বৃহস্পতিবার, ২৫ জুলাই, ২০১৩

যুদ্ধাপরাধের মূলা ও পাঁচীর ঘা!


 অমর কথাশিল্পি মানিক বন্দোপাধ্যায়ের কালজয়ী গল্প প্রাগৈতিহাসিক। এ গল্পের নায়িকা ভিখারিনী পাঁচী। আর তার ভিক্ষার উপকরণ ছিল পায়ের দগদগে ঘা। এই ঘা প্রদর্শন করেই সে ভিক্ষা চাইতো। এতে মানুষ তার প্রতি বেশ সহানুভূতিশীল হতো। এভাবেই চলতো পাঁচী আর বশীরের সংসার। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো পাঁচী কখনোই তার ঘা সারানোর চেষ্টা করতো না বরং অতিযত্মসহকারে এই ঘা সে লালন করে আসছে দীর্ঘ দিন ধরে। কারণ, ঘা যদি ভাল হয় তাহলে মানুষের কাছে তার কোন ভিক্ষা চাওয়ার উপলক্ষ থাকে না। তাই এই ঘা লালনের জন্য পাঁচীর সে কী প্রাণান্তকর চেষ্টা। কিন্তু তার এই সুখের সংসার স্থায়ী হয়নি। বাদ সাধে ভিক্ষু ডাকাত। রাতের অন্ধকারে সে বশীরকে খুন করে পাঁচীকে নিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায়।
গল্পে পাঁচী একটি কাল্পনিক চরিত্র হলেও গল্পকার তার নিপুণ সৃষ্টির মাধ্যমে পাঠক মনে একটি আবেদন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। আমাদের দেশের রাজনীতিতে পাঁচীদের আবির্ভাব অবশ্য অনেক আগেই হয়েছে। রাজনীতির এই পাঁচীরা কথিত যুদ্ধাপরাধের ঘা টা দীর্ঘ দিন অতি যতœসহকারে লালন করে আসছে। আর এর মাধ্যমেই চলেছে রাজনৈতিক ভিক্ষাবৃত্তি। যদিও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৯৫ জন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে দেয়া হয়েছিল। যাদের বিরুদ্ধে কথিত সহযোগিতার অভিযোগ করা হয়েছিল স্বাধীনতা পরবর্তীতে তাদেরকেও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছিল। মনে করা হয়েছিল যে, এখানে যুদ্ধাপরাধের ক্ষত চিহ্নের  পরিসমাপ্তি ঘটেছে। কিন্তু তাহলে তো আর পাঁচীদের  ভিক্ষাবৃত্তির কোন উপলক্ষ থাকে না। তাই রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চের এই পাঁচীরা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পুরোনো ঘা টাকে আবার জাগিয়ে তুলেছে। কারণ, গরজ বড় বালাই।
যুদ্ধাপরাধের এই রঙ্গমঞ্চের মাধ্যমে প্রথমে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ প্রাণদ-ে দ-িত করা হয়েছিল। মনে করা হয়েছিল যে, যেহেতু তিনি পলাতক ছিলেন এবং বিচার চলাকালীন সময়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারেন নি। তাই স্বাভাবিকভাবেই তার গুরুদ- হয়েছে। কিন্তু যারা রাষ্ট্রীয় হেফাজতে থেকে আত্মপক্ষ সমর্থন করলেন। কথিত অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজের নানাবিধ অসংগতি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করলেন, তাদের ভাগ্যে কী ন্যায়বিচার নিশ্চিত হলো? ডিফেন্স পক্ষের আইনজীবীরা প্রথমে সেইফ হাউস কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রমাণ করতে সক্ষম হলেন। কিন্তু বিচারিক কার্যক্রমে এর কোন সুফল তারা লাভ করতে পারলেন না বরং কেলেঙ্কারির মাধ্যমে দাবিকৃত সাক্ষীদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না প্রসিকিউশনের এমন দাবির যৌক্তিকতা মেনে নিয়ে সাক্ষী আদালতে না আসা সত্ত্বেও তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রদত্ত জবানবন্দীকে আদালতে সাক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করা হলো। এরপর প্রসিকিউশনের গণেশচন্দ্র সাহা ডিফেন্স পক্ষে সাফাই সাক্ষী দিলেন। এমন চাঞ্চল্যকর ঘটনার পর প্রসিকিউশনের আর কোন গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। প্রসিকিউশনের অপর সাক্ষী সুখরঞ্জন বালী ডিফেন্স পক্ষে সাফাই সাক্ষী দিতে এসে অপহৃত হলেন। কথিত বিচার প্রক্রিয়ার সবচেয়ে বড় জালিয়াতি ধরা পড়ে বিচারপতির স্কাইপ কেলেঙ্কারির মাধ্যমে। খোদ বিচারপতি এই কেলেঙ্কারির দায় স্বীকার করে নিয়ে পদত্যাগও করেছেন। এতে মনে করা হয়েছিল যে,  স্বাভাবিকভাবেই এই বিচারকাজ স্থগিত হয়ে যাবে এবং ন্যায়বিচারের স্বার্থে ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে নতুন করে বিচার কাজ শুরু করা হবে। কিন্তু তা আর হয়নি বরং বিচারিক অসদাচারণ ও জাল-জালিয়াতিকে ভিত্তি ধরেই বিচারকাজ অব্যাহত রাখা হয়। প্রসিকিউশনের বিশ্বাসভংগের ঘটনা বারবার ট্রাইব্যুনালে প্রমাণ হওয়ার পরও ট্রাইব্যুনাল প্রসিকিউশনকে বৈরী ঘোষণা তো করেইনি বরং তাদের উপস্থাপিত তথ্য-উপাত্ত, সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতেই একের পর এক রাজনৈতিক নেতাদের গুরুদ-ে দ-িত করা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। সে ধারাবাহিকতায় জামায়াতের নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে প্রাণদ-ে দ-িত করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের বিচারে ফাঁসী এখন মাছ-ভাতে পরিণত হয়েছে।
গত কয়েক দিন আগে জামায়াতের সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদ- দেয়া হয়েছে। তাকে এই দীর্ঘ মেয়াদি কারাদ- দেয়া হলেও ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বারবার বলেছেন, গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সরাসরি কোন অপরাধে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রমাণ মেলেনি। এরপরও তার অপরাধ প্রাণদ-ের সমতুল্য। কিন্তু বয়স বিবেচনায় তাকে দীর্ঘমেয়াদী কারাদ- দেয়া হয়েছে। এ ঘটনায় দু-এক দিনের মাথায় জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে প্রাণদ-ে দ-িত করা হয়েছে। তার সম্পর্কেও ট্রাইব্যুনাল বলেছে, তার বিরুদ্ধে নাকি গণহত্যার অভিযোগ প্রমাণ হয়নি। শুধুুমাত্র 'ঝঁঢ়বৎরড়ৎ ৎবংঢ়ড়হংরনরষরঃু’ এর দায় হিসাবে মুজাহিদকে প্রাণদ-ে দ-িত করা হয়েছে। একথা উল্লেখ না করলে অপূর্ণতা থেকে যাবে যে, অধ্যাপক গোলাম আযম ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মামলার কার্যক্রম বেশ আগেই শেষ হয়েছিল। শুধুমাত্র রায়ের অপেক্ষায় ছিল মামলাটি। রায় ঘোষণার আগে ঢাকার কয়েকটি কাগজে মামলার রায় ঘোষণা দিয়ে কথিত অহেতুক বিলম্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলার পরই ট্রাইব্যুনাল তড়িঘড়ি করে এ রায় প্রদান করা হয়। এতে বিচার নিয়ে জনমনে যথেষ্ট সন্দেহেরও সৃষ্টি হয়েছে এবং বিচারিক ট্রাইব্যুনালকে বিশেষ মহলের আজ্ঞাবহ মনে করা হচ্ছে।
রায় ঘোষণার পর সরকার পক্ষকে সন্তুষ্টি প্রকাশ করতে দেখা গেছে। কোন রায় ঘোষণার পর পক্ষে-বিপক্ষে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থাকা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু কোন রায় কবে কার্যকর হচ্ছে অন্তত রাষ্ট্রপক্ষের এমন কথা বলা মোটেই সমীচিন নয়। আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল- আলম হানিফ আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যেই কথিত রায় কার্যকরের কথা বলেছেন। আইনপ্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম তো ঈদের পর কথিত যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে আরেকটি উৎসব করতে চান। প্রধানমন্ত্রী দেশের বিভিন্ন স্থানে জনসভায় বলেছেন, এ সরকারের মেয়াদেই যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায় কার্যকর করা হবে। এমন কী যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু তো আর মোটেই সময় দিতে চান না। ট্রাইব্যুনালের রায় নিয়ে করা আপিল সুপ্রীম কোর্টে শুনানীর অপেক্ষায় থাকলেও তিনি সেপ্টেম্বরের মধ্যেই রায় কার্যকর করতে চান। আপিলের ফলাফল কী হয় তা জানার আগেই তারা কথিত যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসীর রায় কার্যকর করার জন্য ফাঁসীর মঞ্চ সাজিয়ে রীতিমত মহড়া দিতে শুরু করেছেন। এতে বিচারের নিরপেক্ষতা ও আদালতের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। কারণ, অতীতে সরকারি দলের মন্ত্রী-এমপিরা ট্রাইব্যুনালের রায় সম্পর্কে যেভাবে আগাম মন্তব্য করেছেন ঠিক রায় হয়েছে সে ছক অনুযায়ীই। তাই কথিত অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় দেশে ও বিদেশে কোথাও গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না বরং এটি ইতিহাসের নির্মম পরিহাসে পরিণত হয়েছে এবং বিষয়টি নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। থেমে নেই বহির্বিশ্বের গণমাধ্যমগুলোও।
মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরার একটি মন্তব্য প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের সর্বশেষ রায়ে দেশটির অনেক সমস্যার চিত্র ফুটে উঠেছে। শোনা সাক্ষী ও ভুল তথ্যের উপর ভিত্তি করে অভিযুক্তদের মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হচ্ছে। এধরনের বিচার নতুন করে অবিশ্বাস , বিভক্তি  ও ঘৃণার জন্ম দেবে যা এখনই বাংলাদেশে বিরাজ করছে। এ বেদনা বাংলাদেশকে বয়ে বেড়াতে হবে। গত ২২ জুলাই মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরার অনলাইনে প্রকাশিত এক মন্তব্যে একথা বলা হয়েছে। তালহা আহমেদের লেখা এই মন্তব্যে গত সপ্তাহে ট্রাইব্যুনালের রায়, সহিংসতা, জামায়াতে ইসলামীর অবস্থা, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমসহ নানা বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়, ‘যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর আরো দু’জন নেতাকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দিয়েছে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এছাড়াও বাংলাদেশে জন্ম নেয়া বিদেশী নাগরিকদের বিরুদ্ধে তাদের অবর্তমানেই বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।................. কিন্তু প্রশ্ন হলো এর মাধ্যমে ন্যায় বিচার ও জাতীয় ঐক্যের ক্ষেত্রে কতটুকু সহায়ক হবে। এ বিচারের ফলে দেশটিতে বিভক্তি বেড়েছে। দেশটির প্রতিষ্ঠা ও পরিচিতি নিয়ে বিতর্ক দেখা দিচ্ছে। যদিও ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রচারণায় যুদ্ধাপরাধের বিচার বড় কোন অঙ্গীকার ছিল না’। মন্তব্য প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল রক্তক্ষয়ী এবং দু’পক্ষই সহিংসতার জন্য সমানভাবে দায়ী ছিল। বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ আইনে গঠিত ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে আন্তর্জাতিক কোনো ইনস্টিটিউটের কোন সংযোগ নেই। এছাড়া স্বাধীনতাপন্থী যারা অপরাধ করেছিল তাদেরও বিচারের কোনো ক্ষমতা ট্রাইব্যুনালকে দেয়া হয়নি। এটা ন্যায়বিচারের মূলনীতির চরম লংঘন। আর এটা স্পষ্ট যে, এই বিচার প্রক্রিয়া উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। হয়তো এই বিষয়ে অনেকেই ভিন্নমত পোষণ করবে। অভিযুক্ত সকলেই বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দ। তাদের বেশীর ভাগই জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সাথে জড়িত। সকল বিচার সফলভাবে শেষ হলে সকলের মৃত্যুদ- নইলে যাবজ্জীবন কারাদ- হবে। ফলে জামায়াতে ইসলামী শীর্ষ নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়বে। যদিও ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী একটি ছোট এবং কম তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক দল ছিলো’।
মন্তব্যে বলা হয়, ট্রাইব্যুনালের সকল প্রক্রিয়ায় ঘাটতি, অযথার্থতা ও অসম্পূর্ণতা রয়েছে। এ আদালতের লিগ্যাল স্ট্যান্ডার্ড নিয়ে আন্তর্জাতিক বার এসোসিয়েশন ও অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা  গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে। তাদের মতে, এ আদালতে অভিযুক্তরা যথাযথভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে সক্ষম হবে না। আসামী পক্ষের সাফাই সাক্ষী হাস্যকরভাবে কমানো হয়েছে। সাক্ষীর সংখ্যা এতো পরিমাণ কমানোর মত প্রাসঙ্গিকতা নেই। কারণ, এটা সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচারের পূর্বশর্ত’।
মন্তব্যে আরও বলা হয়, ‘বর্তমান সরকার ন্যায়বিচারের চেয়ে পত্রিকার শিরোনামে জয়টাকে বেশি দেখতে আগ্রহী হবে। ট্রাইব্যুনাল দেশটির পুরনো ক্ষত সারিয়ে তুলছে না বরং বাড়াচ্ছে। রাস্তায় বিক্ষোভ, সহিংসতায় মৃত্যু, যখম, শত শত মানুষের জেলে যাওয়া সেই বিভক্তিরই প্রমাণ দেয়। অভিযোগের বিষয়ে যেসব প্রমাণ আনা হচ্ছে তার বিশ্বাসযোগ্যতা খুবই কম। শোনা সাক্ষী ও ভুল তথ্যের উপর ভিত্তি করে অভিযুক্তদের মানবতাবিরোধীদের  অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হচ্ছে। এ ধরনের অবিচার নতুন করে অবিশ্বাস, বিভক্তি ও ঘৃণার জন্ম দেবে যা এখনো বাংলাদেশে বিরাজ করছে। এ বেদনা বাংলাদেশকে বয়ে বেড়াতে হবে’।
ভারতের গণমাধ্যমগুলো অতীতে সকল ক্ষেত্রে আওয়ামী সরকারের অবস্থান সমর্থন করলেও হালে সে অবস্থার একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত ২১ জুলাই কলকাতা থেকে প্রকাশিত ১৩৮ বছরের ঐতিহ্যবাহী দ্য স্ট্যাটস্ম্যান পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে ‘ বাংলাদেশ ওয়ার ক্রাইম ঃ ফেয়ার ট্রায়াল অর পারসিকিউশন’ শীর্ষক প্রতিবেদনেও আল জাজিরার বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করা হয়েছে। এদিকে বিবিসি প্রচারিত খবরে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কার্যক্রমে সরকার সরাসরি হস্তক্ষেপ করছে বলে অভিযোগ করেছেন টোবি ক্যাডম্যান। তিনি জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে বিদেশী আইনজীবী হিসাবে লন্ডনে কাজ করেন। ক্যাডম্যান এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, জামায়াত নেতাদের পক্ষে যারা সাক্ষী দিচ্ছেন সরকারের পক্ষ থেকে তাদেরকে হুমকী দেয়া হচ্ছে। এমন কী সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি মহল এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে বলে তার কাছে প্রমাণ আছে বলে দাবি করেছেন। এসব তথ্য যাচাই করা শেষ হলেই তা প্রকাশ করা হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। এসকল তথ্য প্রকাশের পর দেশের বাইরে এবং ভেতরে থাকা আইনজীবীদের প্রচেষ্টায় এ ট্রাইব্যুনাল ভেঙ্গে দেয়া হবে।
দেশে বিদেশে ও অভিজ্ঞমহলের সকল উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা পরামর্শ উপেক্ষা করে বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ বিচারকাজ এগিয়ে চলেছে। প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই সরকার বিরোধীরা ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে যে ধরনের সন্দেহ-সংশয় এবং আশংকা প্রকাশ করেছিলেন দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ায় বারবার সে কথাই প্রমাণিত হচ্ছে। অভিযোগ আছে যে, কথিত বিচারের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করতে চায়। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে সরকার সে পথেই অগ্রসর হচ্ছে। তারা কোন বিচারিক মান রক্ষা না করেই যেনতেনভাবে সাজানো ও পাতানো বিচারের নামে বিরোধী দলীয় শীর্ষ নেতাদের রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে বিদায় করতে চায়। উল্লেখ করা দরকার যে, ট্রাইব্যুনাল আইনে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের আগে গ্রেফতার করার কোন বিধান ছিল না। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল নিজস্ব আইন ভংগ করেই জামায়াতের আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে আটকাদেশে দেয়। পরে আইন সংশোধন করে ভূতাপেক্ষে তার কার্যকারিতা দেয়া হয়। কোন মামলার রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের প্রচলিত সময়সীমা ৬০ দিন হলেও ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সময়সীমা ৩০ দিনে কমিয়ে আনা হয়েছে। আব্দুল কাদের মোল্লার মামলার রায়ের পর আপিলের আইন সংশোধন করে ভূতাপেক্ষে কার্যকারিতা দেয়া হয়েছে। যা কোন আইনী মানদ-ে টেকে না।
প্রতিহিংসা চরিতার্থ এবং বিশেষ রাজনৈতিক দলকে ধ্বংস করার জন্যই যে কথিত বিচার প্রক্রিয়া চলছে তা সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচন কমিশনের আচরণ থেকেই পরিষ্কার। সরকারের আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন ট্রাইব্যুনালে সাজাপ্রাপ্তদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেয়ার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তাদেরকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। কোন আদালতে দ-িত হলেই তিনি চূড়ান্তভাবে অপরাধী সাব্যস্ত হন না যতক্ষণ তার পক্ষে আপিল করার সুযোগ থাকে। ট্রাইব্যুনালে দ-িতরা কেউ কেউ ইতোমধ্যেই সুপ্রীম কোর্টে আপিল করেছেন এবং অন্যরা আপিলের অপেক্ষায় আছেন। কিন্তু আপিল নিষ্পত্তির আগেই অতিউৎসাহী হয়ে নির্বাচন কমিশন দ-িতদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ এবং নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার প্রক্রিয়া গ্রহণ করে নিজেদের চেহারা ও সরকারের থলির বিড়াল উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এর আগেও তিনি সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী জনগণ মেনে নিয়েছে মন্তব্য করে নিজেকে সরকারে একনিষ্ঠ, অনুগত ও দাসানুদাস হিসাবে প্রমাণ করেছেন। এখন বিএনপিকে ধ্বংস করার জন্য বি এনএফ ফর্মুলা নিয়ে এগুচ্ছেন।
এমতাবস্থায় বাজারে যেসব গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে বা সরকারের ভাব-সাব দেখে যা মনে হচ্ছে তা মোটেই সুখকর নয়। সরকার কথিত যুদ্ধাপরাধের বিচারকে জনগণের নাকের ডগায় ঝুলিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে চায়। সদ্য সমাপ্ত সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে যেভাবে ধবল ধোলাই করেছে তাতে তারা নিজেদের অস্তিত্ব নিয়েই শংকিত হয়ে পড়েছে। বর্তমান অবস্থায় যদি দেশে কেয়ারটেকার সরকারের মাধ্যমে যদি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাহলে আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব থাকবে বলে অভিজ্ঞমহল মনে করে না। তাই তারা কথিত যুদ্ধাপরাধকে ট্রামকার্ড বানিয়ে জামায়াতকে পাতানো ও সাজানো নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য করতে চায়। মূলত তারা যুদ্ধাপরাধ ইস্যুর কোন নিষ্পত্তি বা সুরাহা চায় না। তারা এই ইস্যুকে পাঁচীর ঘায়ের মত প্রদর্শনের বস্তু বানিয়ে রাজনৈতিক ভিক্ষাবৃত্তি করতে চায়। কিন্তু প্রকৃতির অমোঘ ও অলংঘনীয় নিয়মে ভিক্ষুরা যেকোন সময় আবির্ভূত হতে পারে তা কী তারা বেমালুম ভুলে গেছে ? আর এই আত্মবিস্মৃতি কারো জন্য কল্যাণকর হয় না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads