মঙ্গলবার, ৯ জুলাই, ২০১৩

তুমি খাচলতে কিসে ধুবা


মরমী কবি লালন সাঁইয়ের এক বিখ্যাত গানে আছে, “সুখের আশ থাকলে মনে দুঃখের ঘোর নিদানে তুমি অবশ্য মাথায় নিবা, তুমি অবশ্য মাথায় নিবা। /সুখ চেয়ে স্বয়াস্তি ভালো, সুখ চেয়ে স্বয়াস্তি।/ শেষ কালেতে পস্তাবা, তুমি শেষ কালেতে পস্তাবা।/  মন সহজে কী সই হবা?/ মন সহজে কি সই হবা?/ ইল্লতে স্বভাব হলে পানিতে যায়রে ধুলে/ খাচলতে কিসে ধুবা, তুমি খাচলতে কিসে ধুবা।/লালন বলে হিসাব কালে, লালন বলে হিসাব কালে তুমি সকল ফিকির হারাবা, তুমি সকল ফিকির হারাবা/। মন সহজে কী সই হবা?/ মন সহজে কি সই হবা?/ চিরদিন ইচ্ছা মনে আলডাঙায়ে ঘাস খাবা, তুমি আলডাঙায়ে ঘাস খাবা।/ মন সহজে কী সই হবা?/ মন সহজে কী সই হবা?/ মাথার পরে ডাবর  প’লে সেই দিনেতো টের পাবা, সেই দিনেতে তুমি টের পাবা।/ মন সহজে কী সই হবা?/ মন সহজে কি সই হবা?/ মন সহজে কী সই হবা?/”
আমাদের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বে ইল্লতও আছে, খাসলতও আছে। ইল্লতের (মলীনতা, অপরিচ্ছন্নতা) চেয়ে খাসলতের (স্বভাব, আচরণ, অভ্যাস) মাত্রা বেশি। লালন বলেছেন, ইল্লত তবুও পানিতে ধোয়া যায় কিন্তু স্বভাব বা খাসলত কিছু দিয়েই ধোয়া যায় না। এই মালিন্য একেবারেই মানুষের অন্তর্নিহিত। এ থেকে মুক্তির উপায় নেই। কিন্তু এই খাসলত মানব জীবনকে অনেক সময় ধ্বংসের একেবারে দ্বার প্রান্তে নিয়ে যায়। সেটিও লালন মানব সমাজকে সতর্ক করে বলেছেন, মাথার ওপর মুগুড় যেদিন পড়বে সেই দিন এই খাসলতের জবাব দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। সুতরাং কিছু কিছু অভ্যাস বা বদঅভ্যাস পরিবর্তন অতি জরুরি।  
খাসলত এমনই এক নষ্ট বদঅভ্যাস এটি সহজে দূর হতে চায় না। আমৃত্যু খাসলত মানুষকে তাড়িয়ে ফেরে।  কখনো কখনো এর জন্য বিরাট মাশুলও তাকে গুণতে হয়। বেশ কয়েক বছর ধরে আমরা একটি কথা  শুনে আসছি যে দলের ভেতরে গণতন্ত্র চর্চা করতে হবে। এ কেবল শ্রুতিই আমাদের দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে সত্যি সত্যি গণতন্ত্র চর্চার দারুণ অভাব। কখনো কখনো এসব দলের কাউন্সিল টাউন্সিল যে হয় না তাও নয়। কিন্তু সেসব বিষয় একেবারে মুখস্ত বলে দেয়া যায়। দলের নেতা পুনঃনির্বাচিত হবেন। আর অন্যসব নেতা নির্বাচনের ভার দলীয় নেতার হাতে ন্যস্ত করে দেয়া হয়। কাউন্সিল এখানেই শেষ। তারপর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যায়। নেতা তালিকা তৈরি করেন। কাটিকুটি করেন। তারপর ইচ্ছা মতো নেতৃত্ব ঠিক করেন। এখানে আর শত শত কাউন্সিলরের বলবার কিছুই থাকে না। কিন্তু কমিটি গঠিত হয়ে গেলে তুমুল সমালোচনা চলতে থাকে। কেন্দ্র থেকে নির্ধারিত কমিটি স্থানীয়রা মানতে চায় না। তারা পরস্পর মারামারি করেন, হানাহানি করেন। কিন্তু কার্যত তখন কেন্দ্রে আর কিছুই করার থাকে না। লক্ষ্য করেছি তারা চুপচাপ সেসব দৃশ্য দেখতে থাকেন।
এধারা নিঃসন্দেহে দলের ভেতরে কঠোর স্বৈরতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্র তৈরি করেছে। নেতা বা নেত্রী যাকে পছন্দ করবেন কমিটিতে ঠাঁই হবে তারই। এই স্বৈরতন্ত্র রাজনৈতিক দলগুলোকে আসলে গণতন্ত্র থেকে বিচ্যুত করে ফেলেছে। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক যে চেতনার মধ্য দিয়ে একটি রাজনৈতিক দল বিকশিত হতে পারত তাকে অঙ্কুরেই গলাটিপে হত্যা করা হয়। সম্ভাব্য নেতৃত্ব সঠিক আনুগত্য দেখাতে ব্যর্থ হওয়ায় ছিঁটকে পরে যায়। এখন আমরা নেতা আছি তার অর্থ এই না যে আমরাই অনন্তকাল নেতা থাকব। এমনকি প্রাকৃতিক মৃত্যুও আমাদের পৃথিবী থেকে বিদায় করে দিতে পারে। তখন দলটির কী হবে এ কথা যেন কেউই চিন্তা করতে চাচ্ছেন না।
নেতৃত্ব তরুণদের মধ্য থেকেও আসে। আসতেই পারে। সে চিন্তাও এখন যারা রাজনৈতিক নেতৃত্বে আছেন তাদের করতে হবে। কারণ প্রকৃতি শূন্যতা পরিহার করে। ধারাবাহিকভাবে নেতৃত্ব গড়ে তোলা না গেলে, সন্দেহ নেই একটি জাতি ভয়াবহ নেতৃত্ব সঙ্কটে পড়বে। এই তরুণ নেতৃত্ব সাধারণত ওঠে আসে ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন থেকে। কিন্তু ছাত্র সংসদের নির্বাচন গত ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে। ফলে ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্ব করছেন নানা-দাদারা এবং ক্রমেই তাদের মধ্যে আদর্শ বিচ্যুতি ঘটেছে। দাদা হয়ে গেছে অথচ ছাত্রসংগঠনেরই নেতা রয়ে গেছে। এমন নেতা তাহলে কী করবে। এমপি হওয়ার সম্ভাবনা নেই, মন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা নেই, সমাজ উন্নয়নে ভূমিকা রাখার সম্ভাবনা নেই। সম্ভাবনা একটাই আছে। তা হলো মাল কড়ি বানিয়ে নেয়া। ফলে ছাত্র সংগঠনের নামে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি এক অসহনীয় রূপ লাভ করেছে। এ নিয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে হত্যাযজ্ঞ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হচ্ছে। নেতৃত্বে যারা আছেন তাদের নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকতে হচ্ছে। কেননা তারা ওদের জন্য কোনো পথ করে দিতে পারেননি।
ফলে এই সমাজের ভেতর ধারাবাহিক এক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। সে শূন্যতার সুদূর প্রসারী প্রভাব কী সেটি আমাদের নেতানেত্রীরা উপলব্ধি করতে পারছেন বলে মনে হয় না। বিষয়টি সম্ভবত একমাত্র উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তৎকালে বিএনপির সিনিয়ার যুগ্ম-মহাসিচব তারেক রহমান। দলের এই স্থবিরতা লক্ষ্য করে তিনি শুরু করেছিলেন বিএনপির তৃণমূল সম্মেলন। অর্থাৎ বিএনপির কর্মীদের ভোটে বিএনপির তৃণমূলে নেতৃত্ব নির্বাচিত হবে। ক্রমান্বয়ে তারা সামনে ওঠে আসবে। সেই তৃণমূল সম্মেলন সারা দেশে এমন সাড়া জাগায় যে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগ।
আমরা লক্ষ্য করেছি তারেক রহমান যখন তৃণমূল সম্মেলন শুরু করলেন তখন আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা প্রমাদ গুণতে শুরু করেন। তার সকল আন্দোলন, সকল সংগ্রাম সবকিছু তখন খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে তারেক রহমানের দিকে তাক করা হয়। তার কারণ হলো এই যে আওয়ামী লীগের তরুণ নেতৃত্বকে তিনি দল থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। প্রবীণদের ধারাবাহিক অসম্মানের মাধ্যমে একেবারে কোণঠাঁসা করে ফেলেছেন। তিনি ছাড়া তখন আর আওয়ামী লীগের কোনো নেতৃত্ব নেই। কোদালকে কোদাল বলা প্রাজ্ঞ নেতাও নেই। প্রতিবাদী তারুণ্যও নেই। ফলে তার দলে এক মহা শূন্যতার সৃষ্টি হয়। এরকম একটি সময়ে যদি তারেক রহমানের নেতৃত্বে তৃণমূলের বিএনপি সংগঠিত ওয়ে ওঠে তাহলে এই দলের আর কোনো দিন বিলোপ করা সম্ভব হবে না।
আওয়ামী লীগের পথ তিনি নিজেই করেছেন। কিভাবে করেছেন তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছিলেন সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা ফজলুর রহমান। কিভাবে তরুণ নেতৃত্বকে তিনি একেবারে গর্দান মটকে ঘরে বসিয়ে দিয়েছেন এবং প্রবীণ নেতৃত্বকে অসম্মান করতে করতে দলত্যাগে বাধ্য করেছেন। অর্থাৎ পরিস্থিতি এমন দাঁড় করিয়েছে যে তিনি আওয়ামী লীগের সর্বময় নেতৃত্ব কর্তৃত্বের অধিকারী হবেন। আর কেউ যেন এখানে টুঁ শব্দটিও করতে না পারেন। আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমেদ ছাত্রলীগের টেন্ডারবাজির বিষয়ে একবার আফসোস করে বলেছিলেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতো বছর ছাত্র নেতৃত্ব করেছেন কিন্তু কোন ভবন থেকে টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয় বা কোথায় টেন্ডার জমা পরে এর কোনো কিছুই তিনি অবহিত ছিলেন না। আর এখন ছাত্রলীগের রাজনীতি ঐ ভবনকে ঘিরেই। আর কোনো ইস্যু নেই। আর কোনো কাজ নেই। এরা যদি বিরোধী দলকে ঠেঙিয়ে আসতে পারে তাহলে নেত্রীর কাছে তাদের মূল্য অপরিসীম। এতো কষ্ট করে পুলিশের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বিএনপি-জামায়াতকে যারা গুলী করে ঘায়েল করে এসেছে তারা না হয় করলই খানিকটা টেন্ডারবাজি। শেখ হাসিনা সম্ভবত ছাত্র রাজনীতি নিয়ে এমন ধারণাই পোষণ করেন। সেক্ষেত্রে গোল্লায় গেলে যাক। শেখ মুজিবের কথিত আদর্শ গোল্লায় গেলে যাক। আওয়ামী লীগ নিজেও। শুধু ফ্যাসিবাদী এক স্বৈরশাসকের মতো তার ক্ষমতার মসনদ অটুট থাকলেই হলো।
আমরা লক্ষ্য করেছি এখনো শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের হাইব্রিড নেতাদের মুখে জপনাম একটাইÑতারেক রহমান। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা, তারেক রহমানের টাকা পাচারের রূপ কথার গপ্প, তারেক রহমানের ঘুষ খাওয়া এইসব নিয়ে গত সাড়ে চার বছর ধরে তোলপাড় কা- চালানো হয়েছে এবং হচ্ছে। এসব প্রচারণাও তারেক রহমানকে বরং মহিমান্বিতই করেছে। এবং তাকে রাজনীতিতে আরো শক্তি সঞ্চারের সুযোগ করে দিয়েছে। এই সাড়ে ছয় বছরে শেখ হাসিনার ডেকে আনা মঈন ফখরের সামরিক সরকার এবং শেখ হাসিনার আঁতাতের সরকার কেউই তাকে রহমানের বিরুদ্ধে আনীত একটি অভিযোগও প্রমাণ করতে পারেননি। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগের মামলার একাধিক সাক্ষী খুঁজে পেয়েছিলো। কিন্তু তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য একজন লোকও খুঁজে পাওয়া যায়নি। আওয়ামী লীগের লজ্জা থাকলে তারেক রহমানের নামও মুখে আনত না। বরং শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো যখন প্রত্যাহার করা হলো তখনই প্রত্যাহার করে নেয়া উচিত ছিলো খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো।
এই প্রসঙ্গের অবতারণা করেছিলাম পাঁচ সিটি কর্পোরেশনের সাম্প্রতিক ফলাফল নিয়ে। এই পাঁচ সিটি কর্পোরেশনেই জনগণ আওয়ামী লীগের অপশাসনকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। এবং ৯০ শতাংশ মানুষের যা আকাঙ্খা অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি ফিরিয়ে আনা, তার রায় দিয়ে দিয়েছে। রাজশাহী, সিলেট, খুলনা, বরিশালে যখন আওয়ামী লীগের একযোগে ভরাডুবি ঘটল তখন আওয়ামী লীগ সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলো গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনে জেতার। কিন্তু তাতেও কোনো ফল হয়নি। আওয়ামী লীগকে গাজীপুরেও ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে জনগণ। পত্র-পত্রিকায় লেখা হচ্ছে এই পাঁচটি আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বড় ভালো মানুষ ছিলো। কিন্তু আওয়ামী লীগের জাতীয় রাজনীতির কারণে এই ভরাডুবি ঘটল। কিন্তু কেউ বলছেন এই ভরাডুবির জন্য দায়ী কে? নিঃসংশয়ে উচ্চারণ করা যায়, দায়ী শেখ হাসিনা নিজেই।
স্বৈরশাসনের অনিবার্য পরিণতি সাধারণত এভাবেই ঘটে। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে। আওয়ামী লীগেরও কেউ কেউ বলছেন, তারা মূল্যই দিলেন। কিসের মূল্য দিলেন কিংবা কিসের মূল্য দিলেন না সে কথা তারা কেউ খোলাসা করে বলেননি। কিন্তু সেটি অবধারিত সত্য। আর লালনের গানের সেই কথা প্রমাণিত হলো “খাচলতে কিসে ধুবা”।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads