বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০১৩

দেশজুড়ে পরিবহনে চাঁদাবাজি


রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই সড়ক-মহাসড়কে বেপরোয়া গণচাঁদাবাজি চলছে। আওয়ামী সরকারের গত সাড়ে চার বছর ধরে যে যার মতো পারছে নির্বাধায় চাঁদা আদায় করছে, এতে কোনো জবাবদিহিতা আছে বলে মনে হচ্ছে না। আর এ চাঁদাবাজি হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে বিভিন্ন শ্রমিক-মালিক সংগঠন-সমিতির নামে। এছাড়া পুলিশের এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা-সদস্যরাও পরিবহনে চাঁদাবাজি করছে। রাজশাহীর পরিবহন শ্রমিকরা যে ১০ দফা দাবিতে ধর্মঘট পালন করেছে, তার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, সড়ক-মহাসড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। পবিত্র রমযান মাসে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য এ মাসের গোড়ার দিকে এফবিসিসিআই পণ্যের সরবরাহ ও মূল্য নিয়ে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। পণ্যমূল্য যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে ঐ সভায় ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে সরবরাহ-চেইন নির্বিঘœ এবং সড়ক-মহাসড়ক চাঁদাবাজিমুক্ত রাখার দাবি জানানো হয়েছে। এদিকে ঐ একইদিনই রাজশাহীতে পরিবহন শ্রমিক, মালিক ও পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, তাতে কয়েকজন পরিবহন মালিক অভিযোগ করেন যে, যমুনা সেতুর দুই প্রান্তে ও গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জে সরকারি দলের নেতা-পাতি নেতা, কর্মী-ক্যাডার নামধারী সন্ত্রাসী,  চাঁদাবাজরা ও পুলিশের অসাধুরা চাঁদাবাজি করে আসছে। রাজশাহী থেকে ঢাকায় আসা একটি পরিবহনের মালিক একটি জাতীয় দৈনিককে জানিয়েছেন, একটি যাত্রীবাহী বাস ঢাকায় আসতে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। যেসব জেলা পেরিয়ে আসতে হয়, ঐ জেলাগুলোতে মাসিক ভিত্তিতে পুলিশ সার্জেন্টদের ৫০০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। এর বাইরে থানা-ফাঁড়ির পুলিশদেরও নিয়মিত চাঁদা দিতে হয়। এছাড়াও ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠা বিভিন্ন শ্রমিক ও মালিক সংগঠন-সমিতিকেও পয়েন্টে পয়েন্টে চাঁদা দিয়ে পরিবহন ব্যবস্থা চালু রাখতে হয়। সড়ক-মহাসড়কে বেপরোয়া চাঁদাবাজি শুধু রাজশাহী অঞ্চলেই নয়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও সমানভাবে চলছে। আরেকজন পরিবহন ব্যবসায়ীর বরাত দিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ঢাকার সায়েদাবাদ নতুন রাস্তা, মাওয়াঘাট, ভাঙ্গায় পুলিশ সার্জেন্টদের নির্দিষ্ট পরিমাণ চাঁদার টাকা দিতে হয়। মাসিক চাঁদার টাকা না দিলে নানা সাজানো মামলাসহ বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হয়।
দেশের পরিবহন সেক্টরে সড়ক-মহাসড়কে, টার্মিনালে পুলিশের এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা ও সদস্য এবং বিভিন্ন শ্রমিক-মালিক সংগঠন ও সরকার দলীয় সংখ্যক সন্ত্রাসী গ্রুপের চাঁদাবাজির ঘটনা মোটেও নতুন নয়। সারা দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে রাজধানী থেকে শুরু করে স্থানীয় আওয়ামী নেতা-পাতি নেতা,  কর্মী-ক্যাডার নামধারী সন্ত্রাসীদের বেপরোয়া চাঁদাবাজির খবরও নিয়মিতই প্রকাশিত হয়ে আসছে। বর্তমান আওয়ামী সরকারের মেয়াদের শেষ সময়ে এসে আওয়ামী সন্ত্রাসী চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য যে আরো বেড়ে যাবে, এটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। শুধু সড়ক-মহাসড়কেই নয়, শহরে-বন্দরে, অলিতে-গলিতে, বাসা-বাড়িতে, অফিসে-অফিসে, কল-কারখানায়, হাট-বাজার, দোকানপাটেও আওয়ামী সন্ত্রাসী চাঁদাবাজদের বেপরোয়া চাঁদাবাজি চলে আসছে। সরকার বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম দমনের সুযোগে আওয়ামী সন্ত্রাসী চাঁদাবাজ চক্র সারা দেশেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। চাঁদাবাজির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুই ধরনের চাপই দেশের সাধারণ মানুষের ওপর পড়ে। ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজির কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টিও বহুল আলোচিত। এ কারণে সাধারণ ভোক্তারাই শুধু আর্থিক দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উৎপাদক পর্যায়ে কৃষকরাও। পবিত্র রমযান মাসকে সামনে রেখে বরাবরের মতোই সড়ক-মহাসড়কে, টার্মিনালে, ঘাটে ঘাটে সন্ত্রাসী চাঁদাবাজরা ইতোমধ্যে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। রোযার মাসে সর্বাধিক চাহিদা সম্পন্ন পণ্য সামগ্রীর মূল্যও লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে যাচ্ছে। পুরো রমযান মাস এবং ঈদের সময় পণ্যমূল্য আরো বেড়ে যাবে, মানুষের ভোগান্তি চরমে উঠবে। সড়ক-মহাসড়কগুলোতে দুর্ভোগের আরেক কারণ হলো- পরিবহন ব্যবস্থায় নিরাপত্তাহীনতা। বন্দরমুখী রফতানি পণ্য এবং বন্দর থেকে আমদানিকৃত পণ্য পরিবহনে ছিনতাই-ডাকাতি প্রতিনিয়তই ঘটছে। হাইওয়ে পুলিশ ও স্থানীয় থানা পুলিশের ভূমিকা যে এক্ষেত্রে হতাশাজনক, এটা প্রমাণিত হয় উপরোল্লেখিত সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি ও পরিবহন যানে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায়।
গত সাড়ে চার বছরে আওয়ামী দুঃশাসন, সন্ত্রাস, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, প্রতারণা, জালিয়াতি, লুটপাটে আমাদের জাতীয় অর্থনীতি থেকে শুরু করে ব্যক্তিজীবনকে পর্যন্ত নিরাপত্তাহীন ও সঙ্কটময় করে তুলেছে। সরকার ও সরকারি প্রভাবশালী মহলের পোষা অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসী ও দাগী অপরাধীদের জামিনে বের করে আনছে এবং প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বাকিদেরও বের করে আনার পদক্ষেপ নিয়েছে। ছাড়া পেয়ে এরা আবার চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, প্রতারণা, জালিয়াতি, অপহরণ, খুন ও গুমসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। গত সাড়ে চার বছরের আওয়ামী দুঃশাসনে দেশ ও জাতি প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি আর লুটপাটের কবলে পড়েছে। দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ ও প্রভাবশালী মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধের প্রতি দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সরকার, সরকারি দলই বিষয়টি কার্যকরভাবে আমলে নেয়নি। দ্রব্যমূল্য যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে, জনগণকে আর্থিক স্বস্তিদানের লক্ষ্যে সারা দেশের পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি বন্ধের বিকল্প নেই। আওয়ামী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর চাঁদাবাজি বন্ধ করার জন্য মালিক-শ্রমিক ও প্রশাসনের সহায়তায় গঠিত কমিটি ২০১০ সালের ১২ জুলাই প্রথম বৈঠকে পরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করার বিষয়ে একমত হয়েছিল। পরবর্তীতে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ঐ কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তা ভেঙ্গে দেয়। পরে চাঁদাবাজি বন্ধে কার্যকরভাবে আর কিছুই করা হয়নি। এরপর থেকে যে বেপরোয়া আওয়ামী চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে, তা বন্ধ করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। সরকার জনস্বার্থে দেশজুড়ে চাঁদাবাজির বিস্তার রোধ করতে না পারলে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা, উৎপাদক ও ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ সম্ভব নয়।
সড়ক-মহাসড়কে, টার্মিনালে সরকারদলীয় প্রভাব বিস্তারের প্রবণতাও বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় সরকারের ব্যর্থতার দায় সরকারকেই বহন করতে হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads