মঙ্গলবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১২

এ কেমন সন্ত্রাস গ্রাস!


ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী :
 কোনো কিছুই আজকাল কেন যেন আমাদের স্পর্শ করতে পারছে না। আমরা যেন কোনো কিছুকেই  কোনো রকম গুরুত্ব দিতে পারছি না, বা চাইছি না। দুর্নীতি-সন্ত্রাস-গুম-খুন এখন সরকারের প্রধান কর্মকান্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভোট কিংবা জনগণ সরকারের কাছে এখন কোনো ইস্যুই নয়। সরকার যেনো ভবিষ্যৎ কোনো নির্বাচনে জনগণের ভোটের কোনো পরোয়াই করছে না। জনগণ ভোট দিলো কি না দিলো তাতে সরকারের কোনো পরোয়া নেই। সেটা মাথায় রেখেই সরকার নির্বাচন পদ্ধতি, নির্বাচনকালীন সরকার প্রভৃতি বিষয়ে নানা ধরনের আগাম ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। প্রশাসনকে সাজাতে শুরু করেছে তাদের মতো করে। আর নির্বাচন কমিশন! এরা দাসস্য দাস। এদের ওপর কারো কোনো আস্থা নেই। এরা কোনো জাতীয় নির্বাচন করেনি। কিন্তু যে দুই-একটি উপনির্বাচন করেছে তাতে জনগণ উপলব্ধি করেছে যে, এরা স্বাধীন তো নয়ই, বরং হুকুমের দাস। এমনকি স্বাধীন চেতনাও তাদের নেই। ফলে সরকার নাকে সরষের তেল দিয়ে নিশ্চিত থাকছে যে, এই কমিশন, যেই নির্বাচনে জিতুক না কেনো, তাদের প্রার্থীকেই বিজয়ী ঘোষণা করবে। সুতরাং তারাই সরকার গঠন করবে।
এর জন্য আয়োজন বহুবিধ। নির্বাচন কেন্দ্র দখলে প্রতিপক্ষের প্রার্থীদের খুনে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের প্রয়োজন হবে। এখন সেইসব সন্ত্রাসীর অনুসন্ধান চলছে। ৯ ডিসেম্বর বিএনপির অবরোধের দিন ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকায় নিরীহ বিশ্বজিৎ দাসকে ছাত্রদল-শিবির সন্দেহে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ছুরি মেরে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা খুন করেছে। এর ভিডিও চিত্র যেমন টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত হয়েছে, তেমনি সংবাদপত্রের পাতায়ও তাদের ছবি অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে ছাপা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলো সকল খুনিকে চিহ্নিত করে তাদের পরিচয় লিখে জানিয়ে দিয়েছে তারা ছাত্রলীগের ক্যাডার।
ছাত্রলীগের ক্যাডাররা খুন করেছে সেটা কেন সংবাদপত্র বা মিডিয়া প্রকাশ করবে? ফলে প্রথম থেকেই সরকার একটা অনীহ দৃষ্টিভঙ্গি নিলো। এখন এক ফানি ব্যক্তি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন সম্পর্কে আমাদের অনেক অভিযোগ ছিল, অভিযোগ আছে। তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনি এমনি সরিয়ে দেয়া হয়নি। সকলেই তো জানেন যে, এই সরকার সন্ত্রাস-বান্ধব। কিন্তু সাহারা খাতুন তার চেয়ে অনেক বেশি সন্ত্রাসী-বান্ধব ছিলেন। তার ওপর তার অকর্মণ্যতা ও নিষ্ক্রিয়তা বিরাট সমালোচনা সৃষ্টি করেছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে শেষ পর্যন্ত সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে ডিফেন্ড করে চলেছেন, সেভাবে সাহারা খাতুনকে ডিফেন্ড করেননি। বরং তাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন।
সাহারা খাতুনের সময় পরিস্থিতি এতটা খারাপ হয়েছিল যে, শেখ হাসিনার মুখরক্ষা করাও কঠিন হয়ে পড়েছিল। জনগণের কাছে একটা কিছু তো বলতে হবে। সেই কারণে তিনি সাহারা খাতুনকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীরকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। তাতে দেখছি পরিস্থিতি সাহারা খাতুনের চেয়েও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। টিভি স্ক্রিনের ওনার ছবি দেখলে মনে হয় উনি ঘুমিয়ে আছেন। সম্ভবত না। সম্ভবত উনি জেগেই ঘুমান। কিংবা কখনও কখনও ঘুম থেকে জেগে উঠে অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করেই হুট করে কিছু মন্তব্য করে বসেন। প্রথম প্রথম মনে হয়েছিল যে, এটা তার অনভিজ্ঞতা। এখন আমাদের সে ভুল ভেঙেছে। তার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে যে, অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে তিনি সর্বস্তরের সন্ত্রাসী রক্ষায় একেবারে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এতে যদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদন না থাকতো, তাহলে তিনি এ রকম ব্যবস্থা নিতে পারতেন না।
সাম্প্রতিক তিনটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়। প্রথমে স্কুল শিশু পরাগ অপহরণ। আওয়ামী সন্ত্রাসীরা গুলী করে শিশু পরাগের মা-বোনকে আহত করে গাড়ি থেকে পরাগকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এরপর বিরাট অঙ্কের মুক্তিপণ দাবি করে। পরাগ মন্ডলের বাবা সম্পদশালী মানুষ। সন্তানকে ফিরে পাবার জন্য তিনি জিম্মিকারীদের পঞ্চাশ লাখ টাকা দিয়ে সন্তানকে ফিরে পান। এই সাধ্য সকলের নেই। এই অপহরণের পর থেকেই পত্রপত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশিত হলো যে, অপহরণের সাথে জড়িত আছে ঐ এলাকার এক যুবলীগ নেতা। তার লক্ষ্য ছিলো, পরাগ মন্ডলের বিশাল পৈত্রিক সম্পত্তি দখল। সরকার এই ঘটনা ঢোক মেরে গিলে ফেলতে চেয়েছিলো। কিন্তু তারা তা পারেনি। ফলে ধর্মের ঢাক বেজেছেই। জনমতের চাপে সরকার অপহরণকারীদের গ্রেফতারে বাধ্য হয়েছে। আটককৃতরা বলছে যে, তারা এই অপহরণের কাজ করেছে আওয়ামী নেতাদের নির্দেশে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিশ্চুপ।
একই রকম কান্ড ঘটলো দরিদ্র তরুণ দরজি বিশ্বজিতের হত্যাকান্ড নিয়েও। গত ৯ ডিসেম্বর বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সারা দেশে অবরোধের ডাক দিয়েছিল। সে অবরোধ প্রতিহত করার আহবান জানিয়েছিল সরকারি দল। নব্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর আর এক কাঠি ওপরে ওঠে এ কর্মসূচি প্রতিহত করার আহবান জানিয়েছিলেন ছাত্রলীগ-যুবলীগের প্রতি। আর  যায় কোথায়! তারা তো এমনিতেই হানাহানির জন্য মুখিয়ে থাকে। বিরোধী দল হাতের কাছে না পেলে নিজেদের মধ্যে হানাহানি করে রক্ত ঝরায়। এরপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আহবানে তারা একেবারে যেন হত্যার লাইসেন্স হাতে পেয়ে যায়। ঐ দিন পুরানো ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে ডজন ডজন ভিডিও ও স্টিল ক্যামেরার সামনে বিশ্বজিৎকে পিটিয়ে কুপিয়ে খুঁচিয়ে পাশবিক উন্মত্ততায় হত্যা করে।
টেলিভিশনের এক খুনির পিতা-মাতা সে দৃশ্য দেখে শিউরে উঠেছিলেন। যে সন্তানকে লেখাপড়া করার জন্য তারা শহরে পাঠিয়েছিলেন, সে সন্তান এমন ঘাতক হয়ে উঠবে তা তারা কল্পনাও করতে পারেননি। তারা এমন নৃশংসতার জন্য তাদের সন্তানের বিচার দাবি করেছেন। এরপর তার পিতা পাগলপারা হয়ে পড়েন। আত্মগ্লানিতে বাড়ি ছেড়ে চলে যান তিনি। আর তার মাত্র সপ্তাহখানেকের মাথায় হার্ট অ্যাটাকে মারা যান ঐ পিতা। বিশ্বজিতের হত্যায় তারা শোকে বিহবল হয়ে পড়েছেন। কিন্তু শোকাহত হয়নি কেবল সরকার, সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী। পত্র-পত্রিকায় নাম-পরিচয় এমনকি ছাত্রলীগে তাদের পদ-পদবীসহ বিস্তারিত প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। কিন্তু ছাত্রলীগ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর মুখপাত্র-সবাই এই বলে একযোগে রা রা করে উঠলেন যে, এরা ছাত্রলীগ কর্মী নয়। কেউ কেউ আবার বললেন, এরা বহিষ্কৃত। বহিষ্কৃতই যদি হবে, তাহলে ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে তারা একযোগে কী করে এই হত্যাকান্ডে অংশ নিলো? পরের দিন ছাত্রলীগের এক নেতার জন্মদিনে কেক কাটা উৎসবে তারা কেমন করে শরীক হলো। এসব প্রশ্নের কোনো জবাব মেলেনি। টিভির পর্দায় আমরা দেখলাম, ঐ খুনিদের একজন দু'হাতে চাপাতি বাগিয়ে ধরে বিশ্বজিৎকে কোপাচ্ছে। বিস্ময়করভাবে আমরা দেখলাম, ডাক্তার রিপোর্ট দিয়েছে যে, তার গায়ে কোনো কোপের চিহ্ন নেই, ছুরিকাঘাতের চিহ্ন আছে। কী চমৎকার চক্র! মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, ডাক্তার মিলে ছাত্রলীগ নেতাদের খুনের দায় থেকে মুক্ত করার জন্য কি চমৎকার আয়োজনই না করেছে।
এই সকল খুনির পরিচয় গোপন করার উদ্দেশ্যে একেবারে শুরুতেই পুলিশ বলেছিলো, বিশ্বজিতের ঘাতকরা অজ্ঞাত পরিচয়। এদেশের কোটি কোটি মানুষ দেখলো যে, দু'হাতে চাপাতি ধরে ছাত্রলীগের খুনি কোপাচ্ছে বিশ্বজিৎকে। কিন্তু মিডফোর্ড হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের ডাক্তার মাকসুদুর রহমান তার শরীরে কোনো কোপের চিহ্ন পাননি। তেমনিভাবে পাওয়া যায়নি তার শরীরে কোনো পিটানো বা কিল-ঘুষি-লাথির দাগও। যদিও গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বেশিরভাগ আসামী রড ও লাঠি দিয়ে পেটানো ও কোপানোর কথা স্বীকার করেছে। এটি বিস্ময়কর। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, ছাত্রলীগের কোনো কর্মীই বিশ্বজিৎকে হত্যা করেনি। আর প্রধানমন্ত্রীর মুখপাত্র তার প্রেস সচিব অযাচিত এক বিবৃতি দিয়ে বললেন, বিশ্বজিতের হত্যাকারীদের অভিভাবকরা জামায়াত-বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
এত বড় লোক হাসানো বিবৃতি প্রধানমন্ত্রীর দফতর দিতে পারে, সেটা বোধ করি বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো দেশে কল্পনাও করা যায় না। কারো অভিভাবক বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলে তাদের সন্তান ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হবে না, এরকম গ্যারান্টি দেয়া অসম্ভব। এক্ষেত্রে তার পিতামাতার পরিচয়টি বড় নয়। বড় দায়ী ব্যক্তির পরিচয়। সে পরিচয় ছাত্রলীগ।
বিশ্বজিতের পরিবারের জন্য শোক জানায়নি কোনো আওয়ামী লীগ নেতা। সরকার দলের কেউ সান্ত্বনা জানাতে গিয়ে হাজির হয়নি বিশ্বজিতের পরিবারের কাছে। পরিবারের অভিযোগ আমলে নেয়নি থানা-পুলিশ। তাতে স্পষ্টতই প্রমাণ হয় যে, বিশ্বজিৎ কোনো রাজনৈতিক দল করতেন না। যদি করতেন তাহলে ইতোমধ্যেই আমরা অনেক হুংকার শুনতান। বিশ্বজিতের বাড়িতে সরকারি দলের লোকদের ভিড় দেখতাম। খুনিকে খুঁজে বের করার ফাঁকা বুলি শুনতাম। তারপর আওয়ামী লীগ নেতা ইব্রাহিমের হত্যাকান্ডের মতো খুনিদের আড়াল করতে সরকারের প্রাণান্ত প্রয়াস দেখতাম। এখন তার সবই অনুপস্থিত।
এ নিয়ে যখন ডামাডোল, তখন এক কাকডাকাভোরে কাশিমপুর কারাগার থেকে সবার দৃষ্টির অগোচরে ছাড়া পেয়ে গেলো শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ। কারা কর্তৃপক্ষের কাছে আদেশ পৌঁছেছে সকাল সাড়ে ৬টায়। পৌনে ৭টার মধ্যেই বিকাশ কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে সকলের দৃষ্টির আড়াল হয়ে যায়। এর অর্থ অনেক আগে থেকেই বিকাশের মুক্তির ব্যাপারে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়ে প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রাখতে বলা হয়েছিলো। আদেশ এসেছে, আর বিকাশ ছাড়া পেয়ে পনের মিনিটের মধ্যে হাওয়া হয়ে গেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বিকাশ আদালতের নির্দেশেই বের হয়েছেন। এখানে প্রশাসন আইন অনুযায়ী তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছে। অন্তত ২০টি হত্যা মামলার আসামী বিকাশের মুক্তির খবরে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ী সমাজ।
এই আতঙ্কই সরকারের চাই। পাবলিক যেনো ভয় পায় এবং সরকার যা চায়, সে অনুযায়ীই তারা যেনো কাজ করে। এর অন্যথা হলে জনগণের খবর আছে। কিন্তু এইভাবে যে জনগণের খবর করা যায় না, সেইটুকু আক্কেল এই সরকারের কোনোদিনই হলো না। কিন্তু সুযোগ পেলেই জনগণ আক্কেল দিয়ে দেয়। সেরকম দিন সম্ভবত খুব বেশি দূরে নয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads