বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০১৩

তেঁতুল তত্ত্বের পোস্টমর্টেম

অভিযোগ হচ্ছে, আল্লামা শফী তেঁতুলের সাথে নারীদের তুলনা করেছেন। যুক্তি কিংবা তর্কের খাতিরে এই অভিযোগ মেনে নিলেও আল্লামা শফীর বক্তব্য নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ির কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। এ বক্তব্য শুনে যাদের গা ঘিন ঘিন করছে, লজ্জা পাচ্ছেন কিংবা অশ্লীলতার গন্ধ শুঁকে বমি বমি লাগছে, তাদের এ মন্দ লাগার বিষয়টি একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। যারা নারীকে তেঁতুলের সাথে তুলনাকে নোংরামির নামান্তর ভাবছেন, তাদের প্রতিও কোনো অভিযোগ খাড়া করব না। কারণ শব্দ চয়নে তারতম্য ও ভালো-মন্দ লাগার বিষয়টিও ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ফারাক হতে পারে। যারা আহমদ শফী সাহেবের রুচির প্রশ্ন তুলছেন, তাদেরকেও অভিযুক্ত করব না। রুচির বিষয়টিও স্থান-কাল-পাত্র ভেদে তারতম্য হতে পারে। এক অঞ্চলের গালি অন্য অঞ্চলের বুলি। তবে যারা তার জন্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, মানুষ না পশুর গর্ভে জন্ম নিয়েছেন তা নিয়ে বিস্মিত হচ্ছেন, তাদের প্রতি পাল্টা পরামর্শ রাখবÑ বিজ্ঞান, যুক্তি এবং নৈতিকতার বাঁধন রেখে, শ্লীল-অশ্লীল বিবেচনায় নিয়ে আপনার জন্ম সম্পর্কে আপনাকেই নিশ্চিত হওয়া দরকার। আপনার রুচিবোধের মাত্রাজ্ঞানও যাচাই করা প্রয়োজন। বিশ্ব ও বাংলা সাহিত্যে নারীর উপমাগুলো মগজে নিয়ে শ্লীল-অশ্লীল ভাবনার ক্ষেত্রেও আপনার জানার পরিধি ও কাণ্ডজ্ঞান যাচাই করা উচিত। অসংখ্য জাতীয় ইস্যু এড়িয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রীও এ বিতর্কে জড়িয়ে গেলেন। সংসদ পর্যন্ত এ বিতর্ক টেনে নেয়া হলো। এর আগে সংসদে দেয়া একটি আঞ্চলিক শব্দ ‘চুদুর বুদুর’ নিয়েও কম পানি ঘোলা করা হয়নি। লাভ কারো হয়নি। ক্ষতি হয়েছে অতি বাচালদের। এবারো কয়েকটি মিডিয়া অতিউৎসাহ প্রদর্শন করল। একটি চিহ্নিত মহল ‘কিছু একটা পাইছিরে’ বলে চিৎকার শুরু করলেন। এর নেপথ্যে কি নারীর প্রতি সম্ভ্রমের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন, না হেফাজতের উত্তুঙ্গ ইমেজের প্রতি অসহিষ্ণুতা ছড়িয়ে দেয়ার নতুন নীলনকশা বাস্তবায়ন তা জনগণ ভালোভাবেই জানে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে তথ্য নিয়ে ছাপানোর অভিযোগ এনে মাহমুদুর রহমানকে কারাবন্দী করা হলো। তিনি নাকি প্রাইভেসি নিয়ে তামাশা করেছেন। আজব দেশ! চুরির শাস্তি হলো না। চুরি করতে দেখার শাস্তি হলো। এখন বিটিভিসহ কয়েকটি প্রাইভেট চ্যানেলের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই কেন। প্রধানমন্ত্রীও আইনের বাইরে থাকার সুযোগ নেবেন কেন। প্রতিপক্ষের জন্য যা প্রেম কেলি, ক্ষমতাসীনদের জন্য তা দেবতার মতো লীলাখেলা ভাবা হবে কেন। এ বক্তব্য আহমদ শফীর কি না জানি না। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বানানো নাটক কি না তা-ও বলতে পারব না। তবে পরিণত বয়সের একটা বাঁকে এসে নিশ্চিত করে বলতে পারবÑ নারীকে পণ্যমানে যারা বিকাচ্ছেন, বিনোদনসামগ্রী সাজিয়ে বাণিজ্যের পসরা বসিয়েছেন, তরুণদের কাছে তরুণীদের, তরুণীদের কাছে তরুণদের অবাধে মিলেমিশে যেতে প্রলুব্ধ করছেন, তাদের বাড়াবাড়ির মোকাবেলায় কিছু প্রান্তিক মন্তব্য ও বক্তব্য সব যুগেই বিভিন্ন মহল থেকে করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে যারা ওয়াজের মাধ্যমে জনগণকে নৈতিক সবক দেন তাদেরও একটা ভূমিকা রয়েছে। জনগণ তাদের বক্তব্য কিংবা ওয়াজ উড়িয়ে দেন না। অশ্লীলও মনে করেন না। কুরুচির বিষয়ও ভাবতে চান না। জনগণ এসব বক্তব্যের বাস্তবতা বুঝেই গ্রহণ-বর্জন করেন। তেঁতুল একটি রসনা উদ্রেককারী ফল। নারীর প্রতি পুরুষের সহজাত আকর্ষণ দোষের বিষয় নয়। বরং প্রকৃতিসিদ্ধ ও যুক্তিসঙ্গত; কিন্তু প্রলুব্ধ করার মতো কর্ম সমর্থন যোগ্য হতে পারে না। নারী পোশাকে-আশাকে এবং আচার-আচরণে নিজেকে মেলে ধরার একটা সীমা সব ধর্মই মেনে চলে। নৈতিকতার মানদণ্ডও সর্বজন স্বীকৃত। তারপরও নারীর উপমায় যুগ যুগ ধরে ফল-ফুল, নদী-প্রকৃতির উপমা কবিরাও দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ নারী মন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বাংলাদেশের এক প্রগতিশীল কবি নারীর উদোম শরীরের বর্ণনা দিয়েছেন তার কবিতায়। কখনো কখনো এর কিছু প্রতিক্রিয়াও এসেছে; কিন্তু তেঁতুল তত্ত্বের বিরুদ্ধে যারা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন তাদের মতো করে বল্গাহীন মন্তব্য-বক্তব্য দিতে কখনো দেখিনি। আল্লামা শফীকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে যারা নারীদের উসকে দিতে চাইছেন তারা কোনো মহৎ কর্ম করছেন বলে মনে হয় না। বরং সুড়সুড়ি দিয়ে তেঁতুল তত্ত্বের সারবত্তা প্রমাণ করছেন। আমরা নবীও নই, কবিও নই, নারীকে সৃষ্টির সেরা মানুষ তো বটেই বিধাতার অপূর্ব সৃষ্টি কল্যাণময়ী নারী ভাবারও পক্ষে। মানবিক মর্যাদা দেয়া ছাড়াও তাদেরকে বাড়তি মর্যাদায় কন্যা, জায়া, জননীর জায়গায় রাখতে চাই। নারীকে লোভনীয়ভাবে উপস্থাপন করে কাউকে প্রলুব্ধ করারও পক্ষে নই। সতর্ককারী একজন অভিভাবক নারীর সম্ভ্রম রক্ষার জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রসঙ্গ টেনে তুলনা করলে দোষের কিছুও মনে করি না। এমন উপমা প্রকৃতিবিরোধীও নয়, বিজ্ঞানবিরোধীও নয়। বরং জৈবিক বিবেচনায় সত্যেরই স্বীকৃতি। নারীর সৌন্দর্য ও কমনীয়তা পুরুষের ভেতর ভিন্নমাত্রার আবেদন সৃষ্টি করে। পুরুষ দেহে এক ধরনের হরমোন সক্রিয় হয়ে ওঠে। এটি কোনো ভাবাবেগ নয়Ñ গবেষণার ফসল। এ ব্যাপারে কেউ অতিরিক্ত আগ্রহী হলে ব্রিটেনের ডেইলি মেইলের সর্বশেষ গবেষণাপত্র হাতিয়ে দেখতে পারেন। আমাদের আলেম সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নারীদের নিয়ে একটি মহলের বাড়াবাড়ি, বেলেল্লাপনা, অশ্লীলতার প্রসার ঘটানো, কুরুচিপূর্ণ পোশাক, ইভটিজিং, লিভ টুগেদার, আন্তঃধর্ম বিয়ে-শাদি ও যৌনতা ছড়িয়ে দেয়াকে নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী স্বাধীনতা বলে প্রচার-প্রচারণার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করে থাকেন। সেই সমালোচনা কখনো কখনো প্রান্তিক হয়ে যায়। যেকোনো প্রান্তিক মন্তব্যই বাহুল্য বিবেচিত হওয়া উচিত। সবারই স্মরণ করা ভালো, নৈতিক মানে প্রায় উচ্ছন্নে যাওয়া ও নষ্ট সমাজের লাগাম টেনে ধরার স্বার্থে আলেমদের এমন প্রান্তিক বক্তব্যেও সাধারণ মানুষের সায় রয়েছে। আজকের সমাজচিত্র বিবেচনায় নিলে নারীদের নিয়ে আলেম ওলামাদের একাংশের এ ধরনের অবস্থান মোটেও অযৌক্তিক মনে হয় না। বর্তমানে নারীদের এমন সব অপকর্মে ব্যবহার করা হচ্ছে, যা রীতিমতো মানুষের সাথে অসম্মানমূলক আচরণের পর্যায়ে ফেলা যায়। সেই সব ব্যাপারে আমরা কোনো বুদ্ধিজীবীর বক্তব্য দেখি না। মন্তব্য শুনি না। কোনো মিডিয়াকেও সোচ্চার হতে দেখি না। বরং কথিত প্রগতিশীল একটি মহল যখন নারীর সম্ভ্রম লুণ্ঠন করেও বাহবা কুড়ায় তখন লজ্জাও লজ্জা পায়। প্রধানমন্ত্রী নিজেই বললেন, আল্লাহর রসূলের দাওয়াতের প্রতি প্রথম আকৃষ্ট হয়েছিলেন হজরত খাদিজা। তিনি একজন সম্ভ্রান্ত নারী এবং রসূলের স্ত্রী। সেই যুগে জেহাদে প্রথম শহীদও একজন নারী। যে মহীয়সী মহিলার নাম হজরত সুমাইয়া। এসব ইতিহাস জ্ঞানের সাথে আমলের কিছু সাযুজ্য রয়েছে আল্লামা শফীর বক্তব্যের। প্রধানমন্ত্রীর ইতিহাস জ্ঞান এবং বক্তব্য প্রায়ই সাংঘর্ষিক হয়ে উপস্থাপিত হয়। অভিযোগ ধরে নিয়েও যদি বলি, আল্লামা শফী তেঁতুলের উপমা টেনে নারীদের সম্ভ্রম রক্ষায় সতর্ক হতে নসিহত করেছেন। বড়জোর উপমাটিকে ভাষাতাত্ত্বিক বিবেচনায় কম শোভন কিংবা লাগসই উপমা নয় বলা যায়, আঞ্চলিকতা দোষে দুষ্টও ভাবা যেতে পারে, অশ্লীল কিংবা কুৎসিৎ নোংরা বলা যায় না; কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যখন বিরোধীদলীয় নেতা ও আল্লামা শফীকে জড়িয়ে মন্তব্য করেন সেটা সব ধরনের নীতি-নৈতিকতার সীমা ছাড়িয়ে যায়। আল্লামা শফী যদি তেঁতুল প্রসঙ্গে বলে থাকেন তাও বলেছেন সতর্ক করার জন্য। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ঈর্ষাকাতর ভাষায় অশ্লীল কিছু একটা বুঝাবার জন্য। বাস্তবতা হচ্ছে এক দিকে আমাদের সমাজে একটি অংশের ভেতর রয়েছে শিক্ষা-দীক্ষা সম্পর্কে কূপমণ্ডূকতা, অন্য দিকে রয়েছে সীমাহীন প্রগতিশীলতার নামে ভোগবাদ ও বস্তুবাদের কবলে পড়ে উচ্ছন্নে যাওয়ার প্রবণতা। এর কোনোটি ইসলামের পথ নয়। স্বাভাবিকও নয়। আমাদের লালিত মূল্যবোধ, ঐতিহ্য ও লোকজ সংস্কৃতি বিধৌতও নয়। ইসলাম নারীর স্বাধীনতা, ব্যক্তিসত্তা ও সম্ভ্রম রক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে। নারীর মর্যাদা ও সম্ভ্রম নিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি সমর্থনযোগ্য নয়। নারীর অসম্মানজনক অবস্থান আমাদের সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অনুকূলও নয়। এক দিকে বকধার্মিকতা, অন্য দিকে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি ও ব্যবসায়, স্বভাবতই ইসলামের শিক্ষা ও মৌলিক দাবি প্রায়ই ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়। ইসলামে নারীর অধিকার নিয়ে যারা কম জানেন তারা বাড়াবাড়ি করে ফেলেন। আবার যারা বেশি জানেন তারাও মাঝে মধ্যে কুপমণ্ডুকতার মধ্যে ঢুকে পড়েন। আমরা আল্লামা শফীর পক্ষে হেফাজত নেতাদের বক্তব্য, আলেম সমাজের মন্তব্য জেনেছি। সরকারের অবস্থানও আমাদের সামনে স্পষ্ট। সরকার হেফাজত ইস্যুতে যে বিব্রতকর অবস্থানে রয়েছে তার মোকাবেলার জন্য আক্রমণভাগে একটা খেলা শুরু করা দরকার বিবেচনা করেছে। এখানে নারীর প্রতি মমত্ববোধ কিংবা নারীর সম্মান রক্ষার কোনো তাগিদ নেই। আছে রাজনীতির হিসাব-নিকাশ। হেফাজতকে রক্ষণভাগে ঠেলে দেয়ার এই কৌশল হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ প্রধানমন্ত্রী ও তার ত্রাণ কিংবা উদ্ধার কর্তারা যত কথা বাড়াচ্ছেন ততটাই ফাউল খেলছেন। সরকার হেফাজত ইস্যুতে পূর্বাপর দ্বিমুখী আচরণ করছে। মাঝে মধ্যে আপস করতে চাচ্ছে, আবার প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে কোণঠাসাও করতে চায়। এতে ওপরের দিকে থুথু ছিটানোর মতো কাজই করা হচ্ছে। সেই থুথু নিজের গায় মাখছেন। সরকার কার্যত কাদের সিদ্দিকীর ভাষায় কমিউনিস্ট লীগের ভূমিকায় থেকে ইসলামকে বামপন্থীদের মতো আদর্শিক প্রতিপক্ষ বানাচ্ছেÑ যা এই অচেনা আওয়ামী লীগকে আরো বেশি মাত্রায় গণবিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। জনগণ এই খেলা উপভোগ করছে না। তা ছাড়া এখনো একজন আলেম সব দোষত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা নিয়েও যতটা বিশ্বাসযোগ্য, প্রধানমন্ত্রী ও তার আস্থাভাজনেরা ততটা কেউ নন। বরং প্রধানমন্ত্রী ও তার অনুগতদের কাসুন্দি ঘাঁটার কসরত জনগণের প্রতি তাদের দূরত্ব বাড়াচ্ছে। আলেমেরা ততটাই সামনে আসার সুযোগ নিচ্ছেন। জনগণও তাদেরকে জায়গা করে দিতে পেরে স্বস্তিবোধ করছে। অপরপক্ষে আওয়ামী লীগ যতটাই ধর্মীয় সহিষ্ণুতা পরিহার করছে ততটাই ছোট হয়ে আসছে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads