মঙ্গলবার, ২৩ জুলাই, ২০১৩

তবে কি তিনিও দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসী?

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : 
গাজীপুরসহ পাঁচ সিটি করপোরেশনে জনগণের ভোটে ধারাবাহিক পরাজয়ের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক অদ্ভুত কথা বলেছেন। তিনি অবশ্য অনেক সময় নানা ঠল্লকে কথা বলেন। কখনও কখনও তা হাস্যোদ্রেক করে। কখনও কখনও প্রতিপক্ষের একেবারে গা জ্বলে যায়। আমরা নিম্নস্তরের ভোটাররা এই সব থেকে মাঝে মধ্যে আনন্দ অনুভব করি। রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট এই চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকার সমর্থকদের মারাত্মক ভরাডুবি ঘটে। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের সামনে তাদের কেউ দাঁড়াতেই পারেনি।
এরপর একেবারেই জীবন-মরণ চ্যালেঞ্জ হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছিল গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে। সেখানে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় প্রায় সকল নেতাকে মোতায়েন করা হয়েছিল ভোট দখলের জন্য। ৭২ জন এমপি গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকায় ভোট পাওয়ার জন্য দিন-রাত ঘাম ঝরিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। জয়ী তাদের হতেই হবে। গাজীপুরে অবশ্য সামান্য ব্যতিক্রম ছিল। সেটি হলো পরাজিত আওয়ামী লীগের অন্য চারটি সিটি করপোরেশনে মোট ভোটার সংখ্যা ছিল ১২ লাখ। আর গাজীপুরে একাই ভোটারের সংখ্যা ছিল ১০ লাখের অধিক। ফলে আওয়ামী লীগ যদি গাজীপুরে জিততে পারতো তাহলে তারা বলতে পারতো যে, তোমরা ১২ লাখ লোকের মধ্যে সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করেছ, আর আমরা ১০ লাখ লোকের মধ্যে সংখ্যা গরিষ্ঠ। অতএব বিজয়টা সমান সমান হলো। আমরা হারিনি।
কিন্তু সরকার দলের সে আশাও গাজীপুরবাসীরা ভূলুণ্ঠিত করে দিয়েছে। দেড় লাখ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে দিয়েছেন অধ্যাপক আবদুল মান্নান আওয়ামী লীগ প্রার্থী আজমত উল্লাহ খানকে। আজমত উল্লাহ খান জনগণের মনোভাব আগেই টের পেয়েছিলেন। তিনি সেই যে রাত আটটায় নিজ বাসভবনে ঢুকে দরজা বন্ধ করে মোবাইলের সুইচ অফ করে দিয়েছিলেন, তারপর আর কারো সঙ্গে কথা বলেননি। এমনকি তিনি নিজের ওয়ার্ডের যেখানে তার ঘরবাড়ি, বসবাস, আত্মীয়-স্বজন সেখানেও প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। সেদিন তিনি কিছুই বলেননি। পরে তার দলের কয়েকজন নেতাকে তিনি এই পরাজয়ের জন্য দায়ী করেছেন। যাদের দায়ী করেছেন তারাও এ কথা বলতে ছাড়েননি যে, তাদের কারণেই যদি আজমত উল্লাহর পরাজয় ঘটে থাকে, তাহলে নিজ ওয়ার্ডেও তিনি কেন অধ্যাপক মান্নানের চেয়ে কম ভোট পেলেন।
সত্যিই তো। আওয়ামী লীগের পরাজিত প্রার্থী আজমত উল্লাহ খানের এ প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। তিনি তো হেরেছেনই। আর হার মেনে নিয়ে তিনি অধ্যাপক মান্নানের সঙ্গে মিষ্টি খাওয়া-খাওয়ি করেছেন। এটিও গণতন্ত্রের একটি চমৎকার উদাহরণ। হেরে গেছি। জনগণ আপনাকে চায়। এবার আপনার সেবার পালা। সে সেবা থেকে সম্ভবত আমিও বঞ্চিত হব না। আজমত উল্লাহ খান ১৭ বছর টঙ্গী পৌরসভার মেয়র ছিলেন। এই ১৭ বছরে এমন কোনো বছর নেই যে, টঙ্গী পৌরসভা ভবনটি সামান্য বৃষ্টির পানিতেও ডুবে যায়নি। সেটি ছিল সাধারণ মানুষের জন্য অগম্য। নির্বাচনে বোধ করি, তার পরাজয়ের এটিও একটি কারণ ছিল। তার উপর আওয়ামী দুঃশাসন তো ছিলই। সরকার সমর্থক সংবাদপত্রগুলোও একেবারে লীড শিরোনাম করেছে যে, ‘গাজীপুরে টাকা উড়ছে।’ সে টাকা উড়াবার ক্ষমতা সরকার সমর্থকরা যতটা রেখেছেন, বিরোধীদল আশা করি, ততটা রাখেননি।
পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মোটামুটি এই ছিল হাল। তখন সরকার সমর্থক মিডিয়া লিখতে শুরু করলো যে, আহা, পরাভূত সরকারদলীয় মেয়র প্রার্থীরা কতই না ভাল কাজ করেছেন, দেশের কতই না উন্নতি ঘটিয়েছেন। রাস্তা করেছেন। সেতু করেছেন। জনকল্যাণে কাজ করেছেন। তবু তারা আওয়ামী লীগের জাতীয় রাজনীতির কারণে নির্বাচনী ময়দানে একেবারে কুপোকাত হয়ে গেলেন। আহ্্হা, কী ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ই না ঘটে গেল! সাধারণ মানুষ আসলে কিছুই বুঝতে চায় না। তারা বোধ করি কেবলই নগদ নারায়ণের পক্ষপাতী। কিন্তু সে চেষ্টা গাজীপুরে কম হয়নি। আর শুধু গাজীপুর কেন, বাকি চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও এভাবে টাকা উড়েছে। কিন্তু সে টাকা ভোটের বাক্সে ফলদায়ী হয়নি।
কিন্তু আমাদের উদ্বেগের প্রসঙ্গ এখানে নয়। আমাদের উদ্বেগের বিষয় হলো, এই নির্বাচন শেষে ভাগ্নীর  বিয়ে খেয়ে দেশে ফিরে গত ১৩ জুলাই ‘আঁতাতের নির্বাচনের’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন এক কথা বলে বসলেন, যা গণতন্ত্র এবং জনগণের মুখে জুতা মারা ছাড়া আর কিছুই না। তিনি বললেন, ‘যারা সৎ, যারা উন্নতি করেছে, তারা ভোট পায়নি। যারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত, আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি আর খুনের সঙ্গে জড়িত, তারা জিতে এলো।’  কেন তা হলো? এর উত্তর খুঁজতে সবার প্রতি আহ্বান জানালেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমাদের একটা ক্যান্ডিডেটের বিরুদ্ধে তো কেউ কোনো দুর্নীতির অভিযোগ তুলতে পারেনি। যারা দুর্নীতি করেনি, যারা ক্লিন ইমেজের, তারা জিততে পারেনি।’ তার কথায় এ ফলাফল ছিল অপ্রত্যাশিত এবং তিনি বলেন, ‘তাহলে আমরা এ উন্নয়ন কেন করছি? কার জন্য করেছি? যদি দুর্নীতিবাজরাই জিতে আসে তাহলে এই জেতার রহস্যটা কী?
শুনলাম জাতীয় ইস্যুর জন্য হেরে গেছি। জাতীয় ইস্যু কী? আমরা খাদ্য নিরাপত্তা দিতে পারছি কিনা?’ এরপর তিনি তার সরকারের ‘উন্নয়ন চিত্র’ তুলে ধরে বলেন, ‘জাতীয় ইস্যুর জন্যই যদি হারবো, তাহলে আমার প্রশ্ন, জাতীয় ইস্যু হয়ে গেল দুর্নীতি? আমাদের সরকার নাকি দুর্নীতি করেছে। দুর্নীতি করে তো এত উন্নয়ন সম্ভব নয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন, স্বাস্থ্য সেবার মান, শিক্ষার মান, কিছুই তো কমেনি। বরং বেড়েছে। তাহলে দুর্নীতি কোথায় হলো? হলমার্ক ও ডেসটিনি আমরা ধরলাম। আর চোর ধরে আমরা অপরাধী হয়ে গেলাম?’
তিনি বলেন, ‘গাজীপুর ইলেকশনে আমরা যাকে সাপোর্ট দিয়েছি, তিনি তিনবারের পৌরসভা মেয়র। তার বিরুদ্ধে কেউ কোনো দুর্নীতির কথা বলতে পারেননি। ক্লিন ইমেজের লোক। তাকে হারতে হলো। জিতলো কে? ধর্ম প্রতিমন্ত্রী হিসেবে যে হজ্জের টাকা লুটে খেল, ঐ এলাকার ব্যবসায়ীরা আতঙ্কগ্রস্ত, টাকা নিয়ে বসে থাকতে হবে, তাকে চাঁদার টাকা দিতে হবে।’ শেখ হাসিনা বলেন, খুলনার মেয়র নকশাল করতো, আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি। খুনের মামলার আসামী ছিল। জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করে দল করতে গিয়ে খুনের মামলার আসামীকে জেলখানা থেকে বের করে দল করা শুরু করেন। খুলনায় মানিক সাহা, সাংবাদিক বালু ও মনজুরুল ইমাম থেকে যত মার্ডার হয়েছে, এই আন্ডারগ্রাউন্ড জড়িত। সে ভোট পায়, জিতে আসে। কী কারণে হেরেছি, তা আসলে আরও খতিয়ে দেখা উচিত।’
সন্দেহ নেই, এ এক বিশাল প্রশ্ন। তার দলের লোকেরা এত ভাল, অথচ নির্বোধ জনগণ তাদের ভোট না দিয়ে ভোট দেয় তার বিরুদ্ধ দলকে। এবং ঘটনাটি এমনই আশ্চর্য যে, জনগণের ভোটে যারা নির্বাচিত হয়ে এসেছে, শেখ হাসিনা তাদেরকে আগাম অসৎ বলতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। কিন্তু দেউটি যে একে একে নিভে যাচ্ছে, সেটি খেয়াল করার অবকাশ তার নেই। জনগণ এমনই এক পাজী প্রজাতিতে পরিণত হয়েছে যে, তারা তার দল অর্থাৎ আওয়ামী লীগের দুধে ধোয়া প্রার্থীদেরও ভোট দিচ্ছে না। এও কি সহ্য করা যায়?
সহ্য না করা গেলে সঙ্কট ভিন্ন স্থানে জন্মগ্রহণ করে। সেটি হলো, নির্বাচনে অসৎরা জয়লাভ করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন এক নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতাসীন হয়েছেন যে, তার দলের সাধারণ সম্পাদক পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ঐ নির্বাচনটি ছিল পাতানো। অথবা ‘আঁতাতে’র নির্বাচন। যখনই নির্বাচনের ফিকির হয় তখন আবদুল জলিল সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি নিশ্চিতভাবেই জানতেন যে, দল ও সেনাবাহিনীর ভেতর কী ঘটছে। এবং এই ষড়যন্ত্রে ঘোঁট কোথায় গিয়ে থামবে। সে নির্বাচনের কোথাও কোথাও ১১২ শতাংশ পর্যন্ত ভোট পড়েছে। আবার জাল ভোট আওয়ামী লীগের পক্ষে মেরে মুড়ি এদিক ওদিক ছুড়ে ফেলা হয়েছে। কৌতূহলী শিশুরা সেগুলো উদ্ধার করে মানুষকে দেখিয়েছে। আর যায় কোথায়? নির্বাচন কমিশন ঘোষণা দিয়ে বসেছে যে, এরপর থেকে এই মুড়ি যার কাছে পাওয়া যাবে তাকেই গ্রেফতার করা হবে। ধরে নেয়া হবে যে, জাল ভোটগুলো ঐ ব্যক্তিই দিয়েছেন। ফলে শত শত কেন্দ্রের জাল ভোটের কাহিনী আর জনসমক্ষে উপস্থাপিত হয়নি।
নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন এখন গণতন্ত্রের নানা ছবক শোনাচ্ছেন। কিন্তু তখন এইসব অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার ন্যূনতম সাহস তিনি দেখাতে পারেননি। ২০০৮ সালের সে নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট ব্যাপক বিজয় লাভ করেছিলো। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের গৌরবোজ্জ্বল শাসনে দেশ পুনরায় নতুন এগার অর্থনৈতিক পরাশক্তির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলো তাদের জিততে দেয়া হয়নি। জিতে এলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট।
তবে কী আমরা এই মহাজোটে যারা নির্বাচিত হয়ে এসেছেন, জনগণের তথাকথিত ভোটে যারা ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন তাদের অসৎ দুর্নীতিবাজ বলে আখ্যায়িত করব। তারা যে অসৎ ও দুর্নীতিবাজ এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। ক্ষমতাসীন হওয়ার দিন থেকে এই আজ পর্যন্ত তারা দুর্নীতির হিমালয় গড়ে তুলেছেন। প্রতিদিন তাদের দুর্নীতির খবরে সংবাদপত্রের পাতা ভরে থাকছে। হিমালয়ের মতোই দুর্নীতর শিকড় প্রতিদিন উচ্চ থেকে উচ্চতর হচ্ছে। সুতরাং যে যা কিছুই বলুন না কেন একবার আয়নায় নিজের মুখ ভালো করে দেখেই তা বলা উচিত। নইলে থুতু উপরের দিকে ছিটালে তা নিজের মুখের ওপরই পড়তে বাধ্য।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads