রবিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১২

গণআকাঙ্ক্ষা পূরণে সরকার এগিয়ে আসবে কী


আমরা জানি সব মানুষ এক রকম নয়, ভাবনার জগতেও রয়েছে পার্থক্য। তারপরও আমরা পরমতসহিষ্ণু হতে পারছি না কেন? এ ক্ষেত্রে কি আমাদের শিক্ষার অভাব রয়েছে, না সংস্কৃতির? শিক্ষা ও সংস্কৃতির দিক থেকে পিছিয়ে থেকে আমরা উন্নত সমাজ, সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তুলবো কীভাবে? আমরা যে পিছিয়ে আছি তার স্পষ্ট উদাহরণ লক্ষ্য করা যায় রাজনৈতিক অঙ্গনের দিকে তাকালে। মুখে মুখে  অনেকেই নিজেদেরকে গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে দাবি করলেও আচরণে লক্ষ্য করা যায় বিপরীত বিষয়। আমরা কাউকে শুনতে চাই না, বুঝতেও চাই না। কারো কথায় কোনো সত্য বা মঙ্গলের বিষয় আছে কিনা তা অনুসন্ধানের মত প্রবৃত্তি আমাদের নেই। বরং কারো কথাকে মন্দভাবে ব্যাখ্যা করে কিংবা ত্রুটি অন্বেষণ করে কীভাবে ঘায়েল করা যায় তেমন কুপ্রবৃত্তি আমাদের যথেষ্ট আছে। মানুষতো ভুলের ঊর্ধ্বে নয়, মানুষের এমন কোনো সমাজ আছে কি যেখানে ভুল নেই? একারণেই মানব সমাজে ক্ষমা ও উদারতাকে মহৎ গুণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অথচ এসব গুণাবলীকে পরিত্যাগ করে আমরা উন্নত গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের বাগাড়ম্বর চালিয়ে যাচ্ছি। এমন প্রহসনের কারণেই স্বাধীনতার ৪১ বছর পরও দেশের জনগণ কাঙ্ক্ষিত জীবন ও সমাজ পায়নি। বিজয়ের এই মাসে জরুরি ঐসব বিষয়ে আত্মসমালোচনার চেতনা জাগ্রত হলে জাতির মঙ্গল হতে পারে।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, কোনো সমাজে ইতিবাচক তৎপরতা হ্রাস পেলে নেতিবাচক প্রবণতা বেড়ে যায়। আমাদের সমাজ যেন তেমন একটি উদাহরণ। আমাদের সমাজে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মেলামেশা নেই, সংলাপ নেই, মতবিনিময় নেই কিন্তু আছে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি ও সংঘাত-সংঘর্ষ। বৈরিতার কৃষ্ণচাদর যেন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনকে ঢেকে রেখেছে। এর মন্দ প্রভাব শুধু রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের মধ্যেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে না, তা সংক্রমিত হচ্ছে পেশাজীবীদের মধ্যেও। এমন একটি উদাহরণ লক্ষ্য করা গেছে আমাদের সময় পত্রিকার ৫ ডিসেম্বর সংখ্যায়। পত্রিকাটির একটি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় : রাজধানীর মগবাজারে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীরা একটি হাসপাতালে ভাঙচুর চালিয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে ইনসাফ বারাকাহ কিডনি ও জেনারেল হাসপাতালে এ ভাঙচুর চালানো হয়। পুলিশের উস্কানিতে ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতা-কর্মীরা এ হামলা চালায় বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। এ সময় হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। প্রত্যক্ষদর্শী ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতা-কর্মীদের একটি মিছিল মগবাজার এলাকা থেকে সাতরাস্তার দিকে যাচ্ছিল। মিছিলটি হাসপাতালের কাছে পৌঁছলে হঠাৎ হাসপাতাল লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে ও লাঠি দিয়ে আঘাত করে নেতা-কর্মীরা। এ সময় পুলিশের একটি গাড়ি মিছিলের সঙ্গে থাকলেও কোনো বাধা দেয়নি। হামলায় পুলিশের লাঠি ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতা-কর্মীরা ব্যবহার করেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। আমরা জানি ছাত্রলীগ-যুবলীগের হামলা ও সন্ত্রাসের ঘটনা নতুন কোনো বিষয় নয়। চিন্তার বিষয় হলো পুলিশের আচরণ। পুলিশের দায়িত্ব যেখানে মানুষের জান-মাল রক্ষা, সেখানে হাসপাতালের মত একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাঙচুরে পুলিশ ছাত্রলীগ-যুবলীগকে উস্কানি দেয় কেমন করে? পুলিশ শুধু পেশাজীবী নয়, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন তাদের কর্তব্য। কিন্তু আলোচ্য ঘটনায় রাজনৈতিক বিবেচনায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের সাথে পুলিশ একাকার হয়ে গেছে। ছাত্রলীগ-যুবলীগ ভেবেছে হাসপাতালটি আওয়ামী লীগ ঘরানার বাইরের লোকদের। অতএব এখন হরতাল প্রতিরোধের সুযোগে হাসপাতালটি ভাঙ্গা যায়। আর এই কাজে পাওয়া যাবে পুলিশের প্রশ্রয়ও। কিছুদিন আগে আমরা চিকিৎসকদের সংগঠন বিএমএ'র নির্বিচনেও সরকারি ঘরানার চিকিৎসকদের গণতান্ত্রিক চেতনাবিরোধী আচরণ লক্ষ্য করেছি। রাজনৈতিক অঙ্গনের ক্ষুদ্র দলীয় মনোবৃত্তি ও অসহিষ্ণুতা যদি দেশের পেশাজীবী এবং পেশাজীবী সংগঠনের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে তা হলে আমাদের ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীদের বেশি দোষ দিয়ে লাভ নেই। যারা ওদের পরিচালিত করছেন আসল দোষতো তাদের। যেখানে সরকারের মন্ত্রীরা বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের প্রতিহত করার জন্য ছাত্রলীগ-যুবলীগকে প্রকাশ্য জনসভায় আহবান জানান, সেখানে দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে কেমন করে? তাদের ভাবসাব দেখে মনে হয় দেশে যেন কোনো আইন-শৃক্মখলা বাহিনী নেই, অথবা ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীরা ইচ্ছে করলেই আইন-শৃক্মখলা বাহিনীর মত কাজ করতে পারে। এমন ভাবনা ও আচরণ দেশকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে তা উপলব্ধির মত সামর্থ্য কি সরকারের  কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে নেই? আসন্ন জাতীয় নির্বাচন কোন ব্যবস্থায়, কীভাবে হবে তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে আছে। এমন অবস্থায় দমন-পীড়ন ও হরতাল-অবরোধের বদলে প্রয়োজন সংলাপ ও সমঝোতা। সহিষ্ণুতার গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি এ ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে। গণআকাঙ্ক্ষার এ পথে সরকারের দায়িত্ব বেশি। সরকার সংলাপ-সমঝোতার আহবান জানালে তাতে বিরোধীদল সাড়া দিতে বাধ্য। কারণ নির্বাচনের আগে বিরোধীদল জনপ্রিয়তা হারানোর মত কোন কাজ করতে চাইবে না। তাই এখন দেখার বিষয় হলো, সংলাপ ও সমঝোতার পথে সরকার অগ্রসর হয় কিনা।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads