বৃহস্পতিবার, ২৫ জুলাই, ২০১৩

রাজনীতি নিয়ে নাটক


নাটক প্রেম, ট্র্যাজিডি, হাস্যরস নিয়েই বেশি হয়। কিন্তু এখন হচ্ছে রাজনীতি নিয়ে। প্রতিপক্ষ হননের জন্য। দুঃখের বিষয়, এই রাজনীতি হচ্ছে বাস্তবের ময়দানে। কাউকে নিধন, নির্মূল বা ফাঁসিতে ঝুলানোর জন্য যখন একপাশে রাজনীতি আর অন্যপাশে ক্ষমতার খেলা চলতে থাকে তখনই আঁচ পাওয়া যায় নাটকের; দেখতে পাওয়া যায় পুরো রাজনৈতিক নাট্যমঞ্চটির। যদিও নাটক শব্দটির মধ্যেই মিশে আছে নাটকীয়তার রেশ। কিন্তু এখন রাজনীতির মাঠ-ময়দানও নাটকের উত্তেজক মঞ্চের চেয়েও বেশি টগবগে হয়ে গেছে। মানুষ এখন হিংসা ও প্রতিপক্ষ হননের রাজনৈতিক নাট্যকলা দেখতে দেখতে আতঙ্কিত, শিহরিত এবং ভীত-সন্ত্রস্ত। ন্যায়-নীতি বা আদর্শ নয়, ক্ষমতা অর্জন আর হিংসার প্রসারই যখন একমাত্র লক্ষ্য, তখন রাজনীতি নিয়ে নাটক হচ্ছে নাকি নাটক নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে সেটা অনুধাবন করা যায়। চারদিকে এখন এমনই বিভ্রান্তি ও কালো পর্দা।
নাটক এক মহান শিল্পও বটে। শিল্প-সাহিত্যের ঘরানায় নাটক অন্যতম। নাটকের ভক্ত নয়, এমন মানুষ পাওয়া ভার। নাট্যকাররাও তাই নানা রকমের নাটুকে উপাচারে দর্শক চিত্ত জয় করতে মরিয়া। নাটকের মধ্যে এমনই এক অতি নাটকীয় প্রকরণ ‘রাজনৈতিক নাটক’। মানুষ যখন প্রেম, বিরহ, রূপকথা ইত্যাদি দেখতে দেখতে ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে যায়, তখন ভীষণভাবে বাজার দখল করে ‘রাজনৈতিক নাটক’। রাজনৈতিক নাটকের মাধ্যমে দর্শকের স্নায়ু উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এমনিতেই রাজনীতি একটি উত্তেজক বিষয় পৃথিবীর নানা দেশে। তার সঙ্গে যখন শিহরণ-জাগানো নাটক এসে যুক্ত হয়, তখন উত্তেজনার শেষ থাকে না। অতএব রাজনৈতিক নাটক, কি মঞ্চে, কি বাস্তবে, আসলেই এক ভয়ানক উত্তেজক ব্যাপার। 
‘রাজনৈতিক নাটক’ দেখা যায় দুই ভাবে: বাস্তবের ঘটমান-চলমান বিষয়াবলিতে এবং মঞ্চে। বাস্তবে রাজনীতির নাটক দেখার জন্য মঞ্চ নয়, চোখ রাখতে হয় মিডিয়ায়। সংবাদপত্রের পাতায় প্রতিদিনই সেসব ছাপা হচ্ছে। অনেক কিছু আবার ছাপাও হয় না। উৎসাহী পাঠককে আঁচ করতে হয়; কিংবা আকারে-ইঙ্গিতে বুঝে নিতে হয়।
মাঠের রাজনীতির নাটকীয়তার ছায়া দেখা যায় মঞ্চেও। বাস্তব জীবনের রাজনীতির মাঠ-ময়দানে প্রতিনিয়ত নানা নাটক-প্রহসনকে নাটকের ‘পলিটিক্যাল থিয়েটার’ বা ‘রাজনৈতিক নাট্য’ হিসাবে বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে উদ্ভাবন করেন জার্মান পরিচালক এরভিন পিসকাটর, যাকে বলা হয় আধুনিক নাট্যগুরু বের্টোল্ট ব্রেশট-এর পূর্বসূরী। রাজনৈতিক নাট্যধারায় পিসকাটর, গাসবারা, লানিয়া ও ব্রেশট মিলে নাট্যরূপ দেন লেভ তলস্তয়েরর কালজয়ী ‘রাসপুটিন’। রাসপুটিন নাটকটি ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক প্রামাণ্য দলিলের মতো। মঞ্চজুড়ে এক বিশাল গ্লোব, সেটা ঘুরে যাচ্ছে আর তার একেকটি দেয়াল খুলে গিয়ে ভেতরে দৃশ্যমান হচ্ছে নানা মঞ্চ স্থাপত্য; স্বৈরাচারী রুশ জারের প্রাসাদের নানা কক্ষ, রাজনৈতিক দলের দপ্তর, সম্রাজ্ঞীর শয়নকক্ষ, জার্মান শাসক কাইজারের কার্যালয়। গ্লোবটি যখন স্থির, তখন অভিনয় হচ্ছে তার চূড়ায়। দাম্ভিক জার দাঁড়িয়ে পৃথিবীকে পায়ের তলায় চেপে; কিন্তু জার জানে না, তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে বহুগুণ বৃহৎ রাসপুটিনের ছায়া। নাটকের শুরু চলচ্চিত্রে জারদের ইতিবৃত্ত দেখিয়ে। প্রায় প্রত্যেক জারের ছবি দেখিয়েই সংক্ষেপে লিখা: ‘অপঘাতে মৃত্যু’ বা ‘আততায়ীর হাতে নিহত’। মঞ্চে দেখানো হয় জার এবং জারিনা নিভৃতে আলাপরত ‘কী করে ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করা যায়’ সে বিষয় নিয়ে। কিন্তু জারতন্ত্রের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার স্বপ্ন আর বাস্তবে রূপ লাভ করতে পারে না। দৃশ্যে তারপরেই দেখা যায় জনতার হাতে সপরিবারে জারের নিধনযজ্ঞ। পিসকাটর মনে করতেন, যুগের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করাই রাজনৈতিক নাট্যের ঐতিহাসিক দায়িত্ব। তিনি রাসপুটিন নাটকের আঙিক রচনা করেছিলেন সেন্ট পিটার্সবুর্গের ফরাসি রাষ্ট্রদূত মরি পাইলের স্মৃতিকথা পাঠ করে। পিসকাটরের বিরুদ্ধে কাইজার একটি আইনি অভিযোগ এনেছিলেন, যে অভিযোগে বলা হয়Ñপিসকাটর মঞ্চে কাইজারের মুখ দিয়ে যেসব সংলাপ বলিয়েছেন তার সবই বাস্তব জীবনে কাইজার উচ্চারণ করেছেন। বেশ হাঙ্গামা বেঁধেছিল নাটকের অভিনয় নিয়ে। নাটকে জার্মান কাইজারের যতো সংলাপ ছিল, আদালত তা এক আদেশ জারি করে নাটক থেকে বাদ দিতে বলে। পিসকাটর নাটক বন্ধ করলেন না। নাটক ঠিকই চললো। শুধু কাইজারের দৃশ্য ও সংলাপ এলেই নাট্যসহকারী লিও লানিয়া মঞ্চে প্রবেশ করে কাইজারের সংলাপের পরিবর্তে আদালতের আদেশটা গুরুগম্ভীর কণ্ঠে পাঠ করে শোনাতেন। দর্শক হেসে খুন হতো। সরকারি আদেশকে বানচাল করে এবং সেন্সরশিপ ও বাক-স্বাধীনতা নস্যাতকে কাচকলা দেখিয়ে এভাবেই দর্শকদের রাজনৈতিক বাস্তবতায় পৌঁছে দেয়া হয়; উন্মোচন করা হয় স্বৈরশাসক রাশিয়ার জার, জার্মান কাইজার এবং বীভৎস রাসপুটিনকে।
কাইজার, জার ও রাসপুটি রাজনীতির ইতিহাসে তিনটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে কাইজার জার্মানীর শাসক ছিলেন। জার হলো রাশিয়ার সমাজতন্ত্র পূর্বেকার শাসকের পদবি। আমাদের দেশে যেমন রাজা, রাশিয়ায় হলো জার। জারের স্ত্রীকে বা রানীকে বলা হতো জারিনা। আর রাসপুটিন হলো ইতিহাসের এক স্বৈরতান্ত্রিক-কুখ্যাত চরিত্র।  গ্রেগরি এফিসোভিচ রাসপুটিন (১৮৭১-১৯১৬) রুশ বিকৃতমনা ব্যক্তি। ১৯০৫ সালে রাশিয়ার রাজকুমার সারেভিচ অ্যালেক্সি (১৯০৪-১৮) কঠিন রোগাক্রান্ত হলে রাসপুটিন সম্মোহনের মাধ্যমে তাকে সারিয়ে  জার ও জারিনার ওপর প্রভার বিস্তারে সক্ষম হয়। ব্যক্তিগত জীবনে রাসপুটিন অত্যন্ত জঘন্য চরিত্রের বদরাগী, বিকৃতকাম ও দুশ্চরিত্র সম্পন্ন হলেও জার ও জারিনার ওপর তার প্রভাব এতোটাই বৃদ্ধি পায় যে, তখন বিভিন্ন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং চার্চ ও রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন পদসমূহে নিয়োগও নির্ধারিত হতো রাসপুটিনের ইচ্ছা ও নির্দেশে। মদ্যপ রাসপুটিনের যৌন যথেচ্ছাচার রুশ সমাজে তাকে কলঙ্কিত ব্যক্তিত্বে পরিণত করে। ১৯১৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর রাজপুত্র ইউগুপোভ তাকে তীব্র আর্সেনিক বিষ-মিশ্রিত কেক খাইয়ে দিলেও তার মৃত্যু হয়নি। পরে তাকে গুলী করে নদীতে ফেলে দেয়া হয়। এখনও রাষ্ট্র, সরকার ও জনগণের ওপর অনভিপ্রেত স্বৈর-অনাচার  সৃষ্টিকারীদের ‘রাসপুটিন’ বলে অভিহিত করা হয়। রাজপুটিন বিশ্বব্যাপী অগণতান্ত্রিক-স্বৈরতন্ত্রের ঐতিহাসিক প্রতীকে পরিণত হয়।
হিটলার, জার, রাসপুটিন ইত্যাদি বিশ্বনিন্দিত স্বৈরচরিত্র বাস্তব থেকে মিটে গেলেও ইতিহাসের পাতায়, নাটকের মঞ্চে এখনও রয়ে গেছে। বিশ্বের যেখানেই স্বৈরশাসনের প্রেতাত্মারা আনাগোনা করে, সেখানেই তখন মানুষ ভয়ে-আতঙ্কে স্মরণ করে এই ঘৃণিত ত্রয়ীকেÑহিটলার, জার ও রাসপুটিনকে। শিল্পী ও নাট্যকারগণ তখন বাস্তবের স্বৈরতান্ত্রিকতাকে নিয়ে নাটকের অবতারনা করে। উপমহাদেশে এমন ধারা ক্ষীণভাবে চললেও ইউরোপ ও পশ্চিমা জগতের রাজনৈতিক নাটকের বাজার খুবই ভালো। শেক্সপিয়ারের বিশ্ববিশ্রুত নাটকগুলো তো রাজনৈতিক উপাদানে ঠাসা। এখনও সেসব দেশে সমকালীন রাজনৈতিক বিষয়ে একের পর এক নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে। স্বৈরাচারের মতোই পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদকে আঘাত করা হচ্ছে নাটকের বাতাবরণে।
সেই তুলনায় এখানে রাজনৈতিক নাটক কম কেনÑসেটা অবশ্য নাট্য বিশ্লেষকগণ গবেষণা করে দেখতে পারেন। একটি কারণ সম্ভবত এই যে, মানুষ প্রতিনিয়ত বাস্তবের মাঠে এতসব নাটকীয় ঘটনা দেথছে যে, মঞ্চে গিয়ে নতুন করে আর পয়সা খরচ করে নাটক দেখার দরকার পড়ে না। এখানে একেকটি ঘটনা বা দুর্ঘটনা বা চাঞ্চল্যকর ইস্যু এতোই দ্বন্দ্ব-সংঘাতে পরিপূর্ণ, যে নাটকও ততটা সাসপেন্স তৈরি করতে পারবে না। নাটকের আরেক বড় গুণ হলো ডায়ালগ বা সংলাপ। কর্তা ব্যক্তি আর রাজনীতি-সংশ্লিষ্টদের মুখ দিয়ে যেসব মহান সংলাপ বের হচ্ছে, তা বিশ্বের সেরা নাট্যকারও রচনা করতে পারবেন না। হাস্য-কৌতুক-রহস্য-রোমাঞ্চ-নাটকীয়তায় টুইটুম্বুর বাস্তবের রাজনীতির কাছে বরং রাজনৈতিক ঘটনার ছায়াবলম্বনে রচিত নাটক অসহায়। অতএব এখানে এর চাহিদাও কম। দুধই যেখানে সুলভে বিকাচ্ছে, সেখানে ঘোলের দরকার কি!
সাম্প্রতিক এই পরিস্থিতির একটি সুন্দর নাম পাওয়া গেছে: ‘রগচটা রাজনীতি’। একটি দৈনিক পত্রিকায় একজন লেখক লিখছেন: “রগচটা মানুষ থেকে বাঁচা সম্ভব হলেও রগচটা প্রতিষ্ঠান অথবা পদ্ধতি থেকে বাঁচাটা সহজ নয়। যেমন, আমাদের রগচটা রাজনীতি। গণতান্ত্রিক সমাজে রাজনীতির বিকল্প নেই, কিন্তু সেই রাজনীতি রগচটা হলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটাই বিকল হতে বসে।’
কথাটা খুবই সত্যি। বাস্তবের এই কঠিন পরিস্থিতিতে আর যাই হোক, নাটক চলে না। কারণ, বাস্তব যখন নাটকের চেয়েও সত্য হয় তখন সেই সত্যের মর্মস্পর্শী বাস্তবতায় বিপন্ন মানুষই হয়ে যায় নাটকের বাস্তব উপাদান। সে আর নাটক দেখবে কি! প্রাণ বাঁচাতেই দিশেহারা।
যারা রাজনৈতিক নাটকের উৎপত্তি করেছিলেন, তারা পেয়েছিলেন হিটলার-জার-রাসপুটিন ইত্যাদি মুষ্টিমেয় খল-চরিত্র। আর এখন কাদের পাওয়া যাচ্ছে? উত্তর জানা থাকলেও মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
রাজনৈতিক নাটকে নানা ঘটনা সাজাতে হয়, বানাতে হয়। আর এখন কিসব দেখা যাচ্ছে? উত্তর জানা থাকলেও মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
সবই যদি নিষ্প্রয়োজন হয়, তাহলে প্রয়োজন তবে কিসের? এখন বাস্তবিক পক্ষে যা প্রয়োজন, তা হলো, যা চলছে, তা দেখে উপলব্ধি করা। রাজনীতিতে উপলব্ধিরও একটি মূল্য আছে বৈকি! আজকের উপলব্ধিই তো আগামীকালকে কাজে লাগবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads