শুক্রবার, ২৬ জুলাই, ২০১৩

প্রধানমন্ত্রীর ‘ইমেজ’ বিল্ডিং প্রকল্প এবং মন্ত্রীদের শেষ চেষ্টা


রাজনীতিতে ‘ঠ্যালা’ বলে একটা কথা রয়েছে। ‘ঠ্যালা’র নাম নাকি বাবাজি এবং ঠ্যালায় পড়লে ছাগল আর বাঘেও নাকি এক ঘাটে পানি খায়! মেয়াদের শেষ পর্যায়ে এসে যাওয়া আওয়ামী মহাজোট সরকারের অবস্থাও অনেকাংশে তেমনই হয়েছে। লক্ষ্য করে দেখুন, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের বেশিরভাগই বেশ কিছুদিন ধরে হিন্দু সন্ন্যাসীদের মতো ‘মৌনতা’ অবলম্বন করে চলেছেন। যেমন রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল (অব.) ফারুক খানের মতো ডাকসাঁইটে মন্ত্রীদের সম্পর্কেও আজকাল খুব একটা খবর পাওয়া যায় না! কথায় কথায় হুংকার দেয়ার জন্য আলোচিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনেরই বা খবর কি! ওদিকে নিজের ভাই মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমকে ‘রাজাকার’ আখ্যা দেয়ার পর থেকে ধাওয়ার মুখে রয়েছেন বস্ত্রমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী। তাকে এমনকি এই মর্মে ঘোষণা দিতে হয়েছে যে, তিনি আর কখনো ইলেকশনে দাঁড়াবেন না! মন্ত্রী-মিনিস্টারও হবেন না।
ক্ষমতাসীনদের অবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য পটুয়াাখালীর ‘বিখ্যাত’ এমপি গোলাম মাওলা রনির গ্রেফতার নাটক সম্পর্কেও যৎকিঞ্চিত বলা দরকার। কারণ, সাংবাদিকদের পেটানোরও অনেক আগে থেকে টিভির টকশোগুলোতে তিনি বেশি পিটিয়ে এসেছেন সরকারকে অবশ্যই মুখে মুখে, কথার মাধ্যমে। সে কারণে রনির ওপর গোস্বা অনেকেই করেছিলেন। তারাও তক্কে তক্কে ছিলেন। সুযোগ আসা মাত্র (নাকি সুচিন্তিতভাবে সুযোগ সৃষ্টি করে?) তাই দেরি করেননি তারা। কথা উঠেছে এর সঙ্গে হঠাৎ প্রধানমন্ত্রীকে টেনে আনায়। কারণ, বেশ ক’টি দৈনিকের খবর হলো, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই এমপি রনিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, রনির সন্ত্রাসী ধরনের সব কা--কীর্তি সম্পর্কেই জানা ছিল প্রধানমন্ত্রীর। কিন্তু এতদিন এর-ওর ভাগে ‘ভাগ’ যাওয়ার বিষয় ছিল বলে দরকার যেমন হয়নি তেমনি কিছু বলেনওনি প্রধানমন্ত্রী। হয়তো সহজে বলতেনও না। কিন্তু সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গেছে পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর। এখন তাই একদিকে মন্ত্রী-মিনিস্টারদের কম কথা বলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে অন্যদিকে চেষ্টা চলছে প্রধানমন্ত্রীর ‘ইমেজ’ বিল্ডিং করার। ‘বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্ব’ হলেও এমপি রনিকে তাই মিডিয়াকে দিয়েই শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর এই ‘ইমেজ’ বিল্ডিং প্রকল্পকে সাফল্যম-িত করার জন্য আরো অনেকেই নাকি রনির মতো কিংবা রনির চাইতেও মারাত্মক পরিণতির শিকার হতে পারেন।
তাই বলে কথা বলা কিন্তু একেবারে বন্ধ করেননি সকলে। উল্লেখযোগ্য মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে এখনো মাঝে-মধ্যে শোরগোল করে চলেছেন আইনের ‘ফুল’ মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ এবং তার প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। গলায় আগের মতো জোর না থাকলেও এই দু’জন বিশেষ করে কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, রায় এবং রায় কার্যকর করার ব্যাপারে সোচ্চার থাকার চেষ্টা করছেন। এর কারণ, তাদের ওপর চাপানো ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। কোনোভাবে একজনকেও যদি ‘ঝোলাতে’ না পারেন তাহলে নাকি ‘খবর’ আছে বলেই এখনো সময়ে-সময়ে তারা কথা না বলে পারছেন না।
‘বলনেওয়ালাদের’ মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। দু’জনের মধ্যে ‘রাবিশ’ ধরনের মন্তব্য এবং শেয়ার কেলেংকারীর খলনায়কদের বাঁচিয়ে দেয়ার মতো অনেক কারণে অর্থমন্ত্রীর প্রচুর ‘নামডাক’ রয়েছে।  বিরাট বপুর সে অর্থমন্ত্রীকেই সম্প্রতি আচ্ছামতো ধোলাই করেছেন ওবায়দুল কাদের। সাংবাদিকদের কাছে ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলেছেন, অর্থমন্ত্রীর নাকি ‘মেমোরি ডাউন’ হয়ে গেছে! বয়সের ভারে অনেক সময় তিনি নাকি কথার ‘খেই’ হারিয়ে ফেলেন! সেজন্যই অর্থমন্ত্রী নাকি পদ্মা সেতুর সম্ভাবনা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। উল্লেখ্য, আগেরদিন অর্থাৎ ২৮ জুন অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহ্বান করা হলেও ডিসেম্বরের মধ্যে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করা যাবে কি না সে ব্যাপারে তার সন্দেহ রয়েছে। অমন মন্তব্যের জবাবেই তেড়ে উঠেছিলেন যোগাযোগমন্ত্রী। ‘মেমোরিও ডাউন’ হওয়া নিয়ে তামাশা করলেও ওবায়দুল কাদের কিন্তু অর্থমন্ত্রীর যুক্তিকে খ-ন করতে পারেননি। তাকে বরং স্বীকার করতে হয়েছিল, ‘স্টান্টবাজি’ করে লাভ নেই। বর্তমান সরকারের বাকি চার মাসে সেতুর মূল কাজও শুরু করা সম্ভব নয়। যেহেতু আওয়ামী লীগ করেন সেহেতু ওবায়দুল কাদেরের পক্ষে সম্ভব না হওয়ার প্রকৃত কারণ জানানো সম্ভব হয়নি।  চাকরি যাওয়ার ভয় না থাকলে তিনি বলতেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে ‘দেশপ্রেমিক’ খেতাব পাওয়া সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের নেতৃত্বে ‘উচ্চ পর্যায়ের’ দুর্নীতির মাধ্যমে পদ্মা সেতুকে যে ‘কফিনে’ ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে পরবর্তীকালে অন্য সবাই সে ‘কফিনে’ শুধু পেরেকই ঠুকেছেন। বিশ্বব্যাংক তো ঋণ চুক্তিই বাতিল করেছে। এতকিছুর পর কীর্তিমান যোগাযোগমন্ত্রী শোনাচ্ছেন, বিশ্বব্যাংকের জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে তারা নাকি অনেক সময় নষ্ট করে ফেলেছেন এবং এই অপেক্ষা করাটা নাকি উচিত হয়নি! শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত মন্ত্রী হিসেবে এমন কথা ওবায়দুল কাদের বোঝাতে চাইতেই পারেন, অন্যদিকে দেশপ্রেমিক কোনো মহলই কিন্তু মনে করেন না যে, মন্ত্রী আদৌ সঠিক মূল্যায়ন করেছেন। তার বরং বলা উচিত ছিল, দুর্নীতির পথে পা বাড়ানোর ফলেই পদ্মা সেতু হিমঘরে শুধু নয়, কফিনের ভেতরেও ঢুকে পড়েছে। কিন্তু সত্য স্বীকার করলে যে চাকরিই থাকবে না! সে কারণেই সব ঝাল তিনি মিস্টার মুহিতের ওপর ঝেড়েছেন।
এদিকে অর্থমন্ত্রী কিন্তু মোটেও বাড়িয়ে বলেননি। আসলেও মাত্র চার মাসের মধ্যে টেন্ডার আহবান ও বাছাই থেকে কাজ দেয়া এবং নির্মাণ শুরু করা পর্যন্ত বিশাল কর্মকা-ের কিছুটাও করে ওঠা সম্ভব নয়। তা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করাসহ বিভিন্ন কারণে ওবায়দুল কাদের অর্থমন্ত্রীকে ধোলাই করলেও বাস্তবে ‘স্বপ্ন’ দেখানোর এখন আর কোনো সুযোগ নেই। বর্তমান সরকারের বাকি চার মাসে সেতুর মূল কাজও শুরু করা সম্ভব নয়। কিন্তু সব জেনেও ওবায়দুল কাদের একদিকে চীনের সঙ্গে ২০ হাজার কোটি ডলারের ঋণচুক্তি স্বাক্ষরের জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন, অন্যদিকে হাজার কোটি টাকার অংকে হিসাব দিয়ে জানিয়েছেন, পদ্মা সেতুর কাজ নাকি ‘চলমান’ রয়েছে! সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, সত্য আসলে কোনটি? বাস্তবে বরং ‘সব রসুন’ সংক্রান্ত প্রবাদের কথা স্মরণ  করিয়ে বলা হয়েছে, ওবায়দুল কাদের এবং মুহিত সাহেবরা আসলে নতুন কৌশলে ‘নাটক’ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। মেয়াদের একেবারে শেষপ্রান্তে এসে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করার অজুহাতে বিশিষ্ট কারো কারো স্বজনের পকেট ফোলানোর পাশাপাশি দলের নির্বাচনী তহবিলকেও যদি ‘মোটাতাজা’ করা যায় তাহলে মন্দ কি! এজন্যই সম্ভবত অর্থমন্ত্রী ও যোগাযোগম একযোগে মাঠে নেমেছেন। ব্যঙ্গ-তামাশা ও বিতর্কের আড়ালে তারা প্রধানমন্ত্রীর ‘ইমেজ’ বিল্ডিং প্রকল্পকে সফল করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। অন্য দু’চারজনও দৃশ্যপটে আসি আসি করছেন। একই কারণে শেষ মুহূর্তে ‘বলী’ হয়েছেন এমপি রনি। যে করেই হোক প্রধানমন্ত্রীর ‘ইমেজ’ বাড়াতেই হবে!
একই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য লাফিয়ে এসেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনিও। ভারতের কাছ থেকে জনগণকে দেখানোর মতো কিছু একটা আদায়ের ‘শেষ চেষ্টা’ হিসেবে আবারও তিনি দিল্লী গেছেন। কিন্তু তারও আগে হঠাৎ এক সংবাদ সম্মেলন ডেকে আলোড়ন তুলেছেন তিনি। ২২ জুলাইয়ের ওই সংবাদ সম্মেলনে গাল ফুলিয়ে ও ঠোঁক বাঁকিয়ে তুমুল ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন দীপু মনি। অভিযোগ তুলে বলেছেন, মিডিয়া নাকি তার বিদেশ সফর নিয়ে অসত্য ও বানোয়াট খবর প্রকাশ করে চলেছে। এসব রিপোর্টে হিসাবের অংকেও ভূল করা হচ্ছে। একটি দৈনিকে সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্টের উদাহরণ দিতে গিয়ে মন্ত্রী বলেছেন, ওই পত্রিকার রিপোর্টার ও সম্পাদক এমনকি ৬২ আর ১৭-এর মধ্যকার পার্থক্য সম্পর্কেও জানেন না! তাদের ‘গণিত-বিভ্রাট’ রয়েছে বলেও কৌতুক করেছেন দীপু মনি। কারণ, দীপু মনির নিজের হিসাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি এ পর্যন্ত বিদেশ সফর করেছেন ‘মাত্র’ ১১৪ বার কিন্তু ওই পত্রিকাটি লিখেছে ১৮০-১৯০ বার। দ্বিতীয়ত, তার দ্বিপাক্ষিক সফর ছিল ৬২টি কিন্তু পত্রিকাটি লিখেছে ১৭টি। এ পর্যন্ত এসেই ৬২ আর ১৭-এর মধ্যকার তফাত সম্পর্কে জ্ঞান দিয়েছেন দীপু মনি। কথিত ‘গণিত বিভ্রাট’ কিংবা হিসাবের ভুলই অবশ্য ক্ষোভের একমাত্র কারণ নয়। প্রধান কারণ হলো, তার মোট বিদেশ সফরের সময়কাল এবং সফলতা সম্পর্কেও বিভিন্ন পত্রিকায় নাকি অসত্য খবর প্রকাশ করা হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেও তাকে নাকি অন্যায়ভাবে তুলনা করা হয়েছে। অথচ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো দীপু মনির কোনো প্রাইভেট জেট  বিমান নেই। তাকে বরং আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো বাণিজ্যিক বিমানে টিকেট কেটে যাতায়াত করতে হয়। দেশের জন্য এ ভারী লজ্জার কথাই বটে! কিন্তু তা সত্ত্বেও মিডিয়া বানোয়াট খবর প্রকাশ করছেই।
অন্য একটি উদাহরণ দিতে গিয়ে দীপু মনি জানিয়েছেন, আলোচ্য দৈনিকটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি নাকি বিদেশ সফরে ‘বিশ্ব রেকর্ড’ করেছেন! অথচ সত্য হলো, সাড়ে চার বছরে বা ১৬০০ দিনের চেয়ে কিছু বেশি সময়ের মধ্যে তিনি বিদেশে কাটিয়েছেন ‘মাত্রই’ ৫১৭ দিন! ১১৪ বার সফরে গিয়ে মেয়াদের মাত্র ৩১ ভাগ অর্থাৎ প্রতি তিন দিনে একদিন বিদেশে কাটিয়েছেন তিনি। এতেই কিভাবে ‘বিশ্ব রেকর্ড’ হয়ে গেছে সেকথা বুঝতেই পারেননি পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তাছাড়া তার অর্জনের ‘ঝুলি শূন্য’ বলেও ঢাহা মিথ্যা এক মন্তব্য রয়েছে রিপোর্টটিতে। অথচ ‘ফ্লাই’ না করে বা  ‘উড়াল’ না দিয়ে আগের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মতো তিনিও যদি ঘরে বসে থাকতেন তাহলে নাকি এত বিপুল সফলতা অর্জন করা সম্ভব হতো না। দীপু মনি অবশ্য জানাতে পারেননি, কেন ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি এখনো স্বাক্ষরিত হচ্ছে না। বিএসএফ-এর হত্যা এবং সীমান্ত প্রটোকল স্বাক্ষরিত না হওয়ার ব্যাপারেও দীপু মনি কিছূ বলতে পারেননি। তবে অনেকাংশে কূটনীতি শেখানোর ঢঙে তিনি বলেছেন, এগুলো নাকি ‘কূটনৈতিক ব্যর্থতা’ নয়! তার এত সফর ও তৎপরতা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন ও কিভাবে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করতে পারলোÑ এমন এক প্রশ্নের জবাবে দীপু মনি সোজা বেগম খালেদা জিয়া এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দিকে আঙুল তুলেছেন। খালেদা জিয়া নাকি মার্কিন একটি দৈনিকে নিবন্ধ লিখে বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা না দেয়ার জন্য ওকালতি করেছেন। ওদিকে ড. ইউনূস তো গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যাপারে সরকারের ‘সঠিক’ সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তৎপরতা চালাচ্ছেন বহুদিন ধরেই। এজন্যই নাকি বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র! প্রশ্ন উঠেছে, কূটনীতিতে এতই যখন সাফল্য দীপু মনিদের তাহলে তারা কেন মাত্র দু’জন মানুষের কাছে হেরে গেলেন? আরো কিছু বিষয়েও সাংবাদিকদের স্তম্ভিত করেছেন দীপু মনি। যেমন তিনি বলেছেন, সাফল্য থাকলেই ‘তোপের মুখে’ পড়তে হয় এবং তার সাফল্যের পরিমাণ বেশি হওয়ায় ‘ঈর্ষান্বিত’ হয়ে পত্রিকাগুলো নাকি মিথ্য রিপোর্ট করছে! একই অনুষ্ঠানে দীপু মনি ঘোষণা দিয়েছেন, মিথ্যা রিপোর্ট করার জন্য এসব পত্রিকার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মহাজোট সরকারের মহাদাপুটে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন কোনো পত্রিকার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দেন তখন ভীত না হয়ে পারা যায় না। কারণ, সরকারের নেয়া এই ‘ব্যবস্থার’ কারণে  দৈনিক আমার দেশ-এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেছে, এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদককে জেলে কাটাতে হচ্ছে। দৈনিক সংগ্রাম এবং দিগন্ত ও ইসলামিক টিভিসহ আরো কিছূ গণমাধ্যমকেও এরই মধ্যে দীপু মনিদের নেয়া ‘ব্যবস্থার’ অর্থ হাড়ে হাড়ে টের পেতে হয়েছে। পাশাপাশি অন্য একটি কঠিন সত্যও কিন্তু রয়েছে। কারণ, দীপু মনি বিশেষ একটি দৈনিককে ধরে টান দিলেও কারণে-অকারণে তার বিদেশ সফর নিয়ে দেশের প্রায় সব পত্রিকাতেই বিভিন্ন সময়ে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। তাকে নিয়ে এমনকি জাতীয় সংসদেও নিন্দা-সমালোচনার ঝড় বয়ে গেছে। এতে সোচ্চার হয়েছেন তার দলেরই এমপিরা সেখানে খালেদা জিয়া কিংবা ড. ইউনূস গিয়ে উস্কানি দেননি। তাছাড়া পৃথিবীর আর কোনো গরীর রাষ্ট্রের কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী এত অল্প সময়ের মধ্যে এত বেশিবার বিদেশ সফর করেছেন বলে জানা যায় নাÑ যে কারণে ‘বিশ্ব রেকর্ড’ করার বিষয়টি এসেছে। এক রিপোর্টে জানা গেছে, বিদেশ সফরে এশিয়া, ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদেরও টপকে গেছেন তিনি। ভারত ও পাকিস্তানের সদ্য-সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণা এবং হীনা রব্বানী বিদেশ সফরে ‘সেঞ্চুরিও’ করতে পারেননি। মাত্র সেদিন বিদায় নেয়া মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন চার বছরে ১১২টি দেশ সফর করেছেন এবং বিদেশে কাটিয়েছেন ৩০৬ দিন। মার্কিন কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীরই ৪০০ দিনের বেশি বিদেশ সফরের রেকর্ড নেই। অন্যদিকে আমাদের দীপু মনি সাড়ে চার বছরেই বিদেশে কাটিয়েছেন ৫১৭ দিন! একে তো ‘বিশ্ব রেকর্ড’ বলা যেতেই পারে!
কথা শুধু এটুকুই নয়। এমনও দেখা গেছে, কোনো কোনো উপলক্ষে তিনি নাশতা করেছেন ঢাকায়, লাঞ্চ করেছেন দিল্লী¬তে এবং ডিনার সেরেছেন গিয়ে নিউইয়র্কে। বড়কথা, প্রবাসীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যুগ্ম-সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের জন্য আয়োজিত কোনো সেমিনারের মতো অজুহাতেও তিনি দলবল নিয়ে উড়াল দিয়েছেন। যেমন গত ১৩ জুন বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতিমন্ত্রীদের জন্য ইউনেস্কো আয়োজিত এক ২০ মিনিটের ফটোসেশনেও গিয়ে যোগ দিয়েছিলেন দীপু মনি। সেখানে তিনিই ছিলেন বিশ্বের একমাত্র পররাষ্ট্রমন্ত্রী! বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে হাসাহাসি কম হয়নি। কিন্তু দীপু মনির মনে হয়েছে, পত্রিকাগুলো তার মতো বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না বলে ‘ঈর্ষান্বিত’ হয়ে পড়েছে! এখানে খরচের হিসাবে না যাওয়াটাই অবশ্য বেহতর! কারণ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক হিসাবে জানা গেছে, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্যাকেজ ও সিঙ্গেল ট্যুরে দীপু মনির জন্য খরচ হয়েছে চার কোটি ৪৬ লাখ ৬৪ হাজার ৯৫৯ টাকা। বাকি দেড় বছরের খরচের ব্যাপারে পাঠকরাও ধারণা করতে পারেন। এখানে একটি তথ্য অবশ্যই উল্লেখ করা দরকার। সেটা হলো, দীপু মনি এমিরেটস-এর মতো অভিজাত ও ব্যয়বহুল এয়ারলাইন্সে ‘ফ্লাই’ করতে বেশি পছন্দ করেনÑ যার ফার্স্ট ক্লাস প্রিমিয়াম স্যুইটের ভাড়া আট থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত! এ ধরনের বিভিন্ন তথ্য ও পরিসংখ্যানের পরিপ্রেক্ষিতেই বলা হচ্ছে, কোনো পত্রিকা বা সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার পরিবর্তে দীপু মনির উচিত প্রথমে তার অর্জিত ‘বিপুল সাফল্যের’ একটা ফিরিস্তি হাজির করা। শুধু ফিরিস্তি দিলেই চলবে না, কোটি কোটি টাকা খরচ করে এবং মেয়াদের ৩১ ভাগ সময় বিদেশে কাটিয়ে দেশের জন্য ঠিক কোন ধরনের ‘সাফল্য’ তিনি অর্জন করে এনেছেনÑ প্রমাণসহ সে ব্যাখ্যাও তার দেয়া উচিত। না হলে ‘বিশ্ব রেকর্ড’ ধরনের সমালোচনা চলতেই থাকবে। কতজনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার সাধ্য রাখেন দীপু মনি? অত সময়ও কি তিনি আর পাবেন?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads