বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০১৩

সরকারের শেষবেলার খেলা


রমজানের মধ্যেই দেশকে রক্তাক্ত সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দিয়েছে জনরোষে টলটলায়মান মতাসীন সরকার। পরপর পাঁচটি নগর করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে একরকম সরাসরি মতাসীন জোটের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ১৮ দলীয় জোটের প্রার্থীর বিপুল বিজয়ের প্রতিঘাত হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সংঘর্ষের পালা শুরু করেছেন। এর আগেও তিনটি বড় নগর করপোরেশন নির্বাচনে বিদ্রোহী আওয়ামী লীগ বা বিদ্রোহী বিএনপি (ওই তিন নির্বাচনে দলীয়ভাবে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশগ্রহণে বিরত থেকেছে) তথা অবাধ্য বা বিবাদি প্রার্থীদের কাছে শেখ হাসিনার প্রার্থীদের পরাজয় ঘটেছিল। তাতে প্রধানমন্ত্রী তেমন বিব্রতবোধ করেননি, কারণ সেসব স্থানীয় সরকার নির্বাচনে একটা নির্দলীয় চরিত্রের রাখঢাক ছিল। তা ছাড়া বিদ্রোহী আওয়ামী মেয়রদের দলীয় আনুগত্যে প্রত্যাবর্তনের অঙ্গীকারও তিনি পেয়েছিলেন। তবু বিদ্রোহী বিএনপি মেয়রসহ বিদ্রোহী আওয়ামী মেয়রদের প্রাপ্য প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা তিনি শাস্তিস্বরূপ এখনো জব্দ করে রেখেছেন। তাদের সমুচিত বেতন আটকে আছে। সাম্প্রতিক পাঁচ নগর করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে মনোনয়ন হয়েছে খোলাখুলিভাবেই দলীয় এবং জোটভিত্তিক। দলীয় বা জোটের বিদ্রোহী প্রার্থীদের বসিয়ে দেয়া হয়েছে কিংবা দলচ্যুত ঘোষণা করা হয়েছে। মুখোমুখি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে মহাজোট প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিরোধী ১৮ দলীয় জোট প্রার্থীর। প্রচারে অংশ নিয়েছেন দুই পরেই ডাকসাঁইটে নেতারা আর মন্ত্রী-এমপিরা। ভোটও হয়েছে সেই মাপেই। স্বতন্ত্র বা অন্য দলীয় প্রার্থীরা ভোটের পাত্তা পায়নি। তাই পর্যবেকেরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে মতাসীন মহাজোট সরকারকে নাগরিকেরা পাঁচ বড় শহরের ভোটের মাধ্যমে চরম অনাস্থার নোটিশ দিয়েছে, যাকে মহাজোটভুক্ত কোনো কোনো নেতা বলছেন ‘হুঁশিয়ারির দশ নম্বর সিগনাল’, আওয়ামী লীগ নেতারাই কেউ কেউ বলছেন ‘অশনি সঙ্কেত’, বিরোধী জোটভুক্ত কোনো কোনো নেতা বলছেন সরকারকে ‘হলুদ কার্ড’ দেখানো হয়েছে, খোদ সংসদীয় বিরোধী দল নেতা খালেদা জিয়া বলেছেন, শেখ হাসিনাকে ‘লালকার্ড’ দেখিয়েছে দেশবাসী। গত ১৫ জুন চার নগর করপোরেশন মেয়র নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অতি অনুগত প্রশাসনের অধীনেই শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে মতাসীন জোট সমর্থিত সব প্রার্থীর, যারা চারজনই ছিলেন নগর উন্নয়নে সার্থকতার দাবিদার গদিনশিন মেয়র। লোকে বলেছে, ওই গদিনশিন মেয়রদের বিরুদ্ধে তারা ভোটের রায় দেয়নি। রায় দিয়েছে শেখ হাসিনার সরকার ও তার জোট নেতাদের বিরুদ্ধে, যারা ইসলামকে কুৎসা আর উপহাসের বস্তু সাব্যস্ত করতে তথাকথিত ‘ধর্মনিরপে’ সামাজিক যোগাযোগসিদ্ধ ব্লগার প্রজন্মকে উৎসাহিত করেছে। প্রতিক্রিয়ায় অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হেফাজতে ইসলামের ডাকে পুলিশের বাধা উপো করে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ লোক সারা দেশে শান্তিপূর্ণ বিােভ সমাবেশ করেছে; কোথাও কোথাও পুলিশ এবং যুবলীগ ছাত্রলীগের গুণ্ডাদের সাথে সংঘর্ষ রক্তপাত খুনজখম ঘটেছে। তার জেরে উল্টো অজ্ঞাত হাজার হাজার বিােভকারীর বিরুদ্ধে নাম না জানা দাঙ্গাদলের মামলা বা গ্যাংকেস হয়েছে, সেসব মামলায় জড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে চলছে পুলিশের দেদার গ্রেফতারবাণিজ্য। গ্রেফতারের ভয়ে গ্রামে বা মফস্বল শহরে এখনো নিজবাড়িতে থাকছে না অনেক নিরীহ নামাজি ছাত্র শিক সম্পন্ন গৃহস্থ। অনেক মাদরাসা খালি হয়ে গেছে। এসব উপো করে ৫ মে এক রকম হেঁটে (সরকার ট্রেন-বাস-সিএনজিসহ সব রকম আন্তঃজেলা যানবাহন বন্ধ করে দিয়েছিল ওইদিন আগের রাত থেকে) ঢাকায় সড়কপথের সব পয়েন্ট অবরোধ করেছিল মফস্বল থেকে আসা লাখ লাখ হেফাজত নেতাকর্মী অনুসারী মাদরাসা শিক ও ছাত্ররা, যারা ভালোভাবে ঢাকার রাস্তাঘাট চেনে না। তাদের একাংশ সমবেত হয়েছিল পুলিশের অনুমতি নিয়েই ঢাকা শহরের মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার শাপলা চত্বরে তাদের শীর্ষ নেতার বক্তব্য শুনতে। সেই শীর্ষ নেতা আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে সেদিন শাপলা চত্বরে আসতে না দেয়ায় রাতে সমবেত হেফাজত নেতাকর্মীরা অবস্থান ধর্মঘট করেছিল। নিরস্ত্র সেই ঘুমন্ত বা জিকিরে নিবিষ্ট হেফাজত নেতাকর্মীদের মধ্যরাতে এলাকার বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে যুগপৎ টিয়ারগ্যাস ব্যাটন আর গোলাগুলির আক্রমণে দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য করেছিল হাসিনা সরকারের পুলিশ, র‌্যাব আর বিজিবির একটা যৌথ বাহিনী। সেই ‘গণহত্যায়’ মৃত বা গুম হওয়া বহু মানুষের সঠিক সংখ্যা এখনো জানা যায়নি, আরো অনেকে গ্রেফতারের ভয়ে পালিয়ে আছেন। নগর করপোরেশনগুলোর ভোট সরকারের জন্য আরো প্রতিকূল হয়েছে পোশাক শিল্পের নারীশ্রমিকদের কারণে। তারা মালিকদের চেয়েও বেশি আস্থা হরিয়েছে সরকারের ওপর আর ক্রুদ্ধ হয়েছে ঘৃণিত শিল্পপুলিশ ও সরকারি দলের চাঁদাবাজ গুণ্ডাদের ওপর, যারা নানাভাবে ওই নারীশ্রমিকদের উত্ত্যক্ত করেছে, সামান্য আয়ে ভাগ বসিয়েছে, শ্রমবিরোধে মালিকের প নিয়ে মারধর, ধরপাকড় করেছে। ফলে অনেক পোশাক শিল্পে নির্বাচনের আগে শ্রমিকদের তোষণের জন্য আগাম বোনাস পাইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েও তাদের ভোট পায়নি সরকারপ। ওইসব নগরের গ্রামীণ ব্যাংক সদস্যরাও ভোট দিয়েছে সরকারের বিপ,ে কারণ এ সরকার গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক-সদস্যদের স্বত্ব অপহরণ ও ব্যাংকটি ভেঙে কয়েক টুকরো করার উদ্যোগ নিয়েছে। একইভাবে সরকারি দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে সরকারের খয়ের খাঁ চক্রের কারসাজিতে শেয়ারমার্কেট ধসের শিকার হাজার হাজার পরিবার। সরকারি দলের পোষ্য গুণ্ডা চাঁদাবাজ কমিশনখোর আর ছাত্রলীগ যুবলীগ স্বেচ্ছাসেবক লীগের উৎপাতে অস্থির সাধারণ মানুষ ভোট দেয়নি সরকারি প্রার্থীকে; ভোট দেয়নি যারা মূল্যস্ফীতির পীড়নে চোখে সর্ষেফুল দেখছে, যার অন্যতম কারণ সরকারি দলের পথে-ঘাটে-হাটে বেপরোয়া চাঁদাবাজি আর সিন্ডিকেটবাজি, টেন্ডারবাজি। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় অপরাধমণ্ডলের বিস্তার আর পুলিশের অত্যাচার নাগরিকের নিরাপত্তাহীনতাকে যে দুঃসহ পর্যায়ে নিয়ে গেছে, সেটাও সরকারদলীয় প্রার্থীদের ‘ভরাডুবি’র কারণ বৈকি। সর্বজনবিদিত ভোটের এসব হিসাব আমলে নিচ্ছেন না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। লন্ডনে বসে গাজীপুর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় দুর্গে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও অভাবিত পরাজয়ের খবর পেয়ে দমেননি প্রধানমন্ত্রী। বিরোধী দলের অনেকের মতে, অনুগত প্রশাসনকে ব্যবহার করে ভোটের ফল কারচুপির যে পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করে রেখে তিনি বিদেশে গিয়েছিলেন, তার মহড়া ১৮ দলীয় জোটের সমবেত বিপুলসংখ্যক কর্মী ও সমর্থকদের দিবারাত্রির প্রহরায় সফল হতে পারেনি। এটা জেনে প্রধানমন্ত্রী খুব একটা ঘাবড়াননি, কারণ নগর করপোরেশনের সীমিত পরিসরে বিরোধী জোট যে জমায়েত ও পাহারার ব্যবস্থা করতে পেরেছে, দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচনের বহুবিস্তৃত ও বিচ্ছিন্ন ভোটকেন্দ্রগুলোতে তেমন পাহারার ব্যবস্থা প্রশাসনের সহায়তা নিয়ে সরকারি দল ছাড়া আর কারো পে সম্ভব হবে না। তাই আওয়ামী ঘরানার লন্ডনপ্রবাসী লব্ধপ্রতিষ্ঠ সংবাদভাষ্যকার আব্দুল গাফফার চৌধুরী ভারতের লৌহমানবী প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধীর সাথে শেখ হাসিনার তুলনা করে বলেছেন, তারই প্রশাসনাধীনে পাঁচটা নগর করপোরেশন নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে হেরেও শেখ হাসিনা ‘যুদ্ধংদেহি মেজাজে’ রয়েছেন। লন্ডন থেকে বেলারুশ হয়ে দেশে ফিরে প্রথম দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় প্রচারবাদ্যের চড়া সুর বজায় রেখেও এক ধরনের সৌজন্যবোধ ও নমনীয়তার লণ প্রকাশ করেছিলেন। ১১ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে প্রচারিত এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাঁচটি সিটি করপোরেশনে সুষ্ঠু নির্বাচনে গণতন্ত্র ও জনগণ বিজয়ী হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয়েছে নির্বাচন কমিশনের নেতৃত্বে অবাধ ও নিরপে নির্বাচন সম্ভব। দলীয় সরকারের অধীনেও প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনী নিরপে ও প্রভাবমুক্তভাবে নির্বাচনকালে দায়িত্ব পালন করতে পারেন আর জনগণ অবাধে তাদের ভোটাধিকার প্রদান করতে পারেন।’ তিনি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার জন্য জাতীয় পার্টিসহ মহাজোটের সব শরিক দলের নেতাকর্মীদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যারা নির্বাচিত হয়েছেন তাদের অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিদায়ী মেয়রদের নেতৃত্বে ওইসব সিটি করপোরেশন এলাকায় বর্তমান সরকারের আমলে যে নজিরবিহীন উন্নয়ন হয়েছে তা ওই এলাকার জনগণের কল্যাণের স্বার্থে আমাদের সরকার অব্যাহত রাখার আশ্বাস দিচ্ছে।’ কিন্তু অদৃশ্য কোনো শক্তির ইঙ্গিতে বা সুপারিশে তিনি ওই দিনই দলীয় কর্মীদের সাথে মোলাকাতের সময় সুর পাল্টে ফেললেন। ওই দিন থেকে শুরু করে একাধিক নেতাকর্মীর সাথে পরামর্শে তিনি বাস্তবিক ‘যুদ্ধংদেহি’ অবস্থান নিলেন। তারই ভাষায় তার মোদ্দা বক্তব্য তুলে ধরছি : “বিএনপির তুলনায় আমাদের প্রার্থীরা অনেক জনপ্রিয়। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতিরও তেমন কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু বিএনপির দুর্নীতিপরায়ণ প্রার্থীদের বিরুদ্ধে আমাদের প্রার্থীরা নির্বাচনে জিততে পারেনি। এটা মেনে নেয়া যায় না। আসলে ’৭১-এর মতো স্বাধীনতাবিরোধীরা আবারো এক হয়ে গেছে। আমাদের ক্যান্ডিডেটের বিরুদ্ধে তো কেউ কোনো দুর্নীতির অভিযোগ তুলতে পারেনি। যারা দুর্নীতি করেনি, যারা কিন ইমেজের, তারা জিততে পারেনি। আমি মনে করি, সব স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভাবে হওয়া উচিত। আলটিমেটলি এটা দলীয়ভাবেই হয়। দলীয়ভাবে হলে একটা ডিসিপ্লিন থাকবে। ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে দলীয়ভাবেই হয়। তাহলে আমরা এই উন্নয়ন কেন করছি? কার জন্য করছি? যদি দুর্নীতিবাজরাই জিতে আসে। তাহলে এই জেতার রহস্যটা কী? শুনলাম জাতীয় ইস্যুর জন্য হেরে গেছি। জাতীয় ইস্যু কী? আমরা খাদ্য-নিরাপত্তা দিতে পারছি কি না? জাতীয় ইস্যুর জন্যই যদি হারব; তাহলে আমার প্রশ্ন জাতীয় ইস্যু হয়ে গেল দুর্নীতি? আমাদের সরকার নাকি দুর্নীতি করেছে। দুর্নীতি করে তো এত উন্নয়ন সম্ভব নয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন, স্বাস্থ্যসেবার মান, শিার মান কিছুই তো কমেনি, বেড়েছে। তাহলে দুর্নীতি কোথায় হলো? হলমার্ক আর ডেসটিনি আমরা ধরলাম। আর চোর ধরে আমরা অপরাধী হয়ে গেলাম? গাজীপুর ইলেকশনে আমরা যাকে সাপোর্ট দিয়েছি সে তিনবারের পৌরসভা মেয়র। তার বিরুদ্ধে একটা দুর্নীতির কথা কেউ বলতে পারেনি। কিন ইমেজের লোক। তাকে হারতে হলো! জিতল কে? ধর্ম প্রতিমন্ত্রী হিসেবে যে হজের টাকা লুটে খেলো। ওই এলাকার ব্যবসায়ীরা আতঙ্কগ্রস্ত। টাকা নিয়ে বসে থাকতে হবে, তাকে চাঁদার টাকা দিতে হবে। খুলনার মেয়র নকশাল করত, আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি। খুনের মামলার আসামি ছিল। জিয়াউর রহমান মতা দখল করে দল করতে যেয়ে খুনের মামলার আসামিকে জেলখানা থেকে বের করে দল করা শুরু করেন। খুলনায় মানিক সাহা, সাংবাদিক বালু এবং মঞ্জুরুল ইমাম থেকে যত মার্ডার হয়েছেÑ এই আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি জড়িত। সে ভোট পায়। জিতে আসে! ’৭৫-এর পরও অপপ্রচারের কাছে আমরা হেরেছি। এখনো আবার সেই চক্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এ অপপ্রচারের দেয়াল ভাঙতে হবে। আমরা উন্নয়ন করলেও আমাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতিবাজেরা অপপ্রচার ও গুজব ছড়িয়ে ভোট পায়। খুনি খন্দকার মোশতাককে আমরা খুব বিশ্বাস করেছিলাম, যা ছিল মস্ত ভুল। ’৭৫-এর ২৭ জুলাই সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্মদিনে মোশতাক সপরিবারে আমাদের বাসায় আসেন। এর দুই দিন পর আমি জার্মানি চলে যাই। কিন্তু কয়দিন পরই সেই মোশতাক আমার বাবাকে সপরিবারে হত্যা করে। আমি সেই সময় বিদেশ থাকায় বেঁচে যাই। আজকে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে ড. ইউনূস এত কথা বলছেন; এ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৯৮ সালে আমিই টাকা দিই, তাকে সুযোগ করে দিই। আজ তিনি এগুলো বেমালুম ভুলে গেছেন। ড. ইউনূস সেলফিশ। তিনি দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে মতায় গিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ালেও বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনে তা আবার কমে যায়। ১৬০০ মেগাওয়াট থেকে ৪৩০০ মেগাওয়াটে উন্নীত করেছিলাম। সাত বছর পরে (২০০৯ সালে) এসে পেলাম ৩২০০ মেগাওয়াট। আট থেকে ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্যাপাসিটি আমরা অর্জন করেছি। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে করেছি। গতকালও (১৩ জুলাই) ৬৬৭৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। সমস্যার সমাধান করলেও সমস্যা। সেটা নিয়েও কথা। কুইক রেন্টাল কেন করা হলো? অমুক কেন করা হলো? আমি যদি এখন সিদ্ধান্ত নিই, যারা সমালোচনা করে এবং মানুষকে বোঝানোর জন্য... ৩২০০ মেগাওয়াট রেখে বাকি ৫৪-৫৫টা যে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করেছিÑ সেটা বন্ধ করে রাখি দুই চার দিন। তখন অবস্থাটা কী হবে? রোজার পরে এ রকম একটা প্র্যাকটিস করতে হবে। মানুষকে বোঝানোর জন্যÑ কী ছিল, আর এখন কী আছে? না হলে এই সমালোচনা চলতেই থাকবে। ঈদের পর এই ধরনের ‘প্র্যাকটিস’ ঘোষণা দিয়েই করা হবে।” এ কথা বলার অপো রাখে না যে, শেখ হাসিনার ওই বক্তব্যে প্রদত্ত তথ্য-উপাত্তগুলো প্রামাণ্য নয়, বহুলাংশে মনগড়া, একপেশে। তার কথায় একটা বিষয় পরিষ্কার যে, তিনি অবাধ্যতার জন্য এখন ভোটারদেরই শাস্তি দেয়ার ফন্দি আঁটছেন। একই সাথে নয়া বাকশালী কায়দায় শুধু প্রশাসন নয়, নির্বাচনী রাজনীতিকেও নিয়ন্ত্রণে আনার নীলনকশা তৈরি করেছেন। মহাজোটকেই দুই ভাগে সাজিয়ে বিএনপি-জামায়াতসহ গোটা ১৮ দলীয় জোট ও হেফাজতকে ‘সন্ত্রাসের সূতিকাগার’ সাব্যস্ত করে নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে বাদ দিয়ে, গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসকেও ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দিয়ে বিদেশে পার করিয়ে, স্বনিয়ন্ত্রিত প্রশাসনের অধীনে মেকি বহুদলীয় বাকশালী নির্বাচনের ছক কষেছেন। আর সেই ল্েযই তিনি ১১ জুলাই একই দিনে শাহবাগে সাময়িক দখল নেয়া সাধারণ ছাত্রদের চাকরিতে মুক্তিযুদ্ধের কোটাসহ অন্যান্য কোটাবিরোধী মেধার স্বীকৃতির জোরদার আন্দোলনকে হটিয়ে দিলেন ছাত্রলীগ আর পুলিশের সশস্ত্র আক্রমণ ও রক্তপাত ঘটিয়ে। হতবাক মেধাবী ছাত্রদের আন্দোলন দমিত হয়নি। সারা দেশে প্রতিবাদ ও ছাত্রধর্মঘট ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারের ‘কুছ করোয়া নেই’। তারপর রমজানের মধ্যেই জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির ৯৫ বছর বয়সী অধ্যাপক (ভাষাসৈনিক) গোলাম আজমের বিরুদ্ধে তার আজ্ঞাবহ আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়দানের ব্যবস্থা করলেন ১৫ জুলাই। একই সাথে পুলিশি নিরাপত্তার ছত্রছায়ায় শাহবাগ চত্বরে তথাকথিত ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র ধ্বজাধারী প্রজন্মকে পুনঃপ্রবেশ ও স্লোগানবাজির সুবিধা করে দিলেন। তাদের দাপট অবশ্য শাহবাগেই সীমাবদ্ধ। অন্য দিকে জামায়াতের ডাকে দেশজুড়ে চলেছে হরতাল আর সংঘর্ষের টানা কর্মসূচি। এ পর্যন্ত এ দফায় সাতজনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। অধ্যাপক গোলাম আজমের বিরুদ্ধে প্রদত্ত ৯০ বছরের জেল তথা আমৃত্যু বন্দিত্বের রায়ে পর্যবেণ হিসেবে বলা হয়েছে : জামায়াত একটি অপরাধধর্মী বা ‘ক্রিমিনাল’ সংগঠন। জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধেও রায়দানের সময় স্থির করা হয়েছে ১৭ জুলাই। সোমবার থেকে সপ্তাহ জুড়েই এভাবে চলছে হাসিনা সরকারের তরফে জামায়াতপন্থীদের বিরুদ্ধে ‘এস্পার ওস্পার’ দেখে নেয়ার কর্মকাণ্ড। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads