মঙ্গলবার, ১৬ জুলাই, ২০১৩

আওয়ামী লীগ ও সরকার বিপন্নের সম্মুখীন

ড. কর্নেল অলি আহমদ (অব:) বীর বিক্রম, এমপি

লেখক : সংসদ সদস্য ও চেয়ারম্যান, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি বর্তমান সরকারকে জনগণ আর মতায় দেখতে চায় নাÑ কারণ এ সরকার যখনই মতায় আসে দেশের জনগণ বিভিন্নভাবে তিগ্রস্ত হয়। সরকার বিগত সাড়ে চার বছরের অপশাসন-দুঃশাসন, জুলুম-নির্যাতনের কারণে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে এখন ক্ষমতা হারানোর আতঙ্কে প্রমাদ গুনছে। তারা রাজনৈতিক প্রতিপকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়ে জুলুম-নির্যাতন ও দলন-পীড়নের পথ বেছে নিয়েছে। সরকারের মেয়াদ যতই শেষপর্যায়ে আসছে, তারা জনগণের ওপর জুলুম-নির্যাতনের তীব্রতা বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং জনতার ওপর জুলুম-নির্যাতন যত বাড়ছে, জনতার ােভও ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমতাবস্থায় ব্যর্থ ও জুলুমবাজ আওয়ামী লীগ সরকার গণবিস্ফোরণ ও গণ-অভ্যুত্থানের আশঙ্কায় হিতাহিত-জ্ঞানশূন্য হয়ে জনগণের সাথে অসংলগ্ন আচরণ করতে শুরু করেছে; কিন্তু অতীতে জনগণের ওপর দলন-পীড়ন, নির্যাতন চালিয়ে কোনো স্বৈরাচারী শক্তির শেষ রা হয়নি, আওয়ামী লীগেরও শেষ রা হবে না। বর্তমান সরকার মতা গ্রহণের পর সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, অতঃপর কুমিল্লা সিটি করপোরেশন, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সর্বশেষ গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ সরকারের বিরুদ্ধে এক ধরনের অনাস্থা ব্যক্ত করেছে। সরকার বুঝতে পারছে কি না জানি না। সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের বিতর্কিত রায় সারা দেশ এবং জনগণকে অন্ধকার গর্তে ঠেলে দিয়েছে। এ রায়ের ফলে দেশের রাজনীতি বিধ্বস্ত, গণতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে বহু বছর ধরে প্রতিষ্ঠিত, হাইকোর্টের মামলার রায়ে বৈধ হিসেবে বিবেচিত। অথচ সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের সভাপতিত্বে তার অবসরে যাওয়ার প্রাক্কালে তড়িঘড়ি করে একটি বিতর্কিত রায় প্রদান করে যায়। এই রায়ে বলা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এখন থেকে অবৈধ। এ ছাড়া পঞ্চদশ সংশোধনীতে আরো কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা বিরোধী দলকে আরো নিপীড়ন ও দুর্বল করার ল্েয ব্যবহার করা যাবে। মুক্তচিন্তা, বহু মতের চর্চা, বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রুদ্ধ করার সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের এই বিতর্কিত রায়ের মাধ্যমে। গণতন্ত্রকে অব্যাহত রাখতে হলে পঞ্চদশ সংশোধনী সম্পূর্ণরূপে বাতিল করে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নতুন সংশোধন আনয়ন একান্ত বাঞ্ছনীয়। দেশের জনগণ এবং দেশকে বাঁচাতে হবে। আপস বা আলোচনার উদ্যোগ নেয়া পরাজয় নয়। যারা দেশ পরিচালনা করেন তাদের সব সময় উদ্যোগ নিতে হয়। বড় সঙ্কটাপন্ন সময়ের মধ্যদিয়ে জাতি জীবন অতিবাহিত করছে। এখন মানুষের জীবনের মূল্য সবচেয়ে কম। প্রতিনিয়ত মানুষ মারা যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গুলিতে। মানবতার এই দুঃসময়ে পুরো বাংলাদেশই যেন আজ এক উত্তপ্ত কড়াই। এ কড়াইয়ে নিপ্তি হয়েছেন ১৬ কোটি মানুষ। প্রতিনিয়ত জ্বলছেন তারা। সঙ্ঘাতের রাজনীতি অবশ্য বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়েও নতুন করে আলোচনা হচ্ছে। সব দলের অংশগ্রহণে সংলাপ নিয়েও আলোচনা চলছে সর্বত্র। সংঘর্ষের চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন সমঝোতার। তবে সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। মতা হস্তান্তরপ্রক্রিয়া নিয়ে অতিদ্রুতই সমঝোতায় পৌঁছতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। এ সঙ্কট থেকে উত্তরণের আপাতত একমাত্র পন্থা যে নামেই হোক না কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বহাল। তা হলে স্বাভাবিক নিয়মে সংসদের পাঁচ বছর পূরণ করা কঠিন না-ও হতে পারে। বর্তমান সরকার দেশ এবং জনগণকে ভালোবাসে, তা কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করার এখনই উত্তম সময়। বর্তমান সংসদের অধিবেশন শেষ হওয়ার আগেই তা করতে হবে। বর্তমান সরকারের সাড়ে চার বছরের কর্মকাণ্ড দেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। দুর্নীতিতে দেশ ভরে গেছে। শেয়ারমার্কেট, হলমার্ক ও ডেসটিনি কেলেঙ্কারিতে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজি নিত্যদিনের ঘটনা, দলের মধ্যে এবং মন্ত্রিসভার সদস্য ও সংসদ সদস্যদের মধ্যে অন্তর্কলহ সঙ্কটকে আরো তীব্রতর করেছে। দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগ মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও তারা একদলীয় বাকশাল শাসনে বিশ্বাসী। তারা অত্যাচার নির্যাতন ও হামলা মামলা দিয়ে বিএনপিসহ বিরোধী দলের হাজার হাজার কর্মীকে জেলে পুরেছে। দেশের আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে দেশে ১০ জন মানুষ খুন হচ্ছেন এবং ৫০ জন নারী সম্ভ্রম হারাচ্ছেন। এগুলো সব হয়েছে অভিজ্ঞদের বাদ দিয়ে চমক দেখাতে গিয়ে। অভিজ্ঞদের বাদ দিয়ে যাদের আনা হয়েছে তারা দেশ পরিচালনার পরিবর্তে লুটপাটে বেশি ব্যস্ত হওয়ায় এমনটি হয়েছে। ‘গুরু মারা বিদ্যা, হিতে বিপরীত হয়েছে।’ চাটুকারেরা নিজের পরিবারের এবং অত্মীয়স্বজনদের স্বার্থ রার জন্য কখনোই সৎ পরামর্শ দিতে সাহস পায় না। তারা নেতাদের সাথে সব বিষয়ে একমত পোষণ করে। তাদের মতে কর্তা কখনো ভুল করতে পারেন না। মানুষ মাত্রই ভুল, এ কথাটি সদা সর্বদা স্মরণ রাখা উচিত। তোষামোদকারীদের কারণে অনেক সময় নেতারা স্বাধীনভাবে চিন্তা ও বিশ্লেষণ করতে পারেন না। ফলে জনগণ এবং নিজের দলের নেতাকর্মীদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। স্বাধীনতার পর থেকে ইতিহাস তারই একটি জ্বলন্ত প্রমাণ। সৎ ও দ রাজনীতিবিদেরা মুখের ওপর কথা বলবে, তর্ক করবে, তবে কখনো দলের নেতা, দল, দলের নেতাকর্মী এবং দেশের জনগণকে বিপদের দিকে ঠেলে দেবেন না। সৎ এবং সঠিক পরামর্শ দেবেন ও বিপদের সময় পাশে থাকবেন। অন্য দিকে তোষামোদকারী এবং চাটুকারেরা কখনো বিপদের সময় জনগণের মুখোমুখি হয় না। দূরত্বে এবং নিরাপদে আশ্রয় নেয়। কবির ভাষায় বলতে হয়Ñ অসময়ে হায় হায় কেউ কারো নয় সুসময়ে অনেকে বন্ধু বটে হয়। দেশ পরিচালনার জন্য প্রয়োজন ছিল অভিজ্ঞ এবং প্রবীণদের মেধা কাজে লাগানো; কিন্তু আমরা তাদের ভয় পাই। আমাদের বুঝতে হবে, এ ধরনের নেতারা সাথে থাকলে কখনো দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে জেলে যেতে হয় না। আওয়ামী লীগকে মনে রাখতে হবে, বর্তমান দেশের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে জেলে যাওয়ার পালা এবার কিন্তু তাদের। বিএনপি বা ১৮ দলের নয়। সুতরাং রজনী ধীরে চলো। অহঙ্কার পরিহার করো। প্রতিশোধের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আস। গণতন্ত্র হলো আলোচনার মাধ্যমে সরকার পরিচালনা। একগুঁয়েমির মাধ্যমে নয়। মতার অপব্যবহার করে নয়। কটূক্তি করে নয়। মানুষের কথা বলা অর্থাৎ সরকারের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা বন্ধ করতে না পারলে বুঝতে হবে, সরকার তখন সফলতা লাভ করেনি। সমালোচনা তখনই বন্ধ হয় সরকার যখন সঠিক পথে চলে। আমরা যারা বিরোধী শিবিরে অবস্থান করছি এবং আগামী দিন সরকার গঠনের মন-মানসিকতা নিয়ে পরিকল্পনায় লিপ্ত রয়েছি, আমাদেরও উচিত শত্র“, মিত্র, লোভী, তোষামোদকারী এবং যারা সময়ের সাথে ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য রঙ বদলায়, সময় বুঝে ছদ্মবেশ ধারণ করে, তাদের চিহ্নিত করে সাবধান হওয়া। অন্যথায় পুরনো গর্তে আবারো পড়তে হবে। অত্মত্যাগ মানুষকে মহৎ করে। তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ এবং জীবিত কিংবদন্তি দণি আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা এবং ভারতের সোনিয়া গান্ধী। প্রকৃত অর্থে নিজেদের দেশে তাদের আসন প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ওপরে। দেশ কিভাবে চলবে তারাই ঠিক করেন। পৃথিবীর কাছে তারা মহামানব। কারণ তারা ভোগের রাজনীতি থেকে ত্যাগের রাজনীতিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। যোগ্য ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে তাদের কাজে লাগিয়েছেন। ফলে দল, দেশ এবং জনগণ উপকৃত হয়েছে। তারাও হয়েছেন মহান। ২০০৯ সালের ৪ জানুয়ারি সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করার পর সংসদ ভবন থেকে বেরিয়ে আসার পথে ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হই। সবাই সম্মিলিতভাবে একটি প্রশ্ন করেছিলেনÑ আওয়ামী লীগের এই বিরাট এবং বিশাল বিজয়কে আপনি কিভাবে দেখেন? উত্তরে আমি বলেছিলাম, এটি আওয়ামী লীগের জন্য অশনিসঙ্কেত। এখন তা অরে অরে প্রমাণিত হয়েছে। রাজনীতিতে এবং সরকার পরিচালনায় সফল হওয়ার জন্য প্রয়োজন যোগ্য অভিভাবক, দিকনির্দেশনা এবং সরকার পরিচালনার মতো সৎ ও অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। যার দেশপ্রেম প্রশ্নাতীত। ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার মন্ত্রিসভা গঠনের মাধ্যমে চমক সৃষ্টি করেছিল কিন্তু যোগ্য, অভিজ্ঞ এবং দ রাজনীতিবিদের অন্তর্ভুক্তি ছিল না। কবির ভাষায় বলতে হলে বলতে হয়Ñ ‘হায়রে কপাল মন্দ, চোখ থাকিতে অন্ধ। যখন তোমার কেউ ছিল না, তখন ছিলাম আমি। এখন তোমার সব হয়েছে, পর হয়েছি আমি।’

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads