শনিবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১২

বিরোধী দল প্রতিহত করার আহ্বান



ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। পুলিশের কী দায়িত্ব এ বিষয়ে আমরা সাধারণ মানুষ দীর্ঘকাল থেকে এক অন্ধকার জগতে ছিলাম। কারণ আমরা জানতাম, দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাই পুলিশের প্রধান দায়িত্ব। যদিও এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে পুলিশ সে দায়িত্ব পালনের বদলে অধিক মাত্রায় বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলার দায়িত্ব পালন করছিল। পুলিশ কী বর্বরতায় বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালায় তার শত-সহস্র নজির সংবাদপত্রের পাতায় আমরা খুঁজে পাবো। পুলিশ লাঠি কিংবা রাইফেলের আগা বাগিয়ে ধরে বাঁট দিয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর যে নিষ্ঠুর-বর্বর-পৈশাচিক হামলা চালিয়েছে, তা সত্যিই নজিরবিহীন। তার ভেতরে পৈশাচিকতা ও উন্মত্ততার এমন নির্লজ্জ সংমিশ্রণ ঘটেছে যে, আমরা কল্পনাও করতে পারি না এই পুলিশ আমাদের বন্ধু, বিপদে তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করব। প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় সংবাদ হয়, পুলিশ গ্রেফতার-বাণিজ্য চালায়। সন্ধ্যায় থানায় সন্দেহভাজন বলে ডজন ডজন লোককে গ্রেফতার করে আনে। তারপর রাতভর চলে লেনদেন বাণিজ্য। ভোরবেলা থানা খালি হয়ে যায়।
এমনটা কেন সম্ভব হচ্ছে? সম্ভব হচ্ছে, কারণ সরকার পুলিশকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। তারা যদি সরকারের নির্দেশে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের গুম কিংবা নির্যাতন করতে পারে, তাহলে এই প্রশ্রয়ে অন্যান্য বাণিজ্য কেন করতে পারবে না? ফলে এখন পুলিশ বিষয়টি এক নৈতিক অবক্ষয়ের নাম। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ধ্বংসের এক আমলনামা। এসব করেই যে পুলিশ সব সময় পার পেয়ে যাচ্ছে এমন নয়। অনেক জায়গায়ই জনগণ পুলিশের এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে নিজেরাই প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। এবং তাদের গণধোলাই দিয়ে পুলিশের কাছেই হস্তান্তর হচ্ছে। এসব পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে পুলিশ, প্রশাসন বা সরকার কী ব্যবস্থা নেয় বা নিয়েছে সেগুলো জনগণ কোনো দিন জানতে পারে না। একটা সহজ কথা শোনা যায়, তাদের কোজড করা হয়েছে। কিংবা বরিশাল থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে বদলি করা হয়েছে। পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহারের এটা কি শাস্তি হতে পারে?
সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে পুলিশের যে পৈশাচিক আচরণকে ভালোবেসে গ্রহণ করছেন, তার পরিণতি সম্পর্কে আমরা একেবারেই শুরু থেকে সরকারকে সতর্ক করার চেষ্টা করেছিলাম। সেটা মোটামুটি উলু বনে মুক্তা ছড়ানোর মতো ছিল। যে পুলিশ জাতীয় সংসদের বিরোধীদলের চিফ হুইপকে পৈশাচিক নির্যাতন করেছে, সরকার তাকে চমৎকারভাবে পুরস্কৃত করেছে। বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক কোনো সন্ত্রাসী নন। তিনি সংসদ ভবন এলাকায় মিছিল করছিলেন। পুলিশরূপী এক পিশাচ কর্মকর্তা, বয়সে তার চেয়ে অনেক ছোট, তাকে পিটিয়ে ঘাড় ধরে প্রায় দিগম্বর করে সংসদ ভবনের ভেতর থেকে টেনে এনে পৈশাচিক নির্যাতন করেছে। সে জন্য বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে মাস তিনেক ধরে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। এই ‘বিরাট কৃতিত্বের’ জন্য সরকার সেই পুলিশ সদস্যদের পদোন্নতি দিয়ে পুরস্কৃত করেছে। একবারও ভাবতে চায়নি যে, এর পরিণতি কী হতে পারে।
পরিণতি এখনো শুরু হয়নি। শুরু হতে যাচ্ছে। ২০০৯ সালে এই ‘আঁতাতের’ সরকার বিরোধী দল দমনে যেভাবে পুলিশবাহিনীকে ব্যবহার করেছে, সেটি ছিল অভাবনীয়। পুলিশের বিভিন্ন অপরাধ অপরিসীম ক্ষমতার চোখে দেখা হয়েছে। ফলে এখন জনগণ পুলিশের কাছে আর আত্মরক্ষার প্রার্থনা করা তো দূরের কথা, পুলিশের কাছ থেকেই আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে। চোর-ডাকাতের অত্যাচারে তারা গ্রামে গ্রামে প্রতিরোধ টিম গড়ে তুলেছে। এই টিম পালাক্রমে রাতজেগে গ্রাম পাহারা দেয়। কেউ পুলিশের তোয়াক্কা করে না। এই যে পাহারা দেয়, তার সচিত্র প্রতিবেদন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। সরকার ফিরেও তাকায়নি। কিন্তু একবারও ভাবতে চাইছে না যে, এই যে তারা ফিরেও তাকাচ্ছে না, তার পরিণতি কী হতে পারে।
বিএনপি আমলের প্রথম দফায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন আবদুল মতিন চৌধুরী। প্রধানমন্ত্রীকে রিপোর্ট করার সময় বলতেন, ম্যাডাম, ‘আমার পুলিশ’ এই এই শুভ কাজ করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলমাল দমন করেছে, আরো যেন কী কী করেছে। কিন্তু ১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেল তখন ওই একই পুলিশ জিপিওর সামনেই মিছিলরত অবস্থায় আবদুল মতিন চৌধুরীকে পিটিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল। তাকে বেশ কিছু দিন হাসপাতালে ও চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হয়েছিল।
অর্থাৎ আওয়ামী আমলে অধিকাংশ সময়ই পুলিশ এভাবে আপন আশ্রয়দাতাকে খায়। বিজিবি কিংবা সেনাবাহিনী জনগণের কাছাকাছি শ্রেণীর সেবক নয়। পুলিশ জনগণের কাছাকাছি। নিত্যই জনগণকে পুলিশের কাছে যেতে হয়। চুরি, ডাকাতি, খুন, ছিনতাই, হামলা, অপহরণ, প্রভৃতি নানা বিষয়ে অভিযোগ করতে পুলিশের কাছে যেতে হয়। কিন্তু পুলিশের কাছে যাওয়া মানে যেন এখন ‘বাঘের নখ’-এ দাঁড়িয়ে গেছে। ছুঁলেই তিন ঘা হবে। এ রকম পরিস্থিতি আসলে কেউ চায়নি এ দেশে। আমার এই ষাট বছর বয়সে কখনো কখনো মনে হয়, আহা, শৈশবে-কৈশোরে পুলিশকে কত আপন ভেবেছি। তারা এখন আমার কেউ নয়? আমার সন্তানরা যখন বড় হয়ে উঠছিল, তখন তাদের পরামর্শ দিয়েছি যে, যদি হারিয়ে যাও, যদি আমাদের খুঁজে না পাও, তাহলে একজন পুলিশের কাছে যাবে। গিয়ে বলবে, আমি আমার বাবা-মাকে হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের নিশ্চিত ধারণা ছিল যে, বাকি ব্যবস্থা পুলিশ করবে। এখন সে ধারণা নেই।
এখন পুলিশ দেখলেই ভয় পাই। কখনো কখনো নিজে গাড়ি চালাই। ত্রিশ বছর আমার গাড়ি চালানো ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে। হঠাৎ রাস্তায় দাঁড় করিয়ে পুলিশ যদি বলে আপনার লাইসেন্সটি ভুয়া। থানায় চলুন। তাহলে আমার জবাব কী হবে? এই সরকারের আমলে তারা অসীম ক্ষমতাধর। এমন পরিস্থিতির মোকাবেলা কখনো করিনি। কিন্তু যদি করতে হয়, তাহলে তো ভয়ঙ্কর বিপদ। সেই মুহূর্তে লাইসেন্সটি সঠিক কি ভুয়া এটি প্রমাণ করার কোনো পথ আমার কাছে জানা নেই।
সারদা পুলিশ অ্যাকাডেমির শতবর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন যে, পুলিশ যেন ধৈর্যের সাথে জামায়াত-শিবিরকে প্রতিহত করে। পুলিশের তো এটা দায়িত্ব নয়। জামায়াত-শিবির বৈধ রাজনৈতিক দল। পুলিশ কেন তাদের প্রতিহত করে। এর পরিণতির বিষয়ে কল্পনাও করতে পারছেন না শেখ হাসিনা। আগামীকাল কী হবে, সে বিষয়ে এ সরকারের ন্যূনতম কোনো চিন্তা নেই। এ সরকার বোধ করি ধারণা করে যে, আজ টিকলে আগামীকালও কোনো-না-কোনোভাবে টিকে যাবো। সরকার কেমন করে টিকবে? এই সরকার বিশ্বব্যাংকের সাথে যে মশকরা করল, তাতে মনে হয় এরা নিজেদেরকে সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করাকে কোনো সঙ্কট বলে ভাবছে না। মনে হচ্ছে, যদি এই বিচ্ছিন্নকরণ কোনো সঙ্কটের সৃষ্টি করে, তাহলে সরকারের বহুসংখ্যক শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা প্লেনে উঠে বিদেশে চলে যাবেন। এখনো খুব সাধারণ মানুষ বলেন যে, দেশে কিছু ঘটতে পারে এমন কোনো আশঙ্কা দেখলেই হাই কমান্ড আট-দশ দিনের জন্য প্লেনে উঠে পগাড় পার হন। শেয়ারবাজারের বিশ-ত্রিশ হাজার কোটি টাকা, হলমার্কের টাকা, পদ্মা সেতুর টাকাÑ এগুলো বিদেশেই চলে গেছে। টাকার বোধ করি তাদের আর কোনো প্রয়োজন নেই। ভোগের জন্য তা পুরুষানুক্রমে ব্যবহার করতে পারবেন।
স্বৈরাচারী হিটলারের আমলেও পুলিশকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, এমন খবর সঠিকভাবে আমার জানা নেই। তারপর পৃথিবীর ইতিহাস আমাদের চোখের সামনে স্পষ্ট। কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে স্বীকৃত রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া ঘটনা বাংলাদেশে এই সম্ভবত প্রথম। লজ্জায় অধোবদন। এর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন যে, জামায়াত-শিবিরকে প্রতিহত করার জন্য যুবলীগ যেন রাস্তায় ‘তৈয়ার’ থাকে। যুবলীগের সভাপতি ওমর ফারুক এ সম্পর্কে মৃদু প্রতিবাদ করেছিলেন। বলেছিলেন যে, জামায়াত-শিবিরকে যদি প্রতিহত করতেই হয়, সে দায়িত্ব যুবলীগ কেন নেবে? মন্ত্রী পুলিশকে দিয়ে সে দায়িত্ব পালন করুক। ওমর ফারুক চৌধুরীর এই বক্তব্যকে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, তারা এই অপকর্ম সম্পাদনের জন্য রাস্তায় নামবে না। জামায়াত আহূত হরতালের দিন আমরা রাস্তায় আওয়ামী-সমর্থক অনেক গ্রুপ দেখেছি। লাঠিসোঁটা নিয়ে তারা হরতালকারীদের প্রতিহত করার চেষ্টা করেছিলেন।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, বিকেল ৫টায় যখন অফিসে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে গাড়ি নিয়ে বের হলাম, তখনো দেখি রাস্তাঘাট প্রায় শুনশান, ফাঁকা। জিয়ার মাজার পেরিয়ে একেবারে মিনিটেই বিজয় সরণির শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেলাম। সিগন্যাল ছিল না। তবু গাড়ি স্লো করলাম। এ দিকে ফার্মগেট। ও দিকে সেনানিবাস গেট। একটি বাস। গোটা তিনেক সিএনজি। গোটা পাঁচেক রিকশা। এ পথেই ওইটুকুই যানবাহন চলছিল। আমার কাছে কেমন যেন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল। সিগন্যালের ওপারে গিয়ে গাড়ি থামালাম। তারপর পায়ে হেঁটে মেইন রাস্তায় চলে এসে দাঁড়িয়ে থাকলাম। প্রায় মিনিট দশেক পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন নেই। যেমন দেখছিলাম তেমনই। গাড়িতে উঠে তেজগাঁওয়ে দিনকাল অফিসে চলে এলাম।
বারবার বলে আসছি, সব অ্যাকশনেরই রি-অ্যাকশন আছে। সরকারকে বারবার এই বলে সতর্ক করার চেষ্টা করেছি যে, মানুষকে দয়া করে দেয়াল পর্যন্ত ঠেলে নেবেন না। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ শেষবারের মতো রুখে দাঁড়াবেই। এবং সেভাবে যখন তারা রুখে দাঁড়ায়, তখন কোনো স্বৈরাচারই টিকতে পারে না। সরকার এখন মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে দিয়েছে। আবার বলছি, এর পরিণতি ভয়াবহ হতে বাধ্য। তার কিছু আলামত ইতোমধ্যে দেখা গেছে।
কোনো কোনো মিডিয়া প্রকাশ করেছে যে, জামায়াতের কর্মীরা কিভাবে পুলিশের ওপর হামলা করছে। কিন্তু যদিও তারা এর আগে ছেপেছিল যে, পুলিশ তাদের ওপর কী বর্বরোচিতভাবে হামলা চালিয়েছিল, কিন্তু সে দিন জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পুলিশকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু বাস্তবতা থেকে এভাবে মুখ ফিরিয়ে রাখলে রক্ষা করা কি সম্ভব? সম্ভব যে নয় সেটা সরকারকে উপলব্ধি করতে হবে। যদি প্রতিটি মানুষ রুখে দাঁড়ায়, যদি নির্যাতিতরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে, যদি বঞ্চিতরা ব্যারিকেড দিয়ে দাঁড়ায়, তাহলে কিন্তু সরকারের পালানোর পথও থাকবে না। এবং কোনো বাহিনী সরকারকে উদ্ধারে এগিয়ে আসবে না। ইতিহাসের নির্মম শিক্ষা হলো এই যে, ১৯৭৫ সালেও এগিয়ে আসেনি।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads