বৃহস্পতিবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১২

খালেদা জিয়ার গণসংযোগ : জনগণের ভাষা বোঝার চেষ্টা করুন




বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া আরও একবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ২৬ ডিসেম্বর দিনভর গণসংযোগ করার সময় রাজধানীর পৃথক পাঁচটি পথসভায় তিনি বলেছেন, এজন্য ক্ষমতাসীনরা যদি সংবিধানে সংশোধনী আনতে সম্মত হন তাহলে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা সংসদ অধিবেশনে যোগ দেবেন। তত্ত্বাবধায়ক তথা নির্দলীয় সরকার ছাড়া দলীয় কোনো সরকারের অধীনে যে নির্বাচন হতে দেয়া হবে না সে ঘোষণারও পুনরাবৃত্তি করেছেন খালেদা জিয়া। তিনি সেই সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের অপপ্রচারের জবাবে বলেছেন, তাদের আন্দোলন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য। কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর বা ওই বিচারকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য নয়—যেমনটি ক্ষমতাসীনরা বলে বেড়াচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে কিছু কথা জুড়েও দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, বিচার করতে হবে প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের এবং সমগ্র সে বিচার প্রক্রিয়া হতে হবে সুষ্ঠু ও প্রভাবমুক্ত। প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে যেসব যুদ্ধাপরাধী রয়েছেন তাদেরও বিচার করার দাবি জানিয়েছেন খালেদা জিয়া। বলেছেন, বিচারের নামে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা চলবে না। সর্বাত্মক দুর্নীতির পাশাপাশি রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের দলীয়করণ কর্মকাণ্ডের তীব্র সমালোচনা করে তিনি বলেছেন, জনগণের শেষ ভরসার স্থল বিচার বিভাগকেও তারা ইচ্ছাধীন করে ফেলেছেন। দলীয় বিবেচনায় নিযুক্তি দেয়া হচ্ছে বলে বিচারকরাও ক্ষমতাসীনদের নির্দেশ অনুযায়ী রায় দিতে বাধ্য হচ্ছেন। প্রসঙ্গক্রমে দৈনিক আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে অন্যায়ভাবে হয়রানি করার নিন্দা জানিয়েছেন খালেদা জিয়া। বলেছেন, দেশদ্রোহী নন—মাহমুদুর রহমান বরং সাচ্চা একজন দেশপ্রেমিক।
প্রধানমন্ত্রীর ছেলে ও আত্মীয়-স্বজনদের ঘুষ-দুর্নীতি থেকে শুরু করে দ্রুত বেড়ে চলা পণ্যমূল্য এবং হত্যা, গুম, গ্রেফতার, মামলা ও দমন-নির্যাতন পর্যন্ত আরও অনেক বিষয়েই বলেছেন বিরোধী দলের নেত্রী। জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে হরতালের ঘোষণাও দিয়েছেন তিনি। কিন্তু তার বক্তৃতায় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে তত্ত্বাবধায়ক তথা নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিটি। এই দাবির প্রতি নিরঙ্কুশ জনগণেরও যে ব্যাপক সমর্থন রয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে গণসংযোগের সময়। সেদিন রাজধানী প্রকৃতপক্ষে মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়েছিল। পথসভাগুলোতে লাখ লাখ মানুষ গিয়েছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে। বলা দরকার, জনসমর্থনের পাশাপাশি সংবিধানসম্মত আইনের ব্যাখ্যাতেও খালেদা জিয়ার দাবিই সঠিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কারণ, পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে দেয়া উচ্চ আদালতের যে রায়ের ‘আলোকে’ ক্ষমতাসীনরা সংবিধানে নিজেদের ইচ্ছেমত পঞ্চদশ সংশোধনী জুড়ে দিয়েছেন, সে রায়টি প্রথম থেকে শুধু বিতর্কিতই হয়নি, গ্রহণযোগ্যও হয়নি। এর কারণ, আদালত শুধু ব্যাখ্যাই দিতে পারে কিন্তু সংশোধনীসহ সংবিধান সংক্রান্ত প্রতিটি বিষয়ে সম্পূর্ণ এখতিয়ার রয়েছে কেবল জাতীয় সংসদের। সেদিক থেকে জাতীয় সংসদে পাস হওয়া পঞ্চম সংশোধনী ছিল একটি ‘অ্যাক্ট অব পার্লামেন্ট’। সেটা বাতিল বা সংশোধন করার জন্যও দরকার ছিল আরেকটি ‘অ্যাক্ট অব পার্লামেন্ট’-এরই। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরা এমন এক রায়কে অজুহাত বানিয়েছেন, যে রায়ে একদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে, অন্যদিকে আবার একথাও বলা হয়েছে, ‘দেশের শান্তি স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে’ পরবর্তী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। আদালতের প্রতি সম্মান দেখানোর আদৌ ইচ্ছা থাকলে ক্ষমতাসীনরা রায়ের দ্বিতীয় অংশটিকেও বাস্তবায়ন করতেন। কিন্তু উদ্দেশ্যে অসততা রয়েছে বলেই তারা সোজা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছেন।
এদিকে ২৬ ডিসেম্বরের গণসংযোগের মধ্য দিয়েও পরিষ্কার হয়েছে, আদালতের দোহাই দিয়ে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী জুড়ে দেয়া থেকে নিজেদের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা স্থায়ী করার পরিকল্পনা পর্যন্ত ক্ষমতাসীনদের অপচেষ্টার প্রতি জনগণের মোটেও সমর্থন নেই। ফলে সরকার জোর করে নিজেদের ইচ্ছা চাপিয়ে দিতে চাইলে বিঘ্নিত হতে পারে ‘দেশের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা’—যে আশঙ্কা বিভক্ত ও বিতর্কিত রায়টিতেও ব্যক্ত করা হয়েছে। এজন্যই সরকারের উচিত সঙ্কট সৃষ্টি ও সংঘাতের পথে পা আর না বাড়িয়ে প্রথমত তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া এবং তারপর বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতায় আসা। গণসংযোগ উপলক্ষে খালেদা জিয়া নতুন পর্যায়ে সমঝোতার দরজা খুলে দিয়েছেন বলেই আমরা আশা করতে চাই, ক্ষমতাসীনরা জনগণের ভাষা ও মেজাজ বোঝার চেষ্টা করবেন এবং সুযোগটিকে কাজে লাগাবেন। না হলে রাজনৈতিক সঙ্কট ও সহিংসতার ফলে এমনকি গণতন্ত্রও আবার বাধাগ্রস্ত হতে পারে—যার জন্য সম্পূর্ণরূপে ক্ষমতাসীনরাই দায়ী থাকবেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads