শুক্রবার, ২৬ জুলাই, ২০১৩

একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট ও কিছু কথা


গত ১০ জুলাই ‘গওহর রিজভী-ব্যারিস্টার রাজ্জাকের গোপন বৈঠক, বিএনপিতে তোলপাড়’ শিরোনামে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে একটি জাতীয় দৈনিকে। জানি না পত্রিকাটি কোন উদ্দেশ্যে এ প্রতিবেদন করেছে। তবে পুরো সংবাদটি পড়ে মনে হলো বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে ফাটল ধরানোর জন্যই এ প্রতিবেদন। তবে এখানে জামায়াতকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে উল্লেখ করার চেষ্টা করা হয়েছে। জামায়াত আগেও যে বিএনপির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তা মনে করিয়ে দিয়েছে বিএনপিকে। এর মাধ্যমে হয়তো পত্রিকাটি বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করেছে। সংবাদটি পড়লে যে কেউই বুঝতে পারবেন এটি হীন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সংবাদটিতে বোঝানো হয়েছে, জামায়াত এখন সরকারের সাথে সমঝোতা করছে। এরা বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচনে যাওয়ার ফন্দি আঁটছে। এবং জামায়াত যে এমন কাজ করতে পারে এর প্রমাণ ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে আওয়ামী লীগের সাথে জামায়াতের জোটবদ্ধ আন্দোলনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ওয়ান-ইলেভেনের সময় জামায়াতের সাথে তখনকার সেনাসমর্থিত সরকারের সম্পর্ক উল্লেখ করতে গিয়ে লিখেছে ‘তৎকালে বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন সাব-জেলে তার আইনজীবী হয়েও খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করতে পারেননি। কিন্তু জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ সরকারের সাথে সমঝোতা করেই খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন ও খালেদা জিয়ার সাথে কারাগারেই বৈঠক করান।’ সেখানে আরো বলা হয়েছে, তখন বিএনপির নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করার সময় জামায়াত কোনো বিবৃতি দেয়নি। মোটকথা হলো জামায়াত যে বিএনপির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে বিএনপির সূত্র দিয়ে তাই প্রমাণ করতে চেয়েছে পত্রিকাটি। তবে এটি স্পষ্ট, এ সংবাদের মূল উদ্দেশ্য হলো বিএনপি থেকে জামায়াতকে আলাদা করে নির্বাচনে যাওয়ার জন্য বিএনপিকে উদ্বুদ্ধ করা। আর যদি বিএনপি এই ফাঁদে পা দেয় তা হলে জামায়াতের কোনো ক্ষতি হবে না; বরং বিএনপিরই উল্টো বেশি ক্ষতি হবে। প্রথম কথা হলো, জামায়াত একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল। ১৮ দলীয় জোটের কারণেই এরা বিএনপিকে সমর্থন করে। এরা বিএনপির ওপর নির্ভরশীল নয়। এদের নিজস্ব গঠনতন্ত্র রয়েছে। তাই দলের স্বার্থে দেশের স্বার্থে এরা কখন কী করবে আর কী করবে না তা কারো কাছে জিজ্ঞেস করার কিছু নেই। ১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ জামায়াতসহ দেশের প্রখ্যাত আলেমদের জেলে ঢোকাতে শুরু করে এবং ইসলামকে ব্যাপকভাবে অবমাননা শুরু করে, তখন থেকেই জামায়াতের সাথে বিএনপির সখ্য শুরু হয় এবং ইসলামি আরো একটি দল নিয়ে চারদলীয় জোট গঠন করে। আর তখন বিএনপি ইসলামি দলগুলোকে কাছে টেনেছিল। কারণ তখন বর্তমান পরিস্থিতির মতোই জনগণ ধর্মের অবমাননার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগের সাথে জামায়াত কোনো বৈঠক করতে পারবে না এমন কোনো শর্ত তো জোটে নেই। তা ছাড়া ব্যারিস্টার রাজ্জাক ও গওহর রিজভী উভয়ই ঢাকায় নিযুক্ত ভারপ্রাপ্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জন ড্যানি লুইসের চায়ের দাওয়াতে গিয়ে একসাথে বসেছেন। এতে আঁতকে ওঠার তো কিছু নেই। একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব এ উদ্যোগ নিতেই পারেন। আর আওয়ামী লীগ-জামায়াত একসাথে বসা মানেই তো সমঝোতায় চলে আসা নয়। আর জামায়াত যদি আওয়ামী লীগের সাথে আঁতাত করার ইচ্ছাই থাকত, তা হলে তাদের এত হেনস্তা হতে হতো না। দুই শতাধিক কর্মীকে মৃত্যুবরণ করতে হতো না। যুদ্ধাপরাধের নামে নাটকও সাজাতো না আওয়ামী লীগ। বরং আওয়ামী লীগ যখন দেখল জামায়াতকে কিছুতেই বশ মানানো সম্ভব নয়, তখনই সরকার জামায়াতের ওপর অত্যাচারের স্টিম রোলার চালায়। সুতরাং জামায়াত যদি এত নির্যাতিত হওয়ার পরও সমঝোতা করতে চায়, তা হলে এ দৈনিকের এত মাথা ব্যথা কেন? কারণ জামায়াত এখন কান্ত, শ্রান্ত, পরিশ্রান্ত ও কর্মী হারানোর বেদনায় কাতর। এখনো জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা নিজ ঘরে থাকতে পারেন না। পালিয়ে বেড়ান পুলিশের ভয়ে। তাই সরকারের সাথে সমঝোতা করে যদি তারা এটুকু বিশ্রাম পান, যুদ্ধাপরাধ মামলা থেকে যদি রেহাই পান; তাহলে জামায়াত কেন তেমন সমঝোতা করবে না? যদিও সমঝোতা করার কোনো সম্ভাবনাই নেই। আর এখন পর্যন্ত জামায়াতের অবস্থান হলো বিএনপি যদি আওয়ামী লীগের ফাঁদে পা দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়; তা হলে জামায়াত আলাদাভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন চালিয়েই যাবে। সুতরাং আওয়ামী লীগের সাথে জামায়াতের আঁতাত হওয়ার তো কোনো সম্ভাবনা নেই-ই; বরং যদি জামায়াতকে বিএনপি থেকে আলাদা হয় তাহলে সেটি হবে বিএনপির আঁতাতের কারণে। আর যদি পাঁচটি সিটি নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারটিকে যদি বিএনপি শুধু নিজেদের ক্রেডিট হিসেবেই দেখে, তাহলে বিএনপি বোকার স্বর্গে বাস করছে। কারণ শুধু সিটি নির্বাচন নয়, সামনের সংসদ নির্বাচনেও এ ধর্মীয় অনুভূতিই কাজে লাগবে, যা হেফাজত সৃষ্টি করেছে। তবে বিএনপি যদি উল্লিখিত প্রতিবেদনের ওপর ভর করে জামায়াতকে ছেড়ে শুধু হেফাজতের ঘাড়ে ভর করে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখে; তাহলে এটি হবে বিএনপির জন্য একুশ শতকের শ্রেষ্ঠ বোকামি। তৃতীয়ত, পত্রিকাটি লিখেছে সেনাসমর্থিত সরকারের সাথে জামায়াতের সখ্যতার কথা। একটি কথা মনে রাখা দরকার, তখন সবাইকেই আটক করা হয়েছিল দুর্নীতির অভিযোগে। আর এটিও যেমন সত্য যে বিএনপি বেশি দুর্নীতি করেছে, তেমনি এটিও সত্য যে তখন জামায়াতের দুই মন্ত্রীর গায়ে নিজস্ব মন্ত্রণালয়ের কোনো দুর্নীতির কালিও লাগেনি। তবুও রাজনৈতিক কারণেই মন্ত্রী হিসেবে তাদের দু’জনকেই জেল খাটতে হয়েছে। আর ওই সরকারের সাথে জামায়াতের যদি আঁতাত থাকতই তা হলেও তাদের এখন এত নির্যাতন সহ্য করতে হতো না। খালেদার সাথে দেলোয়ারের বৈঠক করিয়ে দেয়ার মধ্যে জামায়াতের কৌশলই ছিল আসল। তা ছাড়া তখন তো বিএনপি বলতে খোন্দকার দেলোয়ার ছাড়া আর কেউ ছিলেনই না। পত্রিকাটি আরো লিখেছে, সম্প্রতি আঁতাত করে শাপলা চত্বরে শিবিরের মিছিল থেকে পুলিশকে ফুল দেয়ার কথা। এখানে বিষয়টি খুবই স্পষ্টÑ তখন মিডিয়ায় খুব জোরেশোরেই বলা হচ্ছিল যে, সরকারকে অন্তত একবার হলেও সুযোগ দেয়া উচিত, যাতে বিরোধী দল শান্তিমতো কর্মসূচি পালন করতে পারে। আর সেই অনুযায়ী শিবির জামায়াতকে এ সুযোগ দেয়াই ছিল সরকারের জন্য বড় ধরনের ভুল। কারণ শিবির প্রমাণ করে দিয়েছে, পুলিশ তাদের ওপর আক্রমণ না করলে তারাও কিছু করে না। তা ছাড়া যদি তখন সরকারের সাথে জামায়াতের সমঝোতা হতো, তাহলে আল্লামা সাঈদীকে ফাঁসির রায় দিত না। এবং রায়-পরবর্তী শতাধিক জামায়াত কর্মীকে সরকার হত্যা করত না। সব শেষে বলব, জামায়াত কখনোই দুই শতাধিক শহীদের রক্তের ওপর পা রেখে আওয়ামী লীগের সাথে আঁতাত করতে পারে না। যদি করেই তাহলে জামায়াতেরও বিদায়ঘণ্টা বাজবে। কারণ এখন জামায়াত যে অবস্থানে আছে, তাতে তাদের হারানোরও কিছু নেই। পাওয়ারও কিছু নেই। যা হারানোর তা হারিয়ে গেছে। শতাধিক মায়ের বুক খালি হয়েছে। সন্তান বাবাকে হারিয়েছেন। বোন তার ভাইকে হারিয়েছেন। সুতরাং জামায়াত কখনোই ছেলেহারা মার, ভাইহারা বোনের, বাবাহারা সন্তানের ও স্বামীহারা স্ত্রীর চোখের সামনে শহীদের রক্তের সাথে বেঈমানি করতে পারে না। মনে হয় বিএনপিও জামায়াত সম্পর্কে এমনটিই ভাবে। কারণ এরা জামায়াতের দীর্ঘ রাজনৈতিক সহযোগী। তাই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কোনো খবরে জোটের মধ্যে ফাটল ধরানো কখনোই শুভ হবে না। ইসলাম, মুসলমান ও আলেম ওলামাদের সাথে বেয়াদবির সমুচিত জবাব দেয়ার স্বার্থেই মিডিয়ার অপপ্রচারে কান না দিয়ে নিজেদের মধ্যে দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তোলাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। আর জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত কাছে আসবে, কুচক্রীমহল ততই জোটের মধ্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করবে। এ সময়ে সবাইকেই সতর্কতার সাথে পা বাড়াতে হবে; যাতে কোনো ষড়যন্ত্রকারীর ষড়যন্ত্রই সফল হতে না পারে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads