রবিবার, ১৪ জুলাই, ২০১৩

কোটা কি রাষ্ট্রীয় অবিচার নয়?


একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছেÑ রাষ্ট্র জনগণের। রাষ্ট্রের কাছে কোনো ভেদ নেই। ধনী-গরিব, সাদা-কালো, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই রাষ্ট্রের কাছে সমান অধিকার পাবে। ১৯৭১ সালে এ দেশের সাধারণ মানুষ যে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল সে যুদ্ধও ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের সর্বপ্রকার বৈষম্যের বিরুদ্ধে। তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকেরা পূর্ব পাকিস্তানিদের কোনোভাবে মূল্যায়ন করত না। এ দেশের সম্পদ লুট করে তারা নিজেদের হৃষ্টপুষ্ট করেছে। এ দেশের মানুষ যাদেরকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে তারা তাদেরকে শাসনমতা না দিয়ে নিজেদের ইচ্ছেমতো শাসন করেছে। এ দেশের মুক্তিকামী জনতা পাকিস্তানি হানাদারদের ওইসব অন্যায়কে মেনে নিতে পারেনি বলে তাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমাদের বাপ-দাদারা যুদ্ধ করে দেশকে মুক্ত করলেন, সেই বৈষম্যই কিনা এখন আমাদের ঘাড়ে চেপেছে নানা নামে; তা-ও আবার রাষ্ট্রীয়ভাবে। এর চেয়ে দুঃখের খবর আর কী হতে পারে? ১৩ জুলাই নয়া দিগন্তে ‘মেধাবীদের সামনে অন্ধকার কোটায় খেয়ে ফেলছে চাকরি’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি আমাদেরকে হতভম্ব করেছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ‘দেশে সরকারি চাকরি েেত্র ১০ শতাংশ জনগোষ্ঠী ৫৬ শতাংশ কোটার সুবিধাভোগী। আর ৯০ শতাংশ জনগোষ্ঠী কোটা সুবিধার বাইরে। বর্তমানে বিসিএস পরীার মাধ্যমে উত্তীর্ণরা নিয়োগের জন্য যেসব কোটার মুখে পড়েন সেগুলো হচ্ছেÑ মুক্তিযোদ্ধা পোষ্য কোটা ৩০ ভাগ, মহিলা কোটা ১০ ভাগ, উপজাতি ৫ ভাগ এবং প্রতিবন্ধী ১ ভাগ।’ সংখ্যাগরিষ্ঠ মেধাবীরা যেখানে ৭০-৮০ নম্বর পেয়েও একটি সরকারি চাকরি জোগাড় করতে পারেন না, সেখানে এসব কোটার অধীনে মাত্র ৫০-৫৫ মার্কস পেয়েও বাগিয়ে নিতে পারেন চাকরি নামক সোনার হরিণটি। বাহ, কী চমৎকার! কোটা অর্থ হচ্ছে, অন্যের ন্যায্য অধিকারকে খর্ব করে আরেকজন অযোগ্যকে অধিকার প্রদান করা। বাংলাদেশের সংবিধানে সব নাগরিককে সমান অধিকার প্রদানের কথা বলা হয়েছে। শুধু চাকরি েেত্র নয় বরং শিা, সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিকসহ সব েেত্র এটি প্রযোজ্য; কিন্তু শিাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু হয় বৈষম্য। উচ্চশিা গ্রহণ করতে গেলে শিার্থীরা কোটাপ্রথার মুখোমুখি হন। ভর্তি পরীায় ভালো মার্কস পেয়েও অনেকে কাক্সিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেন না; কিন্তু কোটা ব্যবস্থার মাধ্যমে অনেকেই কম মার্কস পেয়েও ভর্তি হয়ে যান অনায়াসে। সংবিধানের ধারা ২৮(১)এ বলা হয়েছেÑ ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’ ধারা ২৮(৩)এ বলা হয়েছেÑ ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোনো বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোনো শিাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোনো নাগরিককে কোনো রকম অমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না।’ সংবিধানের এ ধারা অনুযায়ী এ দেশের যেকোনো নাগরিক তার মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী যেকোনো শিাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার অধিকার পাওয়ার কথা। তাকে নারী-পুরুষ ভেদ কিংবা উপজাতি, অ-উপজাতি, মুক্তিযোদ্ধা-সাধারণ নাগরিক ইত্যাদি শ্রেণিবিন্যাস করা সংবিধানসম্মত নয়। উচ্চশিায় প্রবেশের েেত্র কোটা ব্যবস্থা কম হলেও সরকারি চাকরি গ্রহণের বেলায় দেখা যায় ব্যাপক। ৫৬ ভাগ কোটা যথেচ্ছ অপব্যবহার হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। মুক্তিযোদ্ধার কোটার স্থানে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বা নাতি সেজে কেউ কেউ এ সুবিধাটি নিতে চান। আবার মুক্তিযোদ্ধা যদি হয় সরকারি দলের বিপরীত মতাদর্শের, তাহলে তাদের সন্তানেরা এ সুযোগটি নিতে সম না-ও হতে পারেন। মহিলা কোটায় চলে চরম দলীয়করণ। সরকারি দল, টাকা কিংবা আত্মীয় হতে পারলে এই কোটায় সুযোগ নেয়া যায়। এটা তো গেল দৃশ্যমান কোটা। এরপর আছে অদৃশ্যমান কোটা ব্যবস্থা। যা আরো জঘন্য। মন্ত্রী, এমপি, সচিব, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, দলীয় পরিচয়সহ অবস্থানভেদে বিভিন্ন স্থানে এই অদৃশ্যমান কোটা কাজ করে। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ চাকরি পেলে কেউ কেউ বলেন, উনি ভিসির কোটায় নিয়োগ পেয়েছেন, উনি ছাত্রলীগের কোটায় চাকরি পেয়েছেন, উনি মন্ত্রীর কোটায় চাকরি পেয়েছেন প্রভৃতি। এসব কোটা অদৃশ্যমান। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ এই নীতি গ্রহণ করে মতাশালীরা নিজেদের সন্তান ও দলীয় অনুসারীদের জন্য যতদূর অধিকার কেড়ে নিতে পারেন ততটুকু তারা করেন। এসব েেত্র টাকা লেনদেনের বিষয়টিও থাকে। যে যত টাকা ঢালতে পারে তার জন্য চাকরি বরাদ্দ থাকে তত মজবুতভাবে। এসব দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান কোটা ব্যবস্থার গ্যাঁড়াকলে পড়ে এ দেশের বেশির ভাগ গরিব, মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধারণ মেধাবী নাগরিকেরা হন বঞ্চিত। তারা হন রাষ্ট্রীয় অবিচারের মুখোমুখি। যে রাষ্ট্রটি স্বাধীন হয়েছে, গরিব, খেটে খাওয়া ও অধিকার বঞ্চিতদের অধিকার প্রদানের জন্য সেই রাষ্ট্রই আজ পরিণত হয়েছে পেষণযন্ত্রে। সারা দিন রিকশা চালিয়ে, লজিং টিউশনি করে কিংবা কঠোর পরিশ্রম করে ওরা শিার বিভিন্ন স্তরে এ প্লাস, গোল্ডেন এ প্লাসসহ ভালো রেজাল্ট করেছে। ওদের বুকে স্বপ্ন, ওরা চাকরির ময়দানে এসেও পরীায় ভালো রেজাল্ট করে সরকারি চাকরি নিয়ে অসহায় মা-বাবার মুখে হাসি ফোটাবে। কিন্তু না, ওদের স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই রয়ে যায়। চাকরির পরীায় ওরা এ প্লাস পায় সত্যি, কিন্তু ওরা হেরে যায় কোটাপ্রথার কাছে; যেখানে ওর চেয়ে কম মার্কস পেয়েও তুলনামূলক অযোগ্য ও অমেধাবীরা চাকরিটা বাগিয়ে নিচ্ছে। ওরা বঞ্চিত হয়ে দেখছে রাষ্ট্রীয় অবিচারের নির্মম দৃশ্য! যার বাবা বা দাদা মুক্তিযুদ্ধের মতো কঠিন যুদ্ধে জয়ী হতে পেরেছে সে কেন পড়ালেখার যুদ্ধে অন্যের সাথে তাল মেলাতে পারবে না। আমরা তো মনে করি, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হয়ে কোটাপ্রথায় শিা ও চাকরি নেয়া অপমানের বিষয়। বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা কোনো বিশেষ ধরনের সুযোগ নিয়ে নিজেদের পিতাকে হেয় করবে না। তবে কোনো মুক্তিযোদ্ধার পরিবার যদি গরিব থাকে তাহলে সরকার তাকে আর্থিক সুবিধা দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে পারে। তাদের সন্তানদের অবৈতনিক লেখাপড়ার সুযোগ দিতে পারে। সরকারকে অনুরোধ করব, মেধাবী শিার্থীদের যৌক্তিক দাবি মেনে নিয়ে কোটাপ্রথা তুলে দিন। দেশের সব নাগরিককে মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী শিা ও চাকরিপ্রাপ্তির সুযোগ করে দিন। মেধার স্বার রেখে কোনো মেয়ে, উপজাতি ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসনে আসীন হলে কেউ এতে আপত্তি করবে না। এতে রাষ্ট্র আরো উন্নত হবে। সবাই মেধার স্বার রেখে ভালো ফল করার চেষ্টা করবে। মেধাবীরা মূল্যায়িত হলে, যোগ্যরা সমাদর পেলে দেশ থেকে সর্বপ্রকার অনাচার দূর হতে বাধ্য। আল্লাহ সবাইকে সুমতি দিন। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads