বৃহস্পতিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১২

প্রধানমন্ত্রীর উক্তি দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয়


সিরাজুর রহমান

সিরাজুর রহমান
অনেকেই বলেছেন কথাটা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কথা বলতে ভালোবাসেন। বলা যায় নিজের কণ্ঠস্বর তার অতিপ্রিয়, যা নিজে শুনতে খুবই ভালোবাসেন। এজাতীয় লোকদের নিয়ে অনেক সমস্যা। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলতে হলে নানা তথ্য-উপাত্তের প্রয়োজন। সেসব সংগ্রহ কিংবা হজম করার সময় তারা পান না। কথাগুলোর তাৎপর্য কিংবা পরিণতি বিবেচনা না করেই তারা বলে ফেলেন। তা নিয়ে পরে নানা সমস্যা-সঙ্কট দেখা দিতে পারে। এই লোকেরা ভুলে যান যে, তারা অমুক গেরামের ‘ছমিরদ্দি’ কিংবা তমুক গেরামের ‘রইশ্যার নানী’ নন। তাদের ফাতরা কথা দেশ ও জাতির জন্যও বিপদ সৃষ্টি করতে পারে।
শেখ হাসিনার একটা স্বভাবÑ তিনি অনর্গল বিরোধীদলীয় রাজনীতিকদের ‘পরামর্শ’ দিয়ে যান। সবাই মনে করে সেসব পরামর্শ সুপরামর্শ নয়, কেননা সুপরামর্শ হলে নিজ দলের পেশিসর্বস্ব বাচাল নেতা-পাতি নেতাদের দিতেন। সেসব পরামর্শ তাতে তারা ও তাদের দল উপকৃত হতে পারত। বিএনপির যুগ্মমহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যথার্থই প্রধানমন্ত্রীকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, তার পরামর্শ শুনে রাজনীতি করতে হলে তাদের পথে বসতে হতো।
প্রধানমন্ত্রীর আরেকটা অহিতকর অভ্যাস, যেখানে নাক গলানো কিছুতেই তার উচিত নয়, সেখানে তিনি একসাথে উভয় পা-পর্যন্ত ঢুকিয়ে দেন। খুনখারাবিসহ কোনো ঘটনা ঘটলে পুলিশি তদন্তের আগেই এমনকি বিচারাধীন ব্যাপারেও তিনি রায় দিয়ে দেন। তার বৈরীদের দিকে আঙুল তুলে রায় দেন যে, তারাই সেই অপকর্মটি করেছে। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্যÑ এ দেশের শীর্ষ বিচারকেরা অনেক দিন আগেই প্রধানমন্ত্রীকে হুঁশিয়ার করে দিতেন, সতর্কতার সাথে ভেবেচিন্তে কথা বলার পরামর্শ দিতেন তাকে।
শেখ হাসিনা ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন গার্মেন্ট কারখানার মহা-ট্র্যাজেডি সম্বন্ধে এ রকমই একটা গর্হিত কথা বলেছেন। পুলিশি তদন্ত এখনো চলছে। এ ঘটনা সম্পূর্ণভাবেই দুর্ঘটনা ছিল না সাবোটাস, সেটাও এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তা ছাড়া আগুন লাগলেই যে এত লোক মারা যাবে তেমন কোনো কথা নেই। মালিকেরা আগুনের বিরুদ্ধে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছিলেন কি না, আগুন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপযুক্ত ব্যবস্থা ছিল কি নাÑ এসব সম্বন্ধে খোঁজখবরও নেয়া হয়নি। কিন্তু শেখ হাসিনা বলে দিলেন, ঘটনাটা পূর্বপরিকল্পিত। তার কথার আবহ থেকে মনে হতে পারে তিনি সম্ভবত জামায়াতে ইসলামীর প্রতি কটাক্ষ করেই সে কথা বলেছেন। আবহটা এই যে মাত্র কয়েক দিন আগেই প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেছেন, এ দলটি একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে আপাদমস্তক-বেষ্টিত হিসেবে সমালোচিত, মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত জামায়াতের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন। আর আওয়ামী লীগের যে যুগ্মসচিব নিজ মস্তিষ্ক কুষ্টিয়ায় অথবা অন্য কোথাও রেখে এসেছেন বলে কেউ কেউ রসিকতা করে বলে থাকেন, তিনি বিজ্ঞতার ভান করে বলেছেন, দেশবাসী চাইলে জামায়াতকে অবৈধ করার কথা বিবেচনা করবে সরকার।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, জামায়াতকে অবৈধ করার ছলছুতো খুঁজছে সরকার। জামায়াত সোমবার রাজধানীতে একটা সমাবেশ করতে চেয়েছিল কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনুমতি দেননি। কেন? সংবিধান তো এ কথা বলেনি যে, সার্বভৌমত্ব আওয়ামী লীগের দলীয় সম্পত্তি, জনসাধারণের নয়। জনসাধারণ যদি সমাবেশ করতে চায় সে অধিকার তাদের দিতে হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কি জানতেন না যে, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অনুমতি দেয়া না হলে দেশব্যাপী প্রতিবাদ হবে, কোনো সন্দেহ নেই যে, উসকানি দিয়ে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার অজুহাত সৃষ্টি করাই ছিল সরকারের উদ্দেশ্য। প্রধানমন্ত্রীর আলোচ্য উক্তিটি এরই ইঙ্গিত দেয় বলে মনে করা যেতে পারে।

উসকানির পথে মহাবিপদ লুকানো
জামায়াতে ইসলামী দলটিকে নিষিদ্ধ করার ফলাফল কেমন ভয়াবহ হতে পারে তা নিয়ে আমরা আগেও আলোচনা করেছি। জামায়াত ও শিবির চোখের সামনে থাকলে প্রধানমন্ত্রী জানবেন, তারা কী করছে। কিন্তু তারা যদি ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ চলে যায়, তাহলে কখন তারা কী করবে, শেখ হাসিনাও জানবেন না সেটা। এমনকি নিরুপায় হয়ে যদি তিনি সংলাপের পথে যেতে চান, তাহলেও কার সাথে বসতে হবে, কার সাথে সংলাপ করতে হবে স্থির করা তার জন্য অসম্ভব হয়ে উঠবে। শেখ হাসিনা ও তার সরকারকে আবারো হুঁশিয়ার করে দেয়া প্রয়োজন যে, সেই পথে তার ও তার সরকারের জন্য শুধু মহাবিপদই লুকানো আছে।
কেউ কেউ ব্যঙ্গ করে বলেছেন, অপরাধ-দুষ্কৃতিগুলো সম্বন্ধে হাইকমান্ড আগেভাগেই জানেন বলে তার কথা থেকে মনে হতে পারে। আমার কিন্তু সিরিয়াসলি মনে হয়, সবগুলো না হলেও বহু দুষ্কৃতি সম্বন্ধে তিনি আগে থাকতেই অবহিত থাকতে পারেন। কয়েকটা দৃষ্টান্ত দেয়া যাক। নতুন সরকার ক্ষমতায় এলো। শেয়ারবাজার থেকে ৩৫ লাখ স্বল্পবিত্ত মানুষের লগ্নি লুট হয়ে গেল। দেশের প্রায় সব মানুষই জানে, এ সরকারের ক্ষমতা পাওয়ার পেছনে যারা পৃষ্ঠপোষক ছিল, আর যাদের মাধ্যমে ‘ভারতের বস্তা বস্তা টাকা ও পরামর্শ’ যথাস্থানে এসে পৌঁছেছে, শেয়ারবাজারের মহালুট করেছে তারা।
এ ঘটনা অনেকটা চাপা পড়ে যায় বিডিআর বিদ্রোহের দরুন। কয়েক দিন আগে থেকেই প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ তিন ব্যক্তিÑ তাপস, নানক ও মির্জা আজমের সাথে পরবর্তীকালে বিদ্রোহের হোতা বলে পরিচিত বিডিআর কর্মীদের মুঠোফোন-আলাপের খই ফুটছিল। বহু চোখে দেখা প্রমাণ থেকে মনে হয়, দেশের বাইরে থেকে কিছু ‘রুমালধারী’ লোক হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছে এবং ঘটনার পর হঠাৎ উধাও হয়ে গেছে। এমনকি দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা হত্যাকাণ্ডের আগে বিদ্রোহীরা গণভবনে এসে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দীর্ঘ আলোচনা করেছে। তদন্ত কিংবা বিচারের তোয়াক্কা না করেই প্রধানমন্ত্রী তাদের ‘ক্ষমা ঘোষণা’ দিয়েছেন। সেনাবাহিনী বিদ্রোহ দমন করতে এগিয়ে এলে প্রধানমন্ত্রী মাঝপথে তাদের থামিয়ে দেন। দুটো সামরিক আর একটা বেসামরিক গোয়েন্দা বিভাগ প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে। দেশের কোথায় কে তার ও তার সরকারের সমালোচনা করেছে, সেসবই তারা অবিলম্বে প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে দেন। বিডিআর বিদ্রোহ সম্বন্ধে তিনি আগে থেকে কিছু জানতেন না, বিশ্বাস করা কঠিন।
শেখ হাসিনা আজ অবধি তার মূল নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলোর কোনোটাই পূরণ করতে পারেননি। বিদ্যুৎ সঙ্কট চরমে উঠলে তিনি সমাধানের যে পথে যান, তাতে গোটা দেশের মানুষ বিস্মিত ও স্তম্ভিত। বিনা টেন্ডারে বহু হাজার কোটি টাকার কন্ট্রাক্ট দেয়া হয়েছে এবং এর বেশির ভাগই দুর্নীতিবাজদের পকেটে গেছে। কারা পেয়েছে সেসব কন্ট্রাক্ট? পেয়েছে এমন সব ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান যাদের মালিকেরা হাসিনার মন্ত্রী কিংবা নিকটাত্মীয়। ডেসটিনির মহাকেলেঙ্কারি এবং হলমার্ক কোম্পানির কাণ্ডকারখানা সম্বন্ধে প্রধানমন্ত্রী কি আগেভাগে জানতেন না? তার গোয়েন্দা বিভাগগুলোর কথা ছেড়ে দিলেও এই উভয় প্রকল্পে প্রধানমন্ত্রীর দু’জন উপদেষ্টা সরাসরি জড়িত ছিলেন।
‘চোরের মার বড় গলা’ বলে অন্যের প্রতি কটাক্ষ করার আগে প্রধানমন্ত্রীর মনে করা উচিত ছিল, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত করার জন্য বিশ্বব্যাংকের তদন্তকারী দল দ্বিতীয়বার বাংলাদেশে এসেছে এবং নামোল্লেখ করে ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করতে দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে দাবি জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আরো মনে করতে পারতেন যে, কানাডীয় পুলিশ টিম এ বিষয় সম্বন্ধে তদন্ত করছে। তারা কাদের কানাডীয় পাসপোর্ট জব্দ করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে কাদের ব্যবসায় ও সম্পত্তি সম্বন্ধেও তদন্ত করেছে। সরকারের রাবার স্ট্যাম্প হিসেবে পরিচিত দুর্নীতি দমন কমিশন গোড়ায় পদ্মা সেতুর ব্যাপারে দুর্নীতির অভিযোগ অসত্য বলে উড়িয়েই দিয়েছিল। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের চাপে পড়ে এখন ক্রমে ক্রমে দুদকের বোধোদয় হচ্ছে বলেই মনে হয়। শোনা যাচ্ছে, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমানকে মামলার অন্তর্ভুক্ত করতে দুদকের আপত্তির কারণেই নাকি বিশ্বব্যাংকের ঋণ এখনো আটকে আছে। কারণ কিন্তু বাংলাদেশের সব মানুষেরই জানা। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরপরই প্রশাসনিক ব্যবস্থায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সাত হাজার মামলা তুলে নেয়া হয়েছে। সেসবের মধ্যে খোদ প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিচারাধীন ১৫টি দুর্নীতির মামলাও ছিল।
প্রধানমন্ত্রী জানেন অনেক কিছু। কিন্তু তার জানা আর বলার মধ্যে সঙ্গতি থাকে কি না, সেটাই হচ্ছে বড় কথা। বাংলাদেশে রাজনৈতিক গুম ও খুনের যে ঘটনাগুলো ঘটছে হাইকমান্ড নিশ্চয়ই সেসবেরও আগাম খবর জানেন। উচ্চপর্যায়ের নির্দেশ, নিদেন অনুমতি ছাড়া র‌্যাব ইলিয়াস আলীকে ছিনতাই ও গুম করেছে বলে উন্মাদও বিশ্বাস করবে না।

অগ্নিকাণ্ড ও শ্রমিক অশান্তির মহামারী
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির আগুন পূর্বপরিকল্পিত ছিল। সেটা হতেই পারে। পূর্ববর্তী সরকারগুলোর আমলেও কোনো কোনো পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে পোশাকের কারখানায় আগুন লাগার যেন মহামারী চলছে। আগের চেয়ে অনেক বেশি শ্রমিক মারা গেছেন বর্তমান সরকারের আমলে। আরেকটা লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, পোষাকশ্রমিকদের অশান্তি, হরতাল, সড়ক অবরোধ ইত্যাদিও অনেক বেড়ে গেছে এই সরকারের আমলে। পোশাক শিল্পে বিদেশী নাগরিকদের অনুপ্রবেশ ঘটছে।
বাংলাদেশে তৈরী পোশাকের বিদেশী আমদানিকারকেরা স্তম্ভিত ও ক্রুদ্ধ। আমেরিকার বৃহত্তম চেইন স্টোর ওয়ালমার্ট। (ভারতসহ অন্যান্য দেশেও তাদের ব্যবসায় আছে)। তারা বলেছে, বাংলাদেশে তৈরী পোশাক আর তারা আমদানি করবে না। সিঅ্যা-এ ব্রিটেনের বৃহত্তম চেইন স্টোরগুলোর একটি। তারা এবং অন্যান্য চেইন স্টোরও উদ্বেগ জানিয়েছে। বাংলাদেশে তৈরী পোষাকের আনুমানিক অর্ধেক আসে ইউরোপীয় ইউনিয়নে। ইইউ বলেছে, তাজরীন কারখানার মতো দুর্ঘটনা বন্ধ করার ব্যবস্থা বাংলাদেশকে নিতে হবে।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের দুরবস্থা দেখে, বিশেষ করে শ্রমিকনেতা আমিনুল ইসলাম হত্যার পর বাংলাদেশে এসে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটন বলে গেছেন, বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে মার্কিন খদ্দেররা আর বাংলাদেশে তৈরী পোশাক পরতে চাইবেন না। ইউরোপেও একই অবস্থা হতে বাধ্য। কথা হচ্ছে, বাংলাদেশ যদি তার বিদেশী মুদ্রা অর্জনের এক নম্বর উৎস, পোশাক শিল্পের বিদেশী বাজার হারায় তাহলে কারা লাভবান হবে? কোথায় উল্লাস দেখা দেবে? প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় এসব ‘পূর্বপরিকল্পিত’ ঘটনার পেছনে কি তাদের কোনো ইন্ধন থাকতে পারে? সে সম্বন্ধে প্রধানমন্ত্রীর কাছে কি আগাম কোনো খবর আছে?
লন্ডন, ০৪.১২.১২
serajurrahman34@gmail.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads