বুধবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৩

সফল সংলাপের জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিবেশ


দলমত নির্বিশেষে বাংলাদেশের মুসলমানরা বেশ আন্তরিকতার সাথে হজ্জ পালন করে থাকেন। এবারও বাংলাদেশ থেকে বহু মানুষ হজ্জ পালন করতে সউদি আরব গেছেন। তাঁদের অনেকেই দেশে ফিরে এসেছেন, অনেকেই এখনো রয়ে গেছেন পবিত্র ভূমি মক্কা ও মদিনায়। আর কিছুদিনের মধ্যেই সবাই চলে আসবেন স্বদেশে। হজ্জে গেলে সবার কর্মকা-ে এক অভূতপূর্ব ঐক্য লক্ষ্য করা যায়। সবাই চেষ্টা করেন মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে মহানবী (সা:)-এর সুন্নার অনুসরণে হজ্জ পালন করতে। হজ্জ পালন করতে গিয়ে কারো যে কোনো ভুল-ত্রুটি হয় না তা কিন্তু নয়। ভুল-ত্রুটি জ্ঞানের অভাবের কারণেও হয়, অসতর্কতার জন্যও হয়। মুসলমানরা যে আল্লাহর ইবাদাত করেন, ভুল-ত্রুটির জন্য ক্ষমাও চান তাঁরই কাছে। মহান আল্লাহ বেশ ভালভাবেই জানেন যে, মানুষ ভুল করতে পারে।  তাই তিনি খোলা রেখেছেন তওবার পথ। তওবা করে ভুল থেকে প্রত্যাবর্তন করলে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন।
হজ্জে ‘লাব্বাইকা’ ধ্বনি উচ্চারণের মাধ্যমে আমরা যে তালবিয়া পাঠ করে থাকি, তা মুসলমানদের কাছে খুবই পরিচিত। কিন্তু আমরা সবাই কি এই তালবিয়ার অর্থ জানি। কিংবা এর তাৎপর্য উপলব্ধি করতে সমর্থ হয়েছি? তালবিয়ার সরল অর্থ হলো, “হাজির হয়েছি হে আল্লাহ! তোমার ডাকে সাড়া দিয়ে আমি হাজির হয়েছি। আমি হাজির হয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছি তোমার কোনো শরীক নেই, আমি হাজির। নিশ্চয়ই সমস্ত প্রশংসা ও নেয়ামত তোমারই এবং রাজত্বও। তোমার কোনো শরীক নেই।”
তালবিয়ায় এক আল্লাহ তথা তাওহিদের সাক্ষ্য, ¯্রষ্টার প্রশংসা ও নেয়ামত এবং তাঁর রাজত্বের বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। হজ্জের পবিত্র ভূমিতে গিয়ে তালবিয়ার মাধ্যমে আমরা যে সাক্ষ্য দিয়ে এসেছি, হজ্জ পরবর্তী সময়ে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনযাপনে তার প্রতিফলন কতটা ঘটে? অথবা পবিত্র কাবা শরীফ তাওয়াফ শেষে আমরা যখন সাফা ও মারওয়া পর্বত সায়ী করি তখন হযরত ইবরাহীম (আ:) এর ত্যাগ ও মহান আল্লাহর আদেশ পালনের ইতিহাস আমরা কতটা স্মরণ করি? হযরত ইবরাহীম (আ:) এর আদর্শ স্মরণ করতে গেলে যে বিষয়টি বিশেষভাবে স্মরণ করতে হয় তা হলো, আল্লাহকে ভালবাসার পথে কিংবা তার আনুগত্যের পথে যা কিছু বাধা হয়ে দাঁড়াবে তাকে সর্বশক্তি দিয়ে সরিয়ে দিতে হবে। আল্লাহ ও বান্দার এ দৃঢ় সম্পর্কের মধ্যে কোনো বাধাকেই মেনে নেয়া যাবে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, হজ্জ পরবর্তী সময়ে আমরা পবিত্র কাবা তাওয়াফ এবং সাফা-মারওয়া সায়ীর সাথে হযরত ইবরাহিম (আঃ) ও তাঁর পরিবারের যে ত্যাগ-তিতিক্ষা ও আনুগত্য জড়িয়ে আছে সেসব ঘটনার মর্ম কতটা উপলব্ধি করি? আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীক ও বৈশ্বিক জীবন-যাপনে কাবাকেন্দ্রিক জীবনের আদর্শ ও নৈতিকতা কতটা প্রতিফলিত হয়? হজ্জ শেষে স্বদেশের মাটিতে পা রেখে আমরা যদি চারিদিকে একটু গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করি তাহলে আমাদের মনে অবশ্যই প্রশ্ন জাগবে যে, আমরা কী ধরনের মুসলিম? হজ্জ থেকে কি আমরা কোনো শিক্ষাই নিতে সমর্থ হলাম না?
আমরা জানি যে, আমাদের রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করছেন, রাজনৈতিক অঙ্গনে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং সমাজ ও বিভিন্ন পেশায় যারা কর্তৃত্ব করছেন তাদের প্রায় সবাই শুধু একবার নয়, একাধিকবার হজ্জ করে এসেছেন। কিন্তু তাদের জীবন যাপনে এবং আচরণে হজ্জের বার্তা কতটা প্রতিফলিত হচ্ছে? হজ্জের ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, ভ্রাতৃত্ববোধ এবং অপরকে অগ্রাধিকার দেয়ার চেতনা তারা কতটা লালন করতে পারছেন?
কাউকে ছোট করার জন্য আমরা এইসব প্রশ্ন উত্থাপন করছি না। বর্তমান সময়ে আমাদের সমাজে ও রাজনৈতিক অঙ্গনে হিংসা-বিদ্বেষ ও হানাহানির যে চিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তা তো হজ্জের ভ্রাতৃত্ববোধ কিংবা উম্মাহ চেতনার সাথে মোটেও মিলছে না। জানি না জাতির কালান্তরের এই সময়ে নিজের এবং আপন অঙ্গনের আত্মসমালোচনার দায়িত্ব আমরা কতটা পালন করতে সক্ষম হবো?
কিছুদিন আগে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মদিনা সনদের কথা উল্লেখ করেছিলেন। আইয়ামে জাহেলিয়াতের সে যুগে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সঃ) ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে এক আলোকিত ও শান্তির সমাজ গড়ে তুলেছিলেন। তার ঐতিহাসিক এ সাফল্যের মূলে ছিল সততা, বিশ্বস্ততা, নিরপেক্ষতা, আইনের যথার্থ প্রয়োগ এবং ঐশীগ্রন্থ আল কুরআনের আলোক রশ্মি। কিন্তু শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের এই দেশে আমরা নবীর উম্মত হিসেবে তাঁর আদর্শ কতটা অনুসরণ করছি? মদিনা সনদের কথা উল্লেখ করলেও বাস্তবে আমরা তার প্রতিফলনে কতটা আন্তরিক? আন্তরিকতার অভাবের কারণেই আমাদের সমাজে আজ এত হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি আর আস্থার সঙ্কট। দেশ তো পরিচালনা করেন রাজনীতিবিদরা। রাজনীতিবিদদের মধ্যে জনগণের ভোটে যারা সরকার গঠন করেন, তারা যদি অনুরাগ ও বিরাগের বশবর্তী না হয়ে দেশ শাসন করেন তাহলে সুশাসনের বিকাশ ঘটতে পারে। এর সুফল জনগণ ভোগ করলে দেশের প্রগতি ত্বরান্বিত হতে পারে। এছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠার কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার সঙ্কট কাটতে পারে এবং দৃঢ়মূল হতে পারে গণতন্ত্রের ভিত্তি। কিন্তু বর্তমান সময়ে তো আমরা এমন কাক্সিক্ষত চিত্র লক্ষ্য করছি না। বরং লক্ষ্য করছি হরতাল, রাজপথে গোলাগুলী, পুলিশের নিষ্ঠুর আচরণ ও নাগরিক হত্যার অনাকাক্সিক্ষত দৃশ্য। মদিনা সনদের যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা, তার সাথে এসব চিত্রের কোনো মিল নেই। জানি না আমাদের রাজনীতিবিদরা এ বিষয়টি কতটা উপলব্ধি করেন। মানুষ মরণশীল এ কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু মৃত্যুর পর প্রতিটি মানুষকে যে, নিজ নিজ দায়িত্ব ও আচরণ সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে মহান ¯্রষ্টার কাছে, সে বিষয়ে আমরা আদৌ সচেতন আছি কি? সচেতন থাকলে আজ রাষ্ট্র ও সমাজের এই হাল কেন?
আমরা হরতাল চাই না, চাই না রাজপথে নাগরিকদের ওপর পুলিশের গুলীর বৃষ্টি। নাগরিকদের এমন আকাক্সক্ষার অনুকূলে অন্য অনেকের মত সুশীল সমাজ ও সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে রাজনৈতিক সংলাপের কথা বলছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো টিভি-টকশোতে কিংবা পত্রিকার পাতায় সংলাপের আকাক্সক্ষা উচ্চারণ করলেই তো সংলাপ সফল হয়ে যাবে না। একটি সফল সংলাপের জন্য প্রয়োজন সরকার ও বিরোধী দলের দায়িত্বপূর্ণ আচরণ। এর সাথে আরো প্রয়োজন জনগণের রায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন তথা জয় কিংবা পরাজয়কে মেনে নেয়ার মতো গণতান্ত্রিক চেতনা। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, দেশ ও জাতির স্বার্থে একটি সফল সংলাপের ক্ষেত্রে বিরোধী দলের চাইতে সরকার এবং সরকারি দলের দায়িত্ব বেশি। ধৈর্য ও উদারতার উত্তম উদাহরণ তারাই সৃষ্টি করতে পারে। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই চলে আসে সংলাপের পরিবেশ তৈরির কথা। রাজনৈতিক অঙ্গনে তো মতপার্থক্য, তর্ক-বিতর্ক ও প্রতিযোগিতা থাকতেই পারে। কিন্তু একথার অর্থ এই নয় যে, এসব মতপার্থক্য ও প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বিরোধী দল কোনো নিয়ম-নীতি মানবে না, আর সরকারি দল বিরোধী দলের উপর জুলুম-নির্যাতন চালাবে। তাদের সভা সমাবেশ করতে দিবে না এবং জেলে পুরে স্তব্ধ করে রাখতে চাইবে। গণতান্ত্রিক সমাজে তো সব নাগরিকের রাজনৈতিক ও আদর্শিক মতামত ব্যক্ত করার অধিকার থাকে। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতার রাজনীতির চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ হলো, জনগণের মত প্রকাশের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা। এ দায়িত্ব পালনে সরকার ব্যর্থ হলে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়। বর্তমান সময়ে আমরা হরতাল এবং রাজপথে ককটেল বিস্ফোরণের যে চিত্র লক্ষ্য করছি, তার মূলে রয়েছে গণতান্ত্রিকভাবে দেশ পরিচালনায় ব্যর্থতার বিষয়টি। রাজনৈতিক দলগুলো যখন মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে, অপশাসনের শিকার হবে এবং ভিন্নমতের গণমাধ্যমগুলো যখন বন্ধ করে দেয়া হবে, তখন দেশে গণতন্ত্রের বদলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় ফ্যাসিবাদী শাসন। বর্তমান সময়ে পুলিশ যেভাবে রাজনৈতিক দলের নেতাদের গ্রেফতার ও হয়রানি করছে, গুলী করে পাখির মত মানুষ হত্যা করছে এবং মিডিয়া জগতে আমার দেশ পত্রিকা, দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি ও চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে রেখেছে তাতে আমরা কী করে বলবো সরকার সঠিক পথে চলছে? বর্তমান সময়ে হরতালসহ রাজপথে সংক্ষুব্ধ আন্দোলন বন্ধ করতে হলে প্রথমেই সরকারকে সফল সংলাপের জন্য একটি সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আর তা করতে হলে সরকারকে বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার বন্ধ করতে হবে, জলুম-নির্যাতন বন্ধ করে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের মুক্তি দিতে হবে এবং অবিলম্বে বন্ধ পত্রিকা ও টিভিগুলোকে মুক্ত করে দিতে হবে। সরকার এমন উদাহরণ সৃষ্টি করলে তাতে শুধু দেশেরই মঙ্গল হবে না, ইমেজ সংকট কাটিয়ে সরকারও লাভবান হতে পারে। একথা সবাই স্বীকার করেন যে, সামনের সংসদ নির্বাচনটি এখন জাতির কাছে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড। বর্তমান সময়ে তেমন পরিস্থিতি বিরাজমান নেই। সরকারের নানা ভুল নীতির ও চালাকির কারণে কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়ে গেছে। সরকার চাইলে খুব সহজেই সেই সমস্যাগুলো দূর করতে পারে। আমরা জানি, বর্তমান সংসদের শেষ অধিবেশন বসবে নবেম্বরের ৭ তারিখে। হাতে সময় আছে খুবই কম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি বর্তমান সঙ্কটপূর্ণ সময়ে কোনো শুভ সিদ্ধান্ত নিতে চান তাহলে তাকে তা জাতীয় সংসদেই নিতে হবে। কারণ বর্তমান সঙ্কট থেকে জাতিকে উদ্ধার করতে হলে সংবিধানে কিছু সংশোধনের প্রয়োজন হতে পারে। যেমন সংশোধন ইতিপূর্বে খালেদা জিয়ার সরকার করেছিলেন জাতীয় স্বার্থে। সরকার যদি জাতীয় স্বার্থে সঙ্কট থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে অগ্রসর হয়, তাহলে তাতে অনুকূল সাড়া দেয়া বিরোধী দলের কর্তব্য বলে আমরা মনে করি। জনগণ কিন্তু নীরবে সবই লক্ষ্য করছে। রাজনীতিবিদরা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে কিংবা সীমা লঙ্ঘন করলে জনগণ ইতিহাসের অমোঘ ধারায় সরব হয়ে ওঠে এবং যার যা প্রাপ্য তা বুঝিয়ে দেয়। আমরা আশা করবো এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির আগেই আমাদের সরকার ও রাজনীতিবিদরা নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসবেন। আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে তো মদীনা সনদের কথা উচ্চারিত হয়েছে। সেই চেতনার কিছুটা চর্চাও যদি আমাদের রাজনীতিবিদরা করেন, তাহলে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সব নাগরিকই ফিরে পেতে পারেন কাক্সিক্ষত শান্তির সমাজ। হজ্জের পবিত্র এই মাস এমন আকাক্সক্ষার প্রকাশ কি খুবই স্বাভাবিক নয়?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads