রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০১৩

নির্বাচন কমিশনকে সংবিধান নির্ধারিত সীমার মধ্যে থাকতে হবে


জেনারেল মইন উ আহমেদ ও ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত যে অসাংবিধানিক সরকার বহু কলাকৌশল খাটিয়ে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসিয়ে গেছে সে সরকারের সঙ্গে তখনকার নির্বাচন কমিশনের বিশেষ সম্পর্ক নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে এখনো আলোচনা রয়েছে। এসবের মূলকথা হলো, লগি- বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ থেকে দেশপ্রেমিক ইসলামী ও জাতীয়তাবাদী দলগুলোকে নির্মূল করার এবং আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের ব্যাপারে এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন ইসিও ন্যক্কারজনক ভূমিকা পালন করেছিল। এ শুধু বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো বড় দলগুলোর উপস্থাপিত অভিযোগ নয়, নানাভাবে প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত এক কঠিন সত্যও। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, পরবর্তীকালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ‘নির্বাচিত’ ও ‘গণতান্ত্রিক’ নামধারী সরকারের আমলেও ইসির নীতি, কৌশল ও কর্মকা-ে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্যযোগ্য হয়নি। অর্থাৎ সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী সম্পূর্ণ স্বাধীন একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে যদিও এ সময়ের মধ্যে শামসুল হুদার স্থলে সিইসির পদে বসেছেন কাজী রকিবউদ্দিন আহমেদ। দু’জন নির্বাচন কমিশনারও বদল হয়েছেন। কিন্তু ইসির অবস্থা রয়েছে আগের মতোই। অর্থাৎ ইসি এখনো সরকারের হুকুম তামিল করতেই বেশি ব্যস্ত রয়েছে। এ সম্পর্কিত প্রমাণের জন্য বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে কমিশনের নানামুখী তৎপরতার উল্লেখ করা যেতে পারে। দেশের প্রধান দল বিএনপিকেও টার্গেট করেছে ইসিÑ যেমনটি করেছিল হুদা সাহেবের ইসি। তখনকার মতো এ সময়েও কমিশন বিএনপিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কমিশন বিএনপির কাছাকাছি নামের সম্প্রতি গজিয়ে ওঠা দল বিএনএফকে নিয়ে বেশি আগ্রহ দেখানোয় এবং জোর তৎপরতা চালানোর পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যখন ইসির কাছে বিএনপিকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবাদ জানাতে হয়েছে, এম কে আনোয়ারের নেতৃত্বে দলের প্রতিনিধি দল অন্তত তিনবার গিয়ে বৈঠক করেছেন নির্বাচন কমিশনারদের সঙ্গে। কিন্তু এতকিছুর পরও বিএনএফকে নিয়ে ইসির মাতামাতি থেমে যাওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত বিভিন্ন রিপোর্টে বরং উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো খবরই জানা যাচ্ছে। যেমন একজন নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্য উদ্ধৃত করে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, বিএনপির অভিযোগ ও প্রতিবাদের প্রসঙ্গ সুকৌশলে পাশ কাটিয়ে ওই কমিশনার ঘোষণা করেছেন, ইসি নাকি ‘বেআইনী’ কিছু করবে না! বিএনএফসহ আর কয়েকটি দল যারা নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে তারা যদি নির্বাচন কমিশনের শর্ত পূরণ করে তাহলে তাদের নিবন্ধিত করা হবে। এ বিষয়ে কেউ চাইলে তারা কমিশনের কাছে আপত্তি জানাতে পারবেন। খবর শুধু এটুকু হলে অবশ্য কথা বাড়াতে হতো না। অন্যদিকে আসল খবর এসেছে অন্য এক রিপোর্টে। এতে জানা গেছে, বিএনপির প্রতিপক্ষ হিসেবে বিএনএফকে দাঁড় করানোর জন্য বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে সরকার তো তৎপরতা চালাচ্ছেই, বিএনএফকে নিবন্ধন দেয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনেরও নাকি ব্যতিব্যস্ততার শেষ নেই! বিএনএফ-এর পক্ষে সাফাই গাওয়ার ও প্রয়োজনীয় সব সার্টিফিকেট দেয়ার জন্য ইসির পক্ষ থেকে জেলা ও উপজেলার নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উদ্দেশে চিঠির পর চিঠি পাঠানো হচ্ছে। ধমক ও হুমকিও যাচ্ছে। ফলে ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ অবস্থায় পড়েছেন ওই কর্মকর্তারা। কারণ, নিবন্ধনের জন্য পাঠানো আবেদনের সঙ্গে বিএনএফ এমন ১৩৪ টি উপজেলার নাম দিয়েছিল যেসব স্থানে দলটির অফিস এবং নেতাকর্মীরা রয়েছে বলে দাবি করা হয়েছিল। অন্যদিকে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ১৩৪টির মধ্যে ৯৭টিতেই বিএনএফ-এর কোনো অস্তিত্ব নেই। মাত্র ৩২টি উপজেলায় সাইনবোর্ড ধরনের কিছু বিষয়সহ নামকাওয়াস্তে অস্তিত্ব থাকলেও আশপাশের মানুষ কিছুই জানে না। কিছু এলাকায় আবার সরকারি অফিসকেও বিএনএফ-এর দলীয় কার্যালয় হিসেবে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। এভাবে সব মিলিয়েই প্রমাণিত হয়েছে, ভুঁইফোঁড় দল বিএনএফকে সৃষ্টিই করা হয়েছে সরকারের বিএনপি বিরোধী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য। বড়কথা, সামরিক শাসকদের মতো ‘নির্বাচিত’ ও ‘গণতান্ত্রিক’ সরকারও এজন্য বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থাকেই ব্যবহার করছে!
ঘটনাপ্রবাহে বেশি আপত্তি উঠেছে নির্বাচন কমিশনের প্রশ্নসাপেক্ষ দ্বিমুখী ভূমিকার কারণে। কারণ, বিএনপি বাংলাদেশের জনপ্রিয় ও প্রধান এমন একটি দল ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে যে দলটি বিভিন্ন সময়ে বেশিবার ক্ষমতায় থেকেছে। সুতরাং রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরই বিএনপি সম্পর্কে জানা থাকার কথা, নির্বাচন কমিশনারদের তো বটেই। অথচ তাদের কাছেই সব দিক থেকে বিএনপিকে অনুসরণ করে দলের ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্রসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিবরণী জমা দিয়েছে বিএনএফ। যেমন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে বিএনএফ নিজেদের নেতা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। জিয়ার ১৯ দফাকে বিএনএফও দলীয় কর্মসূচি বানিয়েছে। দলের নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে প্রথমে তারা ধানের শীষ বরাদ্দেরই দাবি জানিয়েছিল, ইসিও দেয়ার চিন্তা শুরু করেছিল। কিন্তু বিএনপির প্রতিবাদের মুখে ইসিকে পিছিয়ে যেতে হয়েছে। সবশেষে ইসি এখন ধানের শীষের পরিবর্তে বিএনএফকে গমের শীষ বরাদ্দ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। অন্যদিকে বিএনপির দিক থেকে আপত্তি উঠেছে সঙ্গত অনেক কারণে। বিএনএফ শুধু জিয়াউর রহমানের নাম ও তার ১৯ দফা কর্মসূচিই ব্যবহার করছে না, নির্বাচন উপলক্ষে একপাশে জিয়ার এবং অন্য পাশে গমের শীষের ছবিসহ এমন পোস্টারের নমুনাও তৈরি করেছে, যা দেখে বোঝার উপায় থাকে না যে, ওটা বিএনপির পোস্টার নয়। কিন্তু সব জেনে-বুঝেও নির্বাচন কমিশন ওই দলটিকেই নিবন্ধিত করার এবং গমের শীষ প্রতীক দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে। একই ইসি আবার বলেছে, বিএনএফ-এর ব্যাপারে ‘বেআইনী’ কিছু নাকি করা হবে না। তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে কথাটার মধ্যে কিন্তু অন্য রকম উদ্দেশ্য লক্ষ্য করা গেছে। কারণ, উদ্দিনদের অসাংবিধানিক সরকারের সময় সেকালের সিইসিও ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’র আড়াল নিয়ে বিএনপিকে ছেঁটে ফেলার ভয়ংকর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আমরা তো  মনে করি, বিএনপিকে ঘায়েল করার প্রধান উদ্দেশ্য নিয়ে সরকার যেমন বিএনএফ নামের দলটিকে মাঠে নামিয়েছে, ইসিও তেমনি সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যই আইনের মারপ্যাঁচ খাটানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। বিষয়টি অবশ্যই স্বাভাবিক নয়। কারণ, এমন এক সময়ে বিএনপির আদলে বিএনএফ নামের দলটিকে মাঠে নামানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, দেশে যখন নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলছে। সরকার ব্যবস্থা ও নামের ব্যাপারে বেগম খালেদা জিয়া ছাড় দেয়ার ঘোষণা দিলেও আওয়ামী লীগ চেষ্টা চালাচ্ছে শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের জন্য। ফলে রাজনৈতিক সংকটও মারাত্মক হতে চলেছে। এমন এক অবস্থায় যদি বিএনপিকে নির্মূল করার এবং তার স্থলে বিএনএফ ধরনের কোনো দলকে নামানো হয় তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তেমন অবস্থায় দায়ী হতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। এজন্যই ইসির উচিত নিজের স্বাধীন মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও নিশ্চিত করা এবং সরকার কিংবা অন্য কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অংশ না নেয়া। বিএনপির বিষয়ে শুধু নয়, জামায়াতে ইসলামীর বিষয়েও নির্বাচন কমিশনকে আইন ও সংবিধান নির্ধারিত সীমার মধ্যে থাকতে হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads