বৃহস্পতিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১২

বিশ্বজিত্ হত্যার পুরো দায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর!



সৈয়দ আবদাল আহমদ

বিশ্বজিত্ হত্যার দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারবেন না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। এই হত্যার দায় পুরোটাই এসে পড়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাঁধে। মাত্র কিছুদিন আগে প্রকাশ্যে সমাবেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছাত্রলীগ-যুবলীগকে জামায়াত-শিবির মোকাবিলার আহ্বান জানিয়েছিলেন। বিশেষজ্ঞ মহলের অভিমত, সেই আহ্বানে সাড়া দিয়েই ছাত্রলীগ বিশ্বজিেক নির্মম এবং নৃশংসভাবে খুন করেছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আহ্বানের পর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমানে উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আবদুল জলিল বলেছিলেন, মহীউদ্দীন খান আলমগীর খুব গর্হিত একটি বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি ছাত্রলীগ-যুবলীগকে এ আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস উসকে দিয়েছেন। আবদুল জলিলের কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যে পরিণত হয়েছে। বিশ্বজিত্ আজ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বলি। ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা যখন বিশ্বজিেক চকচকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে এবং লাঠি ও লোহার রড দিয়ে প্রহার করতে করতে নৃশংসভাবে খুন করছিল, তখন পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল পুলিশ। তারা বিশ্বজিেক বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। নীরব দর্শকের মতোই দাঁড়িয়ে ছিল। বিরোধী দলের মিছিল-মিটিং ঠেকানোর দায়িত্ব হলেও ছাত্রলীগের আক্রমণ ঠেকানো যেন তাদের কাজ নয়। কাউকে হত্যা করলেও তারা যেন তা দেখবেন না। কারণ তাদের রাজাধিরাজ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ রয়েছে ছাত্রলীগ-যুবলীগের প্রতি। ছাত্রলীগ যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশমত কাজ করছে, তখন পুলিশ কেন ছাত্রলীগকে বাধা দিতে যাবে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশের বাইরে গিয়ে পুলিশ ছাত্রলীগকে বাধা দেয় কীভাবে? তাই ছাত্রলীগ বীরদর্পে তাদের কাজ করেছে। শুধু পুলিশই নয়, হাসপাতালের চিকিত্সকরাও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। মৃত্যুপথযাত্রী বিশ্বজিেক পথচারীরা মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু কর্তব্যরত চিকিত্সকরা তাকে শিবির মনে করে চিকিত্সা করেননি। রক্তক্ষরণ হতে হতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন বিশ্বজিত্। কী নির্মম! কী বীভত্স! হায়রে মানবতা!
বিশ্বজিত্ হত্যার পাঁচ দিন অতিবাহিত হয়েছে। আজও হত্যাকারীদের গ্রেফতার করা হয়েছে কিনা, এ নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। অথচ প্রতিটি টেলিভিশন চ্যানেল, প্রতিটি সংবাদপত্র হত্যাকারীদের সেদিনের নির্মমতার দৃশ্য ও ছবি প্রচার ও প্রকাশ করেছে। সংবাদপত্রে তাদের নাম-ধাম, ঠিকানা-পরিচয় ছবিসহ ছাপা হয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ১০-১২ জন সশস্ত্র ক্যাডার এই ঘটনা ঘটিয়েছে। এদের মধ্যে মূল হামলাকারী পাঁচজন হলো—মোঃ রফিকুল ইসলাম ওরফে শাকিল, মীর মোঃ নূরে আলম ওরফে লিমন, মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান ওরফে নাহিদ, মোঃ ইমদাদুল হক ও ওবাইদুল কাদের। এই পাঁচজনের মধ্যে শাকিল চাপাতি দিয়ে প্রথম কুপিয়েছে বিশ্বজিেক। বাকিরাও লোহার রড ও লাঠি দিয়ে পিটিয়েছে তাকে। এই ছাত্রলীগ ক্যাডাররা দীর্ঘদিন ধরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ আশপাশের এলাকায় ছিনতাই, মাদক সেবন ও ব্যবসা, টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ধরনের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করার ঘটনায় ২০০৯ সালে দ্রুত বিচার আইনে শাকিলের বিরুদ্ধে মামলা ছিল। প্রতিপক্ষের কর্মীকে ছুরিকাঘাত করার ঘটনায় নাহিদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। লিমন এক শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার অভিযোগে ২০০৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কৃত হয়। ইমদাদুল সংগঠনের কর্মীদের মারধর করার ঘটনায় একবার বহিষ্কৃত হয়। একই অভিযোগ ওবাইদুলের বিরুদ্ধে।
অবরোধের দিন ছাত্রলীগের ক্যাডাররা চাপাতি, দা, লোহার রড, লাঠিসহ নানা অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে মহড়া দিচ্ছিল। ঘটনার সময় ঋষিকেশ দাস লেনের বাসা থেকে বিশ্বজিত্ দাস শাঁখারিবাজারে নিজের টেইলারিংয়ের দোকানে যাচ্ছিলেন। এসময় একটি ককটেল বিস্ফোরিত হয়। ককটেল বিস্ফোরণের আওয়াজে আরও অনেকের সঙ্গে বিশ্বজিত্ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পেট্রলপাম্প সংলগ্ন একটি ভবনের দোতলায় ইনটেনসিভ ডেন্টাল কেয়ার নামের বেসরকারি ক্লিনিকে গিয়ে আশ্রয় নেন। তাকে আশ্রয় নিতে দেখে মহড়ারত ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা দৌড়ে সেখানে গিয়ে দোতলায় ওঠে। বিশ্বজিেক চাপাতি দিয়ে কোপাতে থাকে শাকিল। তার সঙ্গে ছিল ওবাইদুল কাদের। প্রাণ বাঁচাতে বিশ্বজিত্ দৌড়ে নিচে চলে আসে। সেখানে বিশ্বজিেক ছাত্রলীগ ক্যাডার নূরে আলম, মাহফুজুর রহমান, ইমদাদুলসহ ১০-১২ জন রড-লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটাতে থাকে। রক্তে তার পুরো শরীর এবং জামা-কাপড় ভেসে যায়। তিনি করজোড়ে ক্ষমা চাইছেন, প্রাণভিক্ষা চাইছেন। বার বার বলছেন, ‘আমি রাজনীতি করি না, আমি ছাত্রদল নই, শিবির নই। আমি বিশ্বজিত্ দাস। আমি হিন্দু, আমি হিন্দু। দর্জি দোকানে কাজ করি। আমাকে মারবেন না, আমাকে বাঁচান।’ কিন্তু পাষণ্ডদের হৃদয়ে এতটুকু মায়া লাগেনি। বাঘ যেমন হরিণকে শিকার হিসেবে ধরার পর হরিণ প্রাণপণ বাঁচার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না, তেমনি বিশ্বজিেক হত্যা করল ছাত্রলীগ। যে জায়গাটিতে বিশ্বজিেক হত্যা করা হয়, সেখানকার বারান্দার ফ্লোর আর সিঁড়িতে লেগে থাকে ছোপ ছোপ রক্ত। বিশ্বজিতের ওপর এমন নৃশংসতার সময় পথচারীদের কেউ কেউ তাকে পাশের ন্যাশনাল হাসপাতালে নিতে চেষ্টা করলে তাতেও বাধা দেয় ছাত্রলীগ ক্যাডাররা। শেষ চেষ্টা হিসেবে বিশ্বজিত্ দৌড়ে শাঁখারিবাজারের গলিতে গিয়ে ঢলে পড়ে যান। তাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিত্সকরা শিবির কর্মী মনে করে তার চিকিত্সায় এগিয়ে আসেননি। কিছুক্ষণ পর তার মৃত্যু হয়।
বিশ্বজিত্ ২৪ বছরের একজন নিরীহ তরুণ। রাজনীতির ধারেকাছেও নেই। দর্জি দোকানের অতি সাধারণ একজন তরুণকে যে নৃশংসতায় হত্যা করল ছাত্রলীগ, তাতে বিবেকবান মানুষের মন ভেঙে গেছে। তারা যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। আমি হিন্দু—একথা বলেও বাঁচতে পারলেন না বিশ্বজিত্। তার আর্তচিত্কারে এতটুকু মায়ার উদ্রেক হয়নি ঘাতকদের। নির্দয় পেটানো, কোপানো এবং অবশেষে মিটফোর্ড হাসপাতালে বিনা চিকিত্সায় তার জীবন প্রদীপ নিভে গেল। মানুষ যে কত নৃশংস হতে পারে, ছাত্রলীগ যে কত বড় ফ্রাংকেনস্টাইনের দানব, কত বড় দুর্বৃত্ত, হায়েনার মতো আচরণ করতে পারে তা ভাবলেও গা শিউরে ওঠে।
হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতা তো আছেই, এর পরের ঘটনা যে আরও কত নির্মম, তা প্রতিদিনই পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। বিশ্বজিত্ হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে সূত্রাপুর থানায় যে মামলা হয়েছে, তাতে পুলিশ আসামির তালিকায় নামের জায়গায় লিখেছে অজ্ঞাতনামা। গণমাধ্যমে ঘাতকদের পুরো নাম-পরিচয় সচিত্র প্রকাশ হলেও পুলিশের খাতায় তারা অজ্ঞাত। তবে হাইকোর্ট ঘটনাটি আমলে নিয়ে গণমাধ্যমে বিশ্বজিত্ হত্যায় যাদের নামধাম প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে, তাদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করার নির্দেশ দিয়েছেন। হাইকোর্টের আরজিতে পত্রিকায় প্রকাশিত ৫ জন ছাত্রলীগ ক্যাডারের নাম এজাহারভুক্ত করা হয়। ১১ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এ ঘটনায় ৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু এর দুই ঘণ্টা পরই পুলিশ জানায়, কেউ গ্রেফতার হয়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হত্যাকারী ছাত্রলীগ ক্যাডাররা ছাত্রলীগের কেউ নয় বলেও ঘোষণা করেন। কিন্তু প্রতিদিনই কোনো না কোনো সংবাদপত্রে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের পুরো পরিচয় দিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হচ্ছে।
হাইকোর্টের নির্দেশের ২৪ ঘণ্টা এরই মধ্যে পার হয়ে গেছে। কিন্তু দায়ী ছাত্রলীগ ক্যাডারদের গ্রেফতার করা হয়নি। তাদের গ্রেফতার নিয়ে চলছে লুকোচুরি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেই চলেছেন, তারা গ্রেফতার হয়েছে। গতকাল তিনি বলেছেন, ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের ডেপুটি এটর্নী জেনারেল জানান, ১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বিভ্রান্তি সৃষ্টির কারণ কী? অবশ্য পুলিশ গ্রেফতার না করলেও ঘটনায় অভিযুক্ত পাঁচজনকে চিহ্নিত করেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এদের তিনজনকে বহিষ্কার ও দু’জনের সনদ বাতিল করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গ্রেফতার নিয়ে এই বিভ্রান্তিকর বক্তব্যই শুধু নয়, তিনি জোর গলায় দাবি করেছেন, পথচারী বিশ্বজিত্ দাসের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে ছাত্রলীগ জড়িত নয়। তিনি বলেন, ‘আমি বলছি, এ হত্যাকাণ্ডে আমাদের ছাত্রলীগ জড়িত নয়।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে ১১ জনের গ্রেফতারের কথা বলছেন, তারা কোথায়, তাদের নাম-পরিচয় কী, ২৪ ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও কেন তাদের আদালতে হাজির করা হচ্ছে না?
অপরাধের সঙ্গে একবার কেউ জড়িয়ে গেলে তার দ্বারা বারবারই অপরাধ সংঘটিত হয়। তেমনি একবার যে অনাচার করে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে— বারবারই একই কাজের পুনরাবৃত্তি ঘটায়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ওই অভিযুক্ত ক্যাডাররা ইতিপূর্বেও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্ম করেছে। তাই বিশ্বজিতের ঘটনা ঘটাতেও তারা পিছপা হয়নি।
বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরও একজন বিতর্কিত ব্যক্তি। জনতার মঞ্চের মাধ্যমে প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে একটি গণতান্ত্রিক সরকারকে তার কাজে নগ্নভাবে বাধার সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। তাই তার দ্বারা কোনো ভালো কিছু আশা করা যায় না। অরাজকতা এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির নজির রয়েছে তার বিরুদ্ধে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে চেয়ারে বসার পর তার একের পর এক বক্তব্যে নৈরাজ্যই সৃষ্টি হচ্ছে। গতকাল তিনি বলেছেন, বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও তল্লাশি চালানো হবে। এ ধরনের স্বৈরাচারী ভাষাই তার মুখ থেকে বের হচ্ছে!
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
abdal62@gmail.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads