সোমবার, ৮ জুলাই, ২০১৩

এ বিজয় জনগণের বিশ্বাস ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের


রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট সিটি নির্বাচনে ১৮ দল সমর্থিত প্রার্থীদের কাছে মতাসীন মহাজোটের প্রার্থীদের হারার পর এবার নবগঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে লাধিক ভোটের ব্যবধানে ১৮ দলীয় জোট সমর্থিত প্রার্থী এম এ মান্নান পরাজিত করলেন মতাসীন মহাজোট প্রার্থী আজমত উল্লাহকে। দিনভর ভোটগ্রহণ শেষে গাজীপুরের আনুষ্ঠানিক ফলাফল ঘোষণা করতে নির্বাচন কমিশনের প্রায় ১২ ঘণ্টা সময় লেগে যায়। জয়ের প্রতিক্রিয়ায় মান্নান বলেন, ‘আমাকে হারানোর জন্য সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্র ষড়যন্ত্র করেছে। জনগণ সেই ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। ষড়যন্ত্র না হলে আমি আড়াই লাখ ভোটের ব্যবধানে জিততাম।’ সরকারের দুর্নীতি, হত্যা-গুম, খুন এবং বিশেষ করে হেফাজত ইস্যু তার জয়ের পেছনে প্রভাবকের ভূমিকা রেখেছে বলে তার ধারণা। সাংবাদিকেরা তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, সকাল থেকে কারচুপির যে অভিযোগ তিনি করে আসছিলেন বিজয়ী হওয়ার পরও কি তিনি সে অবস্থানে অনড় থাকবেন? জবাবে মান্নান বলেন, ‘জিতে গেলাম বলে অনিয়ম দূর হয়ে যায়নি। ষড়যন্ত্র হয়েছে।’ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ৭ জুলাই ২০১৩ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সোজা কথায় গাজীপুরবাসী এই সরকারকে পুরোপুরি ‘না’ বলে দিয়েছে। ‘নো, আর এখানে দরকার নেই। এবার আপনারা বিদায় হোন। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিয়ে মানে মানে সরে দাঁড়ান।’ গাজীপুরেও সরকার জনরায়ের ফলাফল পাল্টে দেয়ার ‘ষড়যন্ত্র’ করেছিল মন্তব্য করে ফখরুল বলেন, ‘জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ ও নীরব রায়ে সরকারের নীলনকশা ব্যর্থ হয়েছে।’ সরকার জনগণের রায়কে ‘বদলে দেয়ার চেষ্টা’ না করলে মান্নান আরো বেশি ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হতেন বলে তার ধারণা। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ ৫ জুলাই ২০১৩ এক সংবাদ সম্মেলনে বিরোধী দলকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, গোপালগঞ্জের পর গাজীপুর আওয়ামী লীগের সবচেয়ে শক্তিশালী এলাকা। গাজীপুরের মানুষ আওয়ামী লীগ ভাবাপন্ন। তিনি আরো বলেছিলেন, গাজীপুর হচ্ছে আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় গোপালগঞ্জ। তার জোটের এ অবিশ্বাস্য ভরাডুবির পর এখন তিনি কী বলবেন? এখন তিনি স্বীকার করবেন, গোপালগঞ্জ বাংলাদেশে শুধু একটিই, দেশের অন্য কোথাও আর একটিও গোপালগঞ্জ খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা এখন ীণতর হয়ে আসছে। চাপাবাজিতেও এখন হিসাব-নিকাশের অতীব প্রয়োজন।
অনিয়মের যত অভিযোগ
 ভোটের দিন বিকেল ৪টায় এম এ মান্নানের প্রধান নির্বাচনী সমন্বয়কারী হাসান উদ্দিন সরকার রিটার্নিং কর্মকর্তার অফিসে উপস্থিত হয়ে সাতটি ভোটকেন্দ্র দখলের লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন। লিখিত অভিযোগে তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড নম্বর ৩৫-এর ২০৭ নম্বর কেন্দ্রে খন্দকার রজব আলী বিদ্যানিকেতন, ২১ নম্বর ওয়ার্ডের ১২৩ নম্বর কেন্দ্র রোভার পল্লী উচ্চ বিদ্যালয়, ৪০ নম্বর ওয়ার্ডের ইছালী ভোটকেন্দ্র, ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের ১৯১ ও ১৯২ ডেগের চাল কেন্দ্র, ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের ১১৬, ১১৭ ও ১১৮ সালনা নাছির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় ও অনন্ত মডেল উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র সরকারি দল সমর্থিত প্রার্থীর সমর্থকেরা দখল করে নিয়েছে।
একই দিন দুপুরে বিএনপি নেতা এম কে আনোয়ার সিইসির সাথে দেখা করে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসে সরকারি কিছু কর্মকর্তা অবস্থান করছেন এবং তারা নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ করেন। তার অন্যান্য অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ২৪১ নম্বর ওয়ার্ডের ২৪৯ নম্বর ভোটকেন্দ্রের সাত নম্বর বুথে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তা এস আই আবুল বাশার সব ভোটারকে বের করে দিয়ে একাই সিল মেরেছেন। টঙ্গী সরকারি কলেজ কেন্দ্রের ৫ নম্বর বুথে এক মহিলা ১৪ দলের প্রার্থীর পে একাই ৩৬টি ভোট দিয়েছেন। বিএনপির প থেকে নির্বাচন পর্যবেণে থাকা বিএনপি নেতা হাজী শুকুর আলীকে পুলিশ বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গেছে এবং তার কাছে থাকা সব কাগজপত্র ছিনিয়ে নিয়েছে।
অনলাইন পত্রিকা জাস্ট নিউজের ৬ জুলাই ২০১৩ তিনটি সংবাদ ছিল এমনÑ
‘১৪ দলীয় জোট সমর্থিত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খানের বাড়ির পাশের খান আইডিয়াল স্কুল কেন্দ্র দখল করে নিয়েছে সরকারদলীয় ক্যাডারেরা। বিকেল পৌনে ৪টার দিকে সেখান থেকে অধ্যাপক এম এ মান্নানের সব এজেন্টকে জোরপূর্বক বের করে দিয়ে দোয়াত-কলম প্রতীকে সিল মারা হচ্ছে। কেন্দ্র দখলে বাধা দেয়ায় সরকারি দলের ক্যাডারদের হামলায় স্থানীয় যুবদলের চারজন আহত হয়েছেন। খবর দেয়ার পর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্য সেখানে যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন মান্নানের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট হাসান উদ্দিন সরকার। তিনি জানান, কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মোখলেসুর রহমানের কাছ থেকে সরকারদলীয় ক্যাডারেরা জোরপূর্বক ব্যালট বই ছিনিয়ে নিয়েছে। কেন্দ্রটিতে তিন হাজার ভোট রয়েছে।’ (জাস্ট নিউজ/এইচএস/এসকে/একে/জেএইচ/১৭৪৬ঘ)
‘গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের ৩৭৪ নম্বর কেন্দ্রে মুন্নু টেক্সটাইল উচ্চ বিদ্যালয়ে পুলিশ ভোট গণনার আগেই ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। এ সময় উপস্থিত ভোটার, সাধারণ জনগণ, ১৮ দল সমর্থিত মেয়রপ্রার্থী এম এ মান্নানের সমর্থক, পোলিং এজেন্ট ও সাংবাদিকদের বাধায় পুলিশ পিছু হটে।’
‘টঙ্গী স্টেশন রোডের নোয়াগাঁও এম মজিদ উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র দখলে নিয়েছে আওয়ামী সমর্থিত কর্মীরা। সকাল থেকেই তারা এ কেন্দ্রে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে। কেন্দ্রে ঢুকে প্রকাশ্যে দোয়াত-কলমে ভোট দেয়ার জন্য ভোটারদের প্রভাবিত করার পাশাপাশি অবাধে টাকা বিলিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ কর্মীরা। একই সাথে জাল ভোটও দেয়া হচ্ছে এ কেন্দ্রে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, টঙ্গীর সংসদ সদস্য জাহিদ হাসান রাসেলের চাচা ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক মতিউর রহমানের নেতৃত্বে এসব ঘটনা ঘটেছে।’ (জাস্ট নিউজ/এসকে/একে/১৭৫৩ঘ)
অবশ্য নির্বাচনোত্তর সংবাদ সম্মেলনে সিইসি দাবি করেছেন, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। প্রার্থীদের অভিযোগগুলোর মধ্যে যেসবের সুনির্দিষ্টতা পাওয়া গেছে সেগুলোর তাৎণিক ব্যবস্থা নিয়েছে কমিশন।
স্তাবক, সুবিধাভোগী দলান্ধ চাপাবাজেরা আগের চারটি সিটি নির্বাচনে পরাজয়ের পর একসাথে কোরাস গেয়ে উঠে উদ্বাহু নৃত্যে বলেছিল, ‘এটা গণতন্ত্রের বিজয়।’ এবার তারা আবার কোরাস গাইতে শুরু করবে একমাত্র মহাজোট মতায় থেকেই দেশবাসীকে নিরপে নির্বাচন উপহার দেয়ার মুরোদ রাখে। পাঁচটি সিটি করপোরেশনের বিরোধী দলের বিজয়ই তার সার্টিফিকেট। নষ্ট-ভ্রষ্ট-বামেরা বলবে জামায়াত-হেফাজতই তাদের ডুবিয়েছে। ওদের এখন ‘কাট-টু-সাইজ’ সময়ের দাবি। অন্ধের হস্তী দর্শনের মতো মহাজোট পালিত তথাকথিত সুশীলরা এখন পরাজয়ের কারণ নিয়ে অপব্যাখ্যা দিতে শুরু করবে। বিবেকবর্জিত বুদ্ধিজীবীরা সারিন্দায় তাল দেবে।
আসলে এ বিজয় মান্নানের নয়, ১৮ দলীয় জোটের নয়, এ বিজয় ইসলামি মূল্যবোধ এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের বিজয়। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের প্রতি সুস্পষ্ট ম্যান্ডেট। অভিনন্দন জনাব মান্নানকে, বেগম খালেদা জিয়াকে এবং গাজীপুরের ভোটারদের। এ বিজয় ১৮ দলীয় জোটের জাতীয় দাবি নির্বাচনকালীন ‘নির্দলীয় নিরপে সরকারের’ প্রতি এক সুস্পষ্ট ম্যান্ডেট।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads