বুধবার, ৩১ জুলাই, ২০১৩

রাজনৈতিক সংলাপ : অতীতের অভিজ্ঞতা



সেই পাকিস্তান আমল থেকে দেখে আসছি, দেশে যখন নির্বাচন উপলক্ষে রাজনৈতিক সঙ্কট দেখা দেয়, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বিশিষ্ট আইনজীবী, সমাজবিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবী মহল বিবদমান সব পক্ষকেই সংযত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সংলাপে বসার অনুরোধ জানান। সরকারি দল রাজি হয়ে সংলাপে বসলেও দুই একটি ক্ষেত্র বাদে সরকারি দলের একগুঁয়েমির কারণেই সংলাপ নিষ্ফল হয়েছে। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হয় এবং পাকিস্তানে দ্বিতীয়বার সামরিক অভ্যুত্থান হয়। আইয়ুব খানকে বিদায় নিতে হয়। ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া খানের সাথে বঙ্গবন্ধুর সংলাপ সরকারের সদিচ্ছার কারণে ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতার সফলতাআমাদের মহান স্বাধীনতা এবং পাকিস্তানের ক্ষমতা থেকে ইয়াহিয়ার করুণ বিদায়। ১৯৮৪ সালে সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের সাথে বিরোধী দলের সংলাপ ব্যর্থ হয় ক্ষমতাসীন সরকারের কারণে। এরশাদ কারচুপির নির্বাচন করে ক্ষমতায় ৯০ পর্যন্ত থাকলেও রাজনৈতিক বৈধতা পাননি। ১৯৯৪ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কমনওয়েলথ মহাসচিবের মধ্যস্থতায় সংলাপ হলেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের কারণে ওই সংলাপ ব্যর্থ হয়। ১৯৯৪ সালের যে প্রস্তাবে আওয়ামী লীগ রাজি হয়নি, ১৮ বছর পর সেই প্রস্তাবই তারা পুনরায় দিচ্ছে। এ যেন ওপর দিকে থুথু ফেলার মতো অবস্থা। ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের সাথে বিরোধী দলের সংলাপও ব্যর্থ হয়। ফলে বিএনপিকে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার জন্য সংশোধনী পাস করে ক্ষমতা ছাড়তে হয়। ২০০৬ সালে মরহুম আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ও আবদুল জলিলের মধ্যে অনুষ্ঠিত সংলাপ ব্যর্থ হয় দুই দলের শীর্ষ নেতৃত্বে ভূমিকার কারণে। আলোচক দুজনের মধ্যে একজন বহিষ্কৃত হয়েছেন এবং অপরজন মহাসচিবের পদ হারিয়ে দলে অপাঙ্ক্তেয় হয়ে পড়েন। অতীত সংলাপগুলোর মধ্যে একটি বাদে বাকি সব সংলাপই ছিল নির্বাচন কিভাবে হবে, তা কেন্দ্র করে। এখন প্রথিতযশা ব্যক্তিরা দুই নেত্রীকে সংলাপে বসার আহ্বান জানাচ্ছেন। তারা নিশ্চয়ই উপরিউক্ত ছয়টি সংলাপের ভাগ্য সম্পর্কে আমার চেয়ে অনেক বেশি জানেন। কিন্তু সংলাপে বসার নিষ্ফল আহ্বান জানিয়ে কী লাভ? কারণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন ছাড়া তাকে নির্বাচনে হারানোর ক্ষমতা কারো নেই। তাই সেই সাথে প্রতিবন্ধকতার মোক্ষম অস্ত্র সাবেক প্রধান বিচারপতির মাধ্যমে প্রয়োগ করেছেন। ২০০৬ সালে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা এবং প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার ছয়টি বিকল্প বিধান থাকা সত্ত্বেও তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এক নম্বর বিধান অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে মানতে অস্বীকৃতি জানায় এবং ক্ষমতাসীন বিএনপি সরাসরি ছয় নম্বর বিকল্পে গিয়ে রাষ্ট্রপতিকে প্রধান উপদেষ্টা করে বসে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে সংবিধান মোতাবেক রাষ্ট্রপতি প্রচুর ক্ষমতার অধিকারী। পৃথিবীর কোথাও কি আছে উপরাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি তার দায়িত্ব পালন করতে পারেন? বরং রাষ্ট্রপতির অবর্তমানে তিনিই রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করতে পারেন। আওয়ামী লীগ সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। তাহলে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে সুবিধা হয়। এক দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বিতর্কিত করে ভবিষ্যতে তা বন্ধের নীল-নকশা করা গেল। অপর দিকে একটি সামরিক তত্ত্বাবধায়কসরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের সাহায্যে নির্বাচনের পূর্বেইজয় লাভের ব্যবস্থা করা গেল। দলটি বিচারপতি হাসান শহীদ জিয়ার আমলে বিএনপি করতেন, এই অভিযোগে তাকে মানতে অস্বীকৃতি জানায়। অথচ সংবিধানের তোয়াক্কা না করে দ্বৈত নাগরিক ফখরুদ্দীনকে প্রধান উপদেষ্টা মানল কোন নৈতিকতায়? শুধু তা-ই নয়, রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের সরকারের চারজন জাঁদরেল উপদেষ্টা, যারা সবাই আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তারা পদত্যাগ করার সাথে সাথে আওয়ামী নেত্রী তাদের এই সাহসীকাজের জন্য অভিনন্দন জানালেন। অথচ তারা বর্তমান সঙ্কটে একই অভিযোগ তার সরকারের বিরুদ্ধে করায় তাদের নির্বাচন করতে ব্যর্থবলে উপহাস করা হচ্ছে। সংবিধানে বিধান থাকা সত্ত্বেও যারা শুধু এর প্রয়োগ সম্পর্কে সংলাপ করে একমত হতে পারেন না, তাদেরই সুধীসমাজ সংলাপে বসে (যা সংবিধান থেকে যারা কলমের এক খোঁচায় নিশ্চিহ্ন করেছেন তাদের কাছেই) সমাধান আশা করেন কিভাবে? তারা যদি সমাধান করতেনই তাহলে তা সংবিধান হতে মুছে ফেলে এই সঙ্কটের সৃষ্টিই করতেন না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads