রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০১৩

সঙ্ঘাতের রাজনীতি কতকাল চলবে


এক সময় ছিল মানুষ রাজনীতিকে ভালো চোখে দেখত। আজ আর ভালো চোখে দেখছে না। কারণ আমাদের রাজনীতি হয়ে গেছে সঙ্ঘাতের। রাজনীতি যারা করেন তারা বলেন গণতন্ত্রের জন্য, মেহনতি মানুষের জন্য রাজনীতি করেন। কথাগুলো শুনলে মনের মধ্যে একটু ভালো লাগে বটে কিন্তু দলগুলোর সঙ্ঘাতে কত নিরীহ মানুষের প্রাণ যে চলে যায় না-ফেরার দেশে; তা কি রাজনীতিবিদেরা ভাবেন? রাজনীতিতে আজ ভ্রাতৃত্ববোধ, সম্মান, মায়া-মমতা নেই, আছে শুধু হিংসা আর প্রতিহিংসার বিদ্বেষ। কিভাবে মিথ্যে কথা বলে একে অন্যকে ঘায়েল করতে পারে, সে চিন্তায় অনেকে ব্যস্ত থাকেন। আজ আর কেউ কাউকে সম্মান দিয়ে কথা বলছেন না। রাজনীতিতে হত্যা আর খুনের মতো জঘন্য ঘটনা ঘটেই চলছে। এ দেশের সাধারণ মানুষ অনেক সহজ-সরল বিধায় রাজনীতিবিদেরা যা বলেন তারা তা-ই বিশ্বাস করে থাকেন। রাজনীতিবিদেরা প্রায়ই বলেন, জনগণই সব মতার উৎস। তা হলে কেন সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বাতিল করল? রাজনীতিবিদের মুখের কথা বিশ্বাস করে জনগণ ভোট দেয়। আর সে ভোটের অধিকারই আবার সরকার কেড়ে নিতে চায়, যা গণতান্ত্রিক দেশে হতে পারে না। মহাজোট সরকারকে নির্বাচিত করার আগে জনগণ মনে করছিল অতীতের আর বর্তমান আওয়ামী লীগ এক নয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ অতীতকে ভুলে বামপন্থী আর নাস্তিক্যবাদীদের নিয়ে সরকার গঠন করার পরপরই প্রতিশোধের রাজনীতি শুরু করল। বিরোধী দলের সব কর্মসূচিতে বাধা দেয়া হলো। বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের ওপর পুলিশের নারকীয় হামলাই প্রমাণ করেছে সরকার সঙ্ঘাতের রাজনীতি চায়। যে পুলিশ একজন সংসদ সদস্যকে জাতীয় সংসদের সামনে নগ্ন হামলা চালিয়ে দেশকে কলঙ্কিত করেছে; এই মহাজোট সরকার তাকেই পুরস্কৃত করে আবারো প্রমাণ করল, তারা প্রতিশোধের রাজনীতিতে বিশ্বাসী। আওয়ামী লীগ মুখে সবচেয়ে বেশি গণতন্ত্রের কথা বলে, অথচ গণতন্ত্রের কোনো চর্চা নেই। কোন্দলে জর্জরিত দলটির নেতাকর্মীদের মারামারির হাত থেকে রা করতে খোদ প্রধানমন্ত্রীকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সরকারের বিদায় বেলার ঘণ্টা বেজে উঠেছে, তবু বামপন্থীদের আঁচল ছাড়তে পারছে না। সরকার নৌকার ওপর দাঁড়িয়ে আবার মতায় যেতে চায়। জনগণ আর এ সরকারকে মতায় দেখতে চায় না বিধায় পাঁচটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে তাদের হলুদ কার্ড দেখিয়েছে। সে যন্ত্রণায় সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা আবোল-তাবোল প্রলাপ করছেন আর বলছেন, জনগণ ভালো মানুষকে ভোট দেয়নি। মানুষ একটু স্বস্তি, একটু শান্তি আশা করেছিল। কিন্তু সরকার তার পরিবর্তে এ দেশের মানুষকে যা দিয়েছে তা কোনো দিন ভুলতে পারবে না জনগণ। আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ এতই বেপরোয়া তাদের হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক থেকে শুরু করে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। আর অপেক্ষা করছেন কবে শেষ হবে মহাজোট সরকারের সময়। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে, তা সবারই জানা। ছাত্রলীগ-যুবলীগ সারা দেশে টেন্ডারবাণিজ্য, ভর্তিবাণিজ্য করতে গিয়ে খুনাখুনিতে লিপ্ত। কিছু দিন আগে চট্টগ্রামে রেলওয়ের টেন্ডার নিয়ে ছাত্রলীগ আর যুবলীগের গোলাগুলিতে জীবন দিতে হয়েছে এক অসহায় গরিব শিশুকে। মহাজোট নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছিল ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার বিষয়টি। কিন্তু সরকার চাকরি তো দূরের কথা, সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের জীবনের নিরাপত্তা পর্যন্ত দিতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিার্থীকে জীবন দিতে হলো সরকারের সোনার ছেলেদের হাতে। তার পরও কী করে সরকার বলে আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসীÑ তা ভাবতে অবাক লাগে! দেশকে উন্নয়নের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছতে হলে প্রয়োজন সরকার ও বিরোধী দলের ঐকমত্য। সরকার একের পর এক মামলা আর হামলা দিয়ে বিরোধী দলের আন্দোলনকে স্তব্ধ করার ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। বিরোধী দলের নেতাদের ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়েছে, যা কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের কাজ হতে পারে না। বিরোধী দল যদি না থাকে তা হলে গণতন্ত্রের কী আছে? সরকারের মাথায় বামপন্থীরা বসে আছে। তারা বাংলাদেশটাকে একটি অকার্যকর দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী তা অনুধাবন করতে পারছেন না। হত্যার অন্যায় আদেশ যারা দিয়েছেন, তাদের বিচারের কাঠগড়ায় আসতেই হবে। এ দেশের মানুষ শাহবাগ নামটি শুনলে বিরক্ত হয়। রাজধানীর ব্যস্ত শাহবাগে পুলিশের সামনে রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে বসে পড়েছিল ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাকটিভিটিস্ট নেটওয়ার্ক নামে সংগঠনটি। শাহবাগে আন্দোলনের নেপথ্যের অনেক তথ্য আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট। বেসরকারি স্কুলের শিকদের পুলিশবাহিনী পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছিল শাহবাগের পিচঢালা রাজপথ। সেই দিনের আচরণ বেসরকারি স্কুলের শিকেরা ভুলতে পারেননি। কারণ সেই দিন পুলিশ শুধু তাদের পিটিয়ে ান্ত হয়নি, তাদের শরীরের ওপরে মরিচের গুঁড়ার স্প্রে করেছিল। যারা শিকদের ওপর লাঠিচার্জ করেছিল, আজ হোক কাল হোক তার পরিণতি তাদের ভুগতেই হবে। অন্যায় কাউকে মা করে না। বাংলাদেশের ইতিহাস বড়ই নির্মম! ১০ বছরের রাজারও জেলখানায় যেতে হয়েছে। গত ফেব্র“য়ারি মাসে বামপন্থীদের ষড়যন্ত্রে শাহবাগে তৈরি হয়েছিল মঞ্চ। দুই মাস তারা শাহবাগের রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিল। সেই দিন সরকারের পুলিশবাহিনী তাদের সিসি ক্যামেরা দিয়ে নিরাপত্তা দিয়েছিল। ইসলামপ্রিয় জনতা এক হয়ে আন্দোলন শুরু করল। সেই আন্দোলনকে স্তিমিত করতেই শাপলা চত্বরে রাতের অন্ধকারে সরকার তার বাহিনী দিয়ে শেষ করে দিতে চেয়েছিল। কোনো শাসকই পারেনি প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে। গত ১১ জুলাই ছিল পয়লা রমজান। সেই দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য শিার্থী কোটাপদ্ধতি বাতিলের দাবিতে সকাল থেকেই জড়ো হতে থাকেন শাহবাগ চত্বরে। সরকারের বিরুদ্ধে যেখানে দেশের প্রধান বিরোধী দল দাঁড়িয়ে কোনো কথা বলতে পারে না, সেখানে শিার্থী বন্ধুরা কিভাবে বলবেÑ এটি তাদের আগেই ভাবা উচিত ছিল। সাধারণ শিার্থীদের আরেকটি ভুল ধারণা ছিল এ রকম যে, গণজাগরণ মঞ্চের ব্লগাররা যদি মাসের পর মাস শাহবাগে বসতে পারে তা হলে আমরা পারব না কেন। তাদের দাবির সাথে সম্পূর্ণ একমত পোষণ করে বলতে চাই, গণজাগরণ মঞ্চ করেছিল সরকার। তাই পুলিশ তাদের জামাই আদর করে পাহারা দিয়েছিল। শিার্থীদের আন্দোলন অযৌক্তিক নয়। তবু সরকার পুলিশবাহিনীকে দিয়ে নগ্ন হামলা চালিয়ে রোজাদার শিার্থীদের রক্তে শাহবাগের রাজপথ রক্তাক্ত করেছে। তাই পুলিশের সাথে যোগ দিয়ে ছাত্রলীগ যেভাবে বাঁশ ও রড দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছে, তা ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরকে মনে করিয়ে দিয়েছে। আমরা আশা করছিলাম সরকার তাদের বিচারের আওতায় আনবে। তা না করে উল্টো নিরপরাধ শিার্থীদের নামে মামলা করে চরম নীতিহীনতার পরিচয় দিয়েছে। সরকার এখন আর দিশা খুঁজে পাচ্ছে না। তাই বারবার ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। সরকারের উচিত সময় থাকতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা নিয়ে বিরোধী দলের সাথে বসে এ সমস্যার সমাধান করা। যদি ভুল সিদ্ধান্ত নেয় তার খেসারত সরকারকে বহন করতে হবেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি মেনে নিয়ে জনগণের মুখের ভাষা বুঝে সঙ্ঘাতের হাত থেকে এ দেশকে রা করুন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads