শনিবার, ৬ জুলাই, ২০১৩

আওয়ামী লীগের চোখে শর্ষে ফুল : তাই বেগম জিয়াকে ডিফেম করার অপচেষ্টা


রোববারের জন্য লিখতে গিয়ে সম্প্রতি কিছু সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি। জাতীয় জীবনে মাঝে মাঝে এমন দুই একটি ঘটনা ঘটে যেগুলো হয় শুক্রবার না হয় শনিবারে ঘটে। যেমন গাজীপুরের নির্বাচন। সারাদেশ দেখছে যে এটি একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও সারাদেশ তাকিয়ে আছে এই নির্বাচনের দিকে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো বলছে যে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়া সত্ত্বেও এটি পার্লামেন্ট নির্বাচন, অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচনের গুরুত্ব লাভ করেছে। গতকাল শনিবার ‘দৈনিক প্রথম আলোর’ প্রধান সংবাদ শিরোনাম, “গাজীপুরে আজ ‘জাতীয়’ নির্বাচন”। এই স্থানীয় সরকার নির্বাচন কেন এত গুরুত্ব লাভ করেছে সেটি সম্ভব হলে পরে বলবো। কিন্তু যে সমস্যার কথা শুরুতে বলেছি সেটি হল এই যে লেখাটি শুরু করেছি শুক্রবার। শেষ করবো শনিবার বেলা ১২টার মধ্যে। অথচ গাজীপুরের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে শনিবার। ফলাফল পাওয়া যাবে রাতে। সেই ফলাফলের ওপর বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলো নানারকম মন্তব্য করবেন। ঐ ধরনের মন্তব্য আমরাও করতে চাই। কিন্তু লেখার সময় এবং সুযোগ থাকবে না। যেহেতু এটি একটি সাপ্তাহিক কলাম তাই পরের বার লিখতে গেলে আরও ৭ দিন অপেক্ষা করতে হবে। সেজন্যই বলছিলাম যে রোববারে প্রকাশিতব্য সংগ্রামের এই কলামটি লিখতে গিয়ে মাঝে মাঝেই আমার অতৃপ্তি এবং অপূর্ণতা থেকে যায়। পাঠকদের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও আমাকে এখন ভিন্ন প্রসঙ্গে যেতে হচ্ছে।
‘ওয়াশিংটন টাইমসে’ বেগম খালেদা জিয়ার কথিত নিবন্ধ নিয়ে সরকারি দল চায়ের পেয়ালায় বিরাট ঝড় সৃষ্টি করলো। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের ছোট বড় নেতারা এমন সব কথা বললেন যে মনে হলো, যেন বেগম জিয়ার কথিত নিবন্ধটির জন্যই আমেরিকা বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করেছে। এসব কথা শুনে হাসবো না কাঁদবো সেটি বুঝতে পারছি না। যারা এসব কথা বলেন তারা আমেরিকার অবস্থান এবং কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে কোন ধারণা রাখেন বলে মনে হয় না। বেগম জিয়া আমেরিকার একটি অপরিচিত অনুল্লেখযোগ্য পত্রিকায় একটি নিবন্ধ লিখলেন, আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট সেই নিবন্ধ পড়ে বাংলাদেশের জন্য জিএসপি অর্থাৎ বিশেষ সুবিধা স্থগিত করলেন, ব্যাপারটি এত সোজা নয়। বেগম জিয়া বা বিএনপি যদি এত ক্ষমতাধর হতে তাহলে এতদিনে অনেক কিছুই উল্টে যেত।
বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়া আলোচ্য প্রবন্ধটি লিখেছেন  কিনা এবং লিখে থাকলে সেটি ছাপানোর জন্য ওয়াশিংটন টাইমসে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কিনা সেটি ভিন্ন ব্যাপার। ভিন্ন ব্যাপার এই জন্য যে আমাদের পক্ষে সেটি জানা সম্ভব নয়। কিন্তু যে প্রশ্ন যে কোন শিক্ষিত মানুষের মনে তাৎক্ষণিকভাবে এসে যায় সেটি হলো এই যে আমেরিকায় ছাপানোর জন্য বেগম জিয়াকে যদি কোন নিবন্ধ লিখতেই হয় তাহলে সেটা ওয়াশিংটন টাইমসের মতো একটি অখ্যাত পত্রিকায় কেন? তিনি তো ‘নিউইয়র্ক টাইমস’, ‘হেরাল্ড ট্রিবিউন’, ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ প্রভৃতি বিশ্ব বিখ্যাত পত্রিকাতেই লিখতে পারতেন।
‘ওয়াশিংটন টাইমস’ সম্পর্কে এখানে একটি ধারণা দেয়া দরকার। আমেরিকায় যতগুলো দৈনিক পত্রিকা রয়েছে তার মধ্যে ওয়াশিংটন টাইমসের স্থান ১২৬ নম্বরে। বুঝতেই পারছেন যে এটি বলতে গেলে কোনো সার্কুলেশনই নয়। সেই পত্রিকাতে বেগম জিয়ার নামে যেটি ছাপা হয়েছে সেটি কোন উপ-সম্পাদকীয় হিসেবে ছাপা হয় নায়। দশটি নিবন্ধ ঐ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিলো। বেগম জিয়ার কথিত নিবন্ধ সেখানে দশ নম্বরে স্থান পেয়েছে। এই যেখানে অবস্থা সেখানে একটি অখ্যাত পত্রিকার দশ নম্বর নিবন্ধের জোরে বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তির প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা জিএসপি’র সুবিধা স্থগিত করে দিলেন? কোন পাগলেও কি এই কথা বিশ্বাস করবে?
॥দুই॥
মার্কিন প্রশাসন যখন এই ধরনের কোন সিদ্ধান্ত নেয় তখন তাদের কে কতগুলো নিয়ম কানুন এবং পদ্ধতির মধ্যদিয়ে যেতে হয়। একজন মন্ত্রী কোন একটি বিষয়ে কোন একটি ইচ্ছা পোষণ করলেন, আর হুট করে প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী সে ব্যাপারে একটি নির্দেশ জারি করলেন, ব্যাপারটি এত সহজ নয়। আমেরিকার পার্লামেন্ট দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট। একটির নাম সিনেট। আর একটির নাম হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ বা প্রতিনিধি পরিষদ। উভয় কক্ষেরই সংবিধান বর্ণিত নিজ নিজ ক্ষমতা রয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রেই দুই কক্ষ থেকেই নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সম্মিলিতভাবে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। উভয় কক্ষকে সম্মিলিতভাবে বলে কংগ্রেস। তবে সাধারণভাবে প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যদেরকেই কংগ্রেসম্যান বলা হয়। কোন সিনেট সদস্য বা সিনেটরকে কংগ্রেসম্যান বললে তিনি নিজেকে ছোট ভাবেন। এছাড়াও কংগ্রেসে এবং সিনেটে রয়েছে বিভিন্ন কমিটি এবং উপ-কমিটি। প্রতিনিধি পরিষদে বা সিনেটে কোন বিষয় উত্থাপানের পূর্বে সেটি সংশ্লিষ্ট হাউজ কমিটি বা উপকমিটি কর্তৃক পরীক্ষিত হয়। তারা কোন দায়সারা গোছের পরীক্ষা করে না। অত্যন্ত খুটিনাটিভাবে তারা পরীক্ষা করে। তারপর বিষয়টি যখন সিনেটে বা প্রতিনিধি পরিষদে উত্থাপিত হয় তখন সেখানেও দায়িত্বশীলতার সাথে দীর্ঘ সময় ধরে আলোচিত হয়। এরপর তাদের সুপারিশ যায় প্রেসিডেন্টের কাছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, কোন দেশের বিরুদ্ধে কোন প্রতিকূল সিদ্ধান্ত নিতে গেলে আমেরিকায় লম্বা প্রক্রিয়ার মাধ্যেমে অগ্রসর হতে হয়। আওয়ামী ঘরানার কথা শুনে মনে হচ্ছে যে বেগম খালেদা জিয়ার ঐ কথিত প্রবন্ধ পড়েই প্রেসিডেন্ট ওবামা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন যে বাংলাদেশের জন্য জিএসপি সুবিধা স্থগিত করতে হবে। আমেরিকায় বেগম জিয়ার যদি এমন পজিশন হতো তাহলে তার দল এবং তার পরিবার এখন যে দুঃসহ গ্লানি এবং নির্যাতনের মধ্যে আছে তেমন গ্লানিকর অবস্থার মধ্যে থাকতেন না।
আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আমাদের রাজনীতি ব্লেম গেমের ওপর গড়ে উঠেছে। কোন একটি ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটলে আমরা তার ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করি না। আমরা চেষ্টা করি ঐ ঘটনার জন্য একজন নন্দ ঘোষ খাড়া করতে। আজ বেগম জিয়াকে দোষারোপ না করে ক্ষমতাসীন দলের উচিত ঘটনার ভেতরে যেতে। গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম নিহত হন। তার ঘাতকদেরকে খুঁজে বের করা এবং আইনের আওতায় আনার জন্য সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিন্টন ওয়াশিংটনেই দাবি তুলেছিলেন। তারপর বাংলাদেশে এসে সে দাবির পুনরুল্লেখ করেন। তারপর অনেকদিন অতিক্রান্ত হয়েছে। আমিনুল ইসলাম হত্যাকা-ের কোন সুরাহা হয়নি। আজ হিলারি ক্লিন্টন হয়তো পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাই। কিন্তু তার দল তো পুনরায় ক্ষমতায় এসেছে। ওবামা প্রশাসন তো আবার ৪ বছরের জন্য ক্ষমতায় এসেছে। তারা তাদের দাবি থেকে তো সরে যায়নি। ড. ইউনূসকে বার বার অসম্মান করা হয়েছে। আমেরিকা সেটা মেনে নিতে পারেনি। এ ব্যাপারে তাদের অসন্তোষ তারা চাপা রাখেনি। আমিনুল ইসলাম বা ড. ইউনূসের ইস্যুতে আমেরিকা যে আওয়ামী সরকারের ওপর নাখোশ হয়েছে সেজন্য কি বেগম জিয়া দায়ী ?
তাজরীন গার্মেন্টসে অগ্নিকা-ে শতাধিক লোকের মৃত্যু ঘটে। এতগুলো লাশের মিছিল, তারপরেও ঐ ফ্যাক্টরির মালিকের বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এ জন্য যদি মার্কিন ক্রেতা তথা মার্কিন সরকার বাংলাদেশের ওপর অসন্তুষ্ট হন তার জন্য কি বেগম খালেদা জিয়া দায়ী হবেন? রানা প্লাজায় ভবন ধসে ১২ শ’রও বেশি শ্রমিক মারা গেল। এখনও রানা প্লাজার মালিক রানা বহাল তবিয়তে জেলখানায় আছে। বিরোধীদলের রাজনৈতিক কর্মীদেরকে তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে গ্রেফতার করে হাজতে নেয়া হয়। হাজতে তাদের ওপর রিমান্ডের নামে ভয়াবহ শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। এমন নির্যাতনের ভুরিভুরি নজির রয়েছে। অথচ ১২ শতাধিক লোকের মৃত্যুর  জন্য যে ব্যক্তি দায়ী সেই ব্যক্তি অর্থাৎ রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানাকে জেলখানায় জামাই আদরে রাখা হয়েছে। স্থানীয় যে এমপি ভবন ধসের পরেও সোহেল রানাকে প্রটেকশন দিয়েছেন সেই এমপি’র কেশাগ্রও স্পর্শ করা হয়নি। ১২ শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যুর জন্য যদি বাংলাদেশের কর্মপরিবেশকে নি¤œমানের এবং অস্বাস্থ্যকর বলে বিদেশীরা দায়ী করে তার জন্য কি বেগম খালেদা জিয়া দায়ী হবেন? সেই কারণে যদি বিদেশী ক্রেতাদের সুপারিশে মার্কিন কর্তৃপক্ষ জিএসপি সুবিধা বাতিল করে থাকে তার জন্যই বা বেগম খালেদা জিয়াকে দায়ী করা  হবে কেন?
আওয়ামী ঘরানা যে এসব কথা বলছে সেগুলো যে তারা না বুঝে বলছে তা নয়। তারা সবকিছুই বুঝে শুনেই বিএনপি’র ওপর দোষ চাপায়। কারণ আওয়ামী ঘরানার বিলক্ষণ জানা আছে যে বিএনপির পাবলিসিটি উইং ততো স্ট্রং নয়। বিএনপির নেতারা রাজনীতিতে কঠোর পরিভাষা প্রয়োগ করতে জানে না। মাঝে মাঝেই দেখা যায় যে আওয়ামী লীগ যখন সরকারে থাকে তখন তারা প্রচারণার বান ছুটিয়ে দেয়। প্রচারণার এই প্রতিযোগিতায় বিএনপি তথা ১৮ দলীয় জোট পেছনে পড়ে যায়। কত সুযোগই তো তারা হাতছাড়া করলো। রেশমাকে নিয়ে যে নাটক হলো সেটির সদ্ব্যবহার করতে ১৮ দলীয় জোট পুরোপুরি ব্যর্থ হলো। টেলিভিশনের একটি টকশোতে দেখলাম, একটি ইংরেজি দৈনিক নিউএজের সম্পাদক নুরুল কবির অত্যন্ত বলিষ্ঠ বক্তব্য রেখেছেন। ডেইলি মিররের রিপোর্টের সমালোচনা করে সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশন থেকে যে প্রেস কনফারেন্স করা হয়েছিলো সেই কনফারেন্সের বক্তব্যেরও তীব্র সমালোচনা করেছেন নুরুল কবির। ব্যক্তি হিসেবে তিনি যে সাহস রাখেন দল হিসেবে বড় বিরোধী দলটি অনেকক্ষেত্রে সেই সাহসের পরিচয় দিতে পারে না। অথচ এটিএন নিউজে মুন্নী সাহাই তো প্রথম রেশমাকে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন যে ১৭ দিন পর ধ্বংসস্তুূপ থেকে যাকে উদ্ধার করা হলো তাকে দেখতে এত ফ্রেশ লাগছে কেন? তার জামা কাপড়ে ময়লার দাগ কোথায়? ১৭ দিন ধরে যদি রেশমা ধ্বংসস্তূপের মধ্যে পড়ে থাকে তাহলে তার তো হাত মুখ ধোয়ার কোন সুযোগ ছিলো না। তাহলে তার দাঁত এত ঝকঝকে তকতকে ও পরিষ্কার কেন? মুন্নী সাহার এসব প্রশ্ন নিয়েও বিএনপি অনুসন্ধান চালাতে পারতো। কিন্তু তারা সেটা করেনি। তাই এখানেও তারা প্রচারণা যুদ্ধে মার খেয়েছে।
আওয়ামী লীগ একটার পর একটা হিমালয় সদৃশ ভুল করবে, আর তার দায় চাপানো হবে বিএনপি’র ওপর, আর তার খেস এমন অদ্ভুত পরিস্থিতি দেশে আর কতদিন চলতে থাকবে ?
এমন অদ্ভুত পরিস্থিতি দেশে আর কতদিন চলবে ?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads