শুক্রবার, ১২ জুলাই, ২০১৩

ভোটের হিসাবে ঠিক ফলই পাচ্ছে আওয়ামী লীগ


রাজধানী সংলগ্ন গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শোচনীয় পরাজয়ের পর থেকেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়েছে। এটাই অবশ্য স্বাভাবিক। কারণ, ৬ জুলাইয়ের ওই নির্বাচনের আগে গত মাসে অনুষ্ঠিত খুলনা, সিলেট, রাজশাহী ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তো বটেই, সরকার গঠন করার পর পর ২০১০ সালের জুন মাসে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রামের নির্বাচনেও বিএনপিই জিতেছিল। কুমিল্ল¬া সিটি করপোরেশনেও বিএনপিই জিতেছে। নারায়ণগঞ্জে যেহেতু বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে আইভি জিতেছেন সেহেতু ওই আসনটিও আওয়ামী লীগকে দেয়া যায় না। দলটি জিতেছে শুধু রংপুরে। সে হিসাবে ক্ষমতাসীনদের পরাজয় ঘটেছে আসলে আট-এক গোলের ব্যবধানে। নামে মহাজোট হলেও শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ। জিতেছে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামায়াতের ১৮ দলীয় জোট।
কথা শুধু এটুকুই নয়। পরিসংখ্যানের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গাজীপুরের নির্বাচনে ভোটের ব্যবধান আরো বেড়েছে। ১৮ দল সমর্থিত বিএনপির প্রার্থী অধ্যাপক এম এ মান্নান যেখানে পেয়েছেন তিন লাখ ৬৫ হাজার ৪৪৪ ভোট সেখানে মহাজোটের তথা আওয়ামী লীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্ল¬াহ খান পেয়েছেন দুই লাখ ৫৮ হাজার ৮৬৭ ভোট। দু’জনের মধ্যে ভোটের ব্যবধান এক লাখ ছয় হাজার ৫৫৭। বিরোধী দলের এই বিজয় অবশ্য মোটেও সহজ ছিল না। কারণ, ক্ষমতাসীনরা গাজীপুরকে গোপালগঞ্জের পর আওয়ামী লীগের ™ি^তীয় ‘ঘাঁটি’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। এই ‘ঘাঁটি’ তারা হারাতে চাননি বলেই নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকেননি তারা। বিপুল টাকা তো ছড়িয়েছেনই, হুমকি দেয়া থেকে প্রশাসন ও পুলিশকে ব্যবহার করা পর্যন্ত সব বিষয়েই খুবই তৎপর দেখা গেছে তাদের। খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নির্বাচনী অফিস বসানো হয়েছিল। দ্বিতীয় একটি অফিস স্থাপন করা হয়েছিল টঙ্গীর এক বিলাসবহুল হোটেলে। তোফায়েল আহমেদের মতো জাঁদরেল নেতারা নির্বাচনের তদারকি করেছেন। ওদিকে নির্বাচনের দিন বিরোধী দলের সমর্থক ভোটারদের বাধা দেয়া, পুলিশের সহযোগিতায় কেন্দ্রে কেন্দ্রে ঢুকে ব্যালটপেপারে সিলমারা এবং ব্যালটবাক্স থানায় নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সব পন্থাই অবলম্বন করছেন তারা। পুলিশ ও প্রশাসনের সর্বাত্মক হস্তক্ষেপ তো ছিলই। ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্নস্থানে দফায় দফায় গোপন সভা করে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাও যথেষ্টই চালিয়েছেন সরকারি কর্মকর্তারা। সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক পর্যন্ত অনেক রথি-মহারথিকেও ন্যক্কারজনক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা গেছে। কিন্তু সব জেনেও এবং বিরোধী প্রার্থীর পক্ষ থেকে বারবার অভিযোগ জানানোর পরও নির্বাচন কমিশনকে নড়াচড়া করতে দেখা যায়নি। ফলে ভোট ডাকাতি হওয়ার এবং বিজয় ছিনিয়ে নেয়ার আশংকা ছড়িয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে ভোটাররা সব চেষ্টাকেই ব্যর্থ করে দিয়েছেন। ফলে ব্যাপক ভোটের ব্যবধানে হেরে গেছেন ক্ষমতাসীনদের প্রার্থী।
খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হলেও গাজীপুরের এ নির্বাচন উপলক্ষে জাতীয় রাজনীতির বিভিন্ন বিষয় প্রাধান্যে এসে গিয়েছিল। গ্যাস-বিদ্যুৎ থেকে রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতা, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি, শেয়ার বাজারের লক্ষ-হাজার কোটি টাকার লুণ্ঠন, হলমার্ক কেলেংকারি, রানা প্লাজার ধস ও প্রায় ১২০০ শ্রমিকের মানুষের নির্মম মৃত্যু এবং দেশজুড়ে আওয়ামীকরণের মতো কারণগুলোর পাশাপাশি বিশেষভাবে উঠে এসেছিল সরকারের রাজনৈতিক নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন এবং গুম ও খুন। জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবিরের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর অভিযানের পাশাপাশি একটি প্রধান কারণ হিসেবে গত ৫ ও ৬ মে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে রাতের অন্ধকারে চালানো গণহত্যার ভয়ংকর অভিযানের প্রতিক্রিয়াও ভোটারদের প্রবলভাবেই আন্দোলিত করেছে। সে কারণে গাজীপুরের ভোটাররা বুঝিয়ে দিয়েছেন, ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে মুসলমানের ওপর গুলী ও নির্যাতন চালানোর এবং তাদের প্রাণ কেড়ে নেয়ার পরিণতি আদৌ শুভ হতে পারে না। অর্থাৎ মূলত জাতীয় বিভিন্ন ইস্যুর কারণেই গাজীপুরের নির্বাচনে হেরে গেছেন ক্ষমতাসীনরা।
গাজীপুরে ক্ষমতাসীন দলের শোচনীয় পরাজয় নিয়ে সঙ্গত কারণেই সারাদেশে ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে। নাটকীয়তাও কম হয়নি, হচ্ছে না। যেমন পরাজিত প্রার্থী আজমত উল্লাহ খান বলেছেন, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমের ‘সব ভোটই’ নাকি বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে পড়েছে! অন্যদিকে সম্পূর্ণ উল্টো এক মন্তব্য করে আলোড়ন তুলেছেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ। তিনি বলেছেন, দলের চেয়ারম্যান এরশাদ যদি ১৪ দলের প্রার্থীকে সমর্থন না দিতেন তাহলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরও দুই লাখ ভোট কম পেতেন। অর্থাৎ আজমত উল্ল¬াহ খান পেতেন ৫৮ হাজার ৮৬৭ ভোটÑ যাকে ‘মাত্তরই’ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। এটা সত্য হলে জাহাঙ্গীর আলমের ‘সব ভোটই’ আর কতোই হতে পারতো? উল্লে¬খ্য, এরশাদ নির্বাচনের মাত্র একদিন আগে, ৪ জুলাই আজমত উল্ল¬াহ খানকে সমর্থন দিয়েছিলেন। তার আগের ক’দিন ধরে এরশাদ একই সঙ্গে দুই প্রার্থীকে দোয়া ও সমর্থন করার নাটক করেছেন। এর রহস্য নাকি কেবল তিনিই জানেন বলে মন্তব্য করেছেন এরশাদ।
এদিকে মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতাসহ বিশিষ্টজনেরা যার যার মতো মূল্যায়ন, অভিমত ও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। কারো কারো অভিমতও আবার আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। যেমন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে, আওয়ামী লীগ এখন আর ‘তেমন জনপ্রিয় নয়’! সরকারদলীয় প্রার্থীদের এই হারের প্রভাব জাতীয় নির্বাচনেও পড়বে বলেও আগাম জানিয়ে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।  যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও মন্দ শোনাননি। আওয়ামী লীগের মধ্যে যখন গোপালগঞ্জের পর দলের দ্বিতীয় প্রধান ‘ঘাঁটি’ গাজীপুরে হেরে যাওয়ার কারণে মাতম চলছে, তখনই তিনি বলে বসেছেন, জনগণের কাছে ‘দুর্ভেদ্য দুর্গ’ বলে কিছু নেই। তারা আস্থা হারিয়ে ফেললে যে কোনো ‘দুর্গ’ ভেঙে ফেলতে পারে। ওবায়দুল কাদের অবশ্য জাতীয় নির্বাচনে এই পরাজয়ের সম্ভাব্য প্রভাবের প্রশ্নে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তার অভিমত, জাতীয় নির্বাচন আলাদা বিষয়। ওবায়দুল কাদের মনে করেন, গত চার মাসের তুলনায় আগামী চার মাসে ভিন্ন চিত্র থাকবে। আগামী নির্বাচন পর্যন্ত ‘মাতাল হাওয়া’ বইতে থাকবে। এ হাওয়া কোনদিকে যাবে তা নাকি এখনই বলা যাবে না! তোফায়েল আহমেদ আবার কিছুটা ঘুরিয়ে বলেছেন, হয়তো জাতীয় ইস্যুর কারণে ভোটাররা আমাদের প্রার্থীকে ভোট দেয়নি।
লক্ষণীয় যে, মনের অজান্তে হলেও মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা কিন্তু কঠিন সত্যকে স্বীকার করে নিয়েছেন। উদাহরণ দেয়ার জন্য অর্থমন্ত্রীর ‘আওয়ামী লীগ এখন আর তেমন জনপ্রিয় নয়’-এর পাশাপাশি ওবায়দুল কাদেরের ‘দুর্গ’ বিষয়ক মন্তব্য এবং সবশেষে তোফায়েল আহমেদের ‘জাতীয় ইস্যুর কারণে ভোটাররা আমাদের প্রার্থীকে ভোট দেয়নি’ অভিমতকে বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। ঠিক এ কথাটাই কিন্তু চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর থেকে বলে আসছেন বিরোধী দলের নেতারা। শেয়ারবাজারের লুণ্ঠন থেকে পদ্মাসেতুকেন্দ্রিক দুর্নীতি, হলমার্ক ও ডেস্টিনি কেলেংকারি এবং সবশেষে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে চালানো দমন-নির্যাতন-হত্যাসহ হেফাজতে ইসলামের ওপর চালানো গণহত্যা পর্যন্ত অসংখ্য ‘জাতীয়’ ইস্যুর পাশাপাশি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে প্রাধান্যে এসেছে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবিটি। সাধারণ ভোটাররা বুঝলেও ক্ষমতাসীনরা বুঝতেই চাচ্ছেন না যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করার মধ্যেই তাদের জন্য মঙ্গল নিহিত রয়েছে। সুতরাং কথিত ‘ভুলগুলো’ শোধরাতে চাইলে সবার আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তথা নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতায় আসা দরকার। তা সে সরকার যে নামেই হোক না কেন। এ ব্যাপারে বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া অনেক আগেই ছাড় দিয়ে রেখেছেন। সুতরাং তোফায়েল আহমেদরা চাইলে এখনও সুযোগটা নিতে পারেন। এজন্য তাদের শুধু একটি সিদ্ধান্তমূলক ঘোষণা থেকে পিছিয়ে আসতে হবে। সেটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই প্রধানমন্ত্রী রেখে গঠিত সরকারের অধীনে নির্বাচন করা সংক্রান্ত। একথা বুঝতে হবে যে, শেখ হাসিনার মতো একজন বিতর্কিত ও অজনপ্রিয় হয়ে ওঠা নেত্রীর অধীনে অনুষ্ঠিত কোনো নির্বাচনই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। পাঁচ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ভোটার জনগণ আসলে সে কথাটারই জানান দিয়েছেন।
বস্তুত চার সিটি করপোরেশনের পর পর গাজীপুরের নির্বাচনও সবদিক থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গুরুত্ব ও প্রয়োজনকে অনস্ব^ীকার্য করে তুলেছে। কারণ, নির্বাচন কমিশনের আদৌ কোনো স্বাধীনতা ও ক্ষমতা রয়েছে কি না, সে ব্যাপারে সাধারণ মানুষের মনেও এখন আর কোনো সংশয় নেই। তার ওপর রয়েছে আওয়ামী প্রশাসন, যাকে সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে ঢেলে সাজানোর কাজ চলছে পুরোদমে। ওদিকে র‌্যাব ও পুলিশ তো রয়েছেই। ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল রেখে যে নামে ও যাদের নিয়েই নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হোক না কেন, সে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে পারবে না। এজন্যই নতুন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিটি বিশেষ জোরের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে। অন্যদিকে পাঁচ পাঁচটি নির্বাচনে ভরাডুবির পরও ক্ষমতাসীনরা এখনো উল্টো পথেই হাঁটার চেষ্টা চালাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী তো ‘নির্বাচনই হবে না’ বলে ভয়ও দেখাচ্ছেন। ক্ষমতাসীনরা সেই সঙ্গে বলে বেড়াচ্ছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে যে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় এবং জনগণ যাকে খুশি তাকে ভোট দিতে পারে সেটাই নাকি চার সিটি ও গাজীপুরের নির্বাচনে আরো একবার প্রমাণিত হয়েছে! অন্যদিকে বিরোধী দলের সঙ্গে সাধারণ মানুষও মনে করে, সিটি করপোরেশনের নির্বাচন যেহেতু স্থানীয় সরকার পর্যায়ের নির্বাচন সেহেতু এর সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনকে গুলিয়ে ফেলার সুযোগ থাকতে পারে না। কারণ, সিটি করপোরেশনের মতো মিডিয়ার ব্যাপক উপস্থিতি জাতীয় নির্বাচনে তিনশ’ আসনের ক্ষেত্রে সম্ভব হবে না। ফলে ভোট ডাকাতি এবং ইচ্ছামতো সিল মারা ও ব্যালটবাক্স ছিনিয়ে নেয়া প্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে। পুলিশ ও প্রশাসন পালন করবে সরকারের সেবাদাসের ভূমিকা। সুতরাং গণতন্ত্রের ব্যাপারে সত্যি সদিচ্ছা এবং নিজেদের অবদানের ব্যাপারে সৎসাহস থাকলে ক্ষমতাসীনদের উচিত সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা। নির্বাচনকালীন নতুন সরকারের আয়োজন করা। সে সরকার যে কোনো নামেই হতে পারে। এ বিষয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টার মধ্যেই ক্ষমতাসীনদের পাশাপাশি দেশের জন্যও মঙ্গল নিহিত রয়েছে।
ক্ষমতাসীনদের এই ধারাবাহিক পরাজয়ে সাধারণ অনেকে বিস্মিত হলেও বলা দরকার, এমন পরিণতিই অত্যন্ত স্বাভাবিক। কারণ, এই সত্য প্রথম থেকেই প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি ঘটবে বলেই ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচন ভন্ডুল করা হয়েছিল। ২০০৬ সালের অক্টোবরে লগি-বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাসের মাধ্যমে মইন-ফখরুদ্দিনদের অসাংবিধানিক সরকারকে ক্ষমতায় বসানোর পেছনে ভূমিকা পালন করেছিল ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের মতো কয়েকটি দেশ এবং বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফ ধরনের আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। এদের উদ্যোগেই আয়োজিত হয়েছিল ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের ‘ডিজিটাল’ নির্বাচন। সে নির্বাচন সম্পর্কিত কিছু তথ্য পাঠকরাও স্মরণ করে দেখতে পারেন। প্রথমে ফলাফলের দিকে লক্ষ্য করা যাক। নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী ওই নির্বাচনে গড়ে ভোট পড়েছিল ৮৭.১৬ শতাংশ। সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এই পরিমাণ ভোট পড়তে হলে প্রতি মিনিটে একজন করে ভোটারকে ভোট দিতে হয়েছিল। অথচ নিজের ভোটার নাম্বার ও নাম-ঠিকানা জানিয়ে ও মুড়ি বইতে স্বাক্ষর দিয়ে ব্যালট পেপার সংগ্রহ করা, আঙুলে অমোচনীয় কালি লাগানো, পোলিং বুথের ভেতরে যাওয়া, পছন্দের প্রার্থীর ঘরে সিল মারা এবং ব্যালট পেপার ভাঁজ করে স্বচ্ছ বাক্সে ফেলা পর্যন্ত কাজগুলো সারতে হলে কম করে হলেও পাঁচ মিনিট পর্যন্ত সময় লাগার কথা। এজন্যই প্রতি মিনিটে একজন করে ভোটারের পক্ষে ভোট দেয়া একেবারেই সম্ভব নয়।
অন্য কিছু তথ্য-পরিসংখ্যানও যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ। আওয়ামী মহাজোটের প্রার্থীরা ২৯৯ আসনের মধ্যে ১৭০ আসনেই ৮৫ থেকে ৯৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। এদের মধ্যে আবার ৭৪ জন প্রার্থী পেয়েছিলেন ৯০.০১ থেকে ৯৪.৮৯ শতাংশের মধ্যে। অর্থাৎ মহাজোট প্রার্থীদের ৫৬.৮৫ শতাংশ জনই অস্বাভাবিক হারে ভোট পেয়েছিলেন। এত বেশি ভোট গোপনে বাড়তি সিল মারা ছাড়া পাওয়া সম্ভব নয়। কথা আরও আছে। প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এমন অন্তত ৮৮টি আসন ছিল যে আসনগুলোতে ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ভোট পড়েছে এবং মিনিটে একজন নয়, চার থেকে পাঁচজন পর্যন্ত ভোটার ভোট দিয়েছিল! পরিসংখ্যানে এটাও দেখা গেছে, যে ২৬২ আসনে মহাজোট প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছিলেন সে আসনগুলোতেই তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি ভোট পড়েছে। এখানেই ছিল আসল ‘মাজেজা’Ñ চার দলীয় জোট যাকে ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।
প্রধান দুই দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যকার ভোটের ব্যবধান লক্ষ্য করলেও চৌর্যবৃত্তির বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের দুটি নির্বাচনে দল দুটির প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান ছিল যৌক্তিক পর্যায়ে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এক কোটি ৫৮ লাখ এবং বিএনপি এক কোটি ৪২ লাখ ভোট পেয়েছিল। ব্যবধান ছিল ১৬ লাখ ভোটের। এরপর ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই কোটি ২৩ লাখ এবং বিএনপি দুই কোটি ২৮ লাখ ভোট পেয়েছিল। ব্যবধান ছিল পাঁচ লাখ ভোটের। এই ব্যবধানও স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনে দুই প্রধান দলের ভোটের ব্যবধান দেখানো হয়েছিল এক কোটি ১১ লাখ! আওয়ামী লীগ যেখানে পেয়েছে তিন কোটি ৪২ লাখ, বিএনপি সেখানে পেয়েছে দুই কোটি ৩১ লাখ ভোট। এই বিরাট ব্যবধান শুধু অস্বাভাবিক নয়, অগ্রহণযোগ্যও। দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের ভোট যেখানে বেড়েছে এক কোটি ১৯ লাখ, বিএনপির সেখানে বেড়েছে মাত্র তিন লাখ! এমন কোনো হিসাব মোটেও বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না, হয়ওনি।
ওদিকে জামায়াতে ইসলামীকেও একই পরিকল্পনার ভিত্তিতে হারিয়ে দেয়া হয়েছিল। জামায়াতের প্রাপ্ত ভোটের দিকে লক্ষ্য করলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। প্রতি আসনে গড়ে ৮৬ হাজার ৫৪৬টি করে ৩৮ আসনে জামায়াত পেয়েছিল ৩২ লাখ ৮৮ হাজার ৭৮২ ভোট। ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াতের প্রাপ্ত ভোট ছিল ২৩ লাখ ৮৫ হাজার ৩৬১ ভোট। সে হিসাবে ২০০৮-এর নির্বাচনে জামায়াতের ভোট বেড়েছে নয় লাখ তিন হাজার ৪২১টি শতকরা হিসাবে ১৪ ভাগ। এর সঙ্গে বাকি ২৬১ আসনে জামায়াতের ভোটারদের কথাও মনে রাখা দরকার যারা চার দলীয় জোট প্রার্থীদের ভোট দিয়েছিলেন। প্রতি আসনে কম করে যদি ১০ হাজারও ধরা হয় তাহলেও জামায়াতের ভোটারদের সংখ্যা হবে ২৬ লাখ ১০ হাজার। প্রতি আসনে ১৫ বা ২০ হাজার না ধরে সবচেয়ে রক্ষণশীল হিসাবে প্রতি আসনে যদি ১০ হাজার করে ধরেও ৩৮ আসনে প্রাপ্ত ভোটের সঙ্গে যোগ করা হয় তাহলে দেখা যাবে, জামায়াতের ভোটার ছিলেন অন্তত ৫৮ লাখ ৯৮ হাজার ৭৮২ জন। কিন্তু এতে বিপুলসংখ্যক ভোটার ভোট দিলেও সংসদে জামায়াতকে আসন দেয়া হয়েছিল মাত্র দুটি। অথচ এর আগের সংসদেও জামায়াতের এমপি ছিলেন ১৭ জন।
এভাবে অতি সংক্ষেপে পর্যালোচনা করলেও প্রমাণিত হবে যে, ২০০৮ সালের যে নির্বাচনের মাধ্যমে চার ভাগের মধ্যে তিন ভাগেরও বেশি আসনে মহাজোট জিতেছিল সে নির্বাচনে রীতিমতো ‘ডিজিটাল খেল’ দেখানো হয়েছিল। কারচুপি বা জালিয়াতি শুধু নয়, ‘ডিজিটাল চৌর্যবৃত্তি’ও করা হয়েছিল। পেছনে কোন কোন বিশেষ শক্তি ছিল সে সম্পর্কে এতদিন পর নিশ্চয়ই নতুন করে বলার দরকার পড়ে না। কিন্তু যে কথাটি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে জানানো দরকার তা হলো, এই ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করা হয়েছিল অনেক আগে থেকে। উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের ইসলামী ও জাতীয়তাবাদী শক্তিকে ধ্বংস করা, যাতে সংশ্লিষ্ট বিদেশী শক্তিগুলো তথাকথিত নির্বাচিত সরকারকে দিয়ে তাদের ইচ্ছা পূরণ করিয়ে নিতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না, শেখ হাসিনার সরকার তাদের ইচ্ছা পূরণ ও হুকুম তামিল করেছে সর্বতোভাবেই। এখনও সরকার সেবাদাসের ভূমিকাই পালন করে চলেছে। পেছনে ষড়যন্ত্র ও গোপন পরিকল্পনা ছিল বলেই বিএনপিসহ চার দলীয় জোটকে একই সঙ্গে বেশ কয়েকটি ক্ষমতাধর ও শক্তিশালী ফ্যাক্টরের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়েছিল। এসবের মধ্যে প্রকাশ্যে ছিল আওয়ামী মহাজোট, অন্যদিকে অদৃশ্য অবস্থায় তৎপর ছিল নির্বাচন কমিশন, প্রশাসনের একটি বিশেষ গোষ্ঠী, তিনটি দেশের দূতাবাস ও গোয়েন্দা সংস্থা এবং কয়েকশ’ এনজিও। ছিল বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ ও জাতিসংঘের এজেন্টরা। বড় কথা, মইন-ফখরুদ্দিনরা তো ছিলেনই। এতগুলো ক্ষমতাধর ফ্যাক্টরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসলে কারও পক্ষেই জিতে আসা সম্ভব ছিল না। চারদলীয় জোটও তাই জয়ী হতে পারেনি। চারদলীয় জোটকে আসলে হারিয়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু দেশপ্রেমহীন ক্ষমতালোভী শেখ হাসিনার কারণে সেদিনের ষড়যন্ত্র সফল হলেও আওয়ামী লীগের ভোট যে বাড়েনি বরং অনেক কমেছে এবং অন্যদিকে বিএনপিসহ দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী দলগুলোর ভোট যে বহুগুণে বেড়ে গেছে তারই প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে। সুতরাং ধরে নেয়া যায়, তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় কোনো সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলে জাতীয় নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ ও তার মহাজোটকে একইভাবে কুপোকাত হতে হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads