সোমবার, ১৫ জুলাই, ২০১৩

ভোটের রাজনীতিতে শাসক দল অসহায়


মতাসীনেরা হয়তো মনে করেছিল, বিরোধী দলের ওপর হামলা-মামলা ও দমন-পীড়ন চালিয়ে এবং যুদ্ধাপরাধ ইস্যু ও গণজাগরণ মঞ্চের মাধ্যমে জাতিকে স্বাধীনতার প-বিপ এই শিবিরে বিভক্ত করে ভোটের রাজনীতিতে বাজিমাত করবে; কিন্তু পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফলে প্রতীয়মান হয়েছে, জনগণ তাদের এই ইচ্ছা বাস্তবায়ন হতে দেয়নি এবং ভবিষ্যতেও মনে হয় দেবে না। রাজনৈতিক দলের ওপর দমন-পীড়ন মানুষ যেমন ভালো চোখে দেখেনি, তেমনি মিডিয়াবান্ধব মানুষ গণমাধ্যমের ওপর দমননীতিও ভালোভাবে নেয়নি। বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেল বন্ধ করে সরকার মানুষের বিরাগভাজন হয়েছে। ওই টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত ইমলামি অনুষ্ঠান ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে অধিক জনপ্রিয় ছিল। বিশেষ করে ধর্মপ্রাণ মহিলারা এই অনুষ্ঠানের নিয়মিত স্রোতা ছিলেন। চ্যানেলগুলো বন্ধ হওয়ায় তারা অত্যন্ত ুব্ধ হয়েছেন এবং নির্বাচনের মাধ্যমে এই ােভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছেন। গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হাত দিয়ে সরকার চরম ভুল করেছে। গণতন্ত্রের লেবাসধারী কোনো সরকার গণমাধ্যমের সাথে এমন বৈরী আচরণ করতে পারে না। এর ফল সরকার ভোটের রাজনীতিতে পাচ্ছে। জনগণের কাছে ফিরে যেতে হবেÑ এটি হয়তো সরকার ভুলে গিয়েছিল। এখন গণেশ উল্টে যাওয়ায় তাদের বোধোদয় হতে শুরু করেছে। মতাসীন দলের শীর্ষ নেতারা জনগণকে উদ্দেশ করে বলছেনÑ ‘আমাদেরকে ভুল সংশোধনের সুযোগ দিন।’ কিন্তু এরই মধ্যে বুড়িগঙ্গার পানি অনেক দূর পর্যন্ত গড়িয়েছে। এখন জনগণের কাছে সুযোগ চেয়ে কোনো ফায়দা যে হবে নাÑ এটি বলাই বাহুল্য। আসলে সরকার অতীত থেকে কোনো শিা নেয়নি। মইন-ফখরুদ্দীনের দমন-পীড়নের একটা জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত তাদের সামনে ছিল। এ থেকে তারা কোনো শিা নিয়েছে বলে মনে হয় না। নিলে তাদের আচরণে পরিবর্তন অবশ্যই প্রতিফলিত হতো। শুরুতে মইন-ফখরুদ্দীনের সরকারের কিছুটা জনভিত্তি ছিল; কিন্তু দমন-পীড়ন নীতির কারণে তাদের সেই জনভিত্তিতে ধীরে ধীরে ধস নামতে থাকে। দমন-পীড়ন নীতির একপর্যায়ে দুই নেত্রীকে গ্রেফতারের পর তাদের জনভিত্তি শূন্যের কোঠায় নেমে যায়। তারা চামড়া বাঁচানোর পথ খুঁজতে থাকে। দমন-পীড়নে সিদ্ধহস্ত হলেও নির্বাচনী রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ যে কত অসহায়, তার একটা নমুনা দেখা গেছে পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। তাদের এখন একমাত্র সান্ত্বনা দলীয় সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচন করে আবার মতায় আসার স্বপ্ন দেখা। তাই তারা এখন বিপজ্জনক আঁতাতের রাজনীতি শুরু করেছেন। জাতীয় পার্টি ও অন্য কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে কোনো রকমে ম্যানেজ করে একটা যেনতেন নির্বাচনের পথে মতাসীন দল হাঁটছে। এই বিপজ্জনক আঁতাতের রাজনীতি মতাসীন দলের কবর রচনা করবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন। বন্দুকের নল যে মতার উৎস নয়, এটি অনিবার্যভাবে প্রমাণ করেছে জনগণ। দমন-পীড়নের েেত্র বর্তমান সরকার এক নজিরবিহীন ইতিহাস স্থাপন করেছে। এই সরকারের পুলিশ মানুষকে দৌড়ে পলানো অবস্থায়ও পেছন দিক থেকে গুলি করে হত্যা করেছে, যা টিভি চ্যানেলে মানুষ দেখেছে। পুলিশ শুধু মানুষের ওপর গুলিই চালায়নি, সন্ত্রাসী কায়দায় ন্যক্কারজনক ও অকল্পনীয়ভাবে দখল করেছে রাজনৈতিক দলের প্রধান কার্যালয়ও। সেখানে নারকীয় তাণ্ডব চালিয়ে ইতিহাসে স্থাপন করেছে এক অনন্য নজির, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই ঘটনা নজিরবিহীন; এটি মানুষকে চরমভাবে বিুব্ধ করেছে, মানুষ ভোটের মাধ্যমে এর জবার দিয়েছে। বাংলাদেশের জন্মের পর বর্তমান সরকারের আমলে পুলিশের গুলিতে এক দিনে সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যা শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বজুড়ে প্রচার হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি ও গণমাধ্যমের এই যুগে, জনগণের ভোটে নির্বাচিত একটি সরকারের আচরণ এমন ভয়ানক হবে তা ভাবাই যায় না। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, রাষ্ট্রের ভিত্তিও জনগণ; এই জনগণের ওপর শক্তি প্রয়োগ করে রাজনীতিতে টিকে থাকা যে কঠিনÑ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এটি প্রমাণ হয়েছে। এখান থেকে শুধু মতাসীন দলকেই নয়, শিা নিতে হবে অন্যান্য রাজনৈতিক দলকেও। যুদ্ধাপরাধের বিচার, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুসহ অন্যান্য রাজনৈতিক ইস্যুতে শাসক দল তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। ধর্ম, রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মুখোমুখি অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছে। যেখানে জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন ছিল, সেখানে সৃষ্টি করেছে ভয়াবহ বিভক্তি। এই বিভক্তি এখন তাদেরকে কুরে কুরে খাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষ ধর্মীয় চেতনায় বিশ্বাস করে, বিশ্বাস করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়ও; এই দুইয়ের মধ্যে বিরোধ অতীতে সৃষ্টি হয়নি; কিন্তু বর্তমান সরকার এটি করেছে। অন্য দিকে সংখ্যালঘুদের ওপর চলছে অবর্ণনীয় অত্যাচার, তাদের বাড়িঘর ভাঙচুর ও জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে মন্দির, যা অতীতে কখনো বাংলাদেশে হয়নি। এর জন্য সংখ্যালঘুরা সরকারকেই দায়ী করছে। যার জন্য সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সংখ্যালঘুরা আওয়ামী লীগকে সেভাবে ভোট দেয়নি। আসলে যেকোনো নির্বাচনে পরাজয় নিশ্চিত জানতে পারলে, সেটা রাজনৈতিক দলের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। বর্তমান মতাসীন দলেরও প্রতিটি পদপে রাজনীতির জন্য বিপজ্জনক। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল এই বিপজ্জনকেরই একটি অংশ। নির্বাচনে পরাজয়ের ভয়েই তারা এটি বাতিল করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের বিরুদ্ধে বিরোধী দল যাতে কার্যকর ও জোরাল কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারে, সে জন্য রাষ্ট্রের সব মেশিনারি তাদের ওপর ব্যবহৃত হচ্ছে। এক নজিরবিহীন দমন-পীড়নের মুখে তারা পড়েছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একটি বড় অংশকেই জেলে কাটাতে হচ্ছে। দলটির মহাসচিবকে পাঁচবার জেলে নেয়া হয়েছে, যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নজিরবিহীন ইতিহাস। দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির প্রায় পাঁচজন সদস্যকে জেলে নেয়া হয়েছে। জেলে নেয়া হয়েছে পাঁচজন যুগ্ম মহাসচিবকেও। তা ছাড়া অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয়পর্যায়ের সব নেতাকে জেলে যেতে হয়েছে। সারা দেশে হাজার হাজার মামলায় লাখ লাখ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। এসবের একটাই উদ্দেশ্যÑ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল জায়েজ করা এবং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করা। রাজনীতির সর্বোচ্চপর্যায়ে এমন ন্যক্কারজনক উদাহরণের কারণে প্রতিহিংসার দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পরতে পরতে। সমাজে যা কিছু অশুভ, কদর্য, নিন্দনীয়, অবাঞ্ছিত, জনগণ ও দেশের জন্য অকল্যাণকর; তাই ঘটে চলেছে আমাদের রাজনীতিতে। কোনো কিছুই প্রতিহিংসার ছোবল থেকে বাদ যাচ্ছে না। একে অপরকে ধ্বংস করার এমন আত্মঘাতী প্রবণতা অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক। অন্যান্য দাবি নিয়ে জনমনে দ্বিমত থাকলেও নির্দলীয় সরকারের দাবি বিরোধী দলের নিরেট গণতান্ত্রিক দাবি। এই দাবির প্রতি দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের সমর্থন রয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, যে দাবির প্রতি দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের সমর্থন রয়েছে, সে দাবিতে সরকারের টনক নড়ছে না কেন; এটি বিরোধী দলকে আগে ভাবতে হবে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় মানুষের মুখের ভাষা উপলব্ধিতে আনাই দূরদর্শী নেতৃত্বের পরিচায়ক। এটিই গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। গণতন্ত্রকে পরিপক্ব করতে হলে মানুষের এ ভাষার প্রতি শাসকদের অবশ্যই সম্মান দেখাতে হবে এবং সহানুভূতিশীল হতে হবে; সর্বোপরি দেশের স্বার্থ বড় করে দেখতে হবে। রাজনীতিতে পরাজয়কে সহজভাবে মেনে নিতে হবে, জয়কে সহিষ্ণুতার সাথে গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই জনগণের কাছে শাসক দলের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে। হারানো জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে, মানুষ শাসক দলকে নতুন চোখে দেখবে। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads