বুধবার, ৯ অক্টোবর, ২০১৩

গণমাধ্যমের সাম্প্রতিক চ্যালেঞ্জ


সাম্প্রতিক বলতে আমরা যদি দুই দশক ধরি তাহলে নব্বই দশকের শুরু থেকে আলোচনার ভিত্তি হতে পারে। এই দশকের শুরু গণআন্দোলনের সাফল্যের মাধ্যমে, স্বৈরাচারী এরশাদের পতন এবং গণতন্ত্রের বিজয়। বৃহত্তর সাংবাদিক সমাজ প্রথম থেকেই এরশাদের সামরিক শাসনের বিরোধিতা করে এবং ১৯৯০ সালের ২৭ নবেম্বর রাজনৈতিক আন্দোলন দমানোর জন্য সরকার জরুরি অবস্থা জারি করলে সাংবাদিক ইউনিয়ন সেই রাত থেকেই সকল সংবাদপত্রে সর্বাত্মক ধর্মঘট ঘোষণা করে। পরদিন থেকে সকল সংবাদপত্রের প্রকাশনা বন্ধ থাকে। এরশাদের জাতীয় পার্টির মুখপত্র দৈনিক জনতা কেবল কয়েকদিন প্রকাশিত হয়। এরশাদ পদত্যাগ না করা পর্যন্ত ধর্মঘট পালিত হয়।
সাংবাদিকতার চলমান চ্যালেঞ্জ স্বাধীন মত প্রকাশের প্রচেষ্টা। ১৯৯০ সালে স্বৈরশাসনের অবসানেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তবে তা প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ কর্তৃক বিশেষ ক্ষমতা আইনের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা বিষয়ক কয়েকটি বিবর্তনমূলক ধারা বাতিল সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার পথে এক ধাপ অগ্রগতি হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে আছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের আইসিটি আইন ও খসড়া জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা আবার মিডিয়ার কণ্ঠরোধ করবে। সংশোধিত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারাটি দেশকে মধ্যযুগে নিয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন দেশের অনেক বিশিষ্ট নাগরিক। আইনটি অস্পষ্ট এবং তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই ধারায় বলা হয়েছে কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে মিথ্যা ও অশ্লীল কিছু প্রকাশ করলে, যা দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট হতে উদ্বুদ্ধ করে, অন্যের মানহানি ঘটায়, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটায়, ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করে বা কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি দেয়Ñ তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এই আইন জামিনযোগ্য নয় এবং পুলিশ বিনাওয়ারেন্টে অভিযুক্তকে গ্রেফতার করতে পারবে। কোনো ব্যক্তি এ ধরনের অপরাধ করলে তিনি সর্বোচ্চ ১৪ বছরের এবং সর্বনি¤œ সাত বছরের কারাদ- এবং সর্বোচ্চ এক কোটি টাকার অর্থদ-ে দ-িত হবেন।
খসড়া জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালায় বিজ্ঞাপনসংক্রান্ত কয়েকটি বিধিনিষেধ জনস্বার্থের পক্ষে যেমন গুঁড়া দুধের বিজ্ঞাপনে পাঁচ বছরের কম বয়সের শিশুদের মডেল হিসেবে বা তাদের ছবি ব্যবহার করা যাবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে নীতিমালায়। আরো বলা হয়েছে গুঁড়া দুধের বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে শিশুদের জন্য ‘মায়ের দুধের বিকল্প নেই’, ‘এই গুঁড়া দুধ পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য নয়’ এই বাক্য দুটি কমপক্ষে পাঁচ সেকেন্ড সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে স্পষ্টাক্ষরে দেখাতে হবে।
কিন্তু সামগ্রিকভাবে নীতিমালাটি খুবই নিয়ন্ত্রণমূলক, অনেকটা চলচ্চিত্র সেন্সর বিধিমালার মতো। চলচ্চিত্র যাতে ইংরেজ শাসকদের স্বার্থেই বিপক্ষে কিছু না দেখাতে পারে সেই উদ্দেশে ১৯১৪ সালে ভারতীয় সিনেমাটোগ্রাফী আইনের আওতায় সেন্সর বিধিমালা তৈরি করেছিল ঔপনিবেশিক সরকার। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের মানসিকতা কেন এমন হবে?
নব্বই দশকে গণমাধ্যম হিসেবে সংবাদপত্রই বিবেচিত হবে এই রচনার জন্য কেননা ইলেক্ট্রনিক মাধ্যম বলতে তখন ছিলো শুধু বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার। আর এ দুটি প্রতিষ্ঠানই সরকারের নিয়ন্ত্রণে বলে এদের প্রবণতা এক কথায় বলা যায় সরকারের প্রচার এবং বিরাধী দল সম্পর্কে ভুল চিত্র তুল ধরা। পরবর্তী পর্যায়ে গত ২৩ বছরে গণতান্ত্রিক সরকারের আমলেও এর চরিত্র তেমন বদলায়নি। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে সকল বিরোধীদল বেতার টেলিভিশনের স্বায়ত্বশাসন দাবি করে, পরে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বেতার টেলিভিশনের স্বায়ত্বশাসন প্রদান করা হবে বলে অঙ্গীকার করা হলেও কোনো সরকারই সেই উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ফলে সেই সময়ের বেতার টিভি’র খবর প্রচার সাংবাদিকতা নয়।
নব্বই পরবর্তী পর্যায়ে গণমাধ্যম বললে ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমও বুঝাবে। ১৯৯৮’র পর দেশে স্যাটেলাইট টেলিভিশনের সংখ্যা বাড়তে থাকে। কয়েকবছরের মধ্যে শুরু হয় স্যাটেলাইট টেলিভিশনে খবর প্রচার। ‘প্রাচীন’ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিটিভি’র “খবর অনুষ্ঠান” যে ঠিক সাংবাদিকতা নয় সেটা বিটিভি কর্তৃপক্ষও অস্বীকার করেন না। বিটিভি’র খবর সরকারি তথ্যের উপর ব্যাপক নির্ভরতার কারণে এর বিশ্বাসযোগ্যতাও শূন্যের কোঠায়। সরকারি সিদ্ধান্ত ছাড়া ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার রিপোর্ট বিটিভিতে স্থান পেলেও দর্শকের কাছে এসবের গ্রহণযোগ্যতা নেই। এমনকি সড়ক দুর্ঘটনার খবরে উল্লেখ করা নিহতের সংখ্যা নিয়েও দর্শক সন্দেহ পোষণ করেন! একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিটিভি স্পষ্ট রিপোর্টিং চালু করলেও সেটা ঘটনার চাইতে ঐ সরকারি কার্যক্রমকেই কেবল তুলে ধরছে। প্রাইভেট চ্যানেলের বহুবিধ খবর প্রচারের চাপে বিটিভি তার উপস্থাপনায় কিছুটা পরিবর্তন আনলেও নীতিগত ক্ষেত্রে মৌলিক কোনো পরিবর্তন এখনো চোখে পড়ে না।
বাংলাদেশ টেলিভিশন সাংবাদিকতার সূত্রপাত মূলত একুশে টেলিভিশনের মাধ্যমে। অর্থাৎ নব্বই পরবর্তী সময়ে। বাংলাদেশের ঘটনা বাংলা ভাষায় সিএনএন/বিবিসি স্টাইলে টিভিতে দেখানো সম্ভব এটা দর্শক বুঝলেন একুশে টিভির খবরের মাধ্যমে। এই হিসেবে টিভি সাংবাদিকতার এক দশক পেরিয়ে গেছে। বর্তমানে প্রায় সবকটি চ্যানেল প্রতিদিন ৪ থেকে ৫ বার প্রধান খবরসহ ঘণ্টায় ঘণ্টায় খবর আপডেইট করে।
নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ
সাধারণভাবে অনেক চ্যালেঞ্জ পার করতে হচ্ছে মিডিয়াকে। অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা, সাংবাদিকের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি, পেশাজীবী সাংবাদিকদের অনৈক্য ও সাংবাদিক ইউনিয়ন দ্বিধাবিভক্ত হওয়াতো আছেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সংবাদের একচেটিয়া বাণিজ্যায়ন, সম্প্রচার নীতিমালা, আইসিটি আইন, সংবাদ ব্যবস্থাপনায় প্রকাশকের নিয়ন্ত্রণ। কর্তৃত্ব।
গত ২০ বছরে মিডিয়ার বিষয়গত উন্নয়ন এবং উপস্থাপনার দৃষ্টিভঙ্গীতে বিশেষ পরিবর্তন না এলেও এর বাইরের আবরণে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। দৈনিক পত্রিকা চার রঙা হয়েছে এবং বৃহৎ পুঁজি আর ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান মিডিয়ার মালিকানায় চলে এসেছে। এই শতাব্দীর বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার প্রভাবে মিডিয়া এখন পুরোপুরি বাণিজ্যায়ণের শিকার। বৃহৎ বিনিয়োগে সুপুঁজির পাশাপাশি কুপুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটেছে মিডিয়ায়। কুপুঁজি কেবলই মুনাফামুখী, একারণেই কুপুঁজি কল্যাণকামিতা প্রতিরোধ করে। মুক্তবাজার অর্থনীতির দর্শনে সুপুঁজি কুপুঁজির খুব একটা পার্থক্য করা হয় না। এখানে আসল কথা হলো পুঁজি দিয়ে পুঁজি আনার চেষ্টা। বৃহৎ পুঁজি আর ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান মিডিয়ার মালিকানায় আসার পর মিডিয়া এখন পুরোটাই বাণিজ্য, সবকিছুর হিসাব নিকাশ করা হচ্ছে আর্তিক লাভক্ষতি দিয়ে। সামাজিক বিবর্তন ও রাজনৈতিক মেরুকরণে সংবাদপত্রের যে বিশেষ ভূমিকার কথা গত শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত বলা হতো এখন আর সেভাবে বলা হয় না। লাভজনক ব্যবসার মধ্যদিয়ে যতটা সম্ভব কেবল ততটাই পালন করা মিডিয়ার ভূমিকা বলে মনে করা হচ্ছে। এই অঞ্চলের প্রথম সংবাদপত্রের প্রতিষ্ঠাতা কাঙাল হরিনাথ’র ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ (প্রথমে পাক্ষিক ও পরে সাপ্তাহিক আকারে প্রকাশিত হয়) ১৮৭৩ সালে পাবনা প্রজা বিদ্রোহে প্রজাপক্ষ অবলম্বনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। পাবনার ম্যাজিস্ট্রেট হামফ্রে এক চিঠিতে কাঙাল হরিনাথকে লিখলেন ‘এডিটর আমি তোমাকে ভয় করি না বটে, তোমার নির্ভীক সত্য লেখনির জন্য আমি অনেক কুকর্ম ত্যাগে বাধ্য হয়েছি’।
এরকম ঘটনা কী নব্বই পরবর্তী সময়ে কখনো ঘটেছে? বরং সাম্প্রতিক সময়ে যে দুটি বিষয় মিডিয়াতে জেঁকে বসার পথে, একটি ‘বেচে দেয়ার খবর’ অন্যটি ‘মিডিয়া পার্টনারশিপ’। এই প্রক্রিয়া সুবিধাভোগীদের সমর্থনে আমাদের বাধ্য করছে, আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। ‘বেচে দেয়া খবর’ ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতেই বেশি প্রভাব ফেলছে। প্রায় সবক’টি টিভি চ্যানেল তাদের বিভিন্ন খবর ও শিরোনাম ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কাছে বেচে দিচ্ছে, কারিগারি ভাষায় যার নাম ‘স্পন্সরশীপ’। ‘মিডিয়া পার্টনারশিপ’ও অর্থযোগানদাতাদের কাছে এক ধরনের আত্মসমর্পণ। আধুনিক মার্কেটিং এর তরুণ কর্মকর্তাদের এটা সাফল্য বটে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই প্রক্রিয়ায় সাংবাদিকতার মৌলিক দায়িত্বটি হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। খবরের যে শিরোনামগুলো বা যে খবরগুলো কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে সে ক্ষেত্রে বিষয় ও বাছাইয়ে বস্তুনিষ্ঠতা ক্ষুণœ হবে না সেই নিশ্চয়তা থাকে না। কোনো ব্যাঙ্কের সৌজন্যে (ভদ্রতা করে বলা হয়, আসলে তো অর্থের বিনিময়ে) যে বাণিজ্য সংবাদ প্রচার করা হয় সেখানে ঐ ব্যাংকের বিপক্ষে যায় এমন খবর প্রচার বা প্রকাশ করা কি সম্ভব? নিশ্চয়ই না। যাদের সৌজন্যে শিরোনাম এবং অন্য খবর প্রচারিত হচ্ছে সেখানেও ঐ প্রতিষ্ঠানের স্বার্থহানি হয় বা তাদের পছন্দ নয় এমন খবর প্রচার করা সম্ভব নয়। মিডিয়া পার্টনারশিপ’র ক্ষেত্রটিতে আর্থিক লেনদেন অথবা দুই প্রতিষ্ঠানের পারস্পরিক লাভজনক দিকটা প্রাধান্য পায়। জনস্বার্থ বা সামাজিক স্বার্থ সেখানে গৌণ। প্রায় তিরিশ বছর আগে শিশুর টিকাদান কার্যক্রম সফল করার জন্য প্রিন্ট মিডিয়াকে সহযোগী (পার্টনার) করা হয়েছিল। এই পার্টনারশীপ ছিল সম্পূর্ণ অবাণিজ্যিক, কোনো টাকাপয়সার লেনদেন ছিল না। মিডিয়া এগিয়ে এসেছিল শিশু স্বাস্থ্যের উন্নয়নে অঙ্গীকার নিয়ে। এতে কোনো পক্ষের ব্যক্তিগত লাভের প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের মিডিয়া পার্টনারশিপ’র ধরনটি ভিন্ন। কোনো রং প্রস্তুতকারক কোম্পানীর নতুন ব্র্যান্ড বাজারে চালু করার জন্য আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মিডিয়া পার্টনার হওয়ার মধ্যে কোনো সামাজিক দায়িত্ব পালনের প্রসঙ্গ নেই। এখানে আছে উভয়ের নিজস্ব স্বার্থ। আর এর মাধ্যমে খবরের বস্তুনিষ্ঠতা ক্ষুণœ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কেননা মিডিয়া পার্টনার হওয়ার কারণে ঐ অনুষ্ঠানে ভুলত্রুটি ঐ নির্দিষ্ট মিডিয়া প্রকাশ বা প্রচার করা থেকে বিরত থাকবে স্বাভাবিকভাবে। এটাকে মিডিয়ার মুখ বন্ধ করার নতুন একটি করপোরেট মার্কেটিং কৌশল হিসেবেই চিহ্নিত করা যায়।
বৃহৎ পুঁজি ঃ বৃহৎ পুঁজির অনুপ্রবেশের ফলেই মিডিয়া খবর বেচে দিতে বা মিডিয়াকে অন্যের ব্যবসায়ের উপাদানে পরিণত করতে দ্বিধা করছেন না মিডিয়া মালিকরা। এরই প্রভাবে সম্পাদকের প্রতিষ্ঠানও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মর্যাদার দিক থেকে। শিক্ষক, আইনজীবী, চিকিৎসকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী হতে হলে নির্দিষ্ট কিছু অবশ্য পালনীয় পূর্বশর্ত রয়েছ কিন্তু সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার জন্য কোনো নির্ধারিত নীতিমালা নেই। এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারী বা প্রকাশকের ইচ্ছাটাই চূড়ান্ত বলে গণ্য হয়। মিডিয়ায় কর্মরত সকল বিভাগের কর্মীদের জন্য যোগ্যতা ও শর্তাবলী উল্লেখসহ চাকরি বিধিমালা থাকা প্রয়োজন। ব্যবসায়িক কারণে মিডিয়া অনেক সময় পাঠকের প্রত্যাশা পূরণকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে বলে যুক্তি প্রদর্শন করা হয়। অর্থাৎ ঘটনার নিরপেক্ষতার চাইতে পাঠক কোন বিষয়টা পেলে খুশি হবে সেই বিষয়টাকেই বিস্তারিতভাবে এবং গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করা হয়।
প্রত্যাশার ব্যাপারটি আবার ব্যাখ্যার দাবি রাখে। পাঠক তার নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে প্রত্যাশা করে থাকেন। সেকারণে পাঠকের প্রত্যাশারও তারতম্য হতে পারে। তাছাড়া পাঠক কি প্রত্যাশা করছে সেটা জানার মাধ্যম কি? নিয়মিত পাঠক চাহিদা জরিপের কোনো ব্যবস্থা এ দেশে নেই। কখনো কখনো চকিত জরিপের মাধ্যমে যে ফলাফল পাওয়া যায় সেটা প্রকৃত চিত্র নয়। কখনো কখনো বেসরকারি সংস্থা যে মিডিয়া সমীক্ষা করে সেটাও সেই সব সংস্থার অগ্রাধিকারমূলক বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকে। সেই সব যতটা মিডিয়ার মনোভঙ্গী প্রকাশ করে, পাঠকের প্রত্যাশা ততটা নয়। পাঠকের প্রত্যাশাকে আসলে যাচাই করা হয় পত্রিকা বিক্রির পরিমাণের ওপর। সেক্ষেত্রেও সততার অভাব রয়েছে।
পাঠকের প্রত্যাশা পরিবর্তনের ক্ষমতাও আবার মিডিয়ার রয়েছে। রঙিন দৈনিক পাঠক দাবি করেনি। মিডিয়া পাঠককে রঙিন দৈনিকের প্রতি ঠেলে দিয়েছে। দু’একটি পত্রিকা প্রথমে রঙিন পৃষ্ঠা প্রকাশ শুরু করলে অন্যরা ব্যবসায়ে ‘মার’ খাবেন ভেবে রঙে পরিবর্তন করলেন নিজেদের। রঙিন দৈনিক এখন পাঠকের প্রত্যাশা। নতুন দৈনিকের প্রকাশক এখন রঙিন প্রকাশনা ছাড়া ভাবছেন না। ২০০৫ এর শেষ দিকে প্রকাশিত ‘ভিন্ন ধারার’ দৈনিক আমাদের সময় সাদা কালোতে শুরু করলেও পরে প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠায় রঙিন ছবি ও শিরোনাম ব্যবহার শুরু করে।
পাঠকের প্রত্যাশা পাঠকের অধিকারের সঙ্গে একীভূত করে দেখা যায় না। আগেই বলেছি প্রত্যাশা ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে পছন্দ এবং অগ্রাধিকারের আলোকে। কিন্তু অধিকার সকলের এক, এখানে ভিন্নতা নেই। সকল পাঠকের অধিকার একইরকম সেটা  জানার অধিকার, আর এই জানাটা পুরুষ-মহিলা, তরুণ-তরুণী বা বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সকলের জন্যই একই রকমের। অর্থাৎ সত্যটা জানা। আর সত্য  জানাতে হলে মিডিয়াকে সত্যের পক্ষেই থাকতে হয়। এখানে আমি ‘নিরপেক্ষ’ ভূমিকাও সেই সিদ্ধান্তকেই বলব যা সত্যের পক্ষে। নিরপেক্ষতার কথা বলে কোনো ঘটনার সংবাদ প্রকাশ না করাও আসলে পক্ষপাত হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এক্ষেত্রে সত্য প্রকাশ পেলে কোনো একটি পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই সংবাদ প্রকাশ না করার মাধ্যমেও একটি পক্ষকে সমর্থন করা সম্ভব। মিডিয়া পার্টনারশিপ বা বেচে দেয়া সংবাদ মিডিয়াকে ‘নিরপেক্ষ’ রাখার আবরণে শান্তির নামে কবরের শান্তির দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে কি না ভেবে দেখতে হবে।
ঝুঁকি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি শক্তিশালী না হলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কোনো অন্যায়কে প্রকাশ করতে গেলে ঝুঁকি আসবেই। সাংবাদিকতা হল সত্য প্রকাশ। আর সত্য প্রকাশ করতে গেলে যদি অন্যায় এবং অন্যায়কারীর প্রসঙ্গ এসে যায় তবে সাংবাদিকদের দায়িত্ব হল সেটা তুলে ধরা। আর সেটা করতে গেলে তো ঝুঁকি আসবে। দায়িত্বপূর্ণ সকল পেশাতে কম বেশি ঝুঁকি রয়েছে। সমাজে অন্যায় যত বাড়বে, অনাচার যত বাড়বে, বিশৃংখলা যত বাড়বে দায়িত্বশীল সাংবাদিকতায় ঝুঁকি বাড়বে, সৎ ম্যাজিস্ট্রেটের ঝুঁকি বাড়বে, সৎ চিকিৎসকের ঝুঁকি বাড়বে, সৎ পুলিশ কর্মীর ঝুঁকি বাড়বে। ম্যাজিস্ট্রেট যখন নিয়ম ভঙ্গকারী প্রভাবশালী গাড়ির মালিক বা লঞ্চ মালিককে জরিমানা করেন তখন তার জীবন বিপন্ন হয়। চিকিৎসক যখন সন্ত্রাসীর ইচ্ছামত মেডিকেল রিপোর্ট না দেন তার ঝুঁকি বাড়ে, সৎ পুলিশ কর্মী যদি ক্ষমতাবান কারো অন্যায় আচরণ প্রতিরোধ করতে চান তখন তার ঝুঁকি বাড়ে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। মিডিয়া স্বাধীন না হলে গণতন্ত্র পূর্ণতা পায় না, আবার গণতন্ত্র না থাকলে সুশাসন সম্ভব হয় না, সুশাসন না থাকলে মিডিয়া কখনো স্বাধীন হতে পারে না।
দায়িত্ব পালন সেমিনারে ওয়ার্কশপে আমরা মিডিয়া আলোচনায় ফল নিয়েই আলোচনা করি, বৃক্ষ নিয়ে করি না। আমরা মিডিয়ার ভূমিকা, মিডিয়ার শক্তি, মিডিয়ার স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা করলেও মিডিয়ার দায়িত্বের প্রসঙ্গটি উহ্য থেকে যায়। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। মিডিয়ার দায়িত্ব আমাদের কাছে স্পষ্ট হলে এর স্বাধীনতার জন্য যথাযথ পদক্ষেপে সোচ্চার হওয়া সহজ হবে। মিডিয়া একটি টুল, এর কনটেন্ট হলো মৌলিক উপাদান। প্রিন্ট মিডিয়ায় এই কনটেন্ট হলো সাংবাদিকতা। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় সাংবাদিকতা ছাড়াও অন্যান্য উপস্থাপনা ও কনটেন্ট নীতিমালার আওতায় আসবে। সাংবাদিকতার স্বাধীনতা ছাড়াও অন্যান্য উপস্থাপনার ওপরও প্রযোজ্য হবে। মিডিয়া বৃক্ষটি যেভাবে রোপণ করা হবে এর ফল সেইভাবেই ধরবে। একটি উদাহরণ দিয়ে বলা যাক। “একটি প্রভাবশালী পত্রিকার শিক্ষানবিশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক কর্তৃক দুর্নীতিবাজ-সুযোগসন্ধানী চক্র নিয়ে রিপোর্ট করার পর পত্রিকাটি সহযোগিতার হাত না বাড়িয়ে জানায় ...........(রিপোর্টার) পত্রিকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক নয়।” অর্থাৎ পত্রিকাটি মুক্ত সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ করে দিল। আরেকটি উদাহরণ আরো ভয়ঙ্কর ...At least half a dozen newspaper editors or owner-editors are engaged in landgrabbing and defrauding public institutions by using their positions as a shield ...The Canadian gas developer, Niko Resources, blamed local journalists for asking for envelopes full of cash, There has been no reaction from the company’s media consultant who himself is an editor of a vernacular daily”
মুক্ত  বাজার অর্থনীতিতে নষ্ট রাজনীতিক বা দুষ্ট ব্যবসায়ীর মিডিয়া মালিক হওয়া রোধ করা যাবে না। তবে এইক্ষেত্রে সাংবাদিকতার নীতিমালা যথাযথভাবে পালনে সরকার ও নাগরিক সমাজকে আরো বেশি তৎপর হতে হবে।
আগেই বলেছি পরিবর্তিত বিশ্ববাণিজ্যকে প্রেক্ষাপটে মিডিয়া মালিকের মনোভঙ্গীরও পরিবর্তন ঘটেছে। মিডিয়া এখন ব্যবসা, কোনো মিশন নয়। দেশের মিডিয়া জগতে নতুন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বৃহৎ পুঁজি আর ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান মিডিয়ার মালিকানায় আসার পর মিডিয়া এখন পুরোটাই বাণিজ্য, সব কিছুর হিসাব নিকাশ করা হচ্ছে আর্থিক লাভ ক্ষতি দিয়ে। সামাজিক বিবর্তন ও রাজনৈতিক মেরুকরণে সংবাদপত্রের যে বিশেষ ভূমিকার কথা গত শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত বলা হতো এখন আর সেভাবে বলা হয় না। লাভজনক ব্যবসার মধ্য দিয়ে যতটা সম্ভব কেবল ততটাই পালন করা মিডিয়ার ভূমিকা বলে মনে করা হচ্ছে। মিডিয়া তাই বিষয়ের কোয়ালিটি বা বিষয় উপস্থাপনার গুণগত মান নিয়ে ততটা আন্তরিক নয় যতটা বাণিজ্য নিয়ে চিন্তিত। সম্পাদকরা নিউজপ্রিন্টের দাম এবং বিজ্ঞাপন প্রাপ্তি নিয়েই অধিক সময় ব্যয় করেন।
এই কারণেই তথ্য অধিকার এবং মিডিয়ার স্বাধীনতার পাশাপাশি মিডিয়ার দায়িত্বের বিষয়টিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবেই দেখতে হবে। আবার মিডিয়ার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে এর অ্যাক্টরদের সকলের ভূমিকা রয়েছে। মিডিয়া সামাজিক বিকাশের ধারায় রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মানসিক সংস্কারে বড়ো ধরনের মাধ্যম। সামাজিক অগ্রগতির অন্যতম নিয়ামক হতে হলে বাণিজ্যের পাশাপাশি এই দিকটাকে অবহেলা করা যাবে না, করা হলে ঐতিহ্য হিসেবে পাওয়া শ্রদ্ধা তাকে হারাতে হবে। এখন মিডিয়া মোগলরাই সিদ্ধান্ত নেবেন তারা সমাজে শ্রদ্ধার পাত্র থাকবেন না কেবল বিত্তের সন্ধানেই ছুটতে থাকবেন নিরন্তর। সাংবাদিকদের দায়িত্বের প্রসঙ্গটি তাই সাংবাদিকদের বৃহত্তর আঙ্গিকে স্মরণে রাখতে হবে।
সাংবাদিক ইউনিয়নের অনৈক্য গণমাধ্যমের সংকট আরো দীর্ঘস্থায়ী করছে। ১৯৯০ এর ২৭ নবেম্বর কয়েক ঘণ্টার আলোচনায় জাতীয় ঘটনার প্রেক্ষাপটে সর্বাত্মক ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেয়া গেলেও এখন বেতন ভাতা না পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সর্বাত্মক কোনো কর্মসূচিই নেয়া হচ্ছে না। সারা দেশে জাতীয় ইস্যুতেও সার্বিক ঐকমত্য ঘটছে না। চলছে অনৈক্যর এক বিধ্বংসী সংস্কৃতি। মনে করা হচ্ছে “Concious judgement is absent among the journalists.”
মানুষের অনৈক্যের এই বিশাল রাজ্যে সাংবাদিক আসলে পুরো সত্য উপস্থাপন করতে পারেন না। তিনি সত্যের নিকটবর্তী হওয়ার সর্বাধিক প্রচেষ্টা উপস্থাপন করেন অর্থাৎ রিপোর্টটি নির্ভুল, সম্পূর্ণ এবং পক্ষপাতহীন করতে চান। রিপোর্টার চেষ্টা করেন তার স্টোরি যতটা সম্ভব নির্ভুল ও পূর্ণ করতে এবং পক্ষপাতহীন হওয়ার জন্য সংগ্রাম করেন যাতে প্রতিটি ইস্যুর বিভিন্ন দিক তুলে ধরা সম্ভব হয়। কিন্তু পেশাজীবী সাংবাদিকের এই প্রচেষ্টা রাজনৈতিক দল সমর্থক বা ব্যবসায়িক মুনাফা লাভে আগ্রহী সংবাদপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের হস্তক্ষেপে সফল হতে পারে না।
দৃশ্যকল্প
প্রথম দৃশ্য ১৯৬৯ : চায়ের দোকানে বসে একজন খবর পড়ছেন আর শুনছেন অন্যরা। প্রকাশিত সংবাদ নিয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই।
দ্বিতীয় দৃশ্য ১৯৮৭ : পত্রিকার খবরে উদ্দীপ্ত পাঠক। তারা স্বৈরাচারের পতন চান।
তৃতীয় দৃশ্য : ১৯৯৭ : সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি খবর নিয়ে দুই ব্যক্তির বাদানুবাদ, একজন বলছেন খবরটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে তাই অবশ্যই সত্য। অন্যজন বলছেন তিনি বিষয়টি জানেন, সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরটি সঠিক নয়।
চতুর্থ দৃশ্য ২০১২ : একটি জটলায় অধিকাংশ পাঠক বলছেন “পত্রিকায় ওরকম লেখে। সাংবাদিকদের পয়সা দিলে নিজের মতো করে লেখানো যায়। টিভিও তাই” -জটলার মন্তব্য।
চতুর্থ দৃশ্যের ঢালাও মন্তব্য গ্রহণযোগ্য না হলেও চারটি দৃশ্যের বিশ্লেষণ করলে বুঝতে হবে মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতায় ক্রমশ চিড় ধরছে।
পাঠক-দর্শক খবরের জন্য আগ্রহী কিন্তু খবরগুলো ঐ ১৯৬৯ বা ১৯৮৭’র মতো একবাক্যে তারা গ্রহণ করছেন না। মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতার এই সংকটই এখন প্রধান একটি চ্যালেঞ্জ সাংবাদিকদের জন্য।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads