শুক্রবার, ১৯ জুলাই, ২০১৩

বিলেতি কায়দায় বাকশালী নির্বাচন খায়েশ বনাম বাস্তবতা


অনেকেরই হয়তো মনে আছে, ২০০৮-এর নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা পুরো রংপুরবাসীর ‘পুত্রবধূ’ হয়ে গিয়েছিলেন। এরশাদ হয়েছিলেন ভাসুর বা বড়ভাই। সেই হিসেবে টিউলিপের শ্বশুরবাড়ি যে শহরে অবস্থিত সেই লন্ডন শহরের সবাই প্রধানমন্ত্রীর বেয়াই-বেয়াইন। এই শহরের এক বেয়াই জানতে চেয়েছেন, আপনার দেশে সামনের নির্বাচনটি কোন পদ্ধতিতে হবে? প্রধানমন্ত্রী সাথে সাথেই জবাব দিয়েছেন, ‘(কেন বেয়াই সাহেব) আপনারা যে পদ্ধতিতে নির্বাচন করেন, আমরাও সেভাবেই করব।’ বাঙালি বেয়াইনের এমন বুদ্ধিমত্তায় জব্দ হয়ে পড়েছেন বিলেতি বেয়াই। বিলেত আর বাঙ্গাল মুল্লুকের মধ্যকার ফারাকটুকু এক কথার তুড়িতেই তিনি উড়িয়ে দিলেন। নতুন বেয়াই-বেয়াইনরা এই ধরনের রসালো বিতর্কে জড়াতেই পারেন। একজন কথার মারপ্যাঁচে অন্যকে আটকে ফেলেন। বাঘ ভাল্লুক মারার গল্প করেন। বাংলার রসের হাঁড়িটির মধ্যে বড় হাঁড়িটি এই সময় কানায় কানায় ভরে ওঠে। কিন্তু এই রসের হাঁড়িটি একই তলে অবস্থান করলেও বেয়াই-বেয়াইনদের বাস্তবতার তলগুলো কতই না ভিন্ন। শুধু প্রধান উপদেষ্টা নিজের মনের মতো না হওয়ায় মাত্র সাত বছর আগে লগি-বৈঠা দিয়ে এই সুবোধ শান্ত ‘বেয়াইন’ রীতিমতো ‘কেয়ামত’ সৃষ্টি করেছিলেন। আজকে বিলেতি বেয়াইদের মতো জাতীয় নির্বাচন করার যে শখ তার মনের মধ্যে জেগেছে, সেই একই শখ ২০০১-২০০৬ সালে বেগম খালেদা জিয়ার মধ্যে জাগলে এই দুনিয়ায় যে কয়বার কেয়ামত সৃষ্টি হতো ভালো অঙ্ক জানা এই বেয়াইরা ঐকিক নিয়মে সহজেই বের করে ফেলতে পারবেন। আওয়ামী নেতানেত্রী ও সুশীলকুলের বুদ্ধিসুদ্ধি অন্যদের থেকে সব সময়েই একটু বেশি। অন্যরা কলা বেচতে গিয়ে রথ দেখে আসেন। আর তারা রথ দেখার জন্য যেকোনো জায়গায় যখন তখন কলা বেচার আয়োজন করে ফেলেন। এই অসময়ে বেলারুশের মতো দেশে গিয়ে জাতির জন্য ক’টি কলা বেচে এসেছেন তা ধরে ধরে গুনে ফেলা যায়। রাষ্ট্রীয় খরচে ভাগনির বিয়েতে অংশ নেয়া জায়েজ করে রাখলে জাতিকে শুধু লন্ডনে যাওয়ার খরচটি গুনলেই চলত। এ ধরনের খরচকে নাজায়েজ করে রাখাতে এখন বেলারুশে যাওয়ার অতিরিক্ত খরচও বহন করতে হলো। আমজনতা দেখলেই বাঙালিত্বের ইজারাদারেরা উপদেশ বিলি করেন ‘আপনার ছেলেমেয়ের নাম বাংলায় রাখুন’। ছেলেমেয়ের নাম আরবিতে রাখলে এদের বাঙালিত্ব নষ্ট হয়ে যায়। অথচ নিজের পীরদের শাহজাদা শাহজাদিরা বিলেতি, আমেরিকান ও ইউরোপিয়ান বর-কনেকে বিয়ে করলে বাঙালিত্বের কোনোরূপ ক্ষতি হয় না বরং বাঙালিত্ব আরেকটু পোক্ত হয়। একশ্রেণীর ধর্মযাজক রয়েছে যারা রাজা-বাদশাহ বা শাহজাদা-শাহজাদিদের যেকোনো বিকৃত কাজ বা পারভার্সনকে শাস্ত্রসম্মত করে ফেলেন। বাঙালি চেতনার এই যাজকেরাও শাসক পরিবারে বাঙালিত্বের পরম স্খলনকে শুধু সিদ্ধই করেনি, পুণ্যের কাজ বানিয়ে ফেলেছেন। শাহজাদা ও শাহজাদিরা যা করেন সেখানেই এই চামচার দল বাঙালিত্বের গন্ধ খুঁজে পায়। এদের সবাইকে বরাবরের মতোই টেক্কা মেরেছেন লন্ডন প্রবাসী স্বনামধন্য এক কলামিস্ট। এই সংক্রান্ত তার লেখাটি পড়লে আমি নিশ্চিত যে প্রতিটি বাঙালির অন্তরে ভূমিকম্প সৃষ্টি হবে। তার বিশ্বাস, ‘বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে তার বংশধারার এই বিবর্তনে খুশি হতেন’। তিনি আরো মনে করেন, ‘কট্টর জাতীয়তাবাদী গোপালগঞ্জের শেখ পরিবারের এখন বিশ্বজনীন পরিচয়’। টিউলিপের এই বিয়েকে শাস্ত্রসম্মত করতে তিনি টিউলিপের নানার মুখে রবীন্দ্রনাথের একটি যুতসই কবিতা ধরিয়ে দিয়েছেন। টিউলিপের বিয়েকে শাস্ত্রসম্মত করতে তার নানার মুখে এই কবিতাটিই দরকার ছিল। কবিতার সেই মোক্ষম দু’টি লাইন আবৃত্তি করেছেন আবার এই কলামিস্ট সাহেবকেই শুনিয়ে শুনিয়ে। টিউলিপের নানার নিত্যসহচর ছিলেন এ কথা কখনোই শোনা যায়নি। তিনি স্মৃতিচারণ করেননি, গীতিনাট্য লেখেন। মরা মানুষের মুখনিঃসৃত কথাই তার কলামে বেশি থাকে। জীবিতদের মধ্যে বেশির ভাগ সময় তাকে টেলিফোনে তথ্য দেন বেশির ভাগ সময়ে জনৈক বিএনপি নেতা। তার লেখা পড়ে আকাশপানে তাকিয়ে ‘হায়রে সেলুকাস’ বলা ছাড়া অন্য উপায় থাকে না। কোনো কোনো পত্রিকা শিরোনাম করেছে, বাঙালিয়ানায় বঙ্গবন্ধুর নাতজামাই বরণ। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির এই বিলেতি নাতজামাইকে বাঙালিয়ানায় বরণ করা দেখেই আমাদের বাঙালিবোধ আপ্লুত হয়ে পড়েছে। এই বঙ্গের সবচেয়ে বড় বন্ধু অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর নাতজামাই ও নাতবউদের মধ্যে শতকরা হিসাবে মাত্র ২৫ ভাগ হয়েছেন বাঙালি। ফরিদপুরের নূরু মিয়াকে টেনেটুনে বা গ্রেইস নম্বরে বাঙালি হিসেবে খাড়া করলেও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির খাতায় পাস মার্কও ওঠে না। টিউলিপ, ববি ও জয় বিদেশী বিয়ে করে বাঙালিত্বের স্খলন করেননি বরং নানার মনের সেই গোপন বাসনাই পূরণ করেছেন। চামচামি কোনপর্যায়ে পৌঁছতে পারে এই কলাম না পড়লে বোঝা যাবে না। মরার পর যদি মানুষ দুয়েকবার কবর থেকে ওঠার সুযোগ পেত তবে আমি নিশ্চিত শেখ মুজিব প্রথম চান্সেই একটা লাঠি নিয়ে এই কলামিস্টের খোঁজে লন্ডনে চলে যেতেন। মুখে উচ্চারণ করতেন, এই চাটার দল শুধু আমার তিন পুরুষকেই চেটে খায়নি, আমার হাজার পুরুষকে গোগ্রাসে গিলে খেয়েছে। দ্বিতীয়বার ওঠার চান্সটি পেলে একই লাঠি নিয়ে যেতেন বাকশালের কুমন্ত্রণাদাতাদের কাছে এবং আসার পথে যেতেন তার অবুঝ কন্যাকে ভিশন-২০২১-এর কুমন্ত্রণাদাতাদের কাছে, যারা তার নিজের চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজাতে চেয়েছিলেন। ‘আপনাদের মতো নির্বাচন করব’ এ কথায় প্রধানমন্ত্রীর কোনো প্রজ্ঞা ফুটে ওঠেনি বরং কিশোরীসুলভ চপলতা ও প্রগলভতাই করুণভাবে ফুটে উঠেছে। প্রথম বিশ্ব ও তৃতীয় বিশ্বের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রথম বিশ্বের প্রশাসন সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ। সেখানে একজন সর্বনিম্ন স্তরের প্রশাসনিক কর্মকর্তাও তার এখতিয়ারে কখনো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহী চলে এলে নিজের কর্তব্যে শৈথিল্য প্রদর্শন করে না বরং একধরনের ডিগনিটি নিয়ে সর্বোচ্চ নির্বাহীর কোনো স্খলনের দিকে চোখটিকে আরো সতর্ক করেন। নিয়ম ভাঙলে প্রধানমন্ত্রীকেও আটকে দিতে পারেন বেয়াইদের দেশের একজন সামান্য ট্রাফিক সার্জেন্ট। পরের দিন সারা দেশ ট্রাফিক সার্জেন্টের পক্ষে দাঁড়ায়। এই ধরনের অনেক ঘটনা বেয়াইদের বিলেতে অনেকবার ঘটেছে। বেয়াইনদের দেশেও কালো বিড়াল খ্যাত এক মন্ত্রীর এপিএসের ড্রাইভার অসীম সাহস দেখিয়েছিল। কিন্তু এই সাহস দেখানোর অপরাধে তাকে হয় গুম নয়তো বা গোপনে চলে যেতে হয়েছে। সেই মন্ত্রী এখনো উজিরে-খামোখা হয়ে বেয়াইন তথা জাতির ঘাড়ে লটকে আছেন। বেয়াইদের মুল্লুকে কোনো মন্ত্রী-উপদেষ্টা বলার সাহস করবে না যে, ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য কারো চাকরি হবে না। বেয়াইদের দেশে দাদা মুক্তিযুদ্ধ করলে তার নাতিরা কোটা পায় না। ওখানে দলীয়করণ ও গোপালীকরণের মাধ্যমে প্রশাসনকে মেধাহীন ও ব্যক্তিত্বহীন করে ফেলা হয় না। এখানে কোনো পুলিশ বিরোধী দলের চিফ হুইপকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে যায় না। এখানে সরকার পরিবর্তন হলে টপ টু বটম প্রশাসনের রঙটি বদলে যায় না। এখানকার কোনো এমপি কিংবা ছাত্রনেতাকে দেখে ডিসিপর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা টেবিলের নিচে পালায় না। এখানে কোনো এমপি প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে থাপ্পড় মারার সাহস করে না। এখানে কোনো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনে করেন না যে বিরোধী দল ধাক্কা দিয়ে বহুতলা ভবন ফেলে দিতে পারে। ব্রিটেনের পুলিশ সম্পর্কে বরং এক চুটকি গল্প প্রচলিত আছে। এক যুবক রাস্তায় ডিউটিরত এক পুলিশের কাছে একটি কলম চায়। পুলিশ সাথে সাথেই তা বের করে দেয়। একটু পর চায় এক টুকরো কাগজ। সদাশয় পুলিশ কোনো বাক্য ব্যয় না করে তা-ও এগিয়ে দেয়। এদিক-সেদিক তাকিয়ে যুবকটি বলে, ‘আশপাশে কোনো বেঞ্চ বা টেবিল দেখছি না। কাজেই তোমার পিঠটি কিছুক্ষণের জন্য টেবিল হিসেবে আমাকে ব্যবহার করতে দাও। পুলিশ অফিসার তা-ও এগিয়ে দেয়। শুধু একটু ছোট্ট মিনতি করে, ‘ স্যার দয়া করে এই চিঠিটি আবার আমার মেয়ের কাছে পৌঁছে দিতে অনুরোধ করবেন না। বেয়াইদের এ রকম অনেক বাস্তব কাহিনী বেয়াইনদের গল্পের কাছাকাছি। কাজেই বিলাতি বেয়াইরা যেভাবে নির্বাচন করতে পারেন বাঙালি বেয়াইনরা সেভাবে পারেন না। পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন ছিল স্থানীয় নির্বাচন। সাধারণত স্থানীয় ইস্যু এবং প্রার্থীদের ব্যক্তিগত ইমেজ জয়-পরাজয় নির্ধারণ করে। এবার ঘটেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘটনা। দেশের জনগণকে ক্রমাগত বোকা মনে করা এবং এটা নিয়ে সরকারের একধরনের অহংবোধ জনগণকে যারপরনাই ক্ষিপ্ত করে তুলেছে। সরকারের কাছে কিছু মেসেজ পৌঁছানো জরুরি হয়ে পড়ায় জনগণ এই স্থানীয় নির্বাচনগুলোকেই সেই ক্ষোভ প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছে। সরকারদলীয় কোনো কোনো প্রার্থী অধিকতর যোগ্য হলেও জাতীয় রাজনীতির কারণে তাদের শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে হয়েছে। জাতীয় রাজনীতির সবচেয়ে বড় ইস্যু হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বিরোধী দলের নিরঙ্কুশ বিজয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পক্ষেই জনতার রায়টি স্পষ্ট হয়েছে। বর্তমান সরকারের হাইব্রিড ও লালব্রিডের কর্তাব্যক্তিদের নিয়ে বিপদটি হলো, জনগণের এই চূড়ান্ত মেসেজটি নিয়েও চতুর ও ভয়ঙ্কর খেলা শুরু করেছে। জনগণের ভাষা বোঝার ক্ষমতাটিও হারিয়ে ফেলেছে দেশের অন্যতম বৃহৎ এই দলটি। জনগণ সরকারকে দেখাচ্ছে জুতা কিন্তু সরকার ভাবছে এগুলো ফায়িং কিস। জনগণ দিচ্ছে গালি। সরকার মনে করছে এগুলো তাদের উদ্দেশ্যে প্রেমের গীত। একশ্রেণীর মিডিয়া এই জলটিকে আরেকটু ঘোলা করে আওয়ামী লীগকে মাছ ধরার সুযোগ করে দিতে চাচ্ছে। জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য কোনো কোনো পত্রিকায় শিরোনাম ছিল, দিনভর বিএনপির কারচুপির অভিযোগ, রাতে বিজয় মিছিল। এক গুণধর ছাত্র পরীক্ষায় মনের মতো নকল করার পরও ফল প্রকাশের দিন দু’টি গোল্লা পায়। এই ফেলের কারণে পরীক্ষায় তার অসদুপায় গ্রহণ মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়ে পড়ে না বরং মগজে গোবরের পরিমাণ কত বেশি ছিল তা নির্দেশ করে। কাজেই নিজেদের সাধ্যমতো কারচুপি করার পরও এই ফল সরকারের প্রকৃত নাজুক অবস্থাটিই তুলে ধরেছে। সরকারবান্ধব মিডিয়াগুলো এই ফেল করা ছাত্রের মতো এখন সরকারের সচ্চরিত্রের সার্টিফিকেট দিতে চাচ্ছে। আবার কেউ কেউ অতিমাত্রায় পাম্প করে বিএনপিকে ফুলিয়ে দিতে চাচ্ছে। ধারণা দেয়ার চেষ্টা চলছে, যেকোনোভাবেই নির্বাচন হোক না কেন তাতে বিএনপির ক্ষমতায় আসা ঠেকানো যাবে না। কাজেই কোন ধরনের সরকারের অধীনে নির্বাচনটি হলো তা মোটেই ধর্তব্য নয়। বিএনপির বয়স ৩৫ হয়ে পড়লেও এরা মনে করে মাত্র বারো কি তেরো। এদের মিডিয়া মনে করে আরো কম। সব কিছু দেখে এক বাঘের গল্প মনে পড়ে যায়। বাঘটি শেষ বয়সে উপনীত হয়। তার পক্ষে তখন আর শিকারে যাওয়া সম্ভব নয়। শরীরের শক্তি যখন কমে যায় তখন মাথার বুদ্ধিটি বেড়ে যায়। তাই হাতে একটি সোনার বালা, রুপার আংটি ও কিছু পিতলের সামগ্রী নিয়ে বনের রাজা এই বাঘ মহাশয় ঘোষণা করে, আমি এখন ভালো হয়ে গেছি। ওহে বনের অধিবাসীরা! তোমরা শুনে রাখো যে আমি শিকার করা বন্ধ করে দিয়েছি। এখন আমাকে তোমাদের সেবা করার সুযোগ দাও। হে জঙ্গলের অধিবাসীরা, আমার প্রতি তোমরা আস্থা রাখো। ইতোমধ্যে এটাকে আমি শিকারমুক্ত ও সভ্য জঙ্গল হিসেবে ঘোষণা করেছি। আমার কাছে আসতে হলে এখন কোনো তত্ত্বাবধায়কের পাহারা দরকার পড়বে না। তোমরা আর দূরে থেকো না, নির্ভয়ে আমার কাছে এসো। নিজ নিজ ওজন ও সাইজ অনুযায়ী উপঢৌকন নিয়ে ফিরে যাও। চামচিকা, তেলাপোকা প্রভৃতি ছোটখাটো প্রাণিগুলো রাজার আহ্বানে প্রথমেই সাড়া দেয়। আস্থা একটাই যে এই স্বল্প মাংসের প্রতি এই বুড়ো বাঘ মহাশয়েরও কোনো লোভ জন্মাবে না। তারা রাজার কাছে উপস্থিত হয় এবং খুশি মনে উপঢৌকন হাতে নিয়ে ফিরে যায়। রাজার চামচারা অন্যদের দেখিয়ে বলে, ‘দেখলে তো রাজা কেমন ভালো হয়ে গেছে। বনের সুশীল হিসেবে গণ্য তাবৎ শিয়ালসমাজ তাতে হুক্কা-হুয়া রব তুলে। তেলাপোকা, চামচিকার পর ক্রমান্বয়ে ব্যাঙ, গুইসাপ, বেজি প্রভৃতি এগিয়ে যায় ও যথারীতি উপহারসামগ্রী গ্রহণ করে। মাংসহীন প্রাণী থেকে ক্রমান্বয়ে মাংসল প্রাণীও রাজার প্রতি আস্থা ফিরে পাচ্ছে। এবার খরগোসের পালা। বড় খরগোস না গিয়ে তার দুই বাচ্চাকে উত্তর-দক্ষিণ নাম দিয়ে পাঠিয়ে দেয়। রাজার টকটকে জিহ্বা দেখে অর্ধেক রাস্তা থেকে এই উত্তর ঢাকা ও দক্ষিণ ঢাকা নামের দুই ভাই ফিরে আসে। ফিরে এসে দুই ভাই দুই গ্লাস পানি খায়। সুশীল শিয়ালসমাজ বিশেষ বিবেচনায় খরগোসের পরীক্ষাটি আপাতত স্থগিত করে রাখে। সুশীল শিয়ালসমাজ হরিণশাবককে রাজার কাছে পাঠানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ে। রাজা যে ভালো হয়ে গেছে বস্তা বস্তা কাগজ এনে তার প্রমাণ হাজির করে। রাজার হাত থেকে সোনার বালাটি না আনার জন্য হরিণকে তার বোকামির জন্য ধিক্কার দিতে থাকে। হরিণের প্রতি বাঘটি শেষবারের মতো আহ্বান জানালো, আমি আর কত প্রমাণ দেবো যে আমি ভালো হয়ে গেছি। দেখলে তো, আমি সত্যিই ভালো হয়ে গেছি। ওরা কাছে এসেছে কিন্তু আমি ওদের কাউকেই পাকড়াও করিনি। কাজেই ওহে হরিণ ভায়া, কাছে এসো এবং আমার হাত থেকে সোনার বালাটি নিয়ে যাও।’ শিয়াল বা সুশীলসমাজের প্ররোচনা ও প্রণোদনায়, বাঘের এই কাতর আবেদনে এবং নিজের ভেতরের লোভে হরিণশাবকটি এগিয়ে যায়। ক্ষণেকেই আস্ত হরিণশাবকটি বাঘের পেটে চলে যায়। কাজেই ছোটখাটো প্রাণীরা কাছে এলে বাঘটি কেন খায়নি আর হরিণটি কাছে এলে কেন সময় নিলো না তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এই বুঝটি সবচেয়ে বেশি দরকার বিরোধী জোটের টপ টু বটম সবার। বাঘের এই গল্পটি বিরোধী দলের কর্তব্যকর্ম নির্দেশ করে দেয়। বিরোধী জোট যতটুকু ভেবে রেখেছে সম্মুখের সংগ্রামটি আরো অনেক দীর্ঘ হতে পারে। ২০০৬ সাল থেকে যে ষড়যন্ত্রটি স্পষ্ট হয়েছে তার শুরুটি সম্পর্কে যেমন স্পষ্ট ধারণা করা সম্ভব হচ্ছে না, তেমনি এর শেষটি কখন হবে তা-ও ঠাহর করা যাচ্ছে না। সামনে এই ষড়যন্ত্রের আরো অনেক পরত বা ধাপ একের পর এক জাতির সামনে ভাসতে পারে। কাজেই দরকার সতর্ক সজাগ দৃষ্টি। এ দেশের জনগণের ইচ্ছায় সরকার পরিবর্তন না হয়ে এক-এগারোর বৃহত্তর রোডম্যাপটি ধরেই সরকার পরিবর্তনের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। কাজেই বিএনপি তথা আঠারোদলীয় জোটের নেতাকর্মীকে অত্যন্ত প্রজ্ঞার সাথে সামনে এগোতে হবে। জোটের ভেতরে ভাঙন সৃষ্টির সব প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করতে হবে। ডান ও জাতীয়তাবাদী ঘরানার দাবিদার একটি পত্রিকার সাম্প্রতিক ভূমিকা নিয়েও সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। আবারো মনে হচ্ছে পত্রিকাটি আসলেই কার? জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতাদের বিচারের রায় এমনভাবে ঘোষণা করা হচ্ছে যাতে বিএনপি উভয় সঙ্কটে পড়ে, অর্থাৎ মুখটি খুললে বিপদ এবং তা বন্ধ রাখলে আপদ। এই অবস্থায় বিএনপি নীরব থাকলে যাদের খুশি হওয়ার কথা দেখা যাচ্ছে যে তারাও যেন ঠিক খুশি থাকতে পারছে না। সরকার ও সরকারবান্ধব মিডিয়ার পুরো মতলবটি আঠারোদলীয় জোটের নেতা ও কর্মীদের সামনে স্পষ্ট থাকলে এই পরিস্থিতি থেকেও সরকার খুব বেশি সুবিধা করতে পারবে না। পরস্পকে পেইনকিলার এগিয়ে দিয়ে ব্যথাটি লাঘব করার চেয়ে ব্যথার কারণটি বন্ধ করার চেষ্টাই এখন সময়ের দাবি। এ ধরনের কিছু ব্যথা সহ্য করে আঠারোদলীয় জোটকে সেই ব্যথাটির কারণ সমূলে উৎপাটনের চেষ্টাটিই করে যাওয়া উচিত। এখান থেকে সামান্য বিচ্যুতি বা অমনোযোগ পুরো জাতিকে আরো ভয়ঙ্কর অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিতে পারে। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads