শনিবার, ১৩ জুলাই, ২০১৩

এ বিশাল বাজেট লুটপাটের বাজেট


গত ৩০ শে জুন ২০১৩-১৪ অর্থ বছরের বাজেট জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের ওয়াক আউটের মধ্য দিয়ে পাস হয়েছে। ২ লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকার যে বিশাল বাজেট পাস করিয়ে আমাদের অর্থ (না অনর্থ) মন্ত্রী জনাব মুহিত সাহেব পাস করিয়ে নিয়েছেন কণ্ঠভোটের মাধ্যমে। তাঁর বকোয়াজ কথার মত বলে খালাস যে “আমার বাজেট উচ্চাভিলাষী ও জনতুষ্টির।” কিন্তু তার এ বাজেট কোনভাবেই কি কার্যকরী করা যাবে? এটা নির্বাচনের বছর। এর আগের তাঁর কোন বাজেট শতকরা ৬০/৬৫ ভাগ অর্জন করা সম্ভব হয়নি। এ বছর উন্নয়ন কর্মসূচি (অউচ) ধরা হয়েছে ৬৫ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা। তবে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়িত হবে ৮ হাজার ১১৪ কোটি টাকার প্রকল্প। অর্থাৎ সব মিলিয়ে মোট ৭৩ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প। এর কত অংশ যে লুটপাট হবেÑ মাটি ভরাটের নামে পানি মেপে, দলীয় ক্যাডার-ছাত্রলীগ, যুবলীগ কত অংশ কাজ বাগিয়ে নেবে এবং কাজ না করেই বিল তুলে নেবে তা দেখার বিষয়। বিগত সাড়ে চার বছরে তারা টেন্ডারবাজি ও ধান্দাবাজি বহু করেছে। আর নির্বাচনী বছর বলে তাদের পোয়াবারো-কোন জবাবদিহির ব্যাপার নেই। দেদারছে টাকা কামাই করে নেবে। সারা দেশের রাস্তাঘাট ব্রিজ, নদী ভাঙন ইত্যাদিতে কাজের কোন গুণগত মান নেই। প্রকৌশলী ও সুপারভাইজাররা কাজের তদারকি করতে পারে না তাদের দৌরাত্ম্যে। মাঠ পর্যায়ে কোন সুপারভাইজার কাজ তদারকি করতে চাইলে তাদেরকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। তাই তারা কাজ দেখতে সাইটে খুব কমই যায়। চাপের মুখে বিল তুলে নেয়ার ঘটনা প্রায়ই পত্রিকায় দেখা যায়।
এই বাজেটটি তিন সরকারের মাধ্যমে কার্যকরী করা হবে। বর্তমান সরকারের পূর্বের কাজের নমুনা তো আমাদের সামনে উপস্থিত। নির্বাচনকালীন সময় কোন উন্নয়নমূলক কাজ হবে না। আর ক্ষমতায় হাসিনা সরকারের ফিরে আসা খুবই ক্ষীণ। তাই এ বাজেট সম্পূর্ণ ক্লোজ করারই আশংকা। তবে ননউৎপাদনশীল খাতে খরচ বেড়ে যাবে সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। বাজেটে ধরা হয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৬২১ কোটি টাকা। তার মধ্যে একে ধরে রাখতে পারবে বলে মনে হয় না। নতুন অর্থবছরে রাজস্ব খাতের আয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। যার মধ্যে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৯০ কোটি টাকা। এই হিসেবে আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ব্যবধান ৫৫ হাজার ৩২ কোটি টাকা অর্থাৎ বাজেট ঘাটতি এই বিপুল পরিমাণ অংকের টাকা। জাতীয় রেভেনিউ বোর্ড তার ওপর নির্ধারিত রাজস্ব আদায় করার সম্ভাবনা খুবই কম। অর্থাৎ ঘাটতি বাজেট আরো বৃদ্ধি পেতে পারে।  সরকার তখন ব্যংক লোন নিতে বাধ্য হবে। এতে করে শিল্প উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে আর লোন পাবে না। তাই দেশী-বিদেশী উভয় বিনিয়োগ মুখ থুবড়ে পড়বে। আরো শংকার কারণ বিদেশী ঋণ বিশ্ব মহামন্দার কারণে ও হাসিনা সরকারের কর্মকা-ে বিদেশ আয় সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। আর অনুদানতো বলতে গেলে বন্ধ। দেশে বিনিয়োগ না হলে শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ হয়ে যাবে। বিশ্বমন্দা ও সরকারের ভুল নীতির জন্য বিদেশ থেকে বহু শ্রমিক দেশে ফিরে আসছে। এতে যেমন বৈদেশিক মুদ্রার রেমিট্যান্স কমে যাবে, দেশে বেকার জনগণের সংখ্যা বেড়ে যাবে। কর্মহীন মানুষ তখন দেশের আইন শৃংখলার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। প্রতি বছর ৭০ লাখ শ্রমিক বেকার থাকবে। তাই সামনে দেশের চিত্র জনাব মোহিত সাহেব চরম অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে যাচ্ছেন।
দেশের শেয়ার বাজার কেলেংকারি, পদ্মা সেতুর দুর্নীতি, হলমার্ক, ডেসটিনি, রেল বিভাগের কালো বিড়ালের আনাগোনা, গার্মেন্টস শিল্পে দুর্ঘটনাবলি, দলীয় লোকের লুটপাটের কাহিনী সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আজ তলানীতে ঠেকেছে। আমাদের এক আনাড়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী শুধু ব্যক্তিগত সুখের নেশায় সারাবিশ্বে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু জাতির ভাবমূর্তি ও স্বার্থের সাথে তার দৌড়ঝাঁপের কোন সংযোগ নেই।
হাসিনা সরকার দাবি করছে বিশ্ব-মন্দার সময়ও তারা জিডিপিতে ৬.২% অর্জন করছে। এতে শ্লাঘার কিছু নেই। যে দেশের প্রবৃদ্ধি শুরু হয়েছে বলতে গেলে শূন্য থেকে তাদের পক্ষে ৫/৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি করতে তেমন বুদ্ধি বা কর্ম-তৎপরতার প্রয়োজন হয় না। সামান্য সেবা খাত ও শিক্ষায় কিছুটা কাজ করলেই তা অর্জন করা যায়। অনুন্নত দেশেই তা সম্ভব। কিন্তু পশ্চিমা দেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশে ১% প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে জান ফাটাফাটি, কারণ তাদের প্রবৃদ্ধির মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে স্বল্প বৃদ্ধি করতে হলেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। একটা ছোট উদাহরণ দিলেই বিষয়টি বোঝা যাবে। ধরি বাংলাদেশে সম্পদ ১০০ টাকা এবং পরবর্তী বছর বর্ধিত প্রবৃদ্ধি হলো ১০ টাকা। এ অর্থে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হলো ১০%। আর ধরি চীনের সম্পদ আছে ২০০০ টাকা আর তার বর্ধিত সম্পদ হলো ৫০ টাকা তা হলে তার প্রবৃদ্ধি হলো ২.৫% অথচ চীনের অর্জন বাংলাদেশের ৫ গুণ। বিগত দুই দশক চীন প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে ১২%। কিন্তু এখন তার প্রবৃদ্ধি হচ্ছে দুই অঙ্কের নীচে। তাই তলানী থেকে প্রবৃদ্ধি অর্জন বেশী হলে প্রবৃদ্ধির মাত্রা বেশী দেখা যায়। কিন্তু জাতীয় সম্পদ তেমন বাড়ে না। বাংলাদেশ একটি হোমোজিনিয়াস জাতি, ভাষাও বলতে গেলে একই। দেশের মাটি, মানুষ ও পানির অফুরন্ত সমাহার। শুধু জাতীয় ঐক্য ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে এবং রাজনৈতিক মেধা যদি দেশের উন্নয়নে ব্যয় হতো তা হলে জাতি দ্রুত উন্নতি করতে পারতো। আমাদের প্রবৃদ্ধি দুই সংখ্যার ঘরে সব সময় থাকতো। আমাদের রাজনীতিবিদদের লড়াই আছে শুধু গদি দখলের জন্য। তাই দেশের পানি সম্পদের ন্যায্য দাবি ভারতের কাছে উত্থাপন করতেও কোন ঐক্যমত নেই। বিদেশীদের নিজ দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়েও যদি গদি পাওয়া যায়, তার চক্রান্তই বেশী দেখা যায়। বর্তমানে হাসিনা সরকার ভারত সরকারকে ট্রানজিট/করিডোর, নদী, সড়ক ও নৌবন্দর বিনা শুল্কে ব্যবহারের সুযোগ করে দিচ্ছে, আমদানি-রফতানিতে ভারসাম্যহীনতা, প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারতের স্বার্থ রক্ষা করেও যদি গদিতে থাকা যায়, তার প্রচেষ্টাই স্পষ্ট চোখে ধরা পড়ছে। তিস্তা নদীর পানি ও টিপাই মুখ বাঁধের কুফল সম্বন্ধে আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের কাছে কোন জোরালো প্রতিবাদ করছে না। তাই আন্তর্জাতিক নদী থেকে ভারত এক তরফা পানি প্রত্যাহার করে আমাদেরকে পানিতে শুকিয়ে মারছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চল আজ মরুকরণের শিকার পানির অভাবে। এতে করে দেশে খাদ্য-নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে বিঘিœত হচ্ছে।
অরাজনৈতিক ইস্যুকে হাসিনা সরকার রাজনৈতিক ইস্যু তৈরি করে দেশের উন্নয়নের পথে বাধার সৃষ্টি করছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়টি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমাধান করে গেছেন। অথচ হাসিনা সরকার আন্তর্জাতিক মানে গ্রহণযোগ্য নয় এমন বিচার ট্রাইব্যুনাল করিয়ে জাতিকে আজ দ্বিধাবিভক্ত করে ফেলেছে। এই কর্ম দ্বারা তারা রাজনৈতিক বাজিমাত করতে চেয়েছিলো কিন্তু তা বুমেরাং হয়ে তাদের দিকে ধাবিত হয়েছে। মানুষ বর্তমান সরকারের চালবাজি বুঝে ফেলছে। এর প্রভাব আগামী জাতীয় নির্বাচনে অবশ্যই পড়বে। যে হাসিনা জামায়াতে ইসলামীকে সাথে নিয়ে খালেদা সরকারের বিরুদ্ধে লেগে কেয়ারটেকার সরকারের মাধ্যমে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে ক্ষমতায় গেলেন আজ ব্রুট মেজরিটি সংসদ সদস্যের মাধ্যমে তা বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিয়ে জাতিকে আবার দ্বিধাবিভক্ত করলো। আমাদের মত রাজনৈতিক অপরিপক্বতার ক্ষেত্রে কেয়ারটেকার সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন অন্তত: আরো দুই যুুগ চলা উচিত। ইতোমধ্যে জাতি গণতান্ত্রিক পরিপক্বতা অর্জন করতো। বৃটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ যে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হচ্ছে তা গড়ে উঠতে  শত শত বছর লেগেছে। আর আমাদের গণতন্ত্রের চর্চা চলছে মাত্র বিশ বছর। জাতিকে এত দ্বিধাবিভক্ত করলে দেশের উন্নতির ঘরে শূন্য জমা হবে। অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেবের উচ্চাভিলাষী ও গণতুষ্টি বাজেট এই নির্বাচনের বছরে দলীয় লুট-পাটের বাজেট হবে বলেই অভিজ্ঞজন মনে করেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads