রবিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১২

দুর্নীতিতে ডুবছে দেশ


গোলাপ মুনীর

একটা দেশকে সমৃদ্ধ করতে চাইলে অনেকগুলোই পূর্বশর্ত পূরণ করা দরকার। এসব পূর্বশর্তের অন্যতম হচ্ছে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত রাখা। এই অপরিহার্য শর্তপূরণে আমাদের ব্যর্থতা সীমাহীন। মনে হয় দুর্নীতি আমাদের প্রায় গ্রাস করে ফেলেছে। দেশ-জাতি-সমাজ তলিয়ে গেছে দুর্নীতির অতলগহ্বরে। সেখান থেকে উঠে আসার কোনো পথই যেন খোলা নেই। অতএব, আমরা যেন ধরেই নিয়েছি ঝক্কিঝামেলা যতই হোক, এই দুর্নীতি নিয়েই চলবে আমাদের বসবাস। অতএব, আমাদের সবাইকে দুর্নীতির প্রতিযোগিতায় নামতে হবে। নইলে ঠকতে হবে পদে পদে। অতএব দুর্নীতির পথঘাট আমাদের সবাইকে জানতে হবে।
 সব দেশেই দুর্নীতি কম-বেশি হয়। কিন্তু আমাদের দেশের মতো এতটা দুঃসহ মাত্রায় দুর্নীতি খুব কম দেশেই হয়। সবখানে দুর্নীতির থাবা। চাকরি পেতে দুর্নীতি। চাকরি পাওয়ার পর অব্যাহত দুর্নীতি। অফিসের পিয়ন থেকে বড় কর্তা সবই নিয়োজিত ঘুষবাণিজ্যে। চাকরি শেষ হলে নিজের পেনশনের টাকা পেতেও চাই দুর্নীতির অবলম্বন। এমনকি মৃত্যুর সার্টিফিকেট পেতেও প্রয়োজন দুর্নীতির। অন্য দেশে যে ধরনের দুর্নীতির কথা ভাবাও যায় না, সেখানেও আমরা দুর্নীতির শিকার। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বিষয়টি আজ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। এই দুর্নীতির ট্রেড নেম হচ্ছে ‘ভর্তিবাণিজ্য’। শিক্ষক থেকে ছাত্র এমনকি রাজনীতিবিদ কেউই এই ভর্তিবাণিজ্য থেকে বাদ নেই। সরকারি কোনো কাজের টেন্ডার পেতে হলে সেখানেও চলে শত ভাগ দুর্নীতি। এ দুর্নীতি সুপরিচিত দুই রূপে : টেন্ডারবাজি ও টেন্ডার সন্ত্রাস নামে। যেকোনো পরিষেবা পেতে হলে আপনাকে দুর্নীতির রাজ্যে বাধ্য হয়ে প্রবেশ করতে হবে। বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস ইত্যাদির লাইন পাওয়ার কথা কি দুর্নীতির পথ না ধরে কখনো চিন্তা করতে পারি? এভাবে সবখানে দুর্নীতিবাজেরা ঢুকে পড়েছে। আপনি দুর্নীতির পথে না চলার শপথ নিয়ে ঘরের দরজার খিল এঁটে বসে আছেন, তাতেও কোনো উপায় নেই। দুর্নীতি আপনার ঘরের দরজা ভেঙে ঢুকে পড়বে। আপনি বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির বিল সঠিকভাবে দিয়ে আসছেন, একদিন দেখবেন দুর্নীতিবাজেরা আপনার ঘরে ঢুকে বলবেÑ ‘আপনি এত বেশি টাকা মাসে মাসে কেন বিল দিচ্ছেন। আমাদের প্রতি মাসে কিছু ধরিয়ে দেবেন, আপনার বিল আমরা প্রত্যেক মাসে কমিয়ে দেবো।’ তাদের প্রস্তাবে রাজি হলেন, এর অর্থ আপনি দুর্নীতির রাজ্যের নতুন নাগরিক। আর তাদের প্রস্তাবে রাজি হলেন না, পড়লেন নতুন বিপদে। প্রতি মাসে আপনার কাছে আসতে থাকবে ভুতুড়ে বিল। দেখবেন, সাধারণত যে পরিমাণ টাকার বিল আসার কথা, আসছে তার পাঁচ-সাত গুণ বেশি। এই হচ্ছে আমাদের অবস্থা।
দুঃখজনক ব্যাপার হলো, মুখে দুর্নীতির সমালোচনা আমরা নানাজন নানাভাবে করি, বাস্তবে সেই দুর্নীতিকেই আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছি আমাদের বাস্তব জীবনে। আমি বাবা, আমার সন্তান কী বেতনে কী চাকরি করে আমার জানা। কিন্তু আমার চোখের সামনে আমার সন্তান কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছে। এ টাকার উৎস কোথায়, কোনো প্রশ্ন করছি না; বরং উল্টো পুত্রধনের অস্বাভাবিক এ সাফল্যে আমি নিজেও গর্ববোধ করছি। এভাবেই দুর্নীতিবাজদের সম্মানের আসনে আমরা প্রতিষ্ঠিত করে চলেছি। আজকে আমরা প্রকাশ্যে পরিবারের সদস্যদের সামনে উপদেশ ছড়াচ্ছিÑ ‘সৎ পথে কিছু হয় না’। আমার সন্তান নির্বাচনে দাঁড়িয়েছে, কোটি কোটি খরচ করছে, এ নিয়ে প্রশ্ন করছি নাÑ নির্বাচনে কেন এত টাকা খরচ করছো? কারণ, আমি জানি আমার সন্তান ভালো করেই জানে নির্বাচন হচ্ছে এক ধরনের মহালাভজনক বাণিজ্য। নির্বাচনে কোনো মতে উতরে যাওয়ার অপর অর্থ আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ হাতে পাওয়াÑ কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামানোর পথ খুলে যাওয়া। অতএব, আমি এ ব্যাপারে নিশ্চুপ। চাকরি পাওয়ার জন্য ঘুষের টাকা আমি বাবা হয়ে ছেলের হাতে তুলে দিচ্ছি। প্রশ্ন তুলছি না। এটাও এক দুর্নীতি। এভাবে মুরব্বিজনেরা পরিবারের কোনো না কোনো সদস্যকে দুর্নীতিবাজ হওয়ার জন্য প্ররোচিত করছি। এভাবে দূষিত করে তুলছি পরিবার, সমাজ তথা সমগ্র জাতিকে। ভেতরে-বাইরে আমাদের পরিচয় পাকাপোক্ত হচ্ছে একটি দুর্নীতিবাজ জাতি হিসেবে।
কিন্তু দেশের বিবেকবান মানুষ আজকের দুর্নীতি পরিস্থিতির তাপ-উত্তাপ দেখে শঙ্কিত। দুর্নীতির ভয়াবহতা দেখে শঙ্কিত না হয়ে কি উপায় আছে? আমরা যখন শুনি এনবিআরের সমীক্ষা জানাচ্ছেÑ দেশ থেকে বছরে ১৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে, তখন কি শঙ্কিত না হয়ে থাকা যায়? সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। পণ্যমূল্যের কারসাজি করে দেশী-বিদেশী কিছু প্রতিষ্ঠান আয়কর ফাঁকির লক্ষ্যে বিপুল অর্থ পাচার করছে। পাচার করা অর্থের একটি অংশ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহার হতে পারে। এই অর্থ পাচার রোধে সরকারের নানা পদক্ষেপের কথা শুনি, আইন প্রয়োগের কথা শুনি, টাস্কফোর্স সেল কাজ করার কথা শুনিÑ কিন্তু এই পাচার রোধ করতে পারছি না।
দেশে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন থাকা সত্ত্বেও অবৈধ ভিওআইপি (ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল) কলের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ৩৬ হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেছে। এর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে অনেক। কিন্তু মামলারও বিচার নিষ্পত্তি হয়নি। ২০১০ সালে এই অবৈধ কল রোধে সংশোধন করা হয়েছে ‘বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০১’। আইনটি সংশোধিত হওয়ার আগ পর্যন্ত দায়ের করা অবৈধ ভিওআইপি লাইসেন্স নেয়া বাধ্যতাবমূলক করা হলেও লাইসেন্স না নিলে শাস্তির বিধান নেই। ৭৮ ধারায় অনুসন্ধান, মামলা দায়ের এবং তদন্তের কথা বলা হলেও এ ধারায় চার্জশিট দেয়া হচ্ছে না। আইনবিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায়ের সাথে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষেই গেছে এ আইন। টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানগুলোর কে কোন পদে বসবেন তা নির্ধারণেও এই আইন বেশ সহায়ক। রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি রোধে ‘বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন’ একেবারেই অকার্যকর। এ আইনে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা এ আইনে থাকা ব্যাপক অসঙ্গতি। কোন কোন কাজ ভিওআইপি অপরাধ বলে গণ্য হবে, আইনে এর সুনির্দিষ্ট উল্লেখ নেই। কেন এ আইনের এসব অসঙ্গতি দূর করতে পারলাম না? কেন আইনটি কার্যকর করে তুলতে পারলাম না? এসবের উত্তর একটাইÑ সর্ষেতেই রয়েছে ভূত। এ ভূত দুর্নীতির ভূত।
মানুষ বাসাবাড়ি ও কলকারখানায় নতুন গ্যাস সংযোগ পাচ্ছে না। তবে অবৈধ গ্যাস সংযোগ থেমে নেই কিংবা বন্ধ হয়নি। গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা, কর্মচারী ও ঠিকাদার মোটা অঙ্কের বিনিময়ে ঠিকই নতুন সংযোগ দেয়া অব্যাহত রেখেছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার ৯ মাস পর সব ধরনের নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে। এরপর এই অবৈধ সংযোগের ঘটনা আরো বেড়ে গেছে। এতে করে আমাদের গ্যাস চুরি হচ্ছে। সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। খবরে প্রকাশ, বর্তমানে দেশের পাঁচটি বিতরণ কোম্পানির অধীনে বৈধ আবাসিক গ্যাস গ্রাহকের সংখ্যা ২৩ লাখ পাঁচ হাজার ২৩১। আর অবৈধ গ্রাহক সংখ্যা দুই লাখেরও বেশি। সহজেই অনুমেয়, কী বিপুল গ্যাস প্রতিদিন চুরি হচ্ছে। অথচ কোনটি বৈধ আর কোনটি অবৈধ সংযোগ তা চিহ্নিত করাই নাকি কঠিন। দুর্নীতিবাজেরা দুর্নীতিতে এতটাই পটু। যে দুই লাখ গ্রাহক অবৈধ সংযোগ নিয়েছেন, দুর্নীতিতে তাদেরও যে অবদান(?) তা কি অস্বীকার করা যায়?
চলতি বছরের নভেম্বর থেকে এমপিও তালিকায় নতুন ৪৯ হাজার ৪১১ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা যুক্ত হচ্ছেন। এসব শিক্ষক-শিক্ষিকা কয়েক বছর আগে থেকেই এমপিওভুক্ত হওয়ার যোগ্য হলেও মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অবহেলায়  প্রশাসনিক জটিলতা ও নীতিমালার দোহাই দিয়ে তা আটকে রেখেছিল। যদিও বাজেটে তাদের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দও ছিল। শেষ পর্যন্ত শিক্ষক সংগঠনগুলোর অব্যাহত দাবি ও আন্দোলনের মুখে এবং এমপিও খাতে চলতি অর্থবছরের বাজেটে কোনো বরাদ্দ না রাখার সমালোচনা বন্ধ করতে নতুন এই ৪৯ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকাকে এমপিও তালিকায় যুক্ত করা হচ্ছে। এসব শিক্ষক-শিক্ষিকাকে তালিকাভুক্ত করার বিষয়কে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে মাউশিতে শুরু হয়েছে রমরমা এমপিও-বাণিজ্য। মাউশির এই এমপিও-বাণিজ্য সুপ্রতিষ্ঠিত সুদীর্ঘকাল থেকে। গোটা শিক্ষকসমাজকে মাউশির দুর্নীতিতে প্ররোচিত ও অনেকটা বাধ্য করায় মাউশির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে অব্যাহত প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছেন, তা আমরা বন্ধ করতে পারিনি। কী ভয়াবহ একটি দুর্নীতিবাজ জাতিতে আমরা পরিণত হতে যাচ্ছি।
নিয়ম-অনিয়মের বালাই না করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে সরকার সমর্থকদের নিয়োগ-উৎসব। সে কাহিনী সুদীর্ঘ। সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের এই অবৈধ প্রক্রিয়া চলছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এস এম আনোয়ারা বেগম ২০০৯ সালের নভেম্বরে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পান। এক বছর পাঁচ মাস পর গত বছর এপ্রিলে তিনি অধ্যাপক হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী পিএইচডিধারী কোনো শিক্ষককে অধ্যাপক পদে নিয়োগ পেতে হলে সহযোগী অধ্যাপক পদে কমপক্ষে চার বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। এ ছাড়া শিক্ষাজীবনে দু’টি প্রথম শ্রেণী এবং স্বীকৃত জার্নালে ন্যূনতম ১০টি প্রকাশনার বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু আওয়ামীপন্থী ‘নীল দলের’ প্যানেল থেকে নির্বাচিত শিক্ষক সমিতির সহসভাপতি ওই শিক্ষিকার একটিও প্রথম শ্রেণী নেই। প্রকাশনা আছে পাঁচটি। তার পরও নিয়ম ভেঙে তাকে অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তা ছাড়া সেখানে এমন অনেক শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন, যারা সে নিয়োগের যোগ্যতা রাখেন না। কিছু দিন আগে প্রথম আলোর একটি সংবাদ সূত্রে দেশবাসী তা জেনেছে। অন্য পত্রিকাগুলোতে নানা ধরনের অবৈধ শিক্ষক নিয়োগের খবর মাঝে মধ্যে প্রকাশ পাচ্ছে।
মহাজোট এ সরকারের আমলে দেশবাসী শুনেছে নানা মাত্রার নানা আকার-প্রকারের মহা মহা দুর্নীতির ঘটনা, যার কোনো তুলনা হয় না। তেমনি সব মহাদুর্নীতির নানা ঘটনা এ দেশের মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। এসবের মধ্যে আছে পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, রেলওয়ে নিয়োগবাণিজ্য কেলেঙ্কারি, ডেসটিনি কেলেঙ্কারি, টেন্ডার-বাণিজ্য, ইত্যাদি। কিন্তু জাতি হিসেবে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় মাপের লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়ায় যখন শুনি বর্তমান জাতীয় সংসদের অর্ধেকের বেশি এমপি অপরাধকর্মের সাথে জড়িত। গত ১৪ অক্টোবর ২০১২ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, বর্তমান জাতীয় সংসদের অর্ধেকেরও বেশি সংসদ সদস্য হত্যা, দখল, চাঁদাবাজি, কমিশন-বাজি, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ, অবৈধ প্রভাব বিস্তার, মিথ্যা তথ্যে প্লট বরাদ্দ, নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনসহ নানা ধরনের অপরাধে জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাসহ ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। টিআইবির এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে বলে এই সংস্থাটির গবেষণা প্রতিবেদনে দাবি করা হয়। প্রতিবেদন মতে, সংসদের ৯৭ শতাংশ এমপি কোনো না কোনো নেতিবাচক কাজের সাথে জড়িত। তাদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি অর্থাৎ ৫৩.৫ শতাংশ সরাসরি অপরাধ কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। ২০.১ শতাংশ এমপির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রয়েছে। তবে তাদের মধ্যে ৫৩.৭ শতাংশ কোনো না কোনো ইতিবাচক কার্যক্রমের সাথে জড়িত। এই হিসাব মতে, বাকি ৪৬.৩ শতাংশের কোনো ইতিবাচক কাজ নেই। নেতিবাচক কাজগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ প্রশাসনিক কাজে প্রভাব বিস্তার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ, কমিশন গ্রহণ, উন্নয়ন বরাদ্দের অপব্যবহার, হত্যা ও দখলবাণিজ্যসহ অপরাধমূলক কাজে জড়িত হওয়া বা সমর্থন দেয়া, সরকারি ক্রয়-সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তার, নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্লট বরাদ্দ নেয়া। টিআইবির প্রতিবেদনে এমপিদের অপরাধমূলক কাজসহ নেতিবাচক কাজ থেকে বিরত রাখতে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া ও আচরণবিধি প্রণয়ন, স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের সাথে সম্পৃক্ততা থেকে এমপিদের সরিয়ে আনা, এমপিদের সংবিধানস্বীকৃত কাজ নিশ্চিত করা, সংসদ বর্জনের সংস্কৃতি আইন করে বন্ধ করা, সংসদে সদস্যদের অনুপস্থিতির সীমা সর্বোচ্চ ৩০ দিন করা এবং একাধিক্রমে সংসদে অনুপস্থিতির সীমা সাত দিন করার সুপারিশ করা। দেশবাসী মনে করে, সংসদ সদস্যদেরকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-সংশ্লিষ্ট কমিটিগুলো থেকে প্রত্যাহার সবচেয়ে জরুরি হয়ে পড়েছে। নইলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলমান দুর্নীতি, নিয়োগবাণিজ্য ও ভর্তিবাণিজ্যের অবসান ঘটবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে রাজনৈতিক দলাদলিরও অবসান হবে না। সে যা-ই হোক, আমাদের দেশের এমপিরা টিআইবির এ রিপোর্ট নিয়ে টিআইবির প্রতি খুবই ুব্ধ হয়েছেন। টিআইবিকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়ার দাবিও সংসদ সদস্যরা সংসদে তুলেছেন। কিন্তু দেশবাসী মনে করে, টিআইবিকে দেশ থেকে তাড়ানোর কথা না বলে সংসদ সদস্যরা যদি দুর্নীতিকে দেশ থেকে তাড়ানোর শপথটুকু প্রকাশ্যে না হোক নীরবে হলেও নিতেন, তাহলে হয়তো জাতি দুর্নীতিমুক্ত হওয়ার একটা উপায় খুঁজে পেত। তা না করে সংসদ সদস্যরা যেভাবে টিআইবির রিপোর্ট নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন, তাতে দুর্নীতি আরো সম্প্রসারিত হওয়ার সুযোগ পাবে।
আমরা যে যা-ই বলি, দুর্নীতিতে আমরা আরো বেশি করে ডুবছি। আরো দুঃখজনক হলো, আমরা যারা দুর্নীতি ঠেকানোর দায় ঘাড়ে নিয়েছি, তারা দুর্নীতিবাজদের রক্ষার চেষ্টায় মরিয়া। পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, রেলওয়ে-বাণিজ্য কেলেঙ্কারি কিংবা ডেসটিনি কেলেঙ্কারি ইত্যাদি যত কেলেঙ্কারির কথাই বলি; সর্বত্র আমাদের মরিয়া চেষ্টা দুর্নীতিবাজদের বাঁচানোর জন্য। অস্বীকার করার উপায় নেইÑ দুর্নীতিতে আমরা ডুবছি। গত ৫ ডিসেম্বর টিআইবি প্রকাশ করেছে দুর্নীতির ধারণাসূচক। এই ধারণাসূচকে দুর্নীতিতে আমরা আরো ২৪ ধাপ পিছিয়েছি। এ ক্ষেত্রে গত বছর বাংলাদেশের সূচক ছিল ১২০। এবার ১৪৪। এই ধারণাসূচক বলে, দেশে দুর্নীতি আরো অনেক বেড়েছে। বিশ্বের ১৭৬টি দেশের দুর্নীতির ধারণাসূচকসহ বাংলাদেশে এই দুর্নীতিচিত্র প্রকাশ করা হয়েছে। এই সূচক প্রকাশ করার জন্য আয়োজিত সম্মেলনে জানানো হয়, সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ঘাটতি এবং পদ্মা সেতু প্রকল্প, রেলওয়ে দুর্নীতি, শেয়ারবাজার ও হলমার্ক কেলেঙ্কারি ও ডেসটিনির অনিয়মের অভিযোগের মতো বহুল আলোচিত ঘটনাই দুর্নীতিতে এবার বাংলাদেশের অবস্থার এই অবনতি ঘটেছে।
আজকে বলতেই হবে, গোটা জাতিই যেন আজ দুর্নীতি নামের এক জাহাজে সওয়ার হয়ে বসেছে। এ জাহাজ থেকে জাতিকে নামাতে হলে আমাদের সবাইকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা সবচেয়ে মুখ্য। তবে সেই সাথে সব মহলের সব মানুষের মধ্যে দুর্নীতিবিরোধী মনোভাব ও মূল্যবোধ গড়ে তুলতে না পারলে দুর্নীতির মূলোৎপাটন সম্ভব হবে না। সরকার, আমি ও আপনি সবাই জানিÑ আমরা নিজেরা কে কী মাত্রায়, কী আকারে-প্রকারে দুর্নীতির সাথে জড়িত। আমরা যদি দুর্নীতির জন্য আঙুল অন্যের দিকে না দেখিয়ে নিজে দুর্নীতিমুক্ত হওয়ার শপথ নিই; তবেই শুধু সম্ভব দুর্নীতির লজ্জা থেকে জাতিকে রেহাই দেয়া। দেশের সরকার যারা চালান তাদের মধ্যে এ উপলব্ধি আসার চূড়ান্ত সময় এখন। এর কোনো বিকল্প নেই, মহাবিপর্যয় ছাড়া।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads