সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০১৩

গণতন্ত্র : আওয়ামী স্টাইল

গত ১১ জুন ডেনমার্কের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত সাক্ষাৎ করতে গেলে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র টিকে থাকবে। সঠিক কথা। এ দেশে গণতন্ত্র টিকে থাকার জন্যই এসেছে। এ দেশে গণতন্ত্র আনা ও টিকিয়ে রাখার জন্য ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তান আন্দোলন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ইত্যাদি আন্দোলন সংগ্রামে জনগণের ত্যাগ কোরবানি অপরিসীম। সুতরাং এ দেশে গণতন্ত্র টিকে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বর্তমান ক্ষমতাসীনদের মুখে গণতন্ত্র রক্ষার অমিয় বাণী শুনলে মানুষ আনন্দিত হয়, আতঙ্কিত হয়। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বাবা, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গণতন্ত্রের অগ্নিপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হঠাৎ প্রেসিডেন্ট হয়ে ‘বাকশাল’ গঠন করলে স্বাধীন দেশে প্রথম গণতন্ত্রের মৃত্যু হয়। শেখ হাসিনার দলের কর্মীরা ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর দিনদুপুরে রাজধানীর পল্টনে মিডিয়ার সামনে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে কয়েকজন মানুষ খুন করে গণতন্ত্রকে কবর দিয়েছিল। এভাবে ১/১১ এর ক্ষেত্র তৈরি করা হয়। দেশে আসে মইন উদ্দিন ফখরুদ্দীনের উদ্ভট তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এরপর শেখ হাসিনা স্বস্তির সাথে বলেছিলেন, ‘এ সরকার আমাদের আন্দোলনের ফসল।’ বরিশাল মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময়ে ১৯৮৬ সালে এক রাতে দুই ছাত্র সংগঠনের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এতে উভয় পক্ষের বহু ছাত্র আহত হয়েছিল। অনেক রুমে ভাঙচুর ও আগুন দেয়া হয়। সব জাতীয় দৈনিকে খবরটি ছবিসহ ফলাও করে প্রচার করা হলো। ভাবলাম, এ খবর বাড়িতে আমার ভাইয়েরা জানলে চিন্তিত হবেন, মা আমার জন্য অস্থির থাকবেন। তখন মোবাইল ছিল না। সেই অজপাড়াগাঁয়ে কোনো টেলিফোন ছিল না। ঐদিনই আইঅ্যাম ওয়েল ( আমি ভালো আছি), লিখে বাড়িতে একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দিই। দুই দিন পর বড় ভাই কুমিল্লার গ্রামের বাড়ি থেকে বরিশাল গিয়ে হাজির হন। ভোরবেলায় বড় ভাইকে হোস্টেলে দেখে আঁতকে উঠি, না জানি মায়ের কোনো অঘটন ঘটেছে কি না। বড় ভাই বললেন, তোমার টেলিগ্রাম পেয়ে বাড়িতে সবাই অস্থির, মা শয্যাশায়ী। ভাবলাম নিশ্চয়ই কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে। তাই তোমার খোঁজ নিতে আমার আসা। বুঝলাম ‘আমি ভালো আছি’ এ খবরই ‘আমি ভালো নেই’ এ আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে। প্রথম টার্মে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৯৮ সালে যেদিন আওয়ামী লীগ নেত্রী ঘোষণা দিলেন, এ দেশের প্রতিটি মানুষের জন্য নিরাপদ বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হবে, ঠিক পরের দিনই বৃষ্টির মধ্যে কমলাপুর বস্তি উচ্ছেদ করে শত শত নারী, শিশু, অসহায়কে জাতীয় ঈদগাহ মাঠে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছিল তার সরকার। আজ প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, কোনো অনির্বাচিত ব্যক্তি-গোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে না। অথচ ১৯৯৪-৯৫ সালে অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়কের দাবিতে উপর্যুপরি হরতাল দিয়ে, ভাঙচুর, জ্বালাও পোড়াও করে দেশের জানমালের অপূরণীয় ক্ষতি করা হয়েছে। এখন সে আন্দোলনের নেত্রী বলছেন, ‘তত্ত্বাবধায়কের দাবি জানালে দেশে কোনো নির্বাচন হবে না।’ সেদিন আমার চেম্বারে আট বছরের একটি শিশু মেয়ে এসেছিল। তার চোখে একটা ছোট অপারেশন প্রয়োজন। আমরা চোখের ডাক্তারেরা সাধারণত লোকাল অ্যানেসথেসিয়া দিয়েই চোখের অপারেশন করে থাকি। সেই ক্ষেত্রে রোগীর সহযোগিতার খুব প্রয়োজন। তার অপারেশনটিও লোকাল অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিই। রোগীকে অপারেশনের সময় ধৈর্য ধরার জন্য ভালোমতো কাউন্সেলিং করে রেডি করি। সেও কান্নাকাটি করবে না বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। আমরা চার পাঁচজন ওটি স্টাফ। ক্যাপ, মাস্ক, হ্যান্ডগ্লাভস ও গাউন পরা অবস্থায় আমাদের শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। এমতাবস্থায় মেয়েটিকে ওটিতে আনা হয়। প্রথমে সে একটু ঘাবড়ে গেলেও চুপ করে থাকে। আমার এক স্টাফ সাহস দেয়ার জন্য বলে, ভয় পেয়ো না, এরা সবাই মানুষ। আর যায় কোথায়। ভয়ে চিৎকার দিয়ে দরজা ঠেলে বাইরে এসে ওর মাকে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে, অপারেশন করাব না। অবস্থা দেখে ওর মারও অজ্ঞান হওয়ায় জোগাড়। যার বাপকে কুমিরে খেয়েছে সে ঢেঁকি দেখলেও ভয় পায়। বর্তমান সরকার গণতন্ত্রের সব উপাদান ধ্বংস করেছে। বিরোধী দলকে দেখামাত্র গুলি কিংবা নির্যাতন, বিরোধী দলের বেশির ভাগ নেতা জেলখানায়, তাদের বিরুদ্ধে ভূরি ভূরি মামলা, সভা-সমাবেশের ওপর বেআইনি নিষেধাজ্ঞা, বিরোধী দলের প্রচারমাধ্যম বন্ধ, প্রশাসনে নজিরবিহীন দলীয়করণ, দেশের অর্থনীতি ধ্বংস, নতজানু পররাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি দ্বারা প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে গণতন্ত্র ও সুশাসন রোধের। প্রধানমন্ত্রী যখন কোনো বিদেশী রাষ্ট্রদূতকে বলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র টিকে থাকবে, তখন সংুব্ধ জনগণের মনে এ আশঙ্কা জাগা খুবই স্বাভাবিক যে, দেশে হয়তো গণতন্ত্র থাকবে না। না থাকলে টেকা-না টেকার প্রশ্ন আসে না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads