মঙ্গলবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১২

সাংবাদিকদের যোগ্যতা সম্পর্কে অর্থমন্ত্রীর তামাশা



সাংবাদিকদের ঝেড়ে এক হাত নিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। গত রোববার স্বভাবসুলভ অঙ্গভঙ্গি এবং বাংলা ও ইংরেজির সংমিশ্রণে তিনি যা বলেছেন সহজ কথায় তার অর্থ হলো, বাংলাদেশের সাংবাদিকরা অর্থনীতি বিষয়ক রিপোর্টিং করতে জানেন না! সে কারণে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের ক্লাস নেয়ার এবং প্রশিক্ষণ দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, তারা অর্থাৎ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা যখন উন্নয়ন-সমৃদ্ধির ব্যাপারে কিছু বলেন তখন নাকি সাংবাদিকরা সেগুলো হয় বিশ্বাস করেন না অথবা বিশ্বাস করলেও রিপোর্টে সঠিকভাবে তুলে ধরেন না। একই সাংবাদিকরা নাকি আবার বিদেশের কোনো সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরকে ফলাও করে প্রকাশ করেন। এসব কারণে সরকারের সাফল্য সম্পর্কে জনগণ জানতে পারে না। অন্যদিকে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে বিরোধী দল সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় এবং আন্দোলন গড়ে তোলে। সাংবাদিকদের অযোগ্যতা সম্পর্কে উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিক গার্ডিয়ানের একটি সাম্প্রতিক রিপোর্টের উল্লেখ করেছেন যেখানে বলা হয়েছে, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি পাশ্চাত্যের দেশগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে। রিপোর্টটিকে নিয়ে বাংলাদেশের সাংবাদিকরা নাকি হৈচৈ তুলেছেন। অথচ একই কথা তিনি নিজেও বহুদিন ধরে বলে চলেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের সাংবাদিকরা তাকে পাত্তাই দিচ্ছেন না! এর কারণও জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। কারণটি হলো, বাংলাদেশের সাংবাদিকরা সঠিকভাবে রিপোর্ট করতে শেখেননি। এজন্যই সাংবাদিকদের ট্রেনিং দেয়া দরকার এবং সে দায়িত্বটুকুই পালনের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী। অবশ্য তিনি তেমন সময় বা অবসর পান।
আমরা কিন্তু অর্থমন্ত্রীর এই আগ্রহকে সাধুবাদ জানাতে পারছি না। সাংবাদিকরা কেন সরকারের সাফল্য তুলে ধরার ব্যাপারে কথিত কার্পণ্য করেন তার কারণ অন্তত বিদ্বান ও অতিজ্ঞানী অর্থমন্ত্রীর না বোঝার কথা নয়। অর্থমন্ত্রীর এই বুঝতে না পারা এবং সাংবাদিকদের শেখানোর আগ্রহ খুবই কৌতূহলোদ্দীপক সন্দেহ নেই, অন্যদিকে বাস্তব অবস্থা এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছে গেছে, যখন জনাব মুহিত চাইলে সাধারণ মানুষের কাছেও তার জিজ্ঞাসার উত্তর জেনে নিতে পারেন। শেয়ারবাজারের কথাই ধরা যাক। শত বা হাজার কোটি নয়, লক্ষ হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেছে শেয়ারবাজার থেকে। ৩৩ লাখ ক্ষুদে বিনিয়োগকারী তথা সাধারণ মানুষ তাদের শেষ সঞ্চয়টুকু খুইয়ে পথে বসেছেন। কিন্তু সরকার তো বটেই, এত যোগ্য যে অর্থমন্ত্রী তিনিও কিছুই করেননি। তিনি বরং উল্টো বিনিয়োগকারীদেরকে ‘ধান্দাবাজ' ও ‘কিছু লোক' বলে তামাশা করার মাধ্যমে ঝামেলা পাকিয়েছেন। স্মরণ করা দরকার, নামকা ওয়াস্তে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও অর্থমন্ত্রী তার রিপোর্ট থেকে দোষী ব্যক্তিদের নামগুলো ডিলিট করার অর্থাৎ বাদ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তখনও বোঝা গিয়েছিল, লুণ্ঠনের ভাগ ঠিক কোন কোন পর্যায়ে পৌঁছে দেয়া হয়েছে! বলার অপেক্ষা রাখে না, মূলত সে কারণেই দেশের শেয়ারবাজার মুখ থুবড়ে পড়েছে এবং আজ পর্যন্তও আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। মাননীয় অর্থমন্ত্রী যদি শেয়ারবাজারের বারোটা বাজানোকেও তাদের সাফল্য বলতে চান তাহলে স্বীকার করতেই হবে, এদেশের সাংবাদিকরা আসলেও যোগ্যতা রাখেন না! হলমার্ক কেলেংকারি থেকে শুরু করে ব্যাংকিং খাতসহ জাতীয় অর্থনীতির সামগ্রিক অবস্থাও কিন্তু অর্থমন্ত্রীর দাবির পক্ষে যায় না। কারণ, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকারি দল নিজেদের দখল কয়েম করেছে। বেসরকারি ব্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয় ও টিভি চ্যানেল থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ, টেলিযোগাযোগ ও জাহাজ নির্মাণ পর্যন্ত এমন কোনো খাতের কথা বলা যাবে না, যেখানে ক্ষমতাসীনদের বাইরে অন্য কারো পক্ষে বিনিয়োগ ও ব্যবসা করা সম্ভব হচ্ছে। কিছু কিছু খাতে ক্ষমতাসীনরা একচেটিয়া কর্তৃত্বও প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছেন। যেমন রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুতের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে ডাকসাইটে মন্ত্রী ফারুক খানের নাম। এরই মধ্যে তিনি বিদ্যুৎ খাতের ‘মহাজন' হিসেবে কুখ্যাত হয়ে উঠেছেন। তার পারিবারিক প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপ একাই হাসিল করেছে ছয়টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিকানা। তারা আবার এতটাই ক্ষমতাশালী যে, চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে না পারলেও ভর্তুকির টাকা আদায় করে নিচ্ছেন কড়ায়-গন্ডায়। ফারুক খানদের উদর পূর্তির জন্য সরকার একদিকে ৩২ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ভর্তুকি গুনছে অন্যদিকে ভর্তুকির দোহাই দিয়ে তিন-চার মাস পরপর বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে চলেছে। এর ফলে জনগণের নাভিশ্বাস উঠছে। একই অবস্থা চলছে ব্যাংকিং খাতেও। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর থেকে প্রধানমন্ত্রীর ফুফাত ভাইয়ের ছেলে ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, এমপি এবং অন্য নেতারা মিলে নয়টি ব্যাংকের লাইসেন্স বাগিয়েছেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদও ভাগ বসিয়েছেন। টেলিযোগাযোগ এবং জাহাজ নির্মাণের মতো খাতগুলোতেও ক্ষমতাসীনদেরই দৌড়ঝাঁপ চলছে। এজন্য তারা আবার প্রতারণার আশ্রয়ও নিচ্ছেন। রাতারাতি খুলে বসছেন নানা কাগুজে কোম্পানি। এসব কোম্পানিকেই লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যখন এক কথায় বলা চলে, ব্যবসা-বাণিজ্যের খাতগুলোতে ক্ষমতাসীনরা আসলে ডাকাতিই করে বেড়াচ্ছেন।
যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে গলা ফাটিয়ে তারা ক্ষমতায় এসেছেন, সে দুর্নীতিও কি কমেছে সামান্য পরিমাণে? বিশিষ্ট কারো কারো প্রবাসী স্বজনসহ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী থেকে দলের নেতা-কর্মী পর্যন্ত এমন কোনো একজন ক্ষমতাধরের কথাও উল্লেখ করা যাবে না, ঘুষ না দিয়ে যার কাছ থেকে কোনো কাজ বের করে আনা সম্ভব। অর্থমন্ত্রীও নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, ঘুষ-দুর্নীতি প্রতিটি স্তরেই ছড়িয়ে পড়েছে। এভাবে শেয়ারবাজার থেকে শুরু করে পদ্মাসেতু পর্যন্ত খাত ও নাম ধরে ধরে পর্যালোচনা করলে অর্থমন্ত্রীকে কিন্তু লজ্জায় পড়তে হবে। আমরা মনে করি না যে, লাফিয়ে বেড়ে চলা পণ্যমূল্য, ক'দিন পর পর  জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বাড়ানোর মতো বিষয়গুলো পৃথকভাবে উল্লেখ করার প্রয়োজন রয়েছে। বস্তুত অর্থমন্ত্রীর বুঝতে না পারা এবং সমালোচনার জবাবে বরং পাল্টা এমন প্রশ্নই করা দরকার, তাদের সরকার কোন ক্ষেত্রে ঠিক কোন ধরনের সফলতা অর্জন করেছে, যার জন্য বিরোধিতার পরিবর্তে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে সাংবাদিকদের নৃত্য করতে হবে? সুতরাং কেবলই সমালোচনা করার এবং ট্রেনিং দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করার পরিবর্তে অর্থমন্ত্রীর উচিত সাংবাদিকদের সততার প্রতি সম্মান দেখানো। একথাও স্বীকার করা উচিত যে, বাংলাদেশের সাংবাদিকরা যথেষ্ট দায়িত্বশীল বলেই তার মতো ‘অতি যোগ্য' একজন ব্যক্তি এখনো অর্থমন্ত্রীর পদে বহাল থাকতে পারছেন। এটা ভারত বা জাপানের মতো কোনো দেশ হলে অনেক আগেই তাকে পদত্যাগ করে বিদায় নিতে হতো। এসব দেশের রাজনীতিক ও মন্ত্রীরা যেখানে সাংবাদিকদের রিপোর্টের প্রতি সম্মান দেখান আমাদের অর্থমন্ত্রী সেখানে লজ্জার মাথা খেয়ে উল্টো মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছেন। সব দোষ চাপাতে চাচ্ছেন সাংবাদিকদের ওপর। বেশি উদাহরণের ভিড়ে যাওয়ার পরিবর্তে আমরা মনে করি, অর্থমন্ত্রীর উচিত সাংবাদিকদের জন্য মায়াকান্না ছেড়ে অর্থনীতির অবশ্যম্ভাবী বিপদ কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা। জনাব মুহিত যা কিছুই বোঝাতে চান না কেন, তাদের তথা আওয়ামী লীগ সরকারের সব্যব্যাপী ব্যর্থতা এবং ক্ষতিকর নীতি ও দুর্নীতির কারণে দেশের অর্থনীতি মারাত্মক ঝুঁকি ও বিপদের মধ্যে রয়েছে। এই ঝুঁকি কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারে সাংবাদিকরাই বরং অর্থমন্ত্রীকে জ্ঞান না হলেও সঠিক পরামর্শ দিতে পারেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads