মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই, ২০১৩

বাংলাদেশে নির্বাচনী রাজনীতি

নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচন গণতন্ত্রেরই নিয়ামক। নির্বাচন নির্ধারণ করে কোনো দল বা গোষ্ঠী তাদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করবে। মানবজাতির পার্লামেন্ট গণতন্ত্রকে একটি জাতির অবাধ মত প্রকাশের বাহন মনে করে। গণতন্ত্রকে জনগণের শাসন সম্মতির নির্ধারক মনে করে (জাতিসঙ্ঘ : ২০০৫ : ১) এই উপমহাদেশ শাসনপদ্ধতি হিসেবে স্বভাবতই গণতন্ত্রকে ধারণ করে এবং বিশেষত ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার সূত্রে সংসদীয় গণতন্ত্রকে লালন করে। কিন্তু শাসনপদ্ধতি হিসেবে দৃশ্যত গণতন্ত্র অনুসৃত হলেও জীবনপদ্ধতি হিসেবে গণতন্ত্র আজ উপমহাদেশের মাটিতে সুপ্রোথিত নয়। যেহেতু রাজনীতিই গণতন্ত্রের উপজীব্য অথবা গণতন্ত্রই রাজনীতির বৈধ বাহন, তাই রাজনীতি-কেন্দ্রিকতাই এ উপমহাদেশের কোটি কোটি মানুষের ভাগ্যবিধাতা। গোটা বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, রাজনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক অগ্রগতি নির্ভর করছে এ উপমহাদেশের সতর্ক রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার ওপর। রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার উত্তরণ এবং উন্নয়ন নির্ভর করে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার ওপর। উপমহাদেশে ক্রান্তিকাল পালাবদলের হাওয়া বইছে সর্বত্র। পাকিস্তানে তাদের নিজস্ব ধরনের একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লিগ ক্ষমতায় এসেছে। সেকুলার পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয় বরণ করেছে। কারণ, পাকিস্তানে বেসামাল রাজনীতি সামাল দিতে পিপিপি ব্যর্থ হয়েছে। ভারতে সেকুলার কংগ্রেস জোট সরকারের অবস্থা দোদুল্যমান। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের মতো দুর্নীতির রাহুগ্রাস কংগ্রেসকে পেয়ে বসেছে। সেখানে আগামী বছর (২০১৪ সালে) নির্বাচন হওয়ার কথা। নরেন্দ্র মোদির মতো কট্টর মৌলবাদী ক্ষমতার মসনদে বসার খোয়াব দেখছে। শ্রীলঙ্কায় গণতান্ত্রিক সরকার অভ্যন্তরীণ বিরোধ এবং বৈদেশিক অভিযোগ অতিক্রম করে গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা অর্জন করেছে। নেপাল অস্থিরতা অতিক্রম করে নির্বাচনমুখী হয়েছে। সেখানেও আগামী বছর নির্বাচন হতে যাচ্ছে। হিমালয় রাষ্ট্র ভুটানে নির্বাচন হয়েছে সম্প্রতি (১৪ জুলাই, ২০১৩)। সেখানে দ্বিতীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে বড় ব্যবধানে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসছে দেশটির প্রধান বিরোধী দল পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (পিডিপি)। মালদ্বীপ নির্বাচনমুখী। অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব পালন করছে। বাংলাদেশেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে। আগামী অক্টোবর থেকে জানুয়ারির মধ্যে একটি সাধারণ নির্বাচনের তোড়জোড় লক্ষ করা যাচ্ছে। উপমহাদেশের সব রাষ্ট্রবলয়ে পরিবর্তন তথা ক্ষমতাসীনদের পরাজয় এবং বিরোধী দলের ক্ষমতারোহণ বাংলাদেশকেও সেভাবে প্রভাবিত করছে। লক্ষণীয়, বেশির ভাগ দেশে নির্বাচন পরিচালনার জন্য তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ধারণা বিদ্যমান রয়েছে। নির্বাচনী রাজনীতি ব্রিটিশ শাসিত উপমহাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের উত্তরাধিকার মোটামুটি সব দেশে বর্তমান থাকলেও ব্রিটিশ রাজনৈতিক সংস্কৃতি বেশির ভাগ দেশে বেগবান হয়নি। পাকিস্তানে কর্তৃত্ববাদী এবং সামরিক সরকারের সমাহার লক্ষ করা গেছে এর অস্তিত্বকালের বেশির ভাগ সময়ে। শ্রীলঙ্কা একটি ভারসাম্যপূর্ণ শাসন কাঠামো নিয়ে ভালোই এগিয়েছে। নেপাল রাজা বীরেন্দ্রের অধীনে স্থিতিশীলতা অর্জন করেছিল। মাওবাদী বিপ্লব আর ভারতবাদী কংগ্রেসের দোটানায় দেশটি জর্জরিত। মালদ্বীপ প্রথম থেকেই রাষ্ট্রপতিব্যবস্থা অনুসরণ করছিল। ভুটানে রাজতন্ত্র এখনো বিরাজমান। ভারত ছাড়া নির্বাচনী রাজনীতি আক্রান্ত উপমহাদেশের সব দেশ। ভারতের কণ্টকাকীর্ণ প্রাথমিক বছরগুলো আলোকিত রাজনীতিবিদ এবং নিয়মতান্ত্রিক সংসদীয় ব্যবস্থাধীনে পরিচালিত হয়েছে বলে নির্বাচনকালীন আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্কট সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু পাকিস্তান ও বাংলাদেশ গণতন্ত্রায়নে ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’-এর মধ্য দিয়ে অগ্রসর হলেও নির্বাচনপদ্ধতি প্রাতিষ্ঠনিকতা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্কট আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্কট উপমহাদেশের সব দেশে সবকালে কিছু না কিছু ছিল। বাংলাদেশে দ্বিতীয়বার সংসদীয় গণতন্ত্র প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৯৪ সালে মাগুরা উপনির্বাচনে সে সময়ের ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে ভোট কারচুপির অভিযোগ ওঠে। বিরোধী আওয়ামী লীগ এবং জামায়াত একটি নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সব নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য লাগাতার আন্দোলন শুরু করে। সব সাংবিধানিক ব্যবস্থা ব্যর্থ হলে একটি নতুন সংসদ নির্বাচন করে বিএনপি সরকার ‘নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকার’ প্রতিষ্ঠিত করে। সেই থেকে সব জাতীয় নির্বাচন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এতদসত্ত্বে¡ও পরাজিত দলটি সূক্ষ্ম অথবা স্থূল কারচুপির অভিযোগ উত্থাপন করে। ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উত্তরাধিকার প্রশ্নে প্রধান দু’দলে আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্কট সৃষ্টি হয়। রাজপথে দু’দলের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর প্রকারান্তরে সেনাবাহিনী দেশের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করে। অবৈধ সরকার দু’বছর ক্ষমতাসীন থাকে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে সেনাবাহিনীর পরিকল্পিত সমর্থন এবং ভারতের বস্তা বস্তা টাকার বিনিময়ে (দ্য ইকোনমিস্ট, জানুয়ারি ২০১০) আওয়ামী লীগ দেশের ক্ষমতা করায়ত্ত করে। ২০০৯-২০১৩ সাল পর্যন্ত অব্যাহত দুঃশাসনে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা হিমাঙ্কে নেমে আসে। (বিভিন্ন ইস্যুতে বিভিন্ন দৈনিকের জনমত জরিপে তা প্রতিফলিত সর্বশেষ সিটি করপোরেশন নির্বাচন উদাহরণ)। আওয়ামী লীগ অব্যাহত জনপ্রিয়তা কমে যাওয়াকে ইতিবাচক পথে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা না করে অকল্পনীয় দমনপীড়নের আশ্রয় নেয়। দৃশ্যমান জনরোষ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় নির্বাচনে জয়লাভ সম্ভব নয় ভেবে আওয়ামী লীগ তাদেরই সৃষ্ট নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারব্যবস্থার বিলোপ সাধন করে। কোর্টের একটি রায়ের দোহাই দিয়ে ‘অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার অসাংবিধানিক’Ñ এ ধুয়া তুলে ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে ক্ষমতাসীন সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে। পরপর আরো দুটো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের সুপারিশ থাকা সত্ত্বেও ক্ষমতাসীনেরা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে তা প্রত্যাখ্যান করে। সৃষ্টি হয় দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রলম্বিত রাজনৈতিক সাংবিধানিক সঙ্কট। বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোট বর্তমানে নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের দাবিতে অব্যাহত আন্দোলন গড়ে তুলছে। সিটি করপোরেশনের প্রাথমিকভাবে চারটি এবং অবধারিত ভাগ্য নিয়ন্ত্রক অপর নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী দল সমর্থিত প্রার্থীরা বিজয়ী হলে প্রতিকূল আবহাওয়া অনুকূলে প্রবাহিত হয়। গোটা রাজনৈতিক সমীকরণের এ নতুন মেরুকরণ প্রত্যাশিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি ইতোমধ্যে নির্মাণ করেছে। নির্বাচনী সমস্যা নির্বাচন প্রক্রিয়ার দীর্ঘ জটিল এবং বাস্তব সমস্যাগুলোকে আমরা দু’ভাবে ভাগে করতে পারি। মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা : আস্থা ও বিশ্বাসের অভাবে উদ্ভূত পারস্পরিক বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্কট। প্রক্রিয়াগত সমস্যা : ভোট গ্রহণ, ভোট গণনা, ফলাফল প্রকাশ ইত্যাদি কার্যক্রমের মাধ্যমে উদ্ভূত সমস্যা। মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা থেকে উদ্ভূত হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তত্ত্ব। সনাতনী সংসদীয় পদ্ধতি অনুযায়ী মেয়াদ শেষে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের নির্বাচনী ইতিহাস বলে নির্বাচন কখনোই বিশ্বাসযোগ্য হয় না। সমাজতান্ত্রিক প্রথা পদ্ধতিতে দলীয় কাঠামো বা নির্দেশনার বাইরে যাওয়ার অবকাশ নেই। কর্তৃত্ববাদী অর্থাৎ স্বৈরাচার, রাজা-বাদশাহ, আমির ওমরারা যেভাবে নির্দেশ করেন, সেভাবেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আবার আধা কর্তৃত্ববাদী আধা গণতন্ত্রবাদী নির্বাচনে দৃশ্যমান গণতন্ত্রের লেবাস বহাল রেখে মিশ্রণের মিথষ্ক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। এভাবেই একদা গণতন্ত্রের জন্য নানা উপাদেয় বিশ্লেষণ যোগ করা হয়েছে। যেমনÑ আইয়ুব খানের বুনিয়াদি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রীদের শোষিতের গণতন্ত্র, জামাল নাসেরের নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র এবং সুকর্নোর নির্দেশিত গণতন্ত্র। আমাদের দেশের প্রবর্তিত বাকশালকেও শোষিতের গণতন্ত্র বলে অভিহিত করা হয়েছিল। এসব ব্যবস্থা বাতিকগ্রস্ত কোনো ব্যক্তির নিজস্ব ব্যবস্থা মাত্র। যা ‘গণতন্ত্র’ নামক জনপ্রিয় শব্দ দিয়ে স্বৈরাচারকে জায়েজ করার শামিল। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বিবেচনা করে নিচে উল্লিখিত প্রক্রিয়ায় প্রকাশ করা যায় : বিশুদ্ধ ভোটার তালিকা প্রকাশ, রাজনৈতিক দলগুলোর স্বচ্ছ নিবন্ধন, নির্বাচনী এলাকার যৌক্তিক সীমানা নির্ধারণ, দুর্নীতিবিহীন মনোনয়ন, নির্বাচনী ব্যয়ে স্বচ্ছতা, নির্বাচনী প্রচারণায় নীতিমালা মেনে চলা, ভোট গণনায় স্বচ্ছতা, ফলাফল নিশ্চিত করা, ফলাফল প্রকাশ বা আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এবং সার্বিক সততার সাথে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা। সমাজতত্ত্ববিদ ম্যাকউনালের মতে, একটি নির্বাচন তিনটি মৌলিক কার্যক্রম বিবেচনা করে। প্রথমত, একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থাধীনে ক্ষমতার পালাবদল সম্পন্ন করে। মোদ্দাকথা সরকারই এ দায়িত্ব পালন করে। দ্বিতীয়ত, প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে। শাসক ও শাসিতের সংযোগ সাধন করে। শাসিতের পক্ষ থেকে শাসকের প্রতি সম্মতি জ্ঞাপন করে। মূলত নির্বাচন কমিশন সরকারের পক্ষ থেকে কাজটি সম্পন্ন করে। এবং তৃতীয়ত, রাজনৈতিক অগ্রাধিকারগুলো চিহ্নিত করে। অন্যভাবে বলা যায় রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ সাধন করে। রাজনৈতিক দল নির্বাচন অথবা অন্য সময়ে তার আদর্শ, দীক্ষা ও কর্মসূচি অনুযায়ী জনসাধারণকে সংগঠিত ও প্রভাবিত করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাস সব ক্ষমতাসীন মহলের ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার অদম্য মানসিকতা, বাংলাদেশ সমাজব্যবস্থার গতিপ্রকৃতি এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থাÑ সব বিষয় বিবেচনা করে দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ মনে করে ইতঃপূর্বে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সৃষ্ট নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। (দৈনিক প্রথম আলো, প্রকাশিত জরিপ, ১১ মে ২০১৩)। অথচ নিশ্চিত পরাজয় এড়াতে ক্ষমতাসীন সরকার ২০২১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চাইছে। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন না দেয়ার ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছেন। পঞ্চদশ সংশোধনীর কারুকার্যেও ক্ষমতা অব্যাহত থাকার কলাকৌশল আছে বলে আইনবিদেরা সতর্ক করছেন। এ অবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে। উত্তরণের উপায় উপমহাদেশের তথা বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতিকে সুশৃঙ্খল ও নিয়মানুগ পথে পরিচালিত করার জন্য দুই ধরনের পদক্ষেপের চিন্তা করা যায়। একটি আপাত সমাধান আর একটি স্থায়ী সমাধান। যেকোনো সঙ্কট সমাধানের একমাত্র পথ হলো পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা। প্রধানমন্ত্রী দেশের শীর্ষ এবং প্রধান নাগরিকদের দেয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার সঙ্কট সমাধানে নানা ফর্মুলা নাকচ করেছেন। অপর দিকে বিরোধীদলীয় নেতা কয়েকটি পর্যায়ে কাক্সিত ছাড় দিয়েছেন। তত্ত্বাবধায়ক বনাম অন্তর্বর্তীকালীন বিতর্কে বিরোধী পক্ষ নমনীয়। অপর দিকে পার্লামেন্টের কাঠামোর মধ্যে অথবা বাইরে কোনোটিতেই খালেদা জিয়া না বলেননি। কয়েক দিন আগে লন্ডনে অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার’ সেমিনারে সরকার পক্ষ অনমনীয়তা প্রদর্শন করে। দেশী-বিদেশী প্রেসারে আক্রান্ত আওয়ামী লীগ সংলাপে এক সময় রাজি হয়েছিল। শোনা যাচ্ছে, এটা ছিল তাদের উত্তরণ কৌশল। এখন সিটি করপোরেশনে ভরাডুবির পর একটি মনস্তাত্ত্বিক চাপ তাদের কী সংলাপ বা একটি রাজনৈতিক সমাধানের দিকে নিয়ে যায় কি নাÑ রাজনৈতিক সচেতন মহল তার জন্য অপেক্ষা করছেন। ইতঃপূর্বে হার্ডলাইন অবলম্বন করে আওয়ামী লীগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে সবার ধারণা। সুতরাং একটি সমঝোতা নাগরিক সাধারণের মধ্যে স্বস্তি এনে দেবে। এ প্রত্যাশিত সংলাপে সরকারপ্রধানের ক্ষেত্রে কোনো সীমাবদ্ধতা থাকলে রাষ্ট্্রপ্রধান উদ্যোগ নিতে পারেন। রাষ্ট্্রপতির পদটিকে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা বা বিতর্কের ঊর্ধ্বে বিবেচনা করা হয়। সবশেষ উপায় হচ্ছে গণভোটে যাওয়া। ইতঃপূর্বে রাজনৈতিক মহলে গণভোটের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে। সাংবিধানিক বিতর্কে গণভোটই হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। এতে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক বিব্রতকর অবস্থা থেকে মুক্তি পাবে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বিশ্বাস করেন না, ক্ষমতাসীনেরা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে তত্ত্বাবধায়ক দাবি মেনে নেবে। তাহলে একমাত্র বিকল্প হচ্ছে বিরোধী দল উদ্দিষ্ট গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন। স্থায়ী সমাধান স্থায়ী সমাধানের জন্য নিম্নোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়Ñ ০১. রাজনৈতিক আস্থা ও বিশ্বাসের ভিত্তি নির্মাণ করা, ০২. বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার আলোকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্থায়ী সাংবিধানিক কাঠামোর প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, ০৩. নির্বাচন কমিশনকে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন ও কার্যকর কমিশন হিসেবে ক্ষমতায়ন, ০৪. ইলেকশন কমিশনে শুধু আমলাদের প্রাধান্য না ঘটিয়ে বিশেষজ্ঞদেরও অগ্রাধিকার দেয়া, ০৫. নির্বাচন কমিশন সার্ভিস নামে আরেকটি সার্ভিসের উদ্বোধন। কমিশন সচিব বাইরে থেকে না নিয়ে একটি স্থায়ী বিশেষজ্ঞ বলয় তৈরি করা, ০৬. নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, ০৭. নির্বাচন কমিশনের কাঠামো পুনর্গঠন করা, ০৮. নির্বাচন ব্যবস্থা অঞ্চলভিত্তিক না হয়ে রাজনৈতিক দলের ভোটানুপাতে অর্থাৎ সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থা নেয়া, এবং ০৯. সমঝোতামূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ ও লালন। গণতন্ত্র বনাম নির্বাচনতন্ত্র আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে দীর্ঘকাল ধরে গণতান্ত্রিক প্রথাপদ্ধতির পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়ে আসছে। পাশ্চাত্যের অনুসৃত গণতন্ত্র যে সর্বাংশেই আমাদের জন্য যুতসই এমনটি নয়। প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তাবিদেরা এশিয়া গণতন্ত্র বা প্রাচ্য গণতন্ত্রের কথা বলে আসছেন। সাম্প্রতিককালে গবেষণা সমীক্ষা শেষে একদল পাশ্চাত্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার গণতন্ত্র চর্চার ইতিহাস এবং বাস্তব অবস্থা নির্ণয় করে একে গণতন্ত্র না বলে নির্বাচনতন্ত্র বলতে চাচ্ছেন। এর কারণ হলো, শুধু সরকার পরিবর্তনের মাধ্যম হিসেবে এসব দেশে গণতন্ত্রের চর্চা হয়ে আসছে। গণতান্ত্রিক প্রথাপদ্ধতি, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি এবং মৌলিক জীবনবোধ হিসেবে গণতন্ত্র এসব দেশে অনুসৃত হচ্ছে না। জয়ী পক্ষ দেশ শাসনে রাজতন্ত্রের মতোই আচরণ করছে। উপসংহার : নির্বাচন হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রাণ। নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্রের বিকাশ, লালন ও প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্বাচনী সুশাসন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে এ সময়ে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা সুনির্বাচন নিশ্চিত করার প্রকৃষ্ট পন্থা। অবিলম্বে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে নির্বাচনপ্রক্রিয়া স্বচ্ছ সচল, সবার মতের কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য পদক্ষেপ অর্থাৎ সমঝোতার আয়োজন, সংলাপ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা নেয়া জাতির প্রয়োজনেই জরুরি। সব রাজনৈতিক পক্ষের উচিত গণতন্ত্রের স্বার্থে, জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থে, জাতির স্থিতিশীল শান্তির স্বার্থে নির্বাচনকে সঙ্কট মোচনের উপায় হিসেবে ব্যবহার করা।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads