বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৩

প্রতিহিংসার রাজনীতি বনাম জাতীয় সংহতি


ঐতিহাসিক একটি ঘটনা দিয়েই লেখা শুরু করছি। অষ্টম হিজরি সাল। মক্কার মুশরিকদের বিরুদ্ধে ইসলামের বিজয় হয়েছে। মহানবীর কূটনীতির ফলে এ বিজয়ে এক ফোঁটা রক্তও ঝরেনি। মক্কার বিজিত মুশরিকগণ ঐসব লোক যারা হিজরতের আগে তেরটি বছর মহানবী ও সাহাবিদের ওপর অবর্ণনীয় জুলুম-নির্যাতন করেছে, মহানবীকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছে। তাদের জুলুম-নির্যাতনে বাধ্য হয়ে শেষ পর্যন্ত মহানবী ও সাহাবিগণ ঘর-বাড়ি, বিষয়-সম্পত্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য পরিত্যাগ করে মদীনায় চলে গিয়েছেন। মুশরিকরা মদীনায়ও তাঁদেরকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি। আটটি বছর তারা বার বার ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে।
মহানবীর চার পাশে সমবেত মুশরিকদের মধ্যে আছেন তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্রকারীগণ এবং বদর, উহুদ প্রভৃতি যুদ্ধের নায়কগণ। তাদের মধ্যে আরো আছেন মহানবীর অতি প্রিয় চাচা হামযা, (রা.)-এর ঘাতক ওয়াহ্শি এবং হিন্দা নামক ঐ মহিলা যিনি প্রতিহিংসাবশত তাঁর কলিজা চিবিয়ে খেয়েছিলেন। সমবেত মুশরিকদের মধ্যে উৎকণ্ঠা ও শঙ্কার সীমা নেই। মহানবী তাদের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেন, তা তাদেরকে দারুণভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। মহানবী তাদেরকে কী বললেন? তিনি বললেন, যাও, তোমরা সবাই আযাদ। (উল্লেখ্য, ঐ সময় সারা বিশ্বে নিয়ম ছিল, যুদ্ধে পরাজিত নারী-পুরুষ সবাই বিজয়ীদের দাস হবে।)
মহানবী কোনো প্রতিশোধ তো নিলেন না বরং পরাজিত শত্রুদের মধ্যে যারা বিশেষভাবে সম্মানিত ছিল তাদেরকে বিশেষ মর্যাদা দিলেন। ইসলামের ঘোর শত্রু আবু সুফিয়ানের ব্যাপারে তিনি বললেন, যেকেউ আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ। তিনি আরও বললেন, জাহিলিয়াতের (অজ্ঞতার) যুগে যারা শ্রেষ্ঠ, ইসলামেও তারা শ্রেষ্ঠ। খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) প্রমুখ ইসলাম গ্রহণের পর এ কথার সত্যতা চমৎকারভাবে প্রমাণ করেছিলেন। পরাজিত শত্রুদের ব্যাপারে মহানবী যে নীতি অবলম্বন করেছিলেন, তার ফলে অচিরেই ইসলাম কেবল সারা আরবে বিস্তার লাভ করেনি, সারা বিশ্বে একটি উদীয়মান শক্তি হিসেবে দেখা দিয়েছিল।
প্রতিহিংসা পরিহারের এই যে মহান নীতি তা বিশ্বের প্রজ্ঞাবান, জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিগণ সব সময় অবলম্বন করে থাকেন। কারণ, প্রতিহিংসা কেবল হিংসা-বিদ্বেষ ও হানাহানির জন্ম দেয়, এতে দেশের বা জাতির ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ হয় না। এর ফলে শত্রুদের মোকাবিলায় জাতি কেবল দুর্বল হতে থাকে এবং ক্রমে ক্রমে জাতীয় অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যায়।
এ যুগের এক মহানায়ক নেলসন ম্যান্ডেলার কথা আমরা জানি। নিজ দেশে ঔপনিবেশিক শক্তির বর্ণবাদভিত্তিক শোষণের শিকার হয়ে জীবনের সাতাইশটি বছর তিনি কয়েদখানায় কাটিয়েছেন। জেল থেকে মুক্তি লাভ করে যখন তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তখন শ্বেত শোষকদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি বরং বর্ণবাদী গোষ্ঠীর একজন নেতাকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনীত করেছিলেন। সামাজিক শান্তি ও দেশের উন্নয়নের খাতিরে তিনি প্রতিহিংসার বদলে জাতীয় সংহতি ও ঐক্যকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। তাঁর এ নীতির ফলে দেশের অগ্রগতি বাধাপ্রাপ্ত হয়নি। বরং অব্যাহত রয়েছে। উদারতা ও বিশাল ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিয়ে তিনি নিজেও বিশ্বে নন্দিত হয়েছেন। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো পিতৃহত্যার বিচার না করে যে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা প্রশংসিত হয়েছে। ফিলিপিনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর একুইনোও তাঁর স্বামী (যিনি সে দেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন) হত্যার বিচার না করে অতি বড় মনের পরিচয় দিয়েছেন। আমাদের দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া এ ধরনেরই কাজ করেছেন। এতে তাঁর সুনাম ক্ষুণœ হয়নি বরং বেড়েছে।
দেশ ও জাতীয় নেতৃত্ব যাদের ওপর ন্যস্ত, তারা শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিলে বা প্রতিহিংসামূলক কাজ করলে চরম পর্যায়ে এর ফল ভাল হয় না বরং লাভের চেয়ে ক্ষতি হয় বেশি। বৃটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ঔড়যহ ষঁননধপশ বলেছেন, জবাবহমব ফড়বং সড়ৎব যধৎস ঃযধহ ঃযব রহলঁৎু রঃংবষভ. অর্থাৎ, প্রতিহিংসার দ্বারা মূল ক্ষতির চেয়ে ক্ষতি বেশি হয়।
ওপরের উদাহরণগুলো ব্যক্তিবিশেষের সাথে সম্পৃক্ত। জাতীয় নীতি নির্ধারণে সময়ও প্রজ্ঞাবান রাজনীতিকগণ অতীত শত্রুতার প্রতিশোধ নেয়ার পেছনে অর্থ ও সময় ব্যয় না করে কেবল জাতীয় স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। মার্কিন সেনারা ভিয়েতনামে লাখ লাখ লোক হত্যা করেছে, কিন্তু স্বাধীন হওয়ার পর ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করেছে। এর ফলে দেশটি অতি কম সময়ে অভাবিত উন্নতি লাভ করতে পেরেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান তার সবচেয়ে বড় শত্রু আমেরিকার সাথে সখ্যতা স্থাপন করতে মোটেই দ্বিধাগ্রস্ত হয়নি বরং সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে। মার্কিন সহযোগিতার ফলেই জাপান অতি অল্প সময়ে যুদ্ধের ক্ষয়-ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এবং দ্রুতগতিতে উন্নতি লাভ করতে পেরেছে।
অতীত তিক্ততাকে ঘাটাঘাটি করে যে জাতির কোনো লাভ হয় না, এ উপলব্ধি আমাদের অঞ্চলেও দেখা গিয়েছে। যে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি প্রায় দু’শ’ বছর এ উপমহাদেশকে শোষণ করেছে, তার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে ‘ঈড়সসড়হ বিধষঃয-এর সদস্য হতে স্বাধীন পাকিস্তান ও স্বাধীন ভারত সংকোচ বোধ করেনি। বর্তমান ভারতের বহু স্থানের মুসলমান পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানের পক্ষে থাকার কারণে ভারতে তাদের কোনো বিচার হয়নি। যে মুসলিম লীগ পাকিস্তান রাষ্ট্রের  জন্য এককভাবে সংগ্রাম করেছে, তা এখনও ভারতের কেরালা প্রদেশের রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক শক্তি। অনুরূপভাবে, পকিস্তানী এলাকায় যেসব লোক অখ- ভারতের পক্ষে কাজ করেছেন, স্বাধীনতা লাভৈর পর তাদের বিরুদ্ধেও কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে কংগ্রেস পাকিস্তানে অবাধে কাজ করেছে এমনকি কংগ্রেস নেতা ধীরেন্দ্রনাথ পাকিস্তানের প্রথম মন্ত্রীসভায় স্থান পেয়েছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা লাভের পর জাতীয় পরিষদে কায়দে আযম দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন, আজ থেকে আমাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই, আমরা সবাই পাকিস্তানী।
বর্তমান বাংলাদেশকেও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা পরিহারের উদাহরণ আছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিরোধীতা যারা করেছিলেন, জাতীয় সংহতির খাতিরেই মরহুম শেখ মুজিব তাদের ক্ষমা করেছিলেন। এমনকি দেশের বৃহত্তর স্বার্থে ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীকে তিনি ক্ষমা করেছিলেন এবং বলেছিলেন, আমরা দেখিয়ে দিলাম, বাঙালী ক্ষমা করতে জানে। জাতীয় স্বার্থেই তিনি বাংলাদেশের ঘোর শত্রু পাকিস্তানের সাবেক প্রধান মন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে এ দেশে আমন্ত্রণ করে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সুসম্পর্ক স্থাপনে এ মহানুভবতা বিরাট কাজ করেছিল।
স্বাধীনতা লাভের প্রায় চল্লিশ বছর পর বর্তমান বাংলাদেশে ‘দেশকে কলঙ্কমুক্ত করা’র নামে ‘যুদ্ধাপরাধ’ বা ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’-এর বিচার চলছে। ক্ষমতাসীন সরকারের কোনো কোনো নেতার কথায় মনে হয়, এ বিচার হচ্ছে একটা চলমান প্রক্রিয়া, এটা চলতেই থাকবে। আদালতের প্রতি যথাযথ সম্মানপূর্বক বলা যায়, এ ধরনের বিচার প্রক্রিয়া সমাজে অশান্তি ও হানাহানি বৃদ্ধি করে জাতীয় ঐক্য ও সংহতিকে কুরে কুরে নিঃশেষ করে দিচ্ছে কিনা তা ভেবে দেখারও দরকার আছে। যদি আবেগের তাড়নায় বা রাজনৈতিক স্বার্থের খাতিরে এ ধরনের কাজ করা হয় তবে তার পরিণতি জাতির জন্য শুভ নাও হতে পারে।
পরিশেষে আমেরিকার বিশ্বনন্দিত প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন-এর দুটো বাণী উদ্ধৃত করছি। তিনি বলেছেন : : A house divided against itself cannot stand. তিনি আরও বলেছেন : United we stand, divided we fall.

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads