শুক্রবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১২

নির্মাণের আগেই ভেসে যাচ্ছে পদ্মা সেতু



 আশা জাগানিয়া বলে একটা কথা রয়েছে। ক'দিন আগে এই আশা জাগানিয়ার কাজটি করেছিল বিশ্বব্যাংক। সরকার এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের সদিচ্ছার ব্যাপারে সঙ্গত কারণে যথেষ্ট সংশয় থাকা সত্ত্বেও বিশ্বব্যাংক তার আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দলকে ঢাকায় পাঠিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক ঘুষ-দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত রথি-মহারথিদের বিরুদ্ধে সত্যিই ব্যবস্থা নেয়া হয় কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা। তিন সদস্যের প্রতিনিধি দলের এটা ছিল দ্বিতীয় সফর। তথ্যাভিজ্ঞরা জানিয়েছেন, দলটির উদ্দেশ্যে কোনো অসততা ছিল না। সরকার এবং দুদক যদি তাদের দাবি ও পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে সম্মত হতো তাহলেই তারা বিশ্বব্যাংকের কাছে বাতিল করা ঋণচুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সুপারিশ করতেন। প্রতিনিধিদের মধ্যে তেমন মনোভাব দেখাও গিয়েছিল। কিন্তু যাকে বলে আওয়ামী লীগ সরকার! তার ওপর বিষয়টি দেখাশোনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সেই দুদককে, যে প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবল আপত্তি ও বিরোধিতা রয়েছে। তথ্য-প্রমাণসহ বহু উপলক্ষেই অভিযোগ করা হয়েছে, দুদক না-কি সরকারের ইঙ্গিতের বাইরে এক ইঞ্চি পরিমাণও পা বাড়ায় না। আরো সহজ কথায়, নামে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হলেও দুদক সব সময় সরকারের ইচ্ছাই পূরণ করে থাকে। ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো প্রত্যাহারের পাশাপাশি বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীদের ওপর নতুন নতুন মামলা চাপানোর মাধ্যমে দুদক নিজেও অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ করেছে। পক্ষপাতিত্বের সে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে এখনো।
এটা ভিন্ন প্রসঙ্গ হলেও বর্তমান পর্যায়ে কথা উঠেছে এজন্য যে, বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধি দলের সর্বশেষ সফরের সময়ও দেখা গেছে, দুদক সর্বতোভাবে ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছাই পূরণ করেছে। বিপত্তিও ঘটেছে একই কারণে। গত ৫ ডিসেম্বর প্রতিনিধিদলটি ফিরে গেছে প্রচন্ড অসন্তোষ নিয়ে। দৈনিক সংগ্রামসহ বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এবং প্রধানমন্ত্রীর এক আত্মীয়সহ চিহ্নিত তিনজনকে দুর্নীতির মামলায় আসামী করার প্রশ্নে প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দুদকের তীব্র মতপার্থক্য ঘটেছে। দুদক অবুল হোসেনদের আসামী করতে রাজি হয়নি। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা তথ্য-প্রমাণ সহযোগে দেখিয়েছেন, ওই তিনজনই ঘুষ-দুর্নীতির সমগ্র প্রক্রিয়ায় প্রধান নটরাজের ভূমিকা পালন করেছেন। সুতরাং তাদের আসামী করতেই হবে। কিন্তু গোপন নির্দেশ যেহেতু এসেছে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সেহেতু দুদকের পক্ষে এদিক-সেদিক করা সম্ভব হয়নি। আবুল হোসেনসহ তিনজনের ব্যাপারে দুদক শেষ পর্যন্তও ঘাড় বাঁকিয়েই রেখেছে। শুধু তা-ই নয়, আবুল হোসেনদের ছাড় দেয়ার পাশাপাশি দুদকের কর্তাব্যক্তিরা নাকি বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধিদের আইন সম্পর্কেও জ্ঞান দেয়ার চেষ্টা করেছেন। এর ফলে দুনিয়া ভেজে খাওয়া ঝানু প্রতিনিধিরা ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত হয়েছেন এবং আলোচনা ভেঙে গেছে। ওই পর্যায়ে বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধি দল অর্থমন্ত্রীর মধ্যস্থতা চেয়েছিল। সে অনুযায়ী সন্ধ্যায় অর্থমন্ত্রীর বাসভবনে বৈঠক অনুষ্ঠিতও হয়েছে। সেখানে আবার প্রশ্নসাপেক্ষ কারণে প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা গওহর রিজভী গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। ঠিক কোন ধরনের আলোচনা হয়েছে সে বিষয়ে জানা না গেলেও এটুকু অন্তত প্রকাশিত হয়ে পড়েছে যে, বৈঠক সফল হয়নি। অর্থ উপদেষ্টা অর্থমন্ত্রীর দিকে আঙুল তুলেছেন, অন্যদিকে অর্থমন্ত্রী ‘নো কমেন্ট' বলে পাশ কাটিয়ে গেছেন। বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা কিন্তু সরাসরিই বলেছেন, ‘আর কিছু বলার নেই, আমরা বিমানবন্দরে যাচ্ছি'।
এ শুধু কথার কথা ছিল না। বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা সত্যি সত্যি সোজা বিমানবন্দরে চলে গেছেন। সেখান থেকে চলে গেছেন বাংলাদেশ ছেড়ে। যাওয়ার আগে তারা নিজেদের অসন্তোষের কথা গলা ঝেড়েই জানান দিয়ে গেছেন। দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান অবশ্য অসন্তোষের কথাটা স্বীকার করতে চাননি। তিনি বলেছেন, দুর্নীত সংক্রান্ত রিপোর্টের পুনর্মূল্যায়নে দুদকের আরো কিছুদিন সময় লাগবে। এই সময়ের জন্য ‘মহাভারত' না-কি ‘অশুদ্ধ' হয়ে যাবে না বলেও ভাষার মারপ্যাঁচ খাটিয়েছেন দুদক চেয়ারম্যান। কিন্তু বিশ্ব্যাংকের প্রতিনিধিরা হিন্দুদের মহাভারতের ব্যাপারে সামান্য আগ্রহও দেখাননি। দুদকের চেয়ারম্যান তো বটেই, অর্থমন্ত্রী এবং অর্থ উপদেষ্টাসহ সরকারের জাদরেল ব্যক্তিরাও চেষ্টা করে দেখেছেন। কিন্তু প্রতিনিধিদলকে আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে আনতে এবং বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাওয়া থেকে নিবৃত্ত করতে পারেননি। পরিষ্কার বোঝা গেছে, পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক দুর্নীতি এতটাই মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, বিষয়টি আর মহাভারতের ‘শুদ্ধ' হওয়া-না হওয়ার পর্যায়ে আটকে নেই। পর্যবেক্ষকরা বরং দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের নিজের মন্তব্য উল্লেখ করেই পাল্টা মন্তব্য করেছেন, ‘ডালমে' আসলেও ‘কুছ কালা হ্যায়'! না হলে আবুল হোসেনদের বাঁচানোর জন্য এত চেষ্টা কেন করা হবে এবং বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধিদেরই বা কেন ‘আর কিছু বলার' থাকবে না? উল্লেখ্য, রাজনৈতিক কারণে দুদকের চেয়ারম্যান বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিরোধের কথাটা অস্বীকার করলেও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ৬ ডিসেম্বর বলেছেন, মতবিরোধ হয়েছিল। আর সে কারণেই প্রতিনিধিরা চলে গেছেন।
পদ্মা সেতুর সম্ভাবনা নিয়ে নতুন পর্যায়ে আলোচনাও শুরু হয়েছে একযোগে। বলা হচ্ছে, সরকারের পাশাপাশি দুদকের কর্তারা যতো গাল ফুলিয়েই বোঝাতে ও আশ্বস্ত করতে চান না কেন বাস্তবে বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধিরা চলে যাওয়ার সাথে সাথে পদ্মা সেতুও হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। বিষয়টিকে আর ঝুলে যাওয়া বলা যাচ্ছে না, বরং বলতে হয়, তৈরি হওয়ার আগেই ডুবে গেছে পদ্মা সেতু। সেতুটি নির্মাণের সম্ভাবনাও অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। পরিস্থিতি কেন এমন পর্যায়ে এসেছে সে সম্পর্কে সম্ভবত বিস্তারিত বলার অপেক্ষা রাখে না। তা সত্ত্বেও রেকর্ড রাখার প্রয়োজনে কিছু তথ্যের উল্লেখ করা দরকার। পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে, পদ্মা সেতু নিয়ে ঘুষ-দুর্নীতির যে অভিযোগ বিশ্বব্যাংক প্রথম থেকে তুলে এসেছে এবং ঘুষ-দুর্নীতির যে অভিযোগে শেষ পর্যন্ত ঋণচুক্তিও বাতিল করেছে সেসবের প্রতিটির সঙ্গে জড়িত রয়েছে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের নাম। যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে তিনিই পদ্মা সেতু প্রকল্পের দায়িত্বে ছিলেন। মন্ত্রীর সঙ্গে উঠে এসেছিল কানাডীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের নামও। বলা হয়েছিল, এসএনসি-লাভালিনের অভিযুক্ত দু'জন কর্মকর্তার কাছ থেকে জানা গেছে, মন্ত্রী ও যোগাযোগ সচিবসহ তিনজন ১০ শতাংশ হারে ঘুষ দাবি করেছিলেন এবং এসএনসি-লাভালিনও ঘুষ দিতে সম্মত হয়েছিল। এ ব্যাপারে মধ্যস্থতা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর এক মরহুম ফুফাত ভাইয়ের ছেলে। ওয়াশিংটন, লন্ডন ও টরন্টোতে বসবাসরত বিশিষ্ট আরো জনাকয়েকের নামও প্রকাশিত হয়েছিল। তাদের সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারেও তদন্ত করেছিল বিশ্বব্যাংক। তদন্তে ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ শুধু নয়, আবুল হোসেনসহ কয়েকজনের সংশ্লিষ্টতার বিষয়েও প্রমাণ পেয়েছিল বিশ্বব্যাংক। এসব বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সরকারকে তাগিদ দিয়েছিল সংস্থাটি। বিশ্বব্যাংক একই সাথে মন্ত্রী আবুল হোসেনের পাসপোর্ট ও ব্যাংক হিসাবও জব্দ করতে বলেছিল। আবুল হোসেন সদলবলেই ঘুষ-দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন বলে তথ্য-প্রমাণ পেয়েছিল বিশ্বব্যাংক। উইকিলিকসের তথ্যেও প্রথমে অবুল হোসেনের নামই এসেছিল। ‘উইকিলিকস' জানিয়েছিল, মন্ত্রী আবুল হোসেনের ‘সততায় ঘাটতি আছে'।
অন্যদিকে সরকারের ভূমিকা শুধু রহস্যজনক নয়, ছিল কৌতূহলোদ্দীপকও। বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ অস্বীকার করলেও সরকার আবুল হোসেনকে যোগাযোগমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল। এটা ২০১১ সালের ৫ নবেম্বরের ঘটনা। ঘটনাপ্রবাহের ওই পর্যায়ে ক্ষমতাসীনরা বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে অনেকাংশে যুদ্ধই ঘোষণা করেছিলেন! সুদূর লন্ডনে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী জানতে চেয়েছিলেন, টাকাই যেখানে আসেনি সেখানে ঘুষ খাওয়ার এবং দুর্নীতি করার প্রশ্ন আসে কিভাবে? প্রশ্নটি করার সময় প্রধানমন্ত্রী কিন্তু একটি সত্য না বোঝার ভান করেছিলেন। সরকার প্রধান হিসেবে তার অবশ্যই ভালোভাবে জানার কথা যে, ঘুষের বাণিজ্যে ‘সমঝোতা' ও ‘আয়োজন' ধরনের কিছু কথা আছে এবং ‘সমঝোতা' হলে সবই আগাম বা নগদে দিতে হয় না বরং ‘আয়োজন' অনুযায়ী পরবর্তী সময়ে দেয়ার ব্যবস্থা থাকে। বিশ্বব্যাংক সে ধরনের কিছু তথ্য-প্রমাণই পেয়েছিল। কিন্তু অভিযুক্তদের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার ধারেকাছে না গিয়ে প্রধানমন্ত্রী উল্টো তাদের পক্ষেই সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন। ঘোষণা করেছিলেন, সৈয়দ আবুল হোসেন না-কি ‘প্রকৃত দেশপ্রেমিক'! এদিকে সরকারের পাশাপাশি দুদকও জনগণকে স্তম্ভিত করেছিল। তদন্তের নামে শোরগোল তুললেও এক সপ্তাহের মধ্যেই আবুল হোসেনকে সততার সার্টিফিকেট দিয়েছিল দুদক। দুদকের চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছিলেন, ১০ শতাংশ হারে ঘুষ চাওয়ার ব্যাপারটিতে না-কি হিসাবের ‘গরমিল' রয়েছে! অর্থাৎ ঘুষের অভিযোগ সঠিক হলেও ভুল আছে শতকরা হারের হিসাবে! এসবের ফলে বুঝতে অসুবিধা হয়নি, বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর স্বজনসহ ‘প্রভাবশালী' অনেকের নাম এসেছিল সে কারণে দুদকের পক্ষে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে না। সরকার নিজে তো কোনো ব্যবস্থা নেবেই না। ব্যবস্থা সরকার আসলেও নেয়নি।
এত কিছু করেও সরকার অবশ্য রেহাই পায়নি। কারণ, গত বছর দুই দফায় বিশ্বব্যাংক সরকারের কাছে দুর্নীতির প্রমাণ দিয়েছিল, এসবের ভিত্তিতে চারটি ব্যবস্থা নেয়ারও দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু সরকারের জবাব ‘সন্তোষজনক' ছিল না। কোনো পদক্ষেপও নেয়নি সরকার। সে কারণে বিশ্বব্যাংকের পক্ষেও ‘চোখ বুজে থাকা' সম্ভব হয়নি। গত বছরের অর্থাৎ ২০১১ সালের ৩০ জুন সংস্থাটি ঋণচুক্তিই বাতিল করে দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক শুধু পদ্মা সেতু চুক্তি বাতিল করেনি, ৩০ জুনের বিবৃতিতে সিদ্ধান্তের কারণ হিসেবে পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক দুর্নীতি এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারে মহাজোট সরকারের অসহযোগিতারও উল্লেখ করেছিল। বলেছিল, বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তা ও ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ‘উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতিমূলক ষড়যন্ত্র' সম্পর্কে বিভিন্ন উৎস থেকে ‘বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-প্রমাণ' পাওয়া গেছে। তখন থেকেই বিশ্বব্যাংকের চিঠিগুলো এবং রিপোর্ট দুটি প্রকাশ করার জোর দাবি উঠেছে। বলা হয়েছে, প্রকাশ করা হলে জনগণ জানতে পারবে, কোন পক্ষ আসলে দায়ী- বিশ্বব্যাংক না ক্ষমতাসীনরা? জনগণ আরো জানতে পারবে, বিশ্বব্যাংকের আহবান সত্ত্বেও সরকার কেন দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়নি, সরকারের প্রতিক্রিয়া ও জবাব কেন বিশ্বব্যাংকের জন্য ‘সন্তোষজনক' ছিল না এবং বিশ্বব্যাংকের পক্ষে কেন  ‘চোখ বুজে থাকা' সম্ভব হয়নি? খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, চুক্তি বাতিল করার পর মুহূর্ত থেকে বিশ্বব্যাংককে তুলোধুনো করলেও ক্ষমতাসীনরা কিন্তু অভিযোগের যুৎসই জবাব দিতে পারেননি। পরিবর্তে বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন ক্ষমতাসীনরা। সব দোষই তারা বিশ্বব্যাংকের ওপর চাপিয়েছেন। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা শুধু নন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। ঘটনাপ্রবাহের সে পর্যায়েই এসেছিল ‘চমক' দেখানোর পালা। লম্বা অনেক বাগাড়ম্বর করার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হঠাৎ ‘নিজেদের অর্থে' পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়ে বসেছিলেন। বলেছিলেন, তারা আর কারো কাছে ভিক্ষা চাইবেন না- যার অর্থ, এতদিন ভিক্ষা চাইতেই বিশ্বব্যাংকের কাছে ধরণা দিচ্ছিলেন তারা! ‘নিজেদের অর্থ' সংগ্রহের পন্থা সম্পর্কে জানাতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগকেও অর্থ সংগ্রহের হুকুম দিয়েছিলেন। সে হুকুম পালনের জন্য দেশজুড়ে শুরু হয়েছিল চাঁদাবাজি। ‘নিজেদের অর্থে' পদ্মা সেতু নির্মাণের কর্মকান্ডে এরপর ছিল সরকারি-বেসরকারি চারিজীবীদের বেতন ও উৎসব ভাতা কেটে নেয়া, মোবাইল ও বিদুৎ বিলসহ প্রতিটি পণ্যের ওপর বাড়তি কর বসানো পর্যন্ত জনগণের পকেট কেটে নেয়ার নানা পন্থা। বিপুল সে  অর্থের কিছুটা যেতো নেতা-কর্মীদের পকেটে, বাকিটা দিয়ে দলের নির্বাচনী তহবিল বানাতেন ক্ষমতাসীনরা। এখানে মূলত ছিল নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করার কৌশল। এজন্যই তারা বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম সরদারের মতো হওয়ায় তরবারি ঘুরিয়েছিলেন।
অন্যদিকে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলো সরকারের বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সোচ্চার হয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়া সরাসরি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর ‘পরিবার' এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলেই সরকার চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করে চলেছে, যার ফলে দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত ও অসম্মানিত হতে হচ্ছে। অন্যদিকে শেখ হাসিনা তার ‘পরিবার' সদস্যদের সম্পর্কে সার্টিফিকেট দিতে গিয়ে বলেছিলেন, তার ‘পরিবার' বলতে তিনি নিজে, বোন রেহানা এবং দু'জনের পাঁচ সন্তানকে বোঝায়। কথাটা কিন্তু না বললেও চলতো। কারণ, এটুকু সবই জানেন। জনগণ যা জানে না তা হলো, তার বোন রেহানা এবং সুপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ও সুকন্যা পুতুলসহ পাঁচ সন্তানের কে ঠিক কোন ধরনের কাজ করেন অর্থাৎ তাদের আয় আসে কোত্থেকে? এমন প্রশ্নের কারণ, সবাই তারা বিদেশে থাকেন- কেউ লন্ডনে, কেউ ওয়াশিংটনে, কেউ কানাডার টরন্টোতে। শোনা যায়, প্রত্যেকে থাকেনও আবার বিপুল বিলাসিতার মধ্যে, তাদের বিত্ত-বৈভবও না-কি যথেষ্ট। প্রশ্ন উঠেছে, এত টাকা তারা পান কোথায়? তাদের কেউই তো না-কি এমন কোনো চাকরি বা ব্যবসা করেন না, যা থেকে এত বিপুল টাকার আয় আসতে পারে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এসব প্রশ্নের জবাব দেননি। অন্যদিকে দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞরা হিসাব কষে দেখিয়েছিলেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে গেলে লাভের চাইতে ক্ষতি হবে হাজার গুণ বেশি। বিশ্বব্যাংক যেখানে শতকরা মাত্র শূন্য দশমিক পাঁচ ভাগ সুদে ঋণ দিতে চেয়েছিল সেখানে পাঁচ শতাংশের কমে অন্য কোনো সংস্থা বা রাষ্ট্রের কাছেই ঋণ পাওয়া যাবে না। আর পাঁচ বা তার চেয়ে বেশি হারে সুদ গুণতে হলে পদ্মা সেতুকে মোটেও সম্ভাবনাময় বা ভায়াবল বলা যায় না। বিদেশী রাষ্ট্রদূতরাও বলেছছিলেন, সরকার যেভাবে প্রচারণা চালাচ্ছে তা দেখে মনে হচ্ছে, সেতু মির্মাণের মাধ্যমে জনগণের সেবা নিশ্চিত করা তাদের উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য আসলে চমক দেখানো। অর্থাৎ পদ্মা সেতুকে নিয়ে রাজনীতি করা। বস্তুত নানামুখী পর্যালোচনায়ও দেখা গেছে, অশিক্ষিত জনগণের সামনে গালগল্প শোনানো যাবে সত্য কিন্তু ‘নিজেদের অর্থে' আর যা কিছুই হোক পদ্মা সেতু অন্তত নির্মাণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু সব জেনে-বুঝেও ক্ষমতাসীনরা সহজে তাদের প্রচারণা থামাতে চাননি।
অবস্থান অবশ্য কিছুদিনের মধ্যেই পাল্টাতে হয়েছিল। প্রথমে বিদায় নিয়েছিলেন সৈয়দ আবুল হোসেন। তারপর এসেছিল প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের পালা। বিশ্বব্যাংককে সন্তুষ্ট করার জন্য তাকে ছুটি নিতে হয়েছিল। এই দু'জনের পাশাপাশি সাবেক যোগাযোগ সচিব ও প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সরিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীনরা প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিয়েছেন যে, দুর্নীতি আসলেও হচ্ছিল। ঠিক এ পর্যন্ত এসেই নিজেদের ফাঁদে আটকে গিয়েছিলেন ক্ষমতাসীনরা। কারণ, বিশ্বব্যাংক শুধু ওই ক'জনের কথাই বলেনি, বলেছিল আরো অনেকের কথাও- যারা ‘উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতিমূলক ষড়যন্ত্র' করেছিল। তারা কারা- সে প্রশ্নও উঠেছিল। এতদিনে এসে এসব বিষয়েই পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। বিষয়টিকে আরো পরিষ্কার করে গেছে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দল- যারা নিজেদের অসন্তোষের কথা জানাতে কার্পণ্য করেননি। বলা দরকার, এর মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাংক শুধু তীরের কাছাকাছি এসে নৌকাই ডুবিয়ে দেয়নি, রাজনৈতিক অর্থে সরকারকে থাপ্পড়ও কষেই মেরেছে। জনগণের নাকের সামনে বহুদিন ধরে এই একটি মাত্র মুলা ঝুলিয়ে রেখেছিলেন ক্ষমতাসীনরা। তাছাড়া টাকার পরিমাণও তো সামান্য নয়- ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দেয়ার চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। মে ও জুন মাসে চুক্তি হয়েছিল আইডিবি, এডিবি ও জাইকার সঙ্গে। সব মিলিয়ে ঋণ পাওয়া যেতো তিনশ' কোটি মার্কিন ডলারের মতো। বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। পদ্মা সেতু নির্মাণের পরও বিপুল পরিমাণ অর্থ বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। সে সম্ভাবনা তো নস্যাৎ হয়েছেই, পাশাপাশি দেশ ও জাতির গায়ে কলংকের বিরাট একটা তিলকও লেগেছে। গোটা জাতি অসম্মানিত হলেও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষোভের কারণ, তার কেবল সিঁদুর ও চন্দনের তিলক লাগানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে। দুর্নীতির- তাও এত বড় দুর্নীতির তিলক তার জন্য হজম করা কঠিনই হওয়ার কথা! কিন্তু সেটাই লাগিয়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধি দলের চলে যাওয়া এবং বিশ্বব্যাংকের চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্য প্রচন্ড অসম্মান হিসেবেই এসেছে। এমন দুর্নাম জাতির ভবিষ্যতের জন্য শুধু ভয়ঙ্করই নয়, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দৃষ্টিকোণ থেকেও অতি ধ্বংসাত্মক। যেহেতু বিশ্বব্যাংকসহ দাতা সংস্থা ও রাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় বলে সরকার মনে করে, সেহেতু ক্ষমতাসীনদের উচিত বিশ্বব্যাংকের অসন্তোষ দূর করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠা। সে সুযোগও বিশ্বব্যাংকই নতুন করে দিয়েছে। প্রতিনিধি দল চলে যাওয়ার পর ৬ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাংক তদন্ত রিপোর্ট জনসম্মুখে প্রকাশ করতে বলেছে। সত্যি পদ্মা সেতু নির্মাণ করার সদিচ্ছা থাকলে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে সরকারের উচিত বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ, দুটি রিপোর্ট এবং দুদকের তদন্ত রিপোর্টসহ প্রকৃত সকল ঘটনা প্রকাশ করা। দুর্নীতিতে জড়িত হিসেবে বিশ্বব্যাংক যাদের নাম বলেছে তারা কারা- সে পরিচিতিও প্রকাশ করতে হবে। অভিযুক্তদের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কারো স্বজন ও ঘনিষ্ঠজনেরা রয়েছেন কিনা তা যেমন জানানো দরকার তেমনি দরকার অন্য একটি জিজ্ঞাসারও জবাব দেয়া- বিশ্বব্যাংক কেন ‘উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতিমূলক ষড়যন্ত্র' কথাটা বলেছিল? এসবের জবাব না দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও তার সঙ্গি-সাথীরা যদি নতুন পর্যায়েও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে তিক্ততা বাড়াতে থাকেন তাহলে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যাবে না। প্রধানমন্ত্রীকে বুঝতে হবে, তাদের দুর্নীতির কারণে মাটিতে মিশে যাওয়া দেশের মর্যাদা ফিরিয়ে আনা না গেলে জাতিকেই শুধু মাথা নিচু করে থাকতে হবে না, অর্থনীতিও সর্বাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads