মঙ্গলবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১২

বড় বেশি অশিক্ষার গ্রাস



 বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম লিখেছেন যে, দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে স্কাইপি সংলাপ প্রকাশের জন্য নোবেল পুরস্কার দেয়া হোক। আর তা যদি না পারা যায়, তাহলে তাকে দেয়া হোক, অন্ততপক্ষে স্বাধীনতা পুরস্কার। কাদের সিদ্দিকী ও আমি ১৯৬৮ সালে টাঙ্গাঈলের করটিয়ার সা'দত কলেজে কিছুকাল সহপাঠী ছিলাম বলে মনে পড়ে। কলেজে ঢুকেই আমি কাঁচা সমাজতন্ত্রের আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে মওলানা ভাসানীর রাজনীতি ও রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বাধীন ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম। দীঘল-দেহী কাদের সিদ্দিকীর বিষয়ে ১৯৬৮ সালে আমার তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। সামরিক বাহিনী থেকে ফিরে এসে তিনি সম্ভবত সা'দত কলেজে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছিলেন। বয়সে আমার চাইতে অবশ্যই বড় ছিলেন। ছাত্রলীগাররা তার প্রতি সমীহ নিয়ে কথা বলতো। তখন কি আর জানতাম যে, ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ করতে হবে এবং কাদের সিদ্দিকী সখিপুর থেকে তার বিরাট কাদেরিয়া বাহিনী গড়ে তুলবেন।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় আমি তুখোড় বক্তা হিসেবে ছাত্র ইউনিয়ন ও ন্যাপের বিভিন্ন সমাবেশে ঐ এলাকার গ্রাম-গঞ্জ চষে বেড়িয়েছি। মাঝেমধ্যে গ্রেফতার হয়ে দুইএকদিন জেলও খেটেছি। ১৯৬৯-এর আন্দোলনের সময় আমার নামে হুলিয়া হয়েছে জেনে করটিয়া ছেড়ে চট্টগ্রামে আমার চাচার কাছে চলে গিয়েছিলাম। লেখাপড়া বন্ধ। সারাদিন পাহাড়তলির এক লাইব্রেরীতে বসে পড়াশোনা করি। চাচার হোটেলে খাই। ব্যস। সে সময়ে আমি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বই পড়েছি। মাওসেতুং, ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন, কাল মার্কস, হেগেল, মওলানা ভাসানীর উপর লেখা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘ভাসানী যখন ইউরোপে' এবং তার আরও কিছু বই পড়ার সুযোগ পেয়েছি। পড়া ছাড়া আর কোনো কাজ ছিল না। সকালে নাস্তা করে চাচার বাসা থেকে বের হতাম। সোজা লাইব্রেরী। দুপুরে খেতে আসতাম। কোনোমতে নাকেমুখে কিছু গুঁজে দিয়ে আবারও লাইব্রেরী। দেশে কি ঘটছে খবর রাখি পত্রিকার মাধ্যমে। কারো সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল না।
১৯৬৯ সালে আমরা সা'দত কলেজের ছাত্ররা আইয়ূব খানের উন্নয়ন দশকের গাড়িবহরে আগুন দিয়েছিলাম। আমি জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনের পর পরই চট্টগ্রাম চলে গিয়েছিলাম। ঐ যে বললাম, পাহাড়তলির লাইব্রেরীতে পড়াশোনা, সেখানে আমি পড়লাম আবুল মনসুর আহমদের বই ‘পাক-বাংলার কালচার'। সে বইটি আমার চেতনার ধারা বদলে দিল। হঠাৎ করেই মনে হলো, আমি যতই পাকিস্তানী হই না কেন, বাংলাদেশের মানুষের আলাদা জাতিসত্তা আছে। প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে সেই জাতিসত্তার পরিচয়ও গড়ে উঠেছে। বিষয়টি ভালভাবে উপলব্ধি করার জন্য, আমার ধারণা, ঐ একই সময়ে পাক-বাংলার কালচার বইটি আমি আদ্যোপান্ত তিনবার পড়েছি এবং তা আমার হৃদয়ে গ্রথিত হয়ে গেল। আমি অনেকখানি নিশ্চিত হলাম যে, কেন বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের মানুষ হয়েও আমরা পূর্ববাংলার লোকেরা আলাদা জনগোষ্ঠী, আলাদা জাতিসত্তা।
১৯৭০ সালে অলস ভাতিজার জন্য আমার চাচা বাটার দোকানে আমার জন্য একটি চাকরির ব্যবস্থা করলেন। বেতন ১৮০ টাকা। তার ওপর নাকি বিক্রয়ের ওপর কমিশন পাওয়া যাবে। ফলে বেতন দুইশ' টাকা ছাড়িয়ে যাবে। ১৯৭০ সালে ২০০ টাকা কম নয়। ৪০-৪৫ টাকায় মেসে থেকে খাওয়া-দাওয়া সকল খরচ পুষিয়ে যায়। কিন্তু আমার মনে হলো, মানুষের পায়ে জুতো পরিয়ে দেয়ার এই চাকরি আমি করব না। ততক্ষণে বিমান বাহিনীতে এয়ারম্যানের চাকরির দরখাস্ত করেছিলাম। সেটার প্রধান ছিলেন এক বাঙ্গালি অফিসার। আমি টিকে গেলাম। কিন্তু মেডিকেল টেস্টে আমার চোখের সমস্যা ধরা পড়লো। ভদ্রলোক মনে-প্রাণে বাঙ্গালী ছিলেন। তিনি বললেন, ঢুকে যাও। ভবিষ্যতে ওরা তো তোমাদের নেবেই না। আমি বললাম, চোখের সমস্যার কী হবে? তিনি বললেন, প্রকাশই করো না। ট্রেনিং পিরিয়ড শেষ হলে চশমা নিতে বাধা থাকবে না। আশা করি, তুমি দক্ষতার সঙ্গে ট্রেনিং পিরিয়ড শেষ করতে পারবে। বাসায় ফিরে এসে মনে হলো, বিভিন্ন গুণিজনের বক্তৃতায় শুনেছি যে, মিলিটারীদের বুদ্ধি নাকি লেফট-রাইট করতে করতে মাথা থেকে হাঁটুতে নেমে আসে।
সাপ্তাহিক হলিডেতে এনায়েতউল্লাহ খান, বদরুদ্দীন উমর, সিরাজুল হোসেন খান প্রমুখের লেখা পড়ে পড়ে আমার মনে এ ধারণা পোক্ত হয়েছিল। এখন অপশন দু'টি- হয় বাটার দোকানে চাকরি নাও, না হয় বিমান বাহিনীতে এয়ারম্যান হিসেবে জয়েন করো। চাচাও চাপ দিচ্ছিলেন। বসে বসে আর কতদিন খাব। কিন্তু আমি এ দু'টো চাকরির কোনোটিই পছন্দ করিনি। ফলে বিশ টাকা নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আমার চাচাকে একটি মিথ্যে কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম যে, বিমান বাহিনীতে জয়েন করতে চলেছি। কিন্তু সারাদিন পাহাড়তলির রেলস্টেশনে কাটিয়ে সন্ধ্যায় সাড়ে ছয় টাকার টিকিট কেটে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিলাম। আমি লেখক হবো।
সেটা ১৯৭০ সাল। ঢাকায় এসে এক ভয়াবহ জীবনযুদ্ধ। কী করিনি? হকার, কম্পোজিটর, প্রুফরিডার- এইসব কাজ। কিন্তু মনে হলো, লেখাপড়া করা ছাড়া আমার কোনো পরিচয় নেই। এসব পেশার সাথেই ১৯৭০ সালে আবারও জগন্নাথ কলেজে প্রথম বর্ষে ভর্তি হলাম। সময় বয়ে যেতে থাকলো। ১৯৭০ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। ইয়াহিয়া খান একটা ভাল কাজ করলেন যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন বণ্টন হবে। সে হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে আসন সংখ্যা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বেশি হলো। শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলো। আমরা উৎফুল্ল হলাম। ধরে নিলাম যে, শেখ মুজিবুর রহমানই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। পূর্ব পাকিস্তানে বঞ্চনার অবসান ঘটছে।
তার পরের কাহিনী দীর্ঘ। আলাপ-আলোচনা চলল। জেনারেল ইয়াহিয়া খান তার সেনাবাহিনীর অপরাপর জেনারেলকে শেখ মুজিবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন এই বলে যে, ‘জেনারেলস, মিট ইয়োর নেক্সড প্রাইম মিনিস্টার।' ধারণা করি যে, এই ঘোষণায় শেখ মুজিবও উৎফুল্ল হয়েছিলেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অধিকারী পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করলেন। তৎকালীন পাকিস্তানের ২৪ বছরের ইতিহাসে এমন ঘটনা আর কখনও ঘটেনি। পাকিস্তানে যারা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন এই সময়ে, তাদের বেশিরভাগই ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা। তখন পশ্চিম পাকিস্তানের কেউ তাদের নেতৃত্বকে অস্বীকার করেনি। জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের সফল পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। তিনি শিক্ষিত লোকও। পাকিস্তানের রাজনীতি বিষয়ে তার ধারণা স্বচ্ছ থাকারই কথা ছিল। কিন্তু সে রকম স্বচ্ছতার পরিচয় তিনি দিতে পারেননি। যদি সুষ্ঠু বিচার বুদ্ধি দিয়ে তিনি বিবেচনা করতেন, তাহলে নিশ্চিতভাবেই বুঝতে পারতেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ পাকিস্তানের জন্য কী ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে এবং আশ্চর্যের বিষয় এই যে, পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র পূর্ব পাকিস্তানে এক ভয়াবহ গণহত্যা অভিযান অনুমোদন করে বসলো। আমি জানি না, কী পরিপ্রেক্ষিতে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর এই জেদে সাড়া দিয়েছিলেন। শর্মিলা বসুর ‘ডেড রিকনিং' গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে, এখানে চরম ব্যবস্থা নেয়া ছাড়া পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর আর কোনো উপায় ছিল না। তারপরও বলতে হয়, সেই পরিস্থিতি পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রই সৃষ্টি করেছিল। শেখ মুজিব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলে পাকিস্তানের কোনো ক্ষতি হতো না।
কিন্তু যখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ এদেশের নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ওপর হামলে পড়লো, তখন গোটা চিত্র বদলে গেলো। শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে বিদ্রোহ করে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো। আমি জিন্দাবাহার থেকে মহেড়ার কাছাকাছি ভাতকুড়া গ্রামে আমার খালার বাসায় চলে এলাম। আমার খালাতো ভাই সা'দত কলেজে আমার সহপাঠী ছিল। আমি নিশ্চিত সিদ্ধান্ত নিলাম। যদি বসে থাকি তাহলেও তরুণ হিসেবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আমাকে খুন করবে। তারচেয়ে বরং যুদ্ধে যাওয়া ভাল। মরতে তো হবেই। মরলে যুদ্ধ করেই মরি। তখন সা'দত কলেজের ভিপি ছিলেন আবদুল বাতেন। তিনি কাদের সিদ্দিকীর বাইরে ভিন্ন এক মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করার উদ্যোগ নিলেন। বাতেন ভাইয়ের সঙ্গে সংযোগের আগে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য কাদের সিদ্দিকীর এলাকা সখিপুরে গেলাম। কিন্তু কেন যেনো আমাকে কেউ কোনো পাত্তাই দিলো না। বললাম, আমি কাদের সিদ্দিকীর সহপাঠী ছিলাম। তার সঙ্গে কথা বলতে চাই। আমার বয়স কম। তার গার্ডরা বোধ করি বিশ্বাসই করতে চায়নি যে, আমি সত্যি সত্যি তার সহপাঠী ছিলাম। সখিপুর থেকে ফিরে এলাম। এরপর বাতেন ভাই দেশের অভ্যন্তরে ছোটখাট এক বাহিনী গঠন করে প্রতিরোধ শুরু করলেন। আমিও সেই প্রতিরোধের একজন অংশীদার।
এখন পড়ছি শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী'। বইটি পড়ছি আর চমৎকৃত হচ্ছি। পাকিস্তান আন্দোলনের এক তুখোড় নিবেদিতপ্রাণ কর্মী ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা ছাড়া ভারতের মুসলমানদের মুক্তির আর কোনো উপায় নেই। ১৯৪৩ সালের মন্বন্তর আর ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মুসলমানদের জীবনে কী বিপর্যয় নেমে এসেছিল তার বিস্তারিত বর্ণনা আছে শেখ মুজিবের ঐ আত্মজীবনীতে। পাকিস্তান সৃষ্টির সময় তিনি কলকাতা পূর্ব পাকিস্তানে রাখারও আন্দোলন করেছেন। মুসলিম লীগের কাছে তার আশা ছিল অনেক। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্প সময়ের মধ্যেই তার সে আশা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। পাকিস্তানের সরকার দ্রুত স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে। আর শেষ পর্যন্ত মুসলিম লীগ সরকারের পতন ঘটে। শেখ মুজিবের ভবিষ্যৎ বাণীও ছিল তাই। তার এই উপলব্ধি সত্ত্বেও বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন হয়ে ঐ স্বৈরাচারের পথই ধরেছিলেন শেখ মুজিব এবং অনিবার্য পতন ঘটে শেখ মুজিব সরকারেরও। আর তার কন্যা শেখ হাসিনাও সেই স্বৈরাচারী পথেই অগ্রসর হচ্ছেন, যা তাকেও অবশ্যম্ভাবী পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সরকারের কি বোধোদয় হবে না?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads