রবিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১২

‘তত্ত্বাবধায়ক’ আন্দোলন : অতীত বর্তমান


কাজী সাইদ

সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী যুক্ত করার বিল পাশের পর বর্তমান ১৮ দলীয় জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ৩০ জুন ২০১১ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংক্রান্ত ৫৮ (ক) এবং ২ (ক) পরিচ্ছেদ বিলুপ্ত করে দলীয় সরকারের অধীনে প্রহসনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ উন্মুক্ত করা হয়েছে।’ তিনি আরো বলেছিলেন, ‘এই সংশোধনীর মাধ্যমে জাতীয় সংসদের আগামী নির্বাচন মতায় থেকে করার অসৎ উদ্দেশ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা তুলে দিয়ে তথাকথিত অন্তর্বর্তী সরকার নামে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভা ও সংসদ বহাল রেখে  দলীয় সরকারের অধীনে প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়ার যে হীন উদ্যোগ নেয়া হলো তাতে দেশবাসী গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এর মাধ্যমে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপে ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের সব সম্ভাবনা তিরোহিত হলো। এ অপচেষ্টায় দেশের সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠল। গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ পন্থায় মতা হস্তান্তরের সব পথ রুদ্ধ হয়ে গেল।’ হঠাৎ প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) একটি সংপ্তি রায়ের ওপর ভিত্তি করে তাড়াহুড়ো করে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা উচ্ছেদ করা হলো। বিচারপতি হক তার রায়ে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থাকে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বললেও এ ব্যবস্থা পরবর্তী আরো দু’টি সংসদ নির্বাচনে থাকতে পারে বলে তার সংপ্তি রায়ে উল্লেখ করেছিলেন। অবশ্য এই বিষয়ে জাতীয় সংসদের ইচ্ছা অনিচ্ছার ওপর তিনি বিষয়টি ছেড়ে দিয়েছিলেন। দেশের কোনো প্রান্ত থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের দাবি কোনো ব্যক্তি, দল, সংগঠন থেকে কখনো উচ্চারিত হতে শোনা যায়নি। তাহলে কেন এ আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে গেল মতাসীন দল?
 আনন্দবাজারের প্রতিবেদন
২০ জানুয়ারি ২০১২ কলকাতার প্রভাবশালী দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘ষড়যন্ত্র হলে হাসিনার পাশেই থাকবে দিল্লি’Ñ এ শিরোনামে বাংলাদেশে তথাকথিত এক সেনা অভ্যুত্থানের খবর দিয়ে লেখা হয় ‘মতা থেকে অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শেখ হাসিনাকে সরানোর চেষ্টা হলে, তাকে সবরকম সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। বাংলাদেশ সরকারকেও সেই বার্তা দেয়া হয়েছে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘দুই দেশের গোয়েন্দাই রিপোর্ট দিয়েছেন, এই ল্েয হিযবুত তাহরীর, জামায়াতে ইসলামী ও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এক জোট হয়ে কাজ করছে। গোটা ঘটনার মাথা হিসেবে উঠে আসছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানের নামও।’ বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে নয়াদিল্লি ‘চিন্তায়’ রয়েছে উল্লেখ করে আনন্দবাজার লিখেছে, ‘সাধারণ নির্বাচন এখনো অনেক দেরি। ভারতের সাথে বাংলাদেশের অনেক প্রকল্প প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। ঢাকাকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ দেয়া হয়েছে। তিস্তা নিয়ে জট ছাড়ানোর পাশাপাশি বাংলাদেশের মধ্যে পরিবহন চালু করার চেষ্টাও চলছে। এ পরিস্থিতিতে হাসিনা সরকারের কর্তৃত্ব যাতে কোনোভাবেই দুর্বল না হয়ে যায়, তার জন্য স্পষ্ট ও কড়া অবস্থান নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং।’ (২১ জানুয়ারি ২০১২, বিডিনিউজ ২৪.কম)
 আন্দোলনের মডিউল
বিরোধী দলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি উপো করে ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্র“য়ারি বিএনপি মতায় থেকে নির্বাচন করেছিল। সেই নির্বাচনে তিনটি প্রধান দল আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি এবং বাম দলগুলো শুধু যে অংশগ্রহণ থেকে বিরত ছিল তা নয়, নির্বাচন হতে না দেয়ার জন্য সর্বাত্মক জ্বালাও পোড়াওয়ে অংশ নিয়েছিল। সারা দেশ লাগাতার হরতাল, অবরোধ, বিােভে ছিল উন্মাতাল। নির্বাচনের দিন জারি করা হয়েছিল গণকারফিউ। দেশের বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের ভোটদানে প্রকাশ্য বাধা দেয়া হয়েছিল, বুথ জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল, ভোটকেন্দ্রে ঢুকে লুট করা হয়েছিল ব্যালট পেপার, যা পরে আগুনে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল। পুলিং এজেন্ট, প্রিজাইডিং অফিসারদের শিকার হতে হয়েছিল গণধোলাইয়ের। ’৯১ থেকে ’৯৬-এর বিএনপির শাসন আমলে বিভিন্ন দাবিতে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এবং তাদের সমমনা দলগুলো  ১৭৩ দিন হরতাল ডেকে ছিল বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম দাবি করে আসছে। হরতাল অবরোধের ফাঁদে পড়া ’৯৬-এর ফেব্রুয়ারির ১৮ দিনের অচল বাংলাদেশের চিত্রটি ছিল এমন, ‘১৩ ফেব্র“য়ারি ছিল রাজপথ রেলপথ অবরোধ। বাস্তবে এক প্রকার হরতাল। পরের দুই দিন ১৪ এবং ১৫ ফেব্র“য়ারি সংসদ নির্বাচন ঠেকাতে হরতাল। এর মধ্যে দ্বিতীয় দিন ছিল ‘আওয়ামী লীগে’র গণকারফিউ। ১৬ তারিখ শুক্রবার। পরদিন শবেকদরের ছুটি। ১৮, ১৯ তারিখ খোলা নামমাত্র। কারণ ঈদের বাজার ও বাড়ি যাওয়া ২০ থেকে ২২ তারিখ ঈদের ছুটি। এর পর আর এক শুক্রবার, এবার তিন দিনের অসহযোগ ওরফে অবরোধ, মানে কড়া হরতাল। তা বেড়ে দাঁড়াল টানা পাঁচ দিনে। এবার বৃহস্পতিবার। অনেকের হাফ ছুটি। পরের দিন ফুল। অর্থাৎ একনাগাড়ে ১৮ দিন ছুটি ছুটি মৌজ।’
এক হরতালের দিন একজন বেসরকারি চাকুরেকে তার ছেলের বয়সী পিকেটারেরা দিগম্বর করেছিল। এরপর নাকি সরকারি দলের ছোকরারা বিরোধী দলের জনৈকা ওয়ার্ড কমিশনারকে আঁচল টেনে দিগম্বর করতে চেয়েছে। ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে দিগম্বর হয়েছিল অনেকেই যা বাংলাদেশের ইতিহাসে অভূতপূর্ব। অবশ্য এরা কেউ শখ করে বিবস্ত্র হননি, বলপূর্বক করা হয়েছিল বস্ত্রহরণ। প্রার্থীই শুধু নয়, বয়ঃবৃদ্ধ শিক প্রিজাইডিং হওয়ার অপরাধে তাকে বস্ত্রমুক্ত করা হয়েছিল। রংপুরের পীরগঞ্জেও নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ২০০ আনসার হয়েছিলেন গণদিগম্বর। নির্বাচনের পর সেই রংপুরেই একজন বিরোধীদলীয় নেতাকে পাল্টা দিগম্বর করা হয়। সবচেয়ে সেরা সংবাদ ছিল, ভোট দেয়ার দায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রকে আধাডজন ছাত্রী মিলে দিগম্বর করতে ঝটিকা হামলা করেছিল। এসব শুনে একজন নাগরিক তখন বলে উঠেছিলেন, ক) সন্ত্রাস দিগম্বর করেছে রাজনীতিকে  খ) দলীয়করণ দিগম্বর করেছে প্রশাসনকে  গ) নৈতিক অবয় দিগম্বর করেছে সমাজকে ঘ) একঘেয়েমি দিগম্বর করেছে বিএনপিকে ঙ) হরতাল দিগম্বর করেছে অর্থনীতিকে চ) একতরফা নির্বাচন দিগম্বর করেছে ভোটাধিকারকে ছ) ঠুঁটো জগন্নাথগিরি দিগম্বর করেছে নির্বাচন কমিশনকে। সব মিলিয়ে পুরো বাংলাদেশটাই এখন দিগম্বর!
তৎকালীন বিরোধী দলের হুঙ্কার-হামলা, দিগম্বরাতঙ্ক, গালি ও গুলির মধ্য দিয়ে ১৫ ফেব্র“য়ারি যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সে সংসদের মেয়াদ ছিল প্রায় ছয় মাস। একই বছরের জুনে ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ঘটে মতার পালাবদল। কালের পরিক্রমায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে পুনঃস্থাপনে সরকারকে বাধ্য করতে বিােভ, সমাবেশ, গণসংযোগের মতো শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে আসছে বর্তমান বিরোধী ১৮ দলীয় জোট।
ইতোমধ্যে ১৮ দলীয় জোটের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল জামায়াতে ইসলামী সরকারের বদনজরে পড়েছে। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত এ দলটিকে নির্মূল করতে দীর্ঘ দিন সরকার তার পেশিশক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার করে চলেছে। যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে আখ্যা দিয়ে এ দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সারা দেশে গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তাদের শীর্ষ নেতাদের ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচার করে চলতি ডিসেম্বরের মধ্যে কয়েকজনের রায় আশা করছেন খোদ আইনমন্ত্রী, আইন প্রতিমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা। ইকোনোমিস্ট সেই তথ্য ফাঁসও করে দিয়েছে।
 সংঘাত কি অনিবার্য?
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা সংবিধানে পুনঃস্থাপিত না হলে আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে না বলেই ান্ত হয়নি; নির্বাচন হতে দেয়া হবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মতাসীন মহাজোট মতায় থেকে নির্বাচন করার ধনুকভাঙা পণ নিয়ে নির্বাচন প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ১৮ দলীয় জোটের প থেকে নানা কর্মসূচি ঘোষণা করা হচ্ছে। বিরোধী দলের কর্মসূচিগুলো ১৯৯৬-এর মতো রাজপথ উত্তপ্ত করে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। গতকালের অবরোধ সেই কথা নতুন করে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। সরকারকে দাবি মানানোর মতো তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার ওপর নির্ভর করছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভাগ্য। গত ২৮ নভেম্বর বেগম খালেদা জিয়া জনসভায় ইমার্জেন্সির যে সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন সে সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। আন্দোলন আরো তীব্রতর হলে তা দমনে সরকার ব্যর্থ হয়ে ইমার্জেন্সি দিয়ে মতাকে প্রলম্বিত করার ইতিহাস বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দাবিদার পার্শ্ববর্তী দেশেরই রয়েছে।
ইন্দিরা গান্ধী ২৫ জুন ১৯৭৫ সালে ভারতে জরুরি অবস্থা জারি করান, যা ২১ মার্চ ১৯৭৭ পর্যন্ত কার্যকর ছিল। প্রায় ২১ মাস মতা কাকে বলে তা ভারতবাসীকে দেখিয়ে দেন। পরে নির্বাচনে জনগণ কংগ্রেসকে প্রত্যাখ্যান করে। ইন্দিরার সেই দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর শিখদের শান্ত করতে ইন্দিরা শিরোমণি আকালী দলের নেতা শান্ত হরচরণ সিং লাংগোয়ালের সাথে চুক্তি করে পাঞ্জাব রাজ্যসভার ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে চেষ্টা করেছিলেন। লাংগোয়াল ইন্দিরার আমন্ত্রণপত্র প্রত্যাখ্যান করে সাংবাদিকদের সাথে এক সাাৎকারে বলেছিলেন, “The question before us is not whether Indira Gandhi should continue to be prime minister or not. The point is whether democracy in this country is to survive or not. The democratic structure stands on three pillars, namely strong opposition, independent judiciary and free press.” অর্থাৎ, ‘ইন্দিরা গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্ব দীর্ঘায়িত হবে কি না তা আমাদের সামনে প্রশ্ন নয়। বিবেচ্য হচ্ছে, এ দেশে গণতন্ত্র টিকবে কি টিকবে না। গণতন্ত্রের কাঠামো তিনটি স্তম্ভের ওপর দণ্ডায়মান যেমন : শাক্তিশালী বিরোধী দল, নিরপে বিচারব্যবস্থা এবং মুক্ত সংবাদমাধ্যম।’
ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি করে নির্বাচন স্থগিত রাখলেও সংসদ কার্যকর রেখে ভারতীয় সংবিধানের ৩৮, ৩৯, ৪০, ৪১ ও ৪২তমÑ এ পাঁচটি সংশোধনী এনেছিলেন। পরবর্তী নির্বাচনে নির্বাচিত সরকার তার এ সব গণবিরোধী সংশোধনীর বেশির ভাগই বাতিল করে দেয়।
বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে এখন কালোমেঘ ঘনীভূত হচ্ছে। বিদ্বান দুর্জনেরা এবং মতার মৌচাকের চারপাশে ঘুরঘুর করা মৌ-লোভীরা ছাড়া রাজনীতিসচেতন নির্লোভ জনগণ তেমনটিই আশঙ্কা করছেন। মতাসীনরা মতায় থেকে নির্বাচন করে পুনরায় মতায় যাওয়ার সোজাসাপটা পথ থেকে বিরত না হলে দেশে সঙ্ঘাত অনিবার্য। এ সঙ্ঘাতের ফলে রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতছাড়া হয়ে গেলে সবচেয়ে বেশি তিগ্রস্ত হবেন রাজনীতিবিদেরাই। দেশ এবং দেশের জনগণের ললাটেও নেমে আসবে দুর্যোগের ঘনঘটা। গতকালের ১৮ দলীয় জোটের ৮ ঘণ্টার অবরোধ ও সরকারি বাড়াবাড়ি সেই সত্য আরো বেশি স্পষ্ট করল।
kazi_sayed@yahoo.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads