রবিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৩

বাকি হাসিটুকুও ফুরিয়ে যেতে পারে


৫ ফেব্রুয়ারি ছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলায় জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার রায়ের দিন। রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। খবরটি মুহূর্তেই দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রবক্তারা এবং অতি বিপ্লবী বামপন্থীরা এ রায় প্রত্যাখ্যান করলেন। তারা বিক্ষোভে ফেটে পড়লেন। দাবি তুললেন, কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় দিতে হবে। বিচারের প্রক্রিয়ায় রায় যাই আসুক না কেন, তারা ফাঁসির আদেশ চান। তা না হলে তারা ঘরে ফিরবেন না, শাহবাগেই অবস্থান করবেন। কিছু অনলাইন অ্যাক্টিভেস্টকে দিয়ে আন্দোলনের যাত্রা শুরু। বিশেষ করে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের মেয়েরা এ ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখলেন। প্রথম দিকে শাহবাগের আন্দোলনের সাথে প্রায় সব শ্রেণী ও পেশার বহু মানুষ সংহতি প্রকাশ করতে লাগলেন। দলে দলে মানুষ শাহবাগে আসছিল। তখন আন্দোলনকারীদের দাবির ব্যাপ্তিও বাড়তে লাগল। তারা তখন জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের পুরনো দাবিও জুড়ে দিলেন। তাদের পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধের দাবি তুললেন। এ দাবি ছিল উসকানিমূলকÑ ফলে বিভিন্ন স্থানে কিছু ব্যাংকের শাখা, এটিএম বুথ এবং কোচিং সেন্টারে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এসব কিছু ঘটল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনে। মাসাধিককাল ধরে শাহবাগের প্রধান সড়কগুলো অবরোধ করে রেখে পুলিশের পাহারায় গণজাগরণ মঞ্চকর্মসূচি চালিয়ে আসছিল। একদিন জাতীয় পতাকা পর্যন্ত অর্ধনমিত রাখা হলো। অবাক দৃষ্টিতে দেশবাসী লক্ষ করেছে, রাষ্ট্রের কোনো পর্যায় থেকে এই ব্যাপারে কিছুই বলা হয়নি। জাতীয় পতাকার ব্যাপারে কোনো বেসরকারি সংগঠন বা ব্যক্তিবিশেষ সিদ্ধান্ত দিতে পারে কি না সেটি একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। 
অনলাইন অ্যাক্টিভেস্টদের একজন ব্লগার নৃশংসভাবে খুন হলেন, যিনি থাবাবাবানামে পরিচিত ছিলেন। এই কমবয়সী প্রকৌশলীর অকাল মৃত্যুর পরেই তাকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদহিসেবে চিত্রিত করা হলো। পত্রপত্রিকায় দেখেছি, এই ব্লগার তার লেখার মধ্যে ইসলাম ধর্মকে আঘাত করে অনাকাক্সিত, রুচিহীন ও অপাঠযোগ্য কাল্পনিক উক্তি করেছেন। ইসলামবিদ্বেষী এ লেখাগুলো শীর্ষস্থানীয় একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশ হলো। তখনই ঘটল বিপত্তি। এতে মনে হলো, ইসলামবিদ্বেষী কিছু লিখলে অন্যায় হয় না, অপরাধ হয় পত্রিকায় ছাপলে। আসলে ওই পত্রিকাটি প্রভাবশালী একটি মহলের রোষানলে পড়েছিল স্কাইপি সংলাপ প্রকাশ করে, তারপর আবার থাবাবাবাইস্যু। এ দিকে জনমনে শুরু হলো শাহবাগ সম্পর্কে নতুন ভাবনা। কমতে শুরু করল সেখানে মানুষের সংখ্যা। তখন শাহবাগের মঞ্চে অনুষ্ঠানের সময়ে আজানের বিরতি দেয়া শুরু হলো এবং এর উদ্যোক্তারা বলতে শুরু করলেন, গণজাগরণ মঞ্চ ধর্মবিদ্বেষী নয়। এমনকি ব্লগার রাজীব তাদের মঞ্চের কোনো নেতা নন বলে দাবি করা হয়। কিন্তু ততক্ষণে নাস্তিক ব্লগারদের সপক্ষ হিসেবে তারা দেশবাসীর কাছে চিহ্নিত হয়ে গেছেন। 
এ দিকে হেফাজতে ইসলাম এবং তৌহিদি জনতার ব্যানারে আলেমেরা ফুঁসে উঠতে শুরু করলেন। তারা শাহবাগের আন্দোলনের বিরুদ্ধে মাঠে নামলেন এবং জাগরণ মঞ্চ বন্ধের দাবিও জানালেন। এ রকম কয়েকটি দাবি আদায়ের জন্য ৬ এপ্রিল তারা নজিরবিহীন গণসমাবেশ ঘটালেন ঢাকার মতিঝিলে। তারা জানান দিলেন যে, দেশের ইসলামপ্রিয় গণমানুষ শাহবাগীদের গ্রহণ করেনি। শাহবাগের সমাবেশের চেয়ে বহুগুণ মানুষ বেশি লোকসমাগম দেখা গিয়েছিল মতিঝিল শাপলা চত্বরে। লাখ লাখ মানুষ সেখানে এসেছিলেন ধর্মীয় অনুভূতি ব্যক্ত করতে। অনেক রাজনৈতিক সামাজিক সংগঠন, এমনকি ব্যক্তি পর্যায়ে অনেকেই সেখানে এসেছিলেন দূর-দূরান্ত থেকে আসা লোকজনে পিপাসা মেটাতে পানি হাতে নিয়ে। সেদিন দেখেছি, লোকজনে একজন অন্যজনের প্রতি কতটা সহানুভূতিশীল ও উদার। 
৫ মে আবার হেফাজতে ইসলামের লোকজন ঢাকার ছয়টি প্রবেশপথে অবস্থান গ্রহণ করেন ফজরের নামাজের পর থেকেই। শান্তিপূর্ণ অবস্থান শেষে মতিঝিলে মহাসমাবেশ শুরু হয় দুপুর থেকে। মহাসমাবেশ থেকে তারা একটি রাত শান্তিপূর্ণভাবে মতিঝিলে অবস্থান করতে চেয়েছিলেন। শাহবাগে আন্দোলনকারীদের ৩৯ দিন-রাত থাকতে দেয়া হলেও হেফাজতকে মাত্র একটি রাতও থাকতে দেয়া হয়নি। বরং সমাবেশস্থলের বাতি নিভিয়ে গভীর রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী একাধিক বাহিনী কী বীভৎস ঘটনা ঘটাল, তা দেশবাসীর সাথে বিশ্ববাসীও অবলোকন করেছে। হেফাজতের লোকজন ঢাকা ছাড়া করার পর মহলবিশেষের মধ্যে খুশির জোয়ার দেখা গেছে। অনেক পদস্থ ব্যক্তির কটাক্ষ দেশবাসী দেখেছে। কেউ বা ব্যঙ্গ করে বলেছেন, হেফাজতের লোকেরা সোবহানাল্লাহ বলতে বলতে ঢাকা ছেড়ে গেছে। কেউ বলেছেন, তাদের ওপর কোনো আঘাত করা হয়নি, তারা গায়ে রঙ মেখে রাস্তায় শুয়েছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। হেফাজতের নজিরবিহীন হামলায় জনগণের মনের গভীরে এক বিরাট ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এই ব্যথাটাও তারা প্রকাশ করতে পারেনি। তবে এর পরিণতি ঘটেছে অতি সম্প্রতি এতে পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। সরকার ৫-০ গোলেহেরে যাওয়ার জন্য যে কারণগুলো চিহ্নিত করা যায়, তার মধ্যে হেফাজত ইস্যুটি অন্যতম প্রধান। হেফাজতকে হটিয়ে যারা অট্টহাসিতে কটাক্ষ করেছিলেন, তাদের হাসি ম্লান হতে বেশি সময় লাগেনি। আগামী দিনে অবশিষ্ট হাসিটুকুও ফুরিয়ে যেতে পারে। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads