সোমবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৩

হত্যা হামলা ও গ্রেফতার বন্ধ করে আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি করুন


আওয়ামী লীগ সরকারের সুচিন্তিত কূটকৌশল ও কর্মকা-ের পরিণতিতে দেশে এক বিচিত্র পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের ডাকা ৬০ ঘণ্টার হরতালকে ব্যর্থ করে দেয়ার উদ্দেশ্যে একদিকে পুলিশ, র‌্যাব ও দলীয় গু-া-সন্ত্রাসীদের দিয়ে লাশের পর লাশ ফেলা এবং বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে, অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরা সব দোষ চাপাতে চাচ্ছেন বিরোধী নেত্রীর ওপর। জনগণকে বোঝাতে চাচ্ছেন যেন বেগম জিয়ার কারণেই সংলাপ ও সমঝোতার চেষ্টা নস্যাৎ হয়ে গেছে। এই প্রচারণা চালানোর সময় এমনকি অশোভন ও ফ্যাসিস্টসুলভ বক্তব্যও রাখা হচ্ছে যথেচ্ছভাবে। কৃষিমন্ত্রী ও এককালের ‘কমরেড’ মতিয়া চৌধুরী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফসহ কয়েকজন তো খালেদা জিয়াকে ‘বেঈমানি’, ‘প্রতারণা’ ও ‘মোনাফেকি’ করার জন্যও অভিযুক্ত করে বসেছেন। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়া নাকি জাতির সঙ্গে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করেছেন! মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতারা বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের হাত-পা ভেঙে ফেলারও হুমকি দিচ্ছেন। ঘোষণা করেছেন, বিরোধী দলকে এবার তারা ‘শায়েস্তা’ করবেন! ওদিকে দেশজুড়ে যথারীতি চালানো হচ্ছে হামলা ও দমন-নির্যাতন। গত দু’দিনেও সারাদেশে অন্তত আটজনের মৃত্যু ঘটেছে। আহতদের সংখ্যা পাঁচশ ছাড়িয়ে গেছে। গ্রেফতারও করা হচ্ছে ঢালাওভাবে। বলা বাহুল্য, ক্ষমতার দম্ভে যতো কথাই বলা হোক না কেন, এ ধরনের পদক্ষেপ অন্তত সমঝোতার ব্যাপারে সদিচ্ছার প্রমাণ দেয় না।
উল্লেখ্য, বিরোধী দলের ওপর নতুন পর্যায়ে হামলা শুরু হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর বহুল আলোচিত টেলিফোন সংলাপের পর। কয়েকদিন ধরে টেলিফোন করবেন বলে প্রচারণা চালানোর পর গত ২৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় বেগম খালেদা জিয়াকে ফোন করেছিলেন শেখ হাসিনা। প্রায় ৩৭ মিনিট ধরে কথা বলার সময় প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের নেত্রীকে ২৮ অক্টোবর রাতে গণভবনে খাওয়ার জন্য ‘দাওয়াত’ দিয়েছেন। বলেছেন, খেতে খেতে তারা কথা বলবেন। প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে হরতাল প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়েছেন। অন্যদিকে খালেদা জিয়া দাওয়াত দেয়ার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, ১৮ দলীয় জোটের অন্য নেতাদের সঙ্গে কথা না বলে তার একার পক্ষে হরতাল প্রত্যাহার করা সম্ভব নয়। পুলিশের ধাওয়ার কারণে জোটের নেতারা যে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন সে কথা জানানোর পাশাপাশি খালেদা জিয়া আরও বলেছেন, সদিচ্ছা থাকলে ২৫ অক্টোবর রাতেই প্রধানমন্ত্রী তাকে ফোন করতে পারতেন, যেদিন বিকেলে তিনি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মহাসমাবেশে হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। তাছাড়া আমন্ত্রণ জানানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী হরতালের পূর্বদিন অর্থাৎ ২৬ অক্টোবর সারাদিনও সময় পেয়েছিলেন। দিনের মধ্যে ফোন করলেও হয়তো জোটের নেতাদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হতোÑ যদি পুলিশ তাদের ধাওয়ার মুখে না রাখতো। কিন্তু এই দু’দিনের সময়কে কাজে লাগাননি প্রধানমন্ত্রী। এজন্যই ২৮ অক্টোবর রাতের দাওয়াত গ্রহণ করতে অক্ষমতার কথা জানিয়ে দিয়েছেন খালেদা জিয়া। তিনি সেই সঙ্গে আরো বলেছেন, গণভবনে গিয়ে দাওয়াত খাওয়াটা তার জন্য বড়কথা হতে পারে না। তার আগে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীকে ‘নীতিগতভাবে’ সম্মতি জানাতে হবে। এই সম্মতি জানালেই খালেদা জিয়া ৬০ ঘণ্টার হরতালের অর্থাৎ ২৯ অক্টোবরের পর যে কোনোদিন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি আছেন। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিন্তু খালেদা জিয়ার প্রস্তাবের ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া দেননি। তিনি কেবল গণভবনে দাওয়াতের কথাই বলেছেন।
স্মরণ করা দরকার, ২৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় ফোন করার আগে দিনভর নাটকীয়তাও কম করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দুপুরে তিনি নাকি ‘বারবার’ লাল টেলিফোনে চেষ্টা করেও বিরোধী দলের নেত্রীকে ধরতে পারেননি। বিশেষ ইঙ্গিতসহ ‘বারবার’ কথাটা প্রধানমন্ত্রী এমনভাবেই কয়েকবার বলেছেন, যা শুনে মনে হতে পারে যেন বিরোধী দলের নেত্রী ইচ্ছা করেই তার ফোন ধরেননি। অন্যদিকে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, শেখ হাসিনার সরকার তাকে সেনানিবাসের বাসভবন থেকে উৎখাত করার পর তিনি কখনো তার লাল টেলিফোনটিকে সচল পাননি। অথচ রাষ্ট্রীয় প্রটোকল অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রীদের পাশাপাশি বিরোধী দলের নেত্রীর লাল টেলিফোনও সব সময় সচল থাকার কথা। সচল ছিল না বলেই প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা নিয়েও সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, দুপুরে সত্যিই তিনি নিজে যদি ‘বারবার’ চেষ্টা করে থাকেন এবং ‘রিং’ হওয়ার পরও যদি খালেদা জিয়া ফোন না ধরে থাকেন তাহলে প্রধানমন্ত্রীর প্রথমে উচিত ছিল ওই লাল টেলিফোন বিকল হয়ে আছে কি না সে ব্যাপারে খোঁজ-খবর করা এবং সচল করার ব্যবস্থা নেয়া। দ্বিতীয়ত, সন্ধ্যায় যেভাবে মোবাইলে খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলেছেন, সেভাবে তিনি আগেও কথা বলতে পারতেন। কিন্তু অন্তরালে অন্য রকম উদ্দেশ্য ছিল বলেই প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। বেছে বেছে এমন এক সময়ে ফোন করেছেন যখন খালেদা জিয়ার পক্ষে হরতাল প্রত্যাহার করা সম্ভব হতো না। এর ফলে জনগণকে বোঝানো যাবে, প্রধানমন্ত্রী সদিচ্ছা দেখালেও বিরোধী দলের নেত্রী হরতাল প্রত্যাহার করেননি। তিনি আলোচনার টেবিলেও আসেননি। অর্থাৎ অনেক ভেবেচিন্তেই ফোন করেছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। এদিকে ক্ষমতাসীন অন্য নেতাদের আক্রমণাত্মক বক্তব্যের মধ্য দিয়েও বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে আদৌ সততা ছিল না। এজন্যই প্রধানমন্ত্রী ফোন করার তথা ২৬ অক্টোবর রাত থেকেই ক্ষমতাসীনরা বেগম খালেদা জিয়াকে দোষারোপ করার নতুন অভিযানে নেমে পড়েছেন। আমরা মনে করি, সমঝোতার ব্যাপারে সত্যি সদিচ্ছা থাকলে প্রধানমন্ত্রীর উচিত অবিলম্বে হত্যা-হামলা-মামলা ও গ্রেফতার বন্ধ করা এবং আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি করা। প্রধানমন্ত্রীকে বিশেষ করে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের প্রশ্নে ‘নীতিগত’ সম্মতির কথাও ঘোষণা করতে হবে, যে সরকারের রূপরেখা বা প্রস্তাব বেগম খালেদা জিয়া প্রথমে সংবাদ সম্মেলনে এবং তারপর জাতীয় সংসদে পেশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী সম্মত হলেই কেবল দুই নেত্রীর আলোচনা ফলপ্রসূ হতে পারে বলে আমাদের ধারণা। তেমন আন্তরিকতা দেখানোই এখন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব। এজন্য তাকে বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে আক্রমণ ও  অপপ্রচারও বন্ধ করতে হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads