শনিবার, ১৩ জুলাই, ২০১৩

নির্বাচনী কিল


ছোটবেলায় আমার গ্রামের এক মুরব্বির মুখে একটা গল্প শুনেছিলাম। সম্প্রতি দেশে অনুষ্ঠিত পাঁচটি বড় সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল দেখে সে গল্পটাই মনে পড়ে গেল। গল্পটা খুবই ছোট। সেজন্য টেনেটুনে সেটাকে একটু বড় করছি। জেন অস্টিন তার প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস উপন্যাসের শুরুতেই বলেছেন, ‘এটা একটা সর্বজনস্বীকৃত ব্যাপার যে একজন ধনবান অবিবাহিত পুরুষের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হচ্ছে একটা স্ত্রী।’ হ্যাঁ, ধনসম্পত্তি সুখের একটি বড় উপাদান বটে। তবে একজন মানুষ শুধু যে ধন নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে পারে না, তার অন্য সন্তুষ্টিও দরকারÑ অস্টিনের কথায় সেটাই বেশি প্রতিফলিত হয়েছে। পুরুষেরা তাদের স্ত্রীর মাধ্যমে বাড়িতে সুখ ও শান্তির অন্বেষণ করে। বাংলায় একটি পুরনো প্রবাদ ছিলÑ সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। এ নিয়ে রমণীরা বিতর্ক করতে পারেন। তবে আমি এখন সে প্রসঙ্গে যাবো না। পুরুষদের চাওয়া পারিবারিক শান্তির মতো দেশের সাধারণ মানুষও জাতীয় জীবনে শান্তি চায়। তারা কখনো মারামারি, হানাহানি চায় না। ক্ষমতা নিয়ে বিভিন্ন দলের কাড়াকাড়িও দেখতে চায় না। দেশের সার্বিক কল্যাণের জন্য তারা একটি জনকল্যাণমুখী সরকার চায়। সে জন্যই তারা নিজেদের কষ্টে উপার্জিত টাকা ব্যয় করে একটা দলকে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দেয়। ক্ষমতায় এসে তারা জনগণকে আশ্বস্ত করে বলে, ‘আমরা আপনাদের জন্য সব রকম সুখ ও শান্তি নিশ্চিত করব। দেশকে উন্নতির জোয়ারে ভাসিয়ে দেবো।’ নতুন বিয়ে করা বউয়ের কথা স্বামীরা যেমন বিশ্বাস করে, দেশের জনগণও সরকারের সব কথায় তেমনই পুলকিত হয়; কিন্তু তাদের মোহভঙ্গ ঘটতে খুব বেশি সময় লাগে না। উন্নতির জোয়ার কিংবা সুখের বন্যা কিছুই তারা দেখতে পায় না। দেখতে পায় শুধু অন্যায়, অবিচার আর দমন-পীড়ন। জনগণের নিরাপত্তাহীন জীবনে নেমে আসে গভীর হতাশা। ফলে এক সময়ের প্রিয় সরকারের প্রতি তারাই হয়ে পড়ে বীতশ্রদ্ধ। তারা চায় নতুন শাসক। এবার আসি মূল গল্পেÑ গ্রামের এক চাষি অনেক ধুমধাম করে বিয়ে করে। সুন্দরী বউ এসে তার ঘর আলোকিত করে। চাষি তার বউকে নিয়ে সুন্দর ও সুখী জীবনের স্বপ্ন দেখে। বউও তাকে বলে, ‘তোমার জীবনে আমি কোনো দুঃখ রাখব না। আমি আমার সব কিছু দিয়ে তোমার জীবনকে সুখময় করে তুলব।’ স্বামীও স্ত্রীর কথায় আস্থা রাখে এবং প্রথম কিছু দিন তাদের স্বপ্নের ঘোরেই কাটে; কিন্তু তারপরই সে আস্থার গুড়ে বালি পড়ে। দেখা যায় স্ত্রী তার স্বামীর প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ছে। এখন আর সে স্বামীর সুখের কথা ভাবে না। নিজের সুখকেই সে বেশি প্রাধান্য দেয়। স্বামীর খাওয়াদাওয়ার প্রতিও সে কোনো নজর দেয় না। রান্না হয়ে গেলে সে নিজেই আগে খেয়ে নেয়। শুধু তা-ই নয়, যেকোনো খাবারের ভালো অংশটিও সেই খায়। স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক ভালোবাসা আর থাকে না। ঝগড়াঝাটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। স্বামীর মন বিষিয়ে ওঠে। একদিন সে মাঠ থেকে ফিরে এসে দেখে, স্ত্রী সেজেগুজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার কাছে খাবার চাইলে সে বলে রান্না হয়নি। শুধু তাই নয়, সে তার স্বামীকে সাফ জানিয়ে দেয়, এখন থেকে সে আর তার জন্য রান্নাবান্না করবে না। রান্না করতে তার কষ্ট হয়। স্বামী বেচারার রাগ তখন এত চরমে ওঠে যে, সে আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আচমকা চুলের মুঠি ধরে বউকে মাটিতে ফেলে দেয়। উপর্যুপরি তার ওপর পড়তে থাকে কিল আর ঘুষি। পাড়া-প্রতিবেশীরা এসে তাকে রক্ষা করে। ঘটনার আকস্মিকতায় বউ বেচারি তো হতবাক। সে কল্পনাও করতে পারেনি যে তার বোকাসোকা স্বামী তাকে এভাবে মারবে। মনের দুঃখে সে অনেকক্ষণ কাঁদতে থাকে। তারপর বিকেল বেলা সে তার স্বামীর কাছে গিয়ে বলেÑ ‘আচ্ছা বলো তো, তুমি আমাকে এভাবে মারলে কেন? তোমার মনোভাবটা কী? তুমি কি আমাকে রাখতে চাও না?’ স্বামী কিছুক্ষণ চুপ থেকে শুধু একটি কথাই বলেÑ ‘সেটা কি তুই আমার কিলের ওজন থেকে বুঝতে পারিসনি?’ বউটি বুদ্ধিমতী। যা বোঝার সে বুঝে নেয়। কালবিলম্ব না করে সে তার কাপড়চোপড় গোছাতে শুরু করে। যাদের জন্য গল্পটা তারা কি কিছু বুঝল? সিটি করপোরেশনের পাঁচটি নির্বাচনী চপেটাঘাতের ওজন থেকে তারা কি কোনো মেসেজ পেল?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads