বৃহস্পতিবার, ১১ জুলাই, ২০১৩

মিসরে গণতন্ত্র আবার বিপন্ন


গত বুধবার রাত এবং আগের দুই দিনের মিসরীয় সেনাবাহিনীর তৎপরতার পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী সময়ে পূর্ণ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক করা যেতে পারে। কিন্তু নিঃসন্দেহে যেটা স্পষ্ট হয়েছে সেটা হচ্ছে, তারা একটি দেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে সর্বনাশা ক্ষতি করেছে। যে দেশটিতে কয়েক দশক পর প্রথমবারের মতো গণতন্ত্রের সুবাতাস বইতে শুরু করেছিল, সেটাকে তারা স্তব্ধ করে দিয়েছে। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হোসনি মোবারকের পতনের পর যে সেনাবাহিনী রাজনীতি থেকে ফিরে গিয়েছিল, তারাই আবার রাজনৈতিক দৃশ্যপটে ফিরে এসেছে। তারা একজন নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে প্রথমে সঙ্কট সমাধানের জন্য সময় বেঁধে দেয়। অন্যথায় পদত্যাগ করার আহ্বান জানায়। এরপর তারা প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করে সংবিধান স্থগিত করে এবং নতুন রোডম্যাপ ঘোষণা করে। অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল যেটা ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছিলÑ সেটাকে প্রত্যাখ্যান করে তারা দেশের মৌলিক আইনকে পদদলিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কোনো সেনাবাহিনী অতীতে কখনো এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়নি। প্রকৃতপক্ষে সেনাবাহিনীর এই ভূমিকাকে মুরসিবিরোধী বিক্ষোভকারীদের অনেকেই স্বাগত জানিয়েছে। এসব বিক্ষোভকারী প্রথমে মোবারকের বিরুদ্ধে ২০১১ সালে রাস্তায় বিক্ষোভ প্রদর্শনের সাহস দেখিয়েছিল। রাজনৈতিকভাবে কাঁচা এবং দূরদৃষ্টির অভাবে তারা মুরসির ব্যাপারে বেপরোয়া মন্তব্য করেছে। এর অর্থ এই নয় যে, মুরসি নির্দোষ। তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অভিযোগ অনেক দীর্ঘ। তার সব চেয়ে খারাপ অপরাধ হচ্ছে গত নভেম্বরে নিজের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য উচ্চপর্যায়ের ডিক্রি জারি করা। তবে প্রতিবাদ ওঠার পর তিনি দ্রুত ক্ষমতা বৃদ্ধির ওই ডিক্রি বাতিল করেন। সংবিধানের মর্যাদা রক্ষার প্রয়োজনে মৃত্যুবরণ করতে প্রস্তুত বলে ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও রাস্তায় সর্বশেষ বিক্ষোভের সময় তিনি জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন এবং একটি নতুন পার্লামেন্ট গঠনের জন্য দ্রুত নির্বাচন দেয়ার প্রস্তাব দিয়ে পুনরায় সমঝোতার ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন। তবু গত দুই বছরের হতাশার জন্য তাকে পুরোপুরিভাবে দায়ী করা অযৌক্তিক। এ জন্য তিনি নয় বরং পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ পিপলস অ্যাসেম্বলি যে সুপ্রিম অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কোর্ট ভেঙে দিয়েছিল, তারাই এ জন্য দায়ী। এ জন্য মুরসি নয়, বিরোধীদলীয় নেতারাই দায়ী। কারণ প্রেসিডেন্ট তাদের মন্ত্রিসভায় যোগদানের আমন্ত্রণ জানানোর পর তারা তাতে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং তারাই মুসলিম ব্রাদারহুড প্রভাবিত একটি সরকার গঠন করতে প্রেসিডেন্টকে এক অর্থে বাধ্য করেছিল। মিসরের হাজার হাজার যুবক যারা প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি অর্জনের পর চাকরি লাভে ব্যর্থ হচ্ছেÑ মিসরীয় অর্থনীতির এই ব্যর্থতার জন্য নিশ্চিতভাবে প্রেসিডেন্টকে দায়ী করা যাবে না। মিসরের খাদ্য ও ইউটিলিটি মূল্যের ওপর থেকে সাবসিডি দেয়ার অবসান ঘটানোর জন্য আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) পরিকল্পনা নেয়ার কারণে আরো অধিক কৃচ্ছ্রসাধন বা ব্যয় হ্রাস করতে হবে। প্রতিষ্ঠিত বিরোধী দলগুলোর নেতারা যারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য চেঁচামেচি করছেন, তারা এ জন্য মুরসিকে দায়ী করছেন। পর্যটন খাতকে পুনরুজ্জীবিত করতে ব্যর্থতার প্রধান কারণ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও অস্থিতিশীলতা। রাস্তায় অব্যাহত বিক্ষোভের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তথাকথিত বিপদসঙ্কুল বা ব্যর্থ রাষ্ট্রের কাছ থেকে মিসরের গণতন্ত্রের প্রতি বেশ হুমকি এসেছে। মোবারকের ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির কর্মকর্তাদের হাতে এখনো আমলাতন্ত্র বন্দী। এলিট উদ্যোক্তাÑ যারা তাদের একান্ত সহচর তারা এবং সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন করছে অথবা নতুনভাবে বেসরকারীকরণ শিল্পকারখানা এবং বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলো থেকে লাভবান হচ্ছেন। কেউ কেউ এই কর্তৃত্ববাদী এলিটদের সাথে যোগ দেয়ার জন্য মুরসিকে দোষারোপ করছেন। তবে সত্যিকারের অভিযোগ হচ্ছে, তিনি তাদের প্রতি তেমন কোনো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেননি অথবা একটি দুর্নীতিবাজ ও বর্বর পুলিশবাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। গত কয়েক দিনের ঘটনার নির্মম পরিহাস হচ্ছে, যারা তাহরির স্কয়ার এবং অন্যান্য শহরের রাজপথে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে জোরেশোরে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে, তারা এলিটদের তৈরি করা ফাঁদে আটকা পড়েছে। এসব এলিট দেশকে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। এটা সত্য যে, মুসলিম ব্রাদারহুড এবং তার সমর্থকেরা সামাজিক রক্ষণশীল যারা কিছু মিসরীয়র কাছে মানবাধিকারের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু দেশের জন্য বৃহত্তম এবং তাৎক্ষণিক সর্বাধিক বিপদ হচ্ছে রাজনৈতিক অধিকার যেটা মোবারককে ক্ষমতাচ্যুত করে মিসরবাসী অর্জন করেছিল সেটার বিলুপ্তি। এক দলীয় শাসনের অবসান, সব ধরনের রাজনৈতিক গ্রুপে স্বাধীনভাবে সভা-সমাবেশ করার অধিকার, সংবাদমাধ্যমের ওপর থেকে সেন্সরশিপ প্রত্যাহার এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের কারারুদ্ধ করা বাতিল করার সুযোগ যেটা সহজেই পরিত্যাগ করা উচিত হবে না। যারা মনে করেন, সামরিক বাহিনীর প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে নতুন স্বাধীনতা রক্ষা করা, তারা শিগগির হতাশ হবেন। ১৯৭৩ সালে চিলি থেকে ১৯৯৯ সালের পাকিস্তান এবং এক অর্থে আরো বহুবার সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের দীর্ঘ ইতিহাসের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, প্রথম দিকে তাদের ক্ষমতা দখলকে স্বাগত জানানো হলেও পরবর্তী বছরগুলোতে এ জন্য দুঃখ প্রকাশ এবং হতাশ হতে হয়েছে। মিসরের জন্য ওই ধরনের ঐতিহ্য হবে বিপর্যয়কর। গার্ডিয়ান নিউজ অ্যান্ড মিডিয়া থেকে ভাষান্তর মুহাম্মদ খায়রুল বাশার

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads