেন। সে বর্ণনা অনুযায়ী, বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বাংলাদেশের পক্ষে পৃথিবীতে মুখ দেখানো অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। সন্ত্রাস, দুর্নীতি, অরাজকতায় নাকি দেশ ভরে গিয়েছিল। আর এখন চার দিকে দুধের নহর বয়ে যাচ্ছে। জোট সরকারের আমলে একজন শ্রমিক সারা দিন পরিশ্রম করেও, তার কথা অনুযায়ী, দুই কেজি চালও কিনতে পারতেন না। কিন্তু এখন একজন সাধারণ শ্রমিক এক দিনের শ্রমের টাকায় তার ভাষায় ৮-১০ কেজি চাল কিনতে পারেন। তরিতরকারি কিনতে পারেন। তেল-নুন সবই কিনতে পারেন। তিনি বলেছেন, এখন বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় হাজার ডলারের ওপরে। এর আগে রাষ্ট্রীয় সংস্থার ন্যায্য হিসাবে যখন আয় কম বলে খবর প্রকাশ করা হলো, তখন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল একেবারে রেগেমেগে অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। তিনি পরিসংখ্যান ব্যুরোকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, তারা যেন সরকারের টিউনে পরিসংখ্যান তৈরি করে। সে ক্ষেত্রেও তিনি তার কালচারাল ভাষা রাবিশব্যবহার করেছেন। যেন জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো সরকার যা বলে সেটাই বলে দেয়। ফলে আমাদের মাথাপিছু আয় এক হাজার ডলারের ওপরে কি না বুঝতে সন্দেহ হয়। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে নিজের সাফল্যের এত গীত গাইলেন যে, প্রতিটি পয়েন্টে প্রতিবাদ করা যায়। তিনি বললেন, এখন নাকি বিদ্যুতের আর কোনো অভাব নেই। কিন্তু সারা দেশের অভিজাত এলাকা ছাড়া বাকি এলাকাগুলোতে ৭-৮ ঘণ্টা লোডশেডিং হয় দিনে। আমরা নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষেরা এসব ভোগান্তিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। শেখ হাসিনা নিজেও বলেছেন, মানুষ যাতে লোডশেডিংয়ের কথা ভুলে না যায়, সে জন্য তিনি প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে লোডশেডিং করার অর্ডার দিয়েছেন। তিনি আরো বলেছেন, যারা বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের সমালোচনা করেন, তাদের বাসায় তিনি বিদ্যুৎ একেবারেই বন্ধ করে দেবেন। তার পরও জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে তিনি বললেন, বিদ্যুতের ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পন্ন হয়েছে দেশ। বিদ্যুতের আর কোনো সমস্যা নেই।তা-ই যদি হয়, তাহলে নবনির্মিত সব অ্যাপার্টমেন্ট হাউজে তিনি বিদ্যুৎ দিচ্ছেন না কেন? আমাদের তিনি একটি ভারতীয় কুমিরছানা দেখিয়েছেন। ভারত বিদ্যুৎ দেবে। সে তো এক মহা আলোড়নের ব্যাপার। দেশীয় সব বিদ্যুৎ কারখানা বন্ধ করে দিয়ে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির কী যে রহস্য, তা আমাদের সবার অজানা। এই বিদ্যুতের দাম কত, কত গচ্চা দিতে হবে, কতটা যাবে জাতীয় সম্পদ ভারতের হাতে, এসব কিছুর নিশ্চয়তা শেখ হাসিনার কাছে নেই। বলার মতো মুখও তার নেই। বহু তুচ্ছ কথামালা তিনি রচনা করেছেন তার ভাষণে। কিন্তু আমাদের একবারও জানাননি, দেশের চলমান সব বিদ্যুৎ কারখানা বন্ধ করে দিয়ে ভারত থেকে তিনি বিদ্যুৎ আনতে গেলেন কেন? সুতরাং জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণ কিছুতেই প্রশ্নের বাইরে নেই। যে দিন তিনি ভাষণ দিলেন, সে দিন তার ভাইয়ের জন্মদিন ছিল। এরপর তার পিতার করুণ মৃত্যুর কাহিনী। এই নিয়ে টেলিভিশনের পর্দায় তিনি অশ্রুপাত করলেন। যেভাবে তার পিতা মারা গেছেন, প্রায় একই ধরনের ষড়যন্ত্রের ধারায় মারা গেছেন জিয়াউর রহমানও। তার পিতার মৃত্যু যদি করুণ কাহিনী হয়ে থাকে, ষড়যন্ত্র হয়ে থাকে, তাহলে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুও করুণ কাহিনী ও ষড়যন্ত্র। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ অবদান ছিল না। কারণ তিনি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন। তখন পাকিস্তানের আদালতে বারবার উল্লেখ করেছেন যে, তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি। অন্যরা কী করেছে, তার দায়দায়িত্ব তার নয়। তাজউদ্দীন আহমদ সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত টেপ রেকর্ডার নিয়ে শেখ মুজিবের বাসায় হাজির ছিলেন। শুধু একটি বাক্যের জন্য। সে বাক্যটি হলো ৭১-এর ২৫ মার্চ, ‘আমি শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।শেখ মুজিব কোনো অবস্থাতেই সেই ঘোষণা দিয়ে যাননি। কিছু দালাল প্রকৃতির লোক বিডিআর ওয়্যারলেস দিয়ে একটা কাহিনী সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছে। আ স ম আবদুর রব আমার সাথে টেলিভিশনে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি ও শেখ মনিসহ কয়েকজন ছাত্রনেতা তাকে গিয়ে অনুরোধ করেছিলেন : বঙ্গবন্ধু আপনার জন্য পাঁচটি রুট খোলা রেখেছি। যেকোনো রুট দিয়ে ভারত চলে যান। নিরাপদ।তিনি তাদের বলেছিলেন, ‘তোরা পালা। তোদের ব্যবস্থা কর।আবদুর রব জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আপনার কী হবে?’ শেখ মুজিবুর রহমান তাকে বলেছিলেন, ‘আমার ব্যবস্থা আমি করে রেখেছি। তোরা পালা।বেবি মওদুদের লেখা অনুসারে তেঁতুল খেয়ে শেখ হাসিনা পাকবাহিনীর সদস্যদের ঠাট্টা করেছেন। তিনি গর্ভবতী ছিলেন এবং প্রথম দিকে ৩২ নম্বর বাসায়ই ছিলেন। তারপর অন্যত্র সরে যান। শেখ হাসিনা কী বললেন, কী বললেন না, তা নিয়ে দুনিয়ার সব কিছু সরে যায় না। শেখ হাসিনা বিএনপি সরকার, হাওয়া ভবন, দুর্নীতি, কত কথা যে বললেন, শুনলাম। কিন্তু তিনি যে, অনেক কিছুই বললেন না। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে কত রকম খারাপ কাজ হয়েছে সে হিসাব দিতে কুণ্ঠা বোধ করেননি। কিন্তু তার সরকারের আমলে? তার মন্ত্রীর দুর্নীতির কারণে পদ্মা সেতু প্রকল্প পণ্ড হয়ে গেছে। হলমার্ক কেলেঙ্কারি হয়েছে। সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লুট হয়েছে। সরকারি বিভিন্ন ব্যাংকে লুটপাট হয়েছে। শেয়ারবাজারে কারসাজির মাধ্যমে তার লোকেরা ৩৪ হাজার ুদ্র বিনিয়োগকারীকে পথে বসিয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে। একমাত্র গ্রামীণ ব্যাংক নিজের নিয়মে চলছিল, সেটাকেও লুটতরাজ করতে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে নিয়ে গেছে। শেখ হাসিনা, আপনি বুঝুন বা না বুঝুন, আমরা বুঝি যে, আপনি সঠিক পথে নেই। সেই কারণে আপনার সরকারের এসব কথা জাতির উদ্দেশে কিছুই বলেননি। শুধু বলেছেন, বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে দিয়ে গিয়েছে। আর আপনি কেবল অগ্রগতিই দিয়ে গেছেন। এটা কি সম্ভব? বিএনপি সরকার কী সাফল্য অর্জন করেছিল, নিউ ইলেভেন ইকোনমিক জায়ান্টের একটি হয়েছিল। আপনি তো তা ভাষণে কিছুই বললেন না। কেবল নিজের কথাই বলে গেলেন। আগামী নির্বাচন কিভাবে হবে আপনি জানিয়ে দিয়েছেন। সে নির্বাচনে যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা বিরোধী দল গ্রহণ করবে এমন আশা করা যায় না। ভাষণ দিলেন বটে, দিকনির্দেশনা দিলেন না। এর অর্থ দাঁড়াল এই যে, এই শর্তের আড়ালে যদি আপনি প্রধানমন্ত্রী থাকতে চান, তাহলে বিএনপি কী সিদ্ধান্ত নেবে আমি জানি না। শেখ হাসিনা হয়তো বিএনপিকে বলবেন, ৩০০ সদস্যের মধ্যে আপনারা তিনজন। সেই তিনজন কে কে হবে, বলুন। হাসিনা-আহূত সর্বদলীয় সরকারের রূপরেখা কী হবে, তা তিনি ব্যাখ্যা করেননি। প্রশাসন সাজিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন সাজিয়েছেন। আহা! নির্বাচন কমিশনের কী প্রশংসাই না তিনি করেছেন। এসব জিহুজুর জোগাড় করা হয়েছে, শেখ হাসিনার ভাষায়, অনুসন্ধানের মাধ্যমে। নির্বাচন কমিশন যা করেছে, তাকে ইতর কাণ্ড বললেও কম বলা হয়। তারা নিজেদের ক্ষমতা খর্ব করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছে। আহ! এমন আর হয় না। অথচ এই নির্বাচন কমিশনের কত যে দীর্ঘ প্রশংসা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণে, সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যদি তাদের বিন্দুমাত্র আত্মমর্যাদা থাকত, তাহলে অধোবদন হয়ে বিদায় নিতেন। আশ্চর্যজনক হলো, এই কমিশনের কারো কোনো ব্যক্তিত্ব নেই, আত্মমর্যাদা নেই। বাংলাদেশে এই নির্বাচন কমিশন এক নতুন প্রজাতি যাদের দেখার জন্য ভবিষ্যতে গবেষকেরা ভিড় করবেন। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বদলীয় সরকারের আহ্বান বিভ্রান্তিকর । এর আগে তিনি যেটা বলেছেন, তা হলোÑ যদি এ ধরনের সরকার গঠিত হয়, তাহলে সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী তিনিই থাকবেন। অন্য দল থেকে যে যেভাবে আসুক। ব্যাপারটা সেখানেই ফয়সালা হয়ে গেছে। এর অতিরিক্ত তিনি আর কিছুই বলেননি। ফলে আমার মনে হয় এ-ও এক বিরাট চালাকি। বিএনপি কী করবে, জানি না। শেখ হাসিনা ঠাট্টা করেছেন, বিএনপি নাকি একবার তত্ত্বাবধায়ক চায়। একবার নির্দলীয় চায়। একবার সর্বদলীয় চায়। এ রকম। প্রধানমন্ত্রী ঠাট্টা করতে ভালোবাসেন। কিন্তু তার ঠাট্টারও একটা জবাব আছে। দেশটা প্রধানমন্ত্রীর তালুক-মুলুক নয়। দেশ জনগণের। মুুক্তিযুদ্ধে আপনিও অংশগ্রহণ করেননি। অংশগ্রহণ করেছেন কাদের সিদ্দিকী। অংশগ্রহণ করেছেন জিয়াউর রহমান। মেজর জেনারেল নাসিম আর বিচারপতি হাবিবুর রহমান কী ষড়যন্ত্র করেছিলেন, আমি স্বচক্ষে দেখেছি। যাহা সত্য বলিয়া বুঝিয়াছি, তাহা বলিবই। হয় সত্যের জয় হইবে। অথবা সে চেষ্টায় আমার প্রাণ যাইবে।বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads