বুধবার, ১০ জুলাই, ২০১৩

উলুবনে মুক্তা ছড়িয়ে কী লাভ!


ক. এই সময়ের আলোচিত বিষয় গাজীপুর নির্বাচন। অন্য সব জাতীয় ইস্যু ও সংবাদ বিশ্লেষণ ঢাকা পড়ে যায় গাজীপুরের রাজনীতি প্রভাবক নির্বাচনের ছায়ার তলে। বহির্বিশ্বের মিডিয়াজুড়ে রয়েছে মিসর প্রসঙ্গ। মইন-ফখরুদ্দীন ধরনের ছদ্মবেশী সেনাশাসন প্রতিষ্ঠিত হলো মিসরে। মুরসির পায়ের তলার মাটি বেশ শক্ত। গণভিত্তি মজবুত। নীল নদের পানিতে এখন ব্রাদারহুড কর্মীদের রক্ত। মনে হয় মুসা-ফেরাউনের দেশে নতুন চেহারা ও অবয়বে সেই সত্য-মিথ্যার লড়াই চলছে। মনে হচ্ছে ব্রাদারহুড জান দেবে মান দেবে নাÑ এটা পরিষ্কার। শেষ পর্যন্ত মিসর কোন দিকে যাবে সেটাও ভবিষ্যতের বিষয়। তবে আরব বসন্তকে হাইজ্যাক করে যারা গণতন্ত্র হত্যা করে বুটের শাসন চালাচ্ছে, তারা ফেরাউনের মতো নীল নদে ডুববে। মাপজোখ করে সময়টা হয়তো বলে দেয়া কঠিন। এই সুযোগে আমরা আজকের কলামে কিছু ব্যতিক্রমী আলোচনায় যেতে পারি। খ, আমাদের জাতীয় ভাবনার নিরিখে তিনটি বই নিয়ে আজকের আলোচনার সূচনা করতে চাই। বই পড়ার ধরন একেকজনের একেক ধরনের। কেউ একটা বই শেষ করে নতুন বই পড়তে অভ্যস্ত। আবার একসাথে একাধিক বই পড়াও অভ্যাসের ব্যাপার। যারা কোনো বই পড়েন না তাদের অভ্যস্ততার প্রশ্নই ওঠে না। আমরা পেশাগত কারণে পাঠক হতে বাধ্য। নেশার কারণেও বই পড়ে আনন্দ পাই। তুষ্টি বোধ করি। তা ছাড়া সব বই নতুন কিছু শিক্ষা দেয়। সবচেয়ে দুর্বল বিষয়বস্তুর কিংবা ছোট বইয়ের পাতা উল্টালেও জ্ঞানরাজ্য প্রসারিত হয়। নতুন কিছু শেখা যায়। জানার পরিধি বাড়ে। ধীশক্তি, চিন্তার খোরাক এবং প্রজ্ঞার পুঁজি বইয়ের মধ্যেই ঠেসে থাকে। একসাথে পালা করে একাধিক বই পড়ার মজাই আলাদা। রুচি পাল্টানো যায়। স্বাদ আস্বাদনও হয়। একঘেয়েমি আসে না। আবার বিষয় বৈচিত্র্যের কারণে এক ধরনের বাড়তি আগ্রহও থাকে। স্বভাবগত কারণে এ সময় অন্যান্য বইয়ের সাথে আমার টেবিলে তিনটি বই। যখন যেটা কাছে টানে, মনে লয় সেটাই তাৎক্ষণিক কিছু অংশ পড়ার চেষ্টা করি। কারাগারে কেমন ছিলাম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের নতুন বই। বাংলাদেশ পরিবর্তনের রেখাচিত্র ব্যবসায়ী নেতা ও রাজনীতিবিদ আবদুল আউয়াল মিন্টুর গবেষণাধর্মী বই। চীন ভ্রমণ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয় আশয় নিয়ে লিখেছেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও বিজের পরিচালক আশরাফ আল দ্বীন। এই সময়ে বইগুলো টেবিলে টেনে আনার কারণ ছিল একটি স্মৃতিকথাÑ বিশেষত জেল জীবনের রোজনামচা। এ ধরনের বই পড়ে অনেক কিছু শেখা যায়, অভিজ্ঞতাও সঞ্চিত হয়। পাঠেও কান্তি আসে না। যেকোনো স্মৃতিকথা পাঠকমন সহজেই টানে। চীন ভ্রমণের ওপর বইটি টেনে আনার কারণ ভ্রমণকাহিনী অদম্য আগ্রহ জাগায়। সুখপাঠ্য হওয়ার মতো বিষয়। বাংলাদেশ পরিবর্তনের রেখাচিত্র একজন স্বপ্নাভিসারী মানুষের বাস্তবতা ছোঁয়ার ও সেই লক্ষ্যে পৌঁছার নিরন্তর প্রচেষ্টার দলিল। এই বইটির বিষয়বস্তু বহুমাত্রিক। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ-সংস্কৃতির সমন্বিত রূপ। যেকোনো রাজনীতি-সচেতন ও দেশাত্মবোধে উজ্জীবিত মানুষকে অবশ্যই আকৃষ্ট করার মতো। মওদুদ আহমদের কারাগারে কেমন ছিলাম-২০০৭ থেকে ২০০৮ সালে মইন-ফখরুদ্দীন সরকারের নিপীড়নচিত্রের সাদামাটা নয়, বিভীষিকাময় দলিল। নিরাজনীতিকরণের নীলনকশার একটি সময়চিত্র। সে সময়ে সরকারের বাড়াবাড়ির একটি প্রমাণ। একেবারে সহজ-সরল গদ্যে কথ্য ভাষায় লেখা এ জেলজীবনের দিনলিপি কিছু অজানা রাজনীতিরও সন্ধান দেয়। সহজ কথায় ডায়েরিটির রাজনৈতিক গুরুত্ব অসীম। মনে হয়েছে নিজস্ব বোধ বিশ্বাস থেকে মওদুদ আহমদ অকপট থাকারও চেষ্টা করেছেন। দু’চার জায়গায় বিপরীতধর্মী মন্তব্যও রয়েছে। তার পরও একজন রাজনীতিবিদ ও তার সময়কে বোঝার জন্য এমন গ্রন্থের প্রয়োজন সব মহলে স্বীকৃত। এর পাশাপাশি আশরাফ আল দ্বীনের বইটি পড়ে মনে হয়েছে, এ যেন ভ্রমণকাহিনী পড়তে পড়তে শেখা নয়, শিখতে শিখতে ভ্রমণকাহিনী পড়া। সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে বিদেশে, আবদুল হাইয়ের বিলাতে সাড়ে সাত শ’ দিন কিংবা প্রিন্সিপ্যাল ইব্রাহিম খাঁর ইস্তাম্বুল যাত্রীর পত্র নিটোল ভ্রমণকাহিনী। আশরাফ আল দ্বীন ভ্রমণকাহিনীর সাথে ‘আন্তর্জাতিক’ সম্পর্কের বিষয় আশয় জুড়ে দিয়েছেন। চীন, কোরিয়া, তাইওয়ান, জাপান, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও বৈশ্বিক রাজনীতি নিয়ে লেখকের মূল্যায়ন শুধু বিশ্বাস বিধৌত নয়, বাস্তবতার নিরিখে বস্তুনিষ্ঠও। কখনো কখনো মনে হবে লেখক বিশ্লেষণী মনে পরিস্থিতি দেখতে অভ্যস্ত। আবদুল আউয়াল মিন্টু পরিশ্রমী মানুষ। দূরদর্শী চিন্তার লোক। সফল ব্যবসায়ী হওয়া ছাড়াও তার রাজনৈতিক মন ও মনন একবারে স্বচ্ছ। তিনি রাজনীতি-অর্থনীতির নিরিখে তার স্বপ্নের বাংলাদেশের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য রেখাচিত্র এঁকেছেন। তার উন্নয়ন ভাবনা ও পরিকল্পনা রাজনৈতিক অগ্রগতির পরিকল্পিত পাঠ হিসেবে যেকোনো সরকার কাজে লাগাতে পারে। এই গবেষণাগ্রন্থ থেকে উপকৃত হতে পারে যে কেউ। লাগসই প্রযুক্তি ও টেকসই উন্নয়নকাঠামোর আওতায় রাজনীতিকে নতুন মডেলে সাজানোর একটা প্রচেষ্টা বইটিকে সমৃদ্ধ করেছে। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের একটা প্রস্তাব আমাদের মতো দেশের জন্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে। এ ব্যাপারে জানিপপের প্রধান নির্বাহীরাও একটি বই আকারে প্রস্তাবটি জাতির সামনে তুলে ধরেছেন। খ. আমাদের রাজনীতিবিদেরা কম পড়েন, বেশি বলেন। আমাদের বৃদ্ধিজীবী ও সুশীলসমাজ খ্যাতরা মতান্ধ ও দলান্ধ। আমাদের মিডিয়া পক্ষপাতদুষ্ট। চ্যানেলগুলো দু-একটা ব্যতিক্রম ছাড়া বিটিভির নতুন সংস্করণ। সাহেব গোলাম কিংবা মতলবি এজেন্ডার গীত গায়। জনগণ বাধ্য হয়ে রাজনৈতিক বন্ধ্যত্বের শিকার। যে দেশের রাজনীতিবিদেরা দলীয় স্বার্থের বাইরে জাতীয় রাজনীতি নিয়ে ভাবতে নারাজ, ক্ষমতার বৃত্ত ডিঙাতে অপারগ, তারা দেশকে নতুন চিন্তা উপহার দেবেন কিভাবে। এই দেশকে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর কিংবা কোরিয়া বানানোর মতো নেতৃত্ব নেই। আছে ক্ষমতাপাগল একদল হিংসুটে মানুষ, রাজনৈতিক প্রজ্ঞাসম্পন্ন জাতীয় চিন্তা-চৈতন্য লালন করার মতো দূরদর্শিতাও তাদের নেই। বরং চিন্তার বৈকল্য নিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করছে রাজনীতিবিদেরাই। সাথে যোগ দিয়েছেন মতান্ধ বুদ্ধিজীবীরা। পোঁ ধরছে মিডিয়া। সঙ্গত কারণেই নতুন প্রজন্ম স্বেচ্ছায় ব্রেইন ড্রেন হয়ে জাতিকে বঞ্চিত করছে। এ দেশের মানুষকে রাজনীতিবিদেরা ভাবছে বোকার হদ্দ। ভূরাজনৈতিক কৌশল জানা, দেশের শত্রু-বন্ধু বাছাই করার প্রয়াস কারো নেই। সব ক্ষেত্রে জাত্যাভিমান ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে দেখেও দেশাত্মবোধ জাগ্রত হয় না। এখন শাসক ও শাসিতের মধ্যে সম্পর্কটা নিপীড়ক ও নিপীড়িতের। জালেম ও মজলুমের। শোষক ও বঞ্চিতের। এই অবস্থায় জনগণ ও জাতির কিছু বিবেকবান মানুষ বারবার জানান দিচ্ছেন আমাদের অভীষ্ট কী হওয়া উচিত। কেউ সেটা আমলে নিচ্ছেন না। তাদের আবার মওদুদ, মিন্টু ও আশরাফের বই পড়ার মাজেজা বর্ণনা করেইবা কী লাভ! এই কলামে তিনটি বইয়ের আলোচনা টেনে উলুবনে মুক্তা ছড়ানোর কাজটাই না হয় করলাম! গ. আমরা সবাই এখন রোজার সংযমী আবরণে ঢাকা। রোজা আমাদের জাতীয় জীবনে নতুন আবহ সৃষ্টি করে। রাজনীতি-অর্থনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি সব পাল্টে যায়। এক ধরনের আধ্যাত্মবাদ আমাদের জীবনে পরশ বুলিয়ে দেয়। আমরা অবগাহন করি নতুন পরিবেশ-পরিমণ্ডলে। রাজনীতি গতি পাল্টায়, অর্থনীতি ভিন্ন মাত্রায় বেগবান হয়। সর্বত্র টাকা ওড়ে। খরচের বহর বাড়ে। ইফতার-সংস্কৃতির কাছে অন্যসব অনুষ্ঠান হার মানে। এই চিত্রের বাইরেও একটি চিত্র আছে। রোজাকে যারা আপদ ভাবেন তাদের সংখ্যাও কম নয়। আবার বাণিজ্যের মওসুম ভাবার মতো লোকও সর্বত্র রয়েছে। তারপরও রোজা একটি নতুন পরিবেশ উপহার দেয়। সেটা বোধকরি আর কোনোভাবে পাওয়া সম্ভব হয় না। এই মওসুমে দান-সদকা, জাকাত-ফিতরার কারণে অর্থপ্রবাহ বাড়ে। বোনাস-সালামি, ঈদি ও বখশিশের অর্থনৈতিক তাৎপর্যও কম নয়। রোজা মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। মানবিক বৈশিষ্ট্যকে আরো সংবেদনশীল করে তোলে। মমত্ববোধ ও সহমর্মিতা বাড়ায়। সংযমকে উচ্চ মার্গে নিতে সাহায্য করে। আমাদের প্রতিহিংসার রাজনীতির বিপরীতে এ যেন একটু স্বস্তি। অসহিষ্ণু রাজনীতির মোকাবেলায় একটুখানি বাড়তি প্রশান্তি। রোজায় ইবাদত আশ্রয়ী চাদরে ঢাকা এ পরিবেশ জাতিকে নতুন নির্দেশনা দিলেই জনমনে প্রকৃত স্বস্তি ও স্থিতির আমেজ সঞ্চারিত হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads