মঙ্গলবার, ৯ জুলাই, ২০১৩

জবাব দিচ্ছে জনগণ


জনমতকে অবজ্ঞা করলে জনগণও প্রত্যাখ্যান করবে। গাজীপুর সিটি নির্বাচন সেটাই আবার প্রমাণ করল। পাঁচটি সিটিতেই সরকারপন্থীদের শোচনীয় পরাজয় সরকারের প্রতি জনতার চরম অনাস্থা প্রকাশ পেয়েছে। সিটি নির্বাচনে এই ফলাফল দেশব্যাপী সরকারি দলের নেতাকর্মীদের চরম হতাশায় ডুবিয়ে দিয়েছে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী মতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের জনপ্রিয়তা কেন এত বেশি কমে গেল। এই আত্মসমালোচনা দলটির জন্য যেমন প্রয়োজন একইসাথে প্রয়োজন জাতি হিসেবে আমাদের। এখান থেকে ভবিষ্যৎ জাতির কর্ণধারদের শিক্ষা নিতে হবে। মতাসীন হওয়ার পর থেকেই আওয়ামী লীগের নেতারা জনমতকে অবজ্ঞা করা শুরু করে। যেসব কাজে জনমতের কোনো প্রতিফলন নেই, সেসব কাজেই আওয়ামী সরকার বরাবরই ব্যস্ত থেকেছে। যেসব কাজ এ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চিন্তা চেতনা এবং সংস্কৃতির বিরোধী, সেসব কাজেই সরকার সব সময় পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। ফলে শুরু থেকেই জনমত সরকারের বিরুদ্ধে চলে যেতে থাকে, যা সময়ের সাথে অব্যাহত থেকেছে। মতা গ্রহণের পর থেকেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের কর্মকাণ্ড ছিল বিতর্কিত এবং জনস্বার্থবিরোধী। আওয়ামী লীগের মতা গ্রহণের পরের মাসেই অর্থাৎ ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্র“য়ারি দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক ও দুঃখজনক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। বিডিআর জোয়ানেরা বিদ্রোহের নামে সেদিন পিলখানায় আমাদের গৌরবোজ্জ্বল সেনাবাহিনীর ৫৭ জন সেনাকর্মকর্তাসহ মোট ৭৫ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। একটি দিনে একটি দেশের সেনাবাহিনীর এত অফিসারের প্রাণহানির ঘটনা এই প্রথম। এমনকি স্বাধীনতা যুদ্ধের ৯ মাসে মোট ৫৫ জন সেনাকর্মকর্তা নিহত হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের মতা গ্রহণের পরপরই কেন এত বড় একটা হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলো তা আজো জনগণের মনে প্রশ্ন সৃষ্টি করে। এ েেত্র আওয়ামী লীগের ভূমিকা বরাবরই জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ মনে হয়েছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন যেন এ সরকারের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায়। এর সাথে ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের সঙ্ঘবদ্ধ সন্ত্রাস সারা দেশে ত্রাস সৃষ্টি করে। ছাত্রলীগ ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রদল ও শিবিরকে বিতাড়িত করে। শুরু হয় ছাত্রলীগের বেপরোয়া সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি। ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে শুধু ছাত্রশিবির ও ছাত্রদলের কর্মীরা হতাহত হয়নি, ছাত্রলীগের কর্মীরাও হতাহত হয়েছে। ছাত্রলীগের লাগামহীন এই সন্ত্রাস তরুণ সমাজকে আওয়ামী লীগ বিমুখ করেছে। কোনো প্রতিষ্ঠানের টেন্ডার সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে এ রকম নজির খুঁজে বের করা কঠিন। জনগণ এসব পেশিশক্তির কর্মকাণ্ড ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং প্রশাসনের সর্বেেত্র লাগামহীন দুর্নীতি সাধারণ মানুষ অসহায়ের মতো চেয়ে চেয়ে দেখেছে। যারাই এসবের বিরুদ্ধে একটু প্রতিবাদী হওয়ার চেষ্টা করেছে তারাই নির্মম পুলিশি সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে। এ ছাড়া গুম আর খুন ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। নিয়োগ, পোস্টিং ও পদোন্নতির েেত্র সরকার করেছে চরম দলীয়করণ। ঘরে ঘরে চাকরির বদলে তরুণেরা দেখেছে কিভাবে যোগ্যতা ও মেধাকে এ সরকার পদদলিত করেছে। শেয়ারবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। অন্য দিকে লাখো মানুষ নিঃস্ব হয়েছে। অথচ সরকার তাদের জন্য কিছুই করেনি বরং নিঃস্ব মানুষগুলোকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছে, করেছে তুচ্ছতাচ্ছিল্য। এ সরকারের আমলে প্রথম মানুষ প্রত্যক্ষ করল সরকারি ব্যাংক লুটপাট। অবাক হওয়ার মতো ঘটনা হলমার্ক। লুট হয়েছে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা। ডেসটিনি ও ইউনিপে টু ইউসহ অসংখ্য এমএলএম কোম্পানি মানুষের সর্বনাশ করেছে। পদ্মা সেতু নিয়ে সরকার দুর্নীতি করতে পারে, জনগণ এটা ভাবতেও পারেনি। তত্ত্ব¡াবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা এটা কেউ ভাবতে পারি। সরকার এটি বাতিল করে ক্ষান্ত হয়নি বরং এই অযাচিত সিদ্ধান্তের প্রতি সারা দেশের মানুষের বিপক্ষে গিয়ে একরোখা অবস্থান নিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্যই আওয়ামী লীগ এক সময় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আন্দোলন করেছে, জ্বালাও পোড়াও করেছে। হরতালের সর্বনাশা যে সংস্কৃতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তা আওয়ামী লীগই চালু করেছিল। এ ধরনের দ্বিমুখী নীতি দলটির নেতাকর্মীরা সমর্থন করতে পারছে না। গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সরকারের বাড়াবাড়ি এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্মানিত ড. ইউনূসকে হেনস্তা করাটা জনগণের মনে আঘাত করেছে। জনগণের ম্যান্ডেট না নিয়েও ধর্মনিরপেতা প্রতিষ্ঠার জন্য সরকার করেছে অতি বাড়াবাড়ি। সংবিধান থেকে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস বাদ দেয়া এ দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা মেনে নিতে পারেনি। পাশাপাশি ইসলামপ্রিয় মানুষদের কথায় কথায় জঙ্গি বলে গালি দেয়া আর ইসলামের অপরিহার্য বিধান জিহাদকে নিয়ে কটা করাও সাধারণ মুসলমানেরা মেনে নেয়নি। বাংলাদেশের জন্য বিন্দুমাত্র উপকার না হলেও ভারতকে ট্রানজিটের নামে করিডোর প্রদানের জন্য অতিমাত্রায় আগ্রহ দেশপ্রেমিক মানুষকে ুব্ধ করে তুলেছে। অন্য দিকে ভারত থেকে সরকার কিছু আদায় করতে পারেনি। বিএসএফ কর্তৃক নিরীহ বাংলাদেশী হত্যা যেমন বন্ধ করতে পারেনি, ঠিক তেমনই তিস্তার পানি চুক্তিও করতে পারেনি। আবার টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণও বন্ধ করতে পারেনি। যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে বাড়াবাড়ি সরকারের জন্য বুমেরাং হয়েছে। ’৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের জন্য স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেখানে এসব ব্যক্তির কোনো বিচার করেননি, কোনো শাস্তি দেননি, সেখানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য স্বাধীনতার ৪০ বছর পর বঙ্গবন্ধু কন্যা ও আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কেন এত আগ্রহ তা জনমনে প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে। স্বাধীনতার পর পর যুদ্ধাপরাধের দায়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ১৯৫ জন সেনাকর্মকর্তাকে আটক করা হয়। কিন্তু ১৯৭২ সালের ৩ জুলাই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পাদিত সিমলা চুক্তি অনুযায়ী তাদের মুক্তি দেয়া হয়। সরকারের বিচার প্রক্রিয়া যে পুরোটাই রাজনৈতিক তা বুঝতে আজ জনগণের বাকি নেই। স্কাইপ সংলাপ ফাঁস হওয়া, ট্রাইব্যুনালের গেট থেকে সাঈদীর সাী সুখরঞ্জন বালীর অপহৃত হওয়া এবং পরে ভারতের কারগারে তার বন্দী থাকার খবর প্রকাশ এই বিচারকে মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশের বাড়াবাড়িতে জনগণ ছিল ভীতসন্ত্রস্ত। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নামে কথায় কথায় মামলা, গ্রেফতার ও রিমান্ড ছিল একটা মামুলি ব্যাপার। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মিটিংকে গোপন বৈঠক ও নাশকতার পরিকল্পনা বলে অভিহিত করে তাদেরকে গ্রেফতারে পুলিশ ছিল অতিমাত্রায় দ। কিন্তু সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যাকারীকে পুলিশ এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি। পাশাপাশি গুম হওয়া বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবির নেতা মোসাদ্দেক ও ওয়ালী উল্লাহকে পুলিশ এখনো উদ্ধার করতে পারেনি। বিরোধী দলের সভা সমাবেশের ওপর বরাবরই অলিখিত নিষেধাজ্ঞা ছিল। এক মাসের জন্য সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করাটা ছিল অতিমাত্রায় বাড়াবাড়ি। ভিন্ন মতের মিডিয়া দমনে সরকার নির্লজ্জ আচরণ করেছে। চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করা, কোনো ধরনের কারণ দর্শানো ছাড়াই দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি থেকে প্রয়োজনীয় মালামাল নিয়ে যাওয়া এবং চ্যানেল দু’টি বন্ধ করা, দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার এবং পত্রিকাটির ছাপাখানা বন্ধ করে দিয়ে পত্রিকা ছাপানো বন্ধ করে দলটি আবারো প্রমাণ করেছে তারা গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা রাখে না। গণজাগরণ মঞ্চকে দিনের পর দিন পুলিশ সহায়তা দিলেও হেফাজত ইসলামের সমাবেশের ওপর পুলিশ রাতের আঁধারে চালিয়েছে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ। দিন রাত রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে শাহবাগের মোড়ে জাগরণ মঞ্চকে সমাবেশ করতে দিয়েছে এবং আল্লাহ, রাসূল, কুরআন হাদিসের অবজ্ঞাকারী নাস্তিকদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। আর ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য অন্দোলনরত নিরস্ত্র আলেম-ওলামাদের প্রতি চালিয়েছে গুলি। নাস্তিকদের কর্মকাণ্ডকে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বাকস্বাধীনতা বললেও, হেফাজতের দাবিগুলোকে বলেছে মধ্যযুগীয় বর্বরতা। মিয়ানমারের অসহায় মুসলমানেরা জীবন বাঁচানোর তাগিদে বাংলাদেশে আশ্রয় চাইলেও তাদেরকে আশ্রয় দেয়া হয়নি বরং মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে। মিয়ানমারের নির্যাতিত এবং অসহায় মুসলমানদের প্রতি সরকারের এ ধরনের অমানবিক আচরণ এ দেশের মানুষ মেনে নিতে পারেনি।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads